#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(দশ )
‘সঙ্গীসাথী’ ক্লাবের পুজো হল কলকাতার সেরা পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছরই বিভিন্ন চ্যানেল থেকে ‘সেরা প্রতিমা’, ‘সেরা মণ্ডপ সজ্জা’, ‘সেরা থিম’, ‘সেরা আলোক সজ্জা’ – এরকম কোনো না কোনো একাধিক ক্যাটাগরি থেকে প্রাইজ পায় এই ক্লাব। এই ক্লাবের পুজোর আয়োজনকে ঘিরে এই এলাকার লোকজনের ব্যস্ততা হল ওদের সবার কাছে একটা আবেগ। প্রতি বছর মহালয়ার সন্ধ্যাবেলা আয়োজন করা হয় এক বড়োসড়ো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক… পাড়ার মহিলা, পুরুষ, বাচ্চারাই অংশ নেয় এতে। প্রতি বছর মহালয়ার অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করতে আসেন কোনো না কোনো সেলিব্রিটি। কেউ অভিনয় জগতের, কেউ গানের আবার কেউ বা লেখার, সাংবাদিকতা অথবা খেলার জগতের। তেমনই এই বছর এসেছেন প্ৰখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মালবিকা দাশগুপ্ত।
বিকেল চারটে থেকেই শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি। মালবিকার গাড়িটা ঠিক সওয়া পাঁচটায় এসে পৌঁছলো। ছটায় উদ্বোধনের সময় বলা আছে। মালবিকা উদ্বোধন করে দেওয়ার পরে মোটামুটি সাড়ে ছয়টা থেকে শুরু হবে প্রোগ্রাম। তার আগে মালবিকাকে এনে ক্লাবের গেস্টরুমটায় বসানো হয়েছে। ছেলেমেয়েরা এসে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। অনেকেই অটোগ্রাফ নেওয়া আর সেলফি তোলার জন্য অপেক্ষারত। ক্লাবের কর্মকর্তা প্রতাপ রায়চৌধুরী সবাইকে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, “ওসব পরে হবে। এখন ম্যাডাম একটু বিশ্রাম নেবেন।” সামনের একটা ছেলেকে প্রতাপ নির্দেশ দিল ম্যাডামের জন্য কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে আসতে।
এই পুরো দৃশ্যটাই একটু দূর থেকে লক্ষ করছিল এক জোড়া চোখ। খুব শান্তভাবে। সেই চোখ জোড়া আর কারোর না, মালবিকা দাশগুপ্তর এক মাত্র ছেলে অরণ্য দাশগুপ্তর। ভালো করে দেখছিলো সে এই মহিলাকে। গুণী,আত্মনির্ভর, গর্বিত এক নারী। যার কাছে আর পাঁচটা মেয়ের মতো সন্তান,সংসারকে প্রাধান্য দেওয়ার চেয়ে শুধু মাত্র নিজেকে ভালো রাখা,নিজের কথা ভাবাটাই সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
দিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে এসে অরণ্যকে বলল, “মালবিকা দাশগুপ্ত এসে গেছেন? বাবাকে দেখেছো গো?”
-“হ্যাঁ একটু আগেই তো এখানে ছিলেন। কেন কী হয়েছে?”
-“আরে দেখো না, আমার কিছু সেফটিপিন শর্ট পড়ছে। বাবাকে বলতাম কিনে এনে দিতে। আমি তো হাফ সেজে আছি নাচের জন্য। এই অবস্থায় দোকানে কিভাবে যাই! মা-ও ওদিকে ব্যস্ত একটা কাজে।”
-“ওহ, এই ব্যাপার! আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। কটা লাগবে?”
