তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ৮.

0
438

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৮.
কাক ডাকা ভোর। বাহিরে কেবল আলো ফুটতে শুরু করেছে। সূর্যি মামার দেখা পেতে ঢের বাকি। গ্রামের দিকে সকাল নামে খুব আয়োজন করে। চারপাশ কোকিলের ডাকে মুখরিত হয়। লাল ঝুঁটি মোরগেরাও নামে প্রভাতের বার্তা ছড়াতে। গলা ছেড়ে ডাক ছাড়ে। এই একটা ডাকই যথেষ্ট সকাল হওয়ার খবর জানতে। অন্তি এবার গ্রামে এসে এই ব্যাপারটা খুব বেশিই উপভোগ করেছে। আজ ও সে বারান্দায় বসে সকাল হওয়া দেখেছে। কালো আকাশ ফুঁড়ে সাদা ঝলমলে আকাশকে বেড়িয়ে আসতে দেখেছে সে। কি দারুন সে দৃশ্য!
এই মুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই অন্তির মনে হলো তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের প্রকোপ এতটাই বেশি যে তার এই বারান্দাতেই হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তে মন চাইছে।
রাতে দিহানের জন্য অপেক্ষার শেষে তার দু’চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছিল। শত তপস্যা করেও তা ফিরিয়ে আনতে পারেনি অন্তি। বরং পুরোরাত বারান্দায় বসে দারোয়ান রহমত চাচার বদলে সে বাড়ি পাহারা দিয়েছে। এই তো ভোর হওয়ার ঘন্টা আগের কথা। রহমত চাচা চেয়ারে বসে দিব্যি ঘুমোচ্ছিলো। অন্তি দিব্যি তার ভুষ ভুষ করে নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেয়েছে। সেই সুযোগ নিয়েই বাড়ির ভেতরে কেউ প্রবেশ করে। কুঠুরি ঘরের লাল টিমটিমে আলোতে অন্তি স্পষ্ট একটা ছায়া মানব দেখতে পেয়েছিল। অন্তি ফোনের ফ্লাস ফেলতেই তা বড় আম গাছটার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। এরপর ঘন্টাখানেকেও আর কিছু টের পায়নি সে। হয়তো কোনো এক ফাঁকে কেটে পড়েছে।

অন্তি সে ব্যাপারে একদম ভাবছে না। তার ভাবনা জুড়ে বিচরণ করছে দিহান। দিহান মির্জা। লোকটা মোনের সাথে সাথে মস্তিষ্কেও দারুন ভাবে আটকে আছে। দখলদারিতে ইংরেজদের হার মানাবে লোকটা। ইংরেজরাতো সম্পত্তি, ক্ষমতা দখলে নিতো কিন্তু এই ভয়ংকর মানব সরাসরি মোন ও মস্তিষ্কে দখলদারি চালায়।

রাতে দিহানের কল আসায় অন্তি আশ্চর্য বনে যায়। মানে সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। দিহান মির্জা তার ইগো রাগকে সাইডে ফেলে কল করেছে! এটা নিশ্চই যেন তেন ব্যাপার না। অন্তির অবাকের পর্ব শেষ হতে না হতেই কল কেটে গেল। অন্তি দু মিনিট বসে রইলো। এই কল আসে এই কল আসে করে পাক্কা এক ঘন্টায় ও কল আসলো না। অন্তি তখন বিছানায় গোল হয়ে বসে চাতক পাখির ন্যায় ফোনের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু পাষান মানবটা দ্বিতীয় বার কল দিলো না। অন্তি রাগে দুঃখে কেঁদে ফেলে। এমন হবে জানলে সে কল রিসিভ করতে একদমই দেরি করতো না। পরপর ফোন উঠিয়ে কল দেয় কাঙ্খিত মানবটিকে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ফোন সুইচড অফ। এরপর থেকেই থম মেরে বারান্দায় বসে সে। তার মতে দিহান হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে নিষ্ঠুর একজন পুরুষ। যার হৃৎপিণ্ডে চার প্রকোষ্ঠের বদলে রয়ছে একটি মাত্র প্রকোষ্ঠ। এজন্য তার মনে ভালোবাসা কম। দিহানের হৃৎপিণ্ডের সার্জারি করা দরকার। এই রোগ নিরাময় অতি শিঘ্রই হওয়া দরকার।

