ধূসর_রঙের_জলছবি #অস্মিতা_রায় (কুড়ি)

0
411

#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(কুড়ি)
-“আই এম সরি শুভেন্দু। তুমি তোমার ছেলে, বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসেছো, সেই সময়ে আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল!”
-“দেখা হওয়াটা হয় তো ভগবানের ইচ্ছে ছিল। অন্তত আমার তো ছিলই।টুবলু বলেছিলো তোমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছে। তারপর থেকে আমারও ইচ্ছে করছিল তোমার সঙ্গে দেখা করার।“
-“ তাহলে করো নি কেন? কলকাতায় তো এতবার যাও!”
-“ভয় করতো।যদি তুমি তাড়িয়ে দাও!”
-“আজ রাস্তায় ভয় করল না অপমানিত হওয়ার?তোমাদের সঙ্গে ঘোরার প্রস্তাব দিলে! তোমাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছো এখন! কী চাইছো?”
-“জানো মালবিকা, বয়স যত বাড়ছে, একটা ভয় ক্রমশ চেপে ধরছে, সেটা হল নিঃসঙ্গতার ভয়। এখানে এসেছি, দিয়ার বাবা-মা’কে দেখছি কেমন একসঙ্গে রয়েছে এতগুলো বছর। টুবলু বড়ো হয়ে গেল, ও যেমন ব্রাইট মনে হয় ফরেনেই চলে যাবে। বিজি হয়ে যাবে নিজের লাইফেই। এখন বুঝতে পারছি জীবনে স্ত্রী-কে কত দরকার। তখন বয়স কম ছিল, রক্ত গরম ছিল, তোমার সঙ্গে মাথা গরম করে অনেক অনেক অন্যায় করেছি। তোমাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েও কোনোবার ঠিকঠাক করে সরি বলি নি। আজ তোমাকে খুব সরি বলতে ইচ্ছে করছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও মালবিকা!”
শুভেন্দু মালবিকার পায়ের কাছে বসে পড়লো। মালবিকা চমকে পিছিয়ে গিয়ে বলল, “এ কী করছো!” শুভেন্দু বলল, “তোমার গায়ে হাত তুলেছি, তোমাকে কত কথা শুনিয়েছি, তোমাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে খালি টুবলুর কথাই বারবার বলেছি। একবারও বলি নি, শুধু টুবলু নয়, আমার নিজের তোমাকে দরকার।টুবলুকেও সেদিন বোঝালাম, ইগো রেখে কোনো লাভ নেই, নিজেকেই ঠকতে হয়। টুবলু যাতে জীবনে আমার মতো ভুল না করে।দিয়া আর টুবলুর মধ্যে হয় তো প্রেমটা হয়ে যাবে, ওদের দেখে আমারও খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করছে এখন। প্রেম করবে তুমি আমার সঙ্গে ?”
-“তুমি ঠিক আছো তো শুভেন্দু?”
-“একদম ঠিক আছি। এই বয়সে এসে বুঝতে পারছি আগে কতটা ভুল ছিলাম।“
মালবিকার হঠাৎ চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করল। অনেক বছর বাদে ও কাঁদছে। শুভেন্দু বলল, “কী হল তোমার?” মালবিকা বলল, “আর কয়েকটা বছর আগে এসে এসব কথা বলতে পারলে না? আমি যে আর বাঁচবো না বেশিদিন!”
-“কী! কেন কী হয়েছে তোমার?”শুভেন্দু চমকে উঠল।
-“ওভারিয়ান ক্যান্সার। সেকেন্ড স্টেজ।” এমন কথা শুনবে, সেটা শুভেন্দু আশা করে নি। মালবিকা আবার বলল, “জীবনে টাকা যথেষ্ট রোজগার করেছি ঠিকই কিন্তু এখন সবই বেকার হয়ে গেলো। টাকা থাকলেও আজ আমার নিজের বলতে কেউ নেই, যে আমার চিকিৎসায় পাশে থাকবে।” শুভেন্দু মালবিকার হাত ধরে তাড়াতাড়ি বলে উঠল,“আমি আছি মালবিকা। আমি তোমার হাসব্যান্ড। আমার অনেক ভুলের জন্য এতগুলো বছর আমরা দূরে রইলাম। আর তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না আমি।ক্যান্সার এখনকার দিনে এমন কিছু ব্যাপার নয়। সঠিক চিকিৎসায় তুমি ঠিক সেরে উঠবে। তারপর আমরা এনজয় করবো জীবনটাকে। অনেক কিছু বাকি রয়ে গেল যে!” শুভেন্দু মালবিকাকে জড়িয়ে ধরল।
শুভেন্দু রাতে ফোন করে প্রতাপ আর অরণ্যকে বলে দিল, ও রাতে ফিরবে না।
পরের দিনটা শুরুই হল, একখানা রোদ ঝলমলে সকাল দিয়ে। আজ আর মেঘের লেশমাত্র নেই। নানারকম রঙিন ফুল পাহাড়টাকে সাজিয়ে তুলেছে। অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জী ছবি আঁকছেন। তার সেই ধূসর রঙের জলছবিতে আজ নানা রঙের ছোঁয়া। দিয়া, অরণ্য, কাকলি আর প্রতাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। শুভেন্দু আর মালবিকাও এসে পৌঁছলো। প্রতাপ অনিরুদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, “মেঘাচ্ছন্ন ধূসর পাহাড়ে কী এমন রঙিন ফুল দেখা যায়? আপনার মনে হয় ক্যানভাসটা চেঞ্জ করে নিলে ভালো হতো।“
-“আসল ক্যানভাস যার হাতে আছে, তার ছবিতে তো অনেক রঙ। তিনি বিভিন্ন মানুষের ধূসর চরিত্র নিয়ে ধূসর রঙের জলছবি যিনি আঁকছেন,সেখানে খেয়াল করলে বোঝা যাবে আসলে শুধু, সাদা, কালো বা ধূসর চরিত্রই নয়। তার ক্যানভাসে অনেকরকম রঙ। আমার ক্যানভাস তো অতি সামান্য। তার সৃষ্টির সামান্য অংশ বিভিন্ন আঙ্গিকে ধরে রাখার সামান্য চেষ্টা মাত্র।”
অরণ্য দিয়াকে বলল, “তোর কাল রাতের কথাগুলোর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ওনার কথাগুলো। আমাদের ধূসর মস্তিষ্কর ক্যানভাসে নানা বর্ণময় চরিত্রের আঁকিবুকি।আচ্ছা, এমন ধূসর রঙের উপর নানারকম রঙের কম্বিনেশন কোথাও একটা দেখেছি মনে হচ্ছে!” দিয়া বলল, “মনে হয় মালবিকা দাশগুপ্তর সোফা। অনেক রঙের কুশন ছিল ধূসর সোফাটার উপর।”
-“আরে তাই তো!”
-“ওই কম্বিনেশনটা দেখে সেদিনই এসব ভাবনা এসেছিলো মাথায়। কাল রাতে সুযোগ পেয়ে অনেক জ্ঞান দিলাম তোমায়।”
সেদিনের প্রথম সাইট সিইং কেমটি ফলস। অনেকটা সিঁড়ি দিয়ে নামার পরে ঝর্ণার কাছে পৌঁছনো যাবে। নামতে নামতেও যদিও ঝর্নাটা দেখা যাচ্ছে। সিঁড়ি বরাবর রয়েছে সারসার নানা জিনিসের দোকান।কিছুটা নামার পরে মালবিকা বলল, “আমি আর নামবো না। উঠে আসতে কষ্ট হবে। তোমরা ঘুরে এসো।” শুভেন্দু বলল, “আমি থাকছি তোমার সঙ্গে। বাকিরা যাক।”কাকলি বলল, “আমার তো হাঁটুর প্রবলেম। আমি আর নামবো না। আমি বরং দোকানে ঢুকি।” প্রতাপ বলল, “হয়ে গেল! আমাকে তাহলে থাকতেই হয়! নাহলে একলা একলা মনের সুখে আমার কত টাকা যে খসাবে! দিয়া অরণ্য তোমরাই যাও তাহলে।”
প্রতাপ আর কাকলি ঢুকে পড়লো দোকানে। মালবিকার পাশে বসল শুভেন্দু। মালবিকা বলল, “তুমি থাকতে গেলে কেন? গেলেই পারতে!”
-“আর তোমাকে কখনও একা ছাড়ছি না মালবিকা।” মালবিকার পিঠে হাত রাখলো শুভেন্দু। চুয়ান্নর কাঁধে মাথা রাখলো উনপঞ্চাশ।
অরণ্য দিয়াকে বলল, “চল নামি।”
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখা গেলো কয়েকটা জায়গায় শেড দিয়ে কিছু বসার জায়গা করা আছে। জায়গাগুলো ফাঁকাই। দিয়াকে এক জায়গায় থামিয়ে অরণ্য বলল, “দাঁড়া। তোকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে।”
– “কী?”
-“একটা শর্ত আছে। যেটা নিবি, সেই একই জিনিস আমাকেও দিতে হবে।“
-“মানে?” দিয়া বুঝতে পারলো না।
-“কাল আমার এঁটো খেতে চাইলি না?খাবি এখন?”
দিয়া বলল, “কিভাবে?এখানে তো কোনো খাবার জিনিস নেই!”অরণ্য বলল, “ওই যে বললাম, যা নিবি সেটা দিতেও হবে।মানে আমার এঁটো খেলে নিজের এঁটোও খাওয়াতে হবে।“
দিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অরণ্য দুহাত দিয়ে দিয়ার মুখটা ধরল। তারপর নিজের মুখটা নামিয়ে এনে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করল দিয়ার ঠোঁটে।কিছুক্ষন চেপে ধরল।নিজের জিভটাও দিয়ার জিভে ছুঁইয়ে দিল।তারপর বলল, “এই যে দুজন দুজনের এঁটো খেলাম। বুঝলি?” দিয়া কিছুই বলতে পারলো না। ঘটনার আকস্মিকতায় ও বিহ্বল হয়ে পড়েছে। অরণ্য ওকে আবার টেনে নিল নিজের কাছে। জড়িয়ে ধরল নিজের বুকে।
তারপর? তারপর সদ্য একে অপরের কাছে ভালোবাসার কথা স্বীকার করা দুটি অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে নিজেদের কথা দিল, ওরা কোনো দোষ করলে একে অপরকে সরি বলবে, ক্ষমা করবে। কোনো ভুল বোঝাবুঝি যেন পাহাড় প্রমান ইগো নিয়ে ওদের মধ্যে এমন দূরত্ব না তৈরি করে, যে একে অপরের কাছে ফিরতে একুশটা বছর সময় লেগে যায়।

(সমাপ্ত )

© Asmita Roy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here