তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ৪.

0
527

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৪.
সাইকোলজি হিসেবে কোনো মানুষের মনে ঢুকতে হলে সর্বপ্রথম তার চিন্তা চেতনায় প্রবেশ করা দরকার। মানুষটা তোমায় নিয়ে ভাবতে শুরু করলেই বুঝতে হবে মনে ঢোকার কাজটা সহজ হয়ে এসেছে। অন্তি এই কথাটার উপর ভিষণভাবে ফোকাস করছে। তার এসব রিস্কি কাজের কারণ দিহানের মনে কৌতুহল জমানো। কিন্তু আদেও কি মানুষটার মনে কৌতুহল জেগেছে? এটলিস্ট তার আচরণে তো তা বোঝা যায় না। অন্তি বিষন্ন মনে জানালার বাহিরে তাকালো। বিকেল নেমেছে। সূর্য ডুবতে বেশ বাকি। এই মুহূর্তে দিহানের সাথে দেখা হলে খারাপ হতো না।
এর মাঝে তার ডাক এলো। তার বাবা ডাকছে। বসার রুমে যেতেই সাহেদ মেয়েকে দেখে মুচকি হাসলো। কাছে ডেকে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

‘পড়াশোনা কেমন চলছে মা?’

‘ভালো বাবা।’

‘কোচিং এ যাচ্ছ না কেন? তোমার স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল। তোমাকে যেতে বলেছেন।’

‘আমি ওখানে পড়ব না বাবা।’

‘কেন মা? কেউ কিছু বলেছে?’

অন্তি সাহেদের হাত জড়িয়ে ধরলো। আহ্লাদী কন্ঠে বললো,

‘তোমায় তুলির কথা বলেছিলাম না? ঐ মেয়েটাও ওখানে পড়ে। স্যার ওর প্রতি এক্সট্রা কেয়ার নেয়। নিক! তাতে আপত্তি নেই। কথা হচ্ছে আমি কিছু প্রশ্ন করলে স্যার শুনেও এড়িয়ে যায়। বুঝিয়ে দেয় না।’

‘এটা তো খুব খারাপ কথা!’

‘হুম।’

‘কিন্তু সামনেতো তোমার পরীক্ষা। একটা টিচার বাসায় রেখে দেই?’

অন্তি চট করে উঠে বসলো। মিষ্টি হেসে বললো,

‘তার দরকার নেই। কলেজ মোড় এ একটা ব্যাচ আছে। হাকিম স্যারের ব্যাচ। ওখানে খুব ভালো পড়ায়। তন্নি ও ওখানে পড়ে। ওখানে ভর্তি হই?’

সাহেদ হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলেন,

‘তোমার যেখানে সুবিধা হয় তুমি সেখানেই পড়বে। আমি কখনো না করেছি?’

অন্তি দু পাশে মাথা নাড়ল। যার অর্থ কখনো না।

রুমে ফিরেই অন্তি মহা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তার দারুণ খুশি লাগছে। এই যে কাল থেকে নতুন ব্যাচে যাবে! ওখানে গেলেই দিহানের সাথে দেখা হবে। দিহান তো দিন রাত ওখানে বসেই আড্ডা দেয়। মাঝে মাঝে গায়েব হয়। কেন হয় জানা নেই। আপাতত ওসব ভেবে সময় নষ্ট করতে চাইল না সে। এই মুহূর্তে তন্নিকে কল করে এই সুখবরটা জানানো দরকার।

‘হ্যা বল।’

‘সুখবর আছে। কাল থেকে হাকিম স্যারের ব্যাচে যাচ্ছি।’

তন্নি ঠোঁট উল্টে বললো,

‘এতে সুখবরের কি হলো?’