______________

সকালে দিহান যখন জানতে পেরেছে তার দলের ছেলেকে মারা হয়েছে; শুনতেই সে তৎক্ষণাৎ পরশকে কল করে। মাথায় তার রক্ত উঠে গেছে যেন। কপালের পাশের রগ ফুলে উঠেছে। ফর্সা কপালে দৃশ্যমান নীল রগ একটু বেশিই ভয়ংকর ঠেকছে যেন।
পরশের সাথে ঝামেলাটা দিহানের ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত ঝামেলা বাহিরে এলে সেটা সে একদম সহ্য করবে না।

‘দিহান মির্জা? শহরের বাঘ হঠাৎ আমায় কল করলো কি মনে করে?’

পরশের সূক্ষ্ম খোঁচা আঁচ করতে পেরেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো দিহানের। দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করে শুধালো,

‘আমার সাথের ঝামেলা পার্সোনালি হ্যান্ডেল করার জন্য বলেছিলাম! আমার ছেলেদের আঘাত করে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছিস?’

‘এটাই যে বাঘ রূপে থাকা দিহান আসলে একটা হুলো বিলাই। আসল বাঘ তো এখানে!’

দিহান চুপ করে শুনলো। তার সাদা মুখ খানা রাগের কারণে লাল হয়ে এসেছে। নাকের পাটাতন ফুলে উঠছে। শক্ত চোয়ালটা আরো কঠিন হয়ে এলো। রাগ দমিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

‘এতোই যখন ক্ষমতা তাহলে পেছন থেকে চাবুক কেন ছুঁড়ছিস? সামনাসামনি আয়। আসল নকলের ফারাকটা না হয় তখন বুঝিয়ে দিব।’

জবাবে পরশ হাসলো। দিহানের সাথে সকল দেনা পাওনা পরিশোধের সময় এসেছে।
.
.
অন্তিরা আজ ঢাকায় ফিরবে। তাদের পার্সোনাল গাড়িতে করেই ফিরবে। বারোটার দিকে নাহার মেয়েকে টেনে তুললেন। অন্তি তখনো ঘুমে ঢুলছে। মেয়ের উপর যথেষ্ট বিরক্ত নাহার। বিছানায় এলোমেলো হয়ে বসে থাকা অন্তিকে একবার দেখে নিয়ে বললেন,

‘ঝটপট ফ্রেশ হয়ে সব গুছিয়ে নে। নয়তো এভাবেই ফেলে রেখে চলে যাব।’

‘কোথায় যাবে?’

‘তোর বাপের বাড়ি।’

মায়ের কথায় অন্তি বড় করে হামি দিলো। চোখ ঢলতে ঢলতে ঘুম জড়ানো গলায় বললো,

‘আমার বাপের বাড়ি তুমি কেন যাবে? তোমার বাপের বাড়িতে তুমি থাকো। আমি আমার বাপের বাড়িতে যাচ্ছি।’

সকাল থেকে নাহারের মন মেজাজ বেজায় খারাপ। এতদিন বাদে বাবার বাড়িতে এসে আবার দুদিনের মাথায় ফিরে যাচ্ছে। আবার কত বছর পর আসা হবে জানা নেই। এতদিন পর বাপের ভিটায় পা রেখে যতটা শান্তি লেগেছিল এখন বিদায়ের সময় ততটাই বিতৃষ্ণা লাগছে। তাছাড়া বাবা মায়ের বয়স হয়েছে কখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যান বলা যায় না। এসব ভাবতেই তার চোখে জল জমে। তার উপর মেয়ের এমন কথায় যেন গায়ে আগুন লেগে গেল। মুহূর্তেই চেঁচিয়ে উঠলেন মেয়ের উপর।

‘খোটা দিচ্ছিস? তোর বাপের বাড়িতে কি আমি তোদের হাত পা ধরে ঝুলে থাকি? নাকি ওখানে না গেলে মরে যাবো আমি? যাবো না তোর বাপের বাড়ি। দেখি কিভাবে থাকিস। যত বড় মুখ না তত বড় কথা!…’