-“এই দু’তিন পাতা।”
অরণ্য চলে যাওয়ার পরে দিয়া একটু ভালোলাগা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই যে অরণ্য নিজেই ওর জন্য সেফটিপিন আনতে চলে গেল, নাও তো যেতে পারতো।অন্য কাউকেও বলতে পারত। দিয়া নিজে তো অবশ্যই পারতো অন্য কাউকে দিয়ে কয়েক পাতা সেফটিপিন আনিয়ে নিতে। ঝিলমকেই বলতে পারতো। অরণ্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দিয়া ইচ্ছে করেই কথা বলার অজুহাত খুঁজছিল। অরণ্যর আশে পাশে থাকতে ওর খুব ভালোলাগে। অরণ্যকে একবার আবেগের বশে ও নিজের মনের কথা লিখে জানিয়েও ছিল।অরণ্য কোনোদিন যে এগুলোর কোনো প্রত্যুত্তর দিয়েছে, তা একদমই নয়। তবে দিয়াকে কোনোদিন উপেক্ষা করে সরিয়েও দেয় নি। এটুকুই দিয়ার ভালোলাগার কারণ। এটুকু পাত্তা পাওয়ার জন্যই সে উন্মুখ হয়ে থাকে।
এমন সময়ে ঝিলম এসে তাড়া লাগালো, “কী রে তুই এমন হাফ মেকআপ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ড্রেসার ড্রেস পড়াচ্ছে তো সবাইকে এক এক করে! আয় তাড়াতাড়ি!” দিয়া বলল, “আমার সেফটিপিন শর্ট আছে।” ঝিলম বলল, “ধুর, এটা একটা চিন্তা হল! সবার কাছেই এত এক্সট্রা সেফটিপিন, ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চল চল…” দিয়া আর কিছু বলার আগেই ঝিলম ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
অরণ্য ফিরে এসে দিয়াকে দেখতে না পেয়ে দু’একজনকে জিজ্ঞেস করল দিয়ার কথা। ওরা মাথা নেড়ে চলে গেল।
অরণ্য চলে আসতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে ক্লাবের মেম্বার বাবলুদা ওকে দেখে বলল, “আরে এই তো অরণ্য,মালবিকা দাশগুপ্তকে খাবার সার্ভ করবো এখন, তুমি একটু আমাকে হেল্প করো তো!” অরণ্য ভীষণই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ও মালবিকাকে দেখছিল। এখনও পর্দার ফাঁক দিয়ে ভদ্রমহিলাকে দেখা যাচ্ছে। হেসে হেসে তাঁর পাশে থাকা পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে কথা বলছেন। অরণ্য বলল, “বাবলু দা, তুমি অন্য কাউকে ডেকে নাও না!” বাবলুদা বলল, “এই কাজটুকুর জন্য এখন কাকে ডাকবো আমি! তুমি কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছো, তাই তোমাকেই বলছি। নাও, কফির ফ্লাস্কটা ধরো!” অগত্যা বাবলুর সঙ্গে অরণ্য এগিয়ে গেল।
-“ম্যাডাম, এই যে আপনার কফি আর স্ন্যাকস। কফিতে চিনি কেমন দেবো ম্যাডাম?”
আগন্তুকের কথায় ফিরে তাকালো মালবিকা। উত্তর দিল, “নো সুগার।” কথাটা বলতে বলতেই মালবিকার চোখ আটকালো পেছনে কফির ফ্লাস্ক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুনের দিকে। বয়স বড়োজোর কুড়ি একুশ হবে। ছেলেটার মুখখানা তার ভারী চেনা… শুভেন্দু, অবিকল শুভেন্দুর মুখখানাই যেন কেটে বসানো!
মালবিকার খাবার সার্ভ করে দিয়ে ছেলেটা চলে যাচ্ছিল। মালবিকা উঠে গিয়ে ডাকলো, “শোনো, তোমার নাম কী?” ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “অরণ্য দাশগুপ্ত।”
টুবলু! এ তো টুবলু! শুভেন্দু আর ওর সন্তান! হ্যাঁ, টুবলুর তো এখন এরকমই বয়স হওয়ার কথা!মালবিকার ভেঙেচুরে যাওয়া মুখের ভাবের দিকে তাকিয়ে অরণ্য বলল, “আপনি কী আর কিছু বলবেন?” মালবিকা বলল, “তুমি… তুমি আমাকে চেনো?” এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল অরণ্যর মুখে, বলল, “আপনাকে কে না চেনে!আপনি এত ফেমাস একজন সিঙ্গার!” মালবিকা কিছু বলতে যাচ্ছিল, অরণ্য আর দাঁড়ালো না।পেছন ঘুরে হাঁটা শুরু করল।মালবিকা দেখলো, যেতে গিয়ে হঠাৎই নাচের পোশাক পরা একটা ভীষণ মিষ্টি দেখতে মেয়ের সঙ্গে অরণ্যর ধাক্কা লাগলো। মেয়েটা এদিকেই আসছিলো। মেয়েটা বলল, “অরণ্যদা তুমি এখানে? তোমাকে খুঁজছিলাম।আমার সেফটিপিনের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তোমাকে শুধু শুধু হয়রান করলাম।” অরণ্য ওর পকেট থেকে সেফটিপিনের পাতাগুলো বের করে মেয়েটার হাতে দিয়ে রুক্ষভাবে বলে উঠল, “বারবার আমার পেছনে না ঘুরে নাচের দিকে মন দে!”ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল অরণ্য। মালবিকা পরিষ্কার দেখলো মেয়েটার মুখটা কালো হয়ে গেল।