অন্তি হাসলো। তার হাসি চোখ উপচে পড়ছে। হাসি আবার চোখ উপচে পড়ে নাকি? অন্তির পড়ছে। তার হাসির সাথে চোখ দুটোও হেসে উঠছে। এটাই চোখ উপচে পড়া হাসি।

‘আলবত সুখবর। ওখানে গেলেই দিহান মির্জা আমার চোখে বন্দি হবে। এটা অবশ্যই সুখবর।’

তন্নি হাসলো। এই মেয়েটা যে কি ভয়ংকর প্রেমে পড়েছে তা এক বাচ্চা শিশুও বুঝতে পারবে।

‘তুই যে এসব কান্ড করছিস আঙ্কেল জানলে কি হবে বুঝতে পারছিস?’

‘ধুর! কিভাবে জানবে?’

‘বাই এনি চান্স! যদি দিহান ভাইয়া বলে দেয়?’

অন্তির হাসি হাসি মুখ চুপসে এলো। ঐ রাগি কুমরোটা এমন কাজ করতেই পারে। অসম্ভব কিছু না। অন্তি গলার স্বর কঠিন করে বললো,

‘এমন করলে দিহান মির্জার মাথার চুল আমি একটা একটা করে ছিড়ব। সবার সাথে গুন্ডামি মাস্তানি করুক, সেটা আমি দেখতে যাচ্ছি না। আমার সাথে লাগতে আসলে আমি তাকে বুঝিয়ে দিব কত চালে কত ভাত হয়।’

____________

আজ অন্তি কলেজ যায়নি। ইচ্ছা করেই যায়নি। মাঝে মাঝে নিয়মের হেরফের করতে হয়। এই যে যেমন সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিকে ওঠে। এটা পুরো পৃথিবীর মানুষ জানে। এই নিয়ম চলছে পৃথিবী তৈরির পর থেকেই। তাই এ ব্যাপারে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই। সূর্য উঠছে তার মতো উঠুক! কিন্তু হঠাৎ করেই যদি এই নিয়মের ব্রেক কষে সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে তাহলে পুরো পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি হবে। সবার কৌতূহল বাড়বে। হাজার হাজার প্রতিবেদন তৈরি হবে। অন্তির মতে আজ যদি সে কলেজ নি যায় তাহলে দিহান অবাক হবে। তার আশপাশে উঁকি ঝুঁকি দেওয়া মেয়েটা হঠাৎ আজ গায়েব ব্যাপারটা তাকে ভাবাবে। না চাইতেও দিহান বাধ্য হবে অন্তিকে নিয়ে ভাবতে। বিজ্ঞদের মতো এসব ভেবেই আজ কলেজ পথে পা রাখেনি অন্তি। বিকেলে তাকে দেখে কেমন চমকাবে দিহান তা ভেবেই মিটিমিটি হাসছে সে।

‘খাওয়া রেখে পাগলের মতো ওমন হাসছিস কেন?’

নাহারের ধমকে হুস ফিরল অন্তির। সে বোকা চোখে মায়ের দিকে তাকাল। নাহার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে। আজকাল মেয়ের হাবভাব তার কেমন যেন লাগে। অন্তি কিছু হয়নি এমন ভাবে গালে ভাত তুলল। নাহার একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল,

‘তোর মামা কল করেছিল। মা নাকি অসুস্থ। একবার যেয়ে দেখে আসব।’

‘যাও।’

‘আমার সাথে তুই ও যাচ্ছিস।’

‘আমি কখন বললাম আমি যাব!’

‘তোকে কেন বলতে হবে? আমি বলেছি তাই যাচ্ছিস।’

অন্তির চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। সে এখন গ্রামে গেলে দিহানকে কিভাবে দেখবে?

‘কতদিন থাকবে?’

‘এই ধর দু একদিন। তোর বাবা বাসায় একা থাকবেন। তাই তাড়াতাড়ি চলে আসবো। তোর ও তো পড়াশোনা আছে।’

‘হুম।’

