তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ১১.

0
445

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১১.
কলেজ শেষে আজ দু বান্ধবী ফুচকা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে। এখানের ফুচকাটা দারুন। বিশেষ করে তিন ধরনের আলাদা স্বাদের টকের জন্যই এই মামার ফুচকার এত কদর। প্রতি প্লেট পঞ্চাশ টাকা। আজ বিলটা অন্তির পক্ষ থেকে। লম্বা সিরিয়াল পরেছে। কম করে হলেও বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্তি ভীর ঠেলে দু প্লেট ফুচকার অর্ডার দিলো। অদ্ভূত ভাবে দোকানদার তাকে দেখতেই এক গাল হেসে বললো,

‘একটু দাঁড়ান আপা, এহনি দিতাছি।’

অন্তি একটু অবাক হলো। সচরাচর অর্ডার দিলে লোকটা ভিষণ ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,

‘দেরী