*********************************
একা একাই একটা হিন্দি সিনেমা দেখতে এসেছিল কৌস্তভ।সিনেমাটার নাম “লক্ষ্য”,হৃতিক রোশন আর প্রীতি জিন্টা আছে। একটা সাধারণ ছেলের অ্যাসপিরেশনের গল্প।দেখে বেশ ভালো লাগলো। তাছাড়া প্রীতি জিন্টা কৌস্তভের একজন ফেভারিট হিরোইন।প্রীতি জিন্টার গালের টোলটার উপর ওর একটা ক্রাশ আছে। সিনেমা দেখে বেরিয়ে এসে একটা আইসক্রিম কিনলো কৌস্তভ । আজকাল একাই নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করছে ও। মালবিকা রাগ করে কথা বন্ধ করে দিয়েছে ওর সঙ্গে। মাঝে মাঝে নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে নিজেরই হাসি পায় কৌস্তভের। গোটা মালদা শহর জানে ও আর মালবিকা প্রেম করে এক সাথে পালিয়ে এসেছে। ঘটনাচক্রে একখানা বদনাম ওর গায়ে এসে লাগলো। অথচ যার জন্য এমনটা হল, সেই মালবিকাই ওর প্রেম প্রস্তাবে সাড়া দিতে নারাজ। ওর সঙ্গে মালবিকার সম্পর্ক নিয়ে নিজের মা-বাবা কেও কোনো সুদুত্তর দিতে পারে না এখনও কৌস্তভ। ও অনায়াসেই বলে দিতে পারে যে ওর সঙ্গে মালবিকার কোনো সম্পর্ক নেই, কোনোদিন ছিলও না। তবে বলতে গিয়েও পারে না। আটকে যায়। ও শুধু আশায় আছে, যদি মালবিকা ওকে কখনও ভালোবাসতে রাজি হয়! ও মালবিকাকে এটাও বলেছে, ওকে বিয়ে করার দরকার নেই। শুধু ভালোবেসে এক সঙ্গে থাকলেই হবে। তাতেও মালবিকার এক উত্তর, না।
আইসক্রিমটা খাচ্ছিল কৌস্তভ, এমন সময়ে পাশ থেকে একটা পরিচিত গলা, “আরে কৌস্তভদা!” তাকিয়ে দেখে, অফিসের বিদিশা। পাশে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা। বিদিশা আলাপ করিয়ে দিল, মহিলাটি ওর মা। আজ ছুটির দিনে দুজনে সিনেমা দেখতে এসেছে।কৌস্তভ বলল, “আপনারা চা খাবেন?” ওরা দুজন রাজি হল। কাছেই একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসল তিনজন।তিনটে চায়ের সঙ্গে ওমলেটও বলল কৌস্তভ। অফিসে সেভাবে কথা হয় না। তবে এখন খেতে খেতে কিছু কথাবার্তা হল তিনজনের।বিদিশার বাবা ছোটোবেলাতেই মারা গেছেন। মা আর মেয়ের সংসার। বিদিশাকে ওর মা অনেক কষ্ট করে বড়ো করেছেন। দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে হয়েছে।এখন বিদিশা চাকরি পাওয়াতে সংসারের হাল ফিরেছে। বিদিশার সংগ্রামটার সঙ্গে নিজের কিছুটা মিল পেল কৌস্তভ।কৌস্তভের মালদায় বাড়ি শুনে বিদিশার মা জিজ্ঞেস করলেন , “মালদার কোন জায়গায় বাড়ি তোমার?” কৌস্তভের পাড়ার নাম শুনে বিদিশার মা আবার বললেন, “তোমার বাবার নাম কী?”
-“অমল সরকার।“
-“মা?”
-“সুজাতা।“
বিদিশার মা খুশি খুশি মুখে বললেন, “ সবই মিলে যাচ্ছে। সুজাতা নামে আমার এক বান্ধবী ছিল কলেজে। কলেজে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেছিল ওর। মনে হচ্ছে এই সে। তোমার কাছে তোমার মায়ের কোনো ছবি হবে?” কৌস্তভের পার্সে ওর বাবা মায়ের একখানা করে পাসপোর্ট সাইজের ফটো সব সময়ই রাখা থাকে। দেখালো সেটা। ফটো দেখে উল্লসিত হয়ে বিদিশার মা বললেন, “আরে এই তো সুজি! কী দারুন ব্যাপার! তুমি ওকে বলো তো শিখা নামের কোনো কলেজের বন্ধুকে ওর মনে আছে কীনা! মা-বাবাকে নিয়ে একবার এসো আমাদের বাড়িতে।“ কৌস্তভ হেসে বলল, “নিশ্চয়ই বলবো। আপনাদেরও মালদায় যাওয়ার নেমন্তন্ন আমি আগে থেকেই করে রাখলাম ।” বিদিশা বলল, “মালদায় কিছু দেখার জিনিস আছে?”
-“কেন আমবাগান! মালদার আম পৃথিবী বিখ্যাত তা জানেন তো?তারপর গৌড়, আদিনা, পাণ্ডুয়া। অনেক কিছু দেখাবো ঘুরিয়ে আপনাদের।” বিদিশা হাসল। কৌস্তভ খেয়াল করল, হাসলে বিদিশার গালে প্রীতি জিন্টার মতো টোল পড়ে।
(ক্রমশ)
© Asmita Roy