.
.
অন্তি আজ সুন্দর করে সেজেছে। আসমানী রঙের একটা কামিজ পড়েছে। সেলোয়ার আর ওড়না সাদা রঙের। কপালে কালো ছোট্ট টিপ পড়েছে। ঠোঁটেও হালকা লিপস্টিক দিয়েছে। চোখেও টেনেছে চিকন কাজলের প্রলেপ। সাজ শেষে আয়নায় ঘুরে বার কয়েক নিজেকে দেখলো। নিজেকে শুধালো,
এই সাজ কেবল দিহান মির্জার জন্য। লোকটা সকালে ওকে না দেখতে পেয়ে নিশ্চই অবাক হয়েছে। হয়তো একটু আধটু মিস ও করেছে। অন্তি যখন এই পরিপূর্ণ রূপে তা্য সামনে দাঁড়াবে তখন সে সকালের সামান্য বেদনা ভুলে যাবে। অন্তি তো মহৎ হৃদয়ের এক মহৎ প্রেমিকা। সে কি প্রেমিক পুরুষটাকে কষ্ট দিতে পারে? একদম না!

ব্যাচ শুরু হবে পাঁচটা থেকে। অন্তি ঠিক এক ঘন্টা আগে অর্থাৎ চারটায় ঘর থেকে বের হলো। হেলেদুলে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখা হলো মিলার সাথে। মিলা মাঝে মধ্যেই তাদের বাসায় আসে। তার মায়ের সাথে ভিষণ ভাব কিনা! ওকে দেখতেই মিলা বলে উঠলো,

‘কোথাও যাচ্ছিস নাকি?’

অন্তি মুখ বাঁকালো। বললো,

‘হুম। ব্যাচে যাচ্ছি।’

‘সেকি! এত সেজেগুজে ব্যাচে যাচ্ছিস? আমি ভাবলাম বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছিস!’

অন্তি মহা বিরক্ত হয়ে মিলার দিকে তাকালো। ততক্ষণে নাহার ছোট ছোট চোখ করে মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন। বললেন,

‘ও তো ঠিকই বলেছে। এত সেজেছিস কেন?’

অন্তি বিরক্ত হয়ে বললো,

‘উফ মা এত কোথায় দেখছ? আর একটু সেজেছি তাতেই বা কি?’

পাশ থেকে মিলা বলে উঠলো,

‘বাড়ির মেয়ে কোথায় যাচ্ছে না যাচ্ছে কি করছে তা তো আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। চাচি তুমি একদিন ওর ব্যাচে যেয়ে খোঁজ খবর নিও তো। দিনকাল যা পড়েছে!’

এ পর্যায়ে অন্তির মন চাইলো মিলার চুল টেনে ধরে দুই গালে দুটো করে চারটা থাপ্পর লাগাই দিতে। কতবড় বজ্জাত মহিলা। নিজে সারাদেশ চড়িয়ে বেরায় সে বেলায়? এই তো দুদিন আগেই এক ছেলের সাথে রিকশা করে পুরো ঢাকা শহর ঘুরে এসেছৈ সেটা বুঝি সে জানে না? কিন্তু অন্তি এসব কথা গিলে ফেলল। এখন ঝামেলা করতে গেলেই দেরী হয়ে যাবে।

অন্তি আজ রিকশা নিলো। এখান থেকে হেঁটে যেতে পনেরো মিনিটের মত লাগবে। কিন্তু আজ হাঁটতে মন চাইছে না।
রিকশা ছুটতেই বিকেলের নরম রোদ এসে চোখে মুখে লেপ্টে পড়তে লাগলো। মৃদু বাতাসে খোলা চুল নিজের মতো করে উড়তে লাগলো। অন্তি বাঁধা দিলো না। উড়তে দিলো তাদের নিজের মতো করে।

দিহানদের বিকেলের আড্ডা জমে উঠেছে। তাদের মধ্যে শাহিন নামের একজন খুব শীঘ্রই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছে। সেই খুশিতে মিষ্টি মুখ করা হচ্ছে। পাঁচ কেজি মিষ্টি আনা হয়েছে। তাদের খাওয়া শেষ হলে বাকি মিষ্টি সকল দোকানদারদের একটা করে দেওয়া হচ্ছে। নুহাশ রসিকতা করে বললো,

‘সারাদিন ভাই ভাই করিস আর সেই ভাইয়ের আগেই কিনা বিয়ের পিঁড়িতে বসতেছো। তুমি তো মামা আগাই গেলা! আমরাই পিছিয়ে আছি।’