অন্তির ঘুম মায়ের চিৎকারের সাথে সাথেই এ পাড়া থেকে পালিয়েছে। অন্তিও দ্রুত বেড থেকে‌ নেমে ওয়াশরুমে ছুটেছে। ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে দারুন ভাবে ফেঁসে গেছে সে। মায়ের স্বভাব তার খুব জানা আছে। দেখা গেলো সত্যিই ঢাকায় ফিরলো না। তখন কি হবে? অন্তির মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো। মন চাইলো নিজের চুলের মুঠি ধরে টানতে আর সবার কাছে বলতে ,’আমি হলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাধা।’

অন্তির ভাবনাকে ভুল করে নাহার গোছগাছ করে নিচে নামলেন। গাড়িতে ওঠার আগে আধ ঘন্টার মতো বিদায়ের কান্নার পর্ব চললো। অন্তি খুব মনোযোগ দিয়ে সবটা দেখলো। তার মামা পর্যন্ত বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তার ও কি দিহানের বাড়িতে যাওয়ার সময় কান্না পাবে? বাবা মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলবে! তৎক্ষণাৎ অন্তির ভেতর সত্তা বলে উঠলো,’আর ইউ কিডিং মি! কান্না? দিহানের কাছে যাওয়ার কথা‌ শুনলেতো তুমি ধেই ধেই করে নাচ শুরু করবে। কান্নার সময় পাবে কই?’
অন্তি সম্মতি দিতে পারলো না। এতটাও নির্দয় সে না হুহ!

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। গ্রামের ইটের রাস্তা ছেড়ে গাড়ি পিচঢালা রাস্তায় উঠেছে। নাহার গাড়িতে ওঠার দশ মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এটা তার অন্যতম স্বভাব। গাড়ি চলতে শুরু করলে সে কিছুতেই ঘুম ধরে রাখতে পারে না। অন্তির এই অভ্যাস নেই। গাড়িতে থাকা কালিন পুরোটা সময় সে জেগে জেগে আশপাশ দেখতে থাকে। ঐ যে ছুটতে থাকা গাছে সারি, দালান এগুলো ভিষণ ভালো লাগে তার।
এত কিছুর মাঝে অন্তি দিহানের কথা একদম ভোলেনি। লোকটা যে গত রাতে ওমন কান্ড করলো তার জন্য অন্তি কিছুটা ক্ষেপে আছে। সেই রাগ থেকেই অন্তি দিহানকে ম্যাসেজ করলো।

‘আপনি কি জানেন আপনি ভিষণ রকম একটা অসহ্য ক্যারেক্টর?’

ম্যাসেজটা সেন্ড করে দুদন্ড সময় নিলো। পরপর আবারো টাইপ করলো,

‘আমি নেহাৎ ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছি নয়তো আপনার মতো পাথুরে মানবকে ইঁদুর ছুঁচো ও পাত্তা দিত না।’

‘অসহ্য লোক!’

অন্তি ভেবে নিয়েছিল এসব ম্যাসেজ দেখার মতো সময় বা সূযোগ কোনোটাই দিহানের হবে না‌। ব্যস্ত মানুষ কিনা!
কিন্তু দিহান দেখলো। রিপ্লাই ও করলো তৎক্ষণাৎ।

‘দ্যাটস্ মিন ইঁদুর ছুঁচোর মাথায় ও তোমার থেকে বেশি ঘিলু আছে!’

লোকটা তার বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে! এটা ভিষণ অপমান জনক কথা হলেও অন্তি রাগ করলো না। দিহান রিপ্লাই করেছে এতেই খুশি সে। লাজুক হেসে রিপ্লাই দিলো,

‘এত্তগুলা ভালোবাসা ভিলেন সাহেবকে। আর কাল রাতের ভুলের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হলো।’

দিহানের চোখ কুঁচকে এলো। কাল রাতে সে কি করেছে যার জন্য ক্ষমা করবে মেয়েটা তাকে? ব্রেইনে কিঞ্চিত চাপ প্রয়োগ করলেও কিছু মনে করতে পারলো না। বেশি ঘাটলো না সে। কি জানি কোন ব্যাপারে নিজে রাগ করে আবার নিজেই ক্ষমা করেছে পাগলটা!

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here