শাহিন নামের ছেলেটা লজ্জা পেলো। তবে কিছু বললো না।
ঠিক সেই সময়ে অন্তির রিকশা এসে থামলো। নুহাশ সেদিকে তাকাতেই মুখ হাঁ হয়ে গেলো। এ কাকে দেখছে সে? আড় চোখে একবার দিহানের দিকে তাকালো। সে আপাতত সিগারেটে আগুন ধরাতে ব্যস্ত।

অন্তির আজ দিহানের সামনে দাড়াতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। লজ্জায় তার চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে।
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে একই জায়গায় সে দু মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো। নিজেকে ধাতস্থ করে সরাসরি দিহানের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বললো,

‘কেমন লাগছে আমায়? আপনার চোখে লাগার মতো?’

দিহানের সিগারেটে টান দেওয়া হলো না। হাত থেকে সেই কখন তা খসে পড়েছে তার ঠিক নেই। তার চোখ আটকে আছে কাজল টানা একজোড়া চোখের মাঝে। শুধুই কি তাই? ঐ কাঁপতে থাকা গোলাপী ঠোঁট জোড়া ও তার চোখকে বেহায়া করলো।
অন্তি তার কথা রিপিট করলো,

‘কেমন লাগছে আমায়?’

দিহান চোখ সরালো। ভারী গলার ঝংকার তুলে নুহাশকে বললো,

‘এই মেয়ে এখানে কেন?’

অন্তির মুখে আঁধার নামলো। চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো জল। এত অপমান? আজ অন্তত নুহাশ চায়নি দিহান এমন কঠোর আচরণ করুক। এমন ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটাকে বারবার প্রতাক্ষাণ কিভাবে করে দিহান? মায়া হলো তার ভিষণ।
অন্তি আর ওখানে দাঁড়ালো না। আর না কিছু বললো। মাথা নিচু করে বের হয়ে এলো। ব্যাচ আর একটু সামনেই। এখন অন্যদের ক্লাস হচ্ছে। অন্তি চাইলেও ব্যাচের ভেতর ঢুকতে পারবে না। লজ্জায় তার মাটিতে মিশে যেতে মন চাচ্ছে। কোথায় লুকাবে সে নিজেকে? চোখের জল ইতিমধ্যে গাল গড়িয়েছে। মানুষটা এমন পাথর কেন?

অন্তির পেছষ পেছন নুহাশ ও বেড়িয়ে এলো। এই প্রথম মেয়েটার চোখে পানি দেখেছে সে। তার খারাপ লাগছে। অন্তি ব্যাচের সামনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নুহাশ পেছন থেকে ডাক দিল,

‘এই যে মিষ্টি ভাবী!’

নুহাশ হাসি মুখে এগিয়ে এলো। অন্তি মাথা নিচু করে নিলো। এখন তার আরো কান্না পাচ্ছে। নিশ্চই লোকটা তার মজা নিতে ভাবী বলে ডাকছে! কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে নুহাশ মিষ্টি করে হেসে বললো,

‘দিহানের কথায় কষ্ট পেও না পিচ্চি। ও তো একটু অমনি। নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘোরে। কিন্তু তুমি যদি কান্না থামাও আমি তোমায় একটা সিক্রেট বলতে পারি।’

অন্তি জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে তাকালো। সিক্রেট জানার আগ্রহ চেপে রাখতে পারলো না। চটপট করে ওড়নার কোণে চোখ মুখ মুছে নিলো। তা দেখে নুহাশ হাসলো।

‘গুড গার্ল।’

‘সিক্রেট বলুন।’

নুহাশ তার হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আগে একটা মিষ্টি খাও। এত সুন্দর কথা মিষ্টি মুখ না করে বলা যাবে না।’

অন্তি না চাইতেও একটা মিষ্টি তুলে নিলো। নুহাশ তখন ফিসফিস করে বললো,

‘আমার মনে হয় দিহান মির্জা পা স্লিপ করেছে আমার মিষ্টি ভাবীর উপর!’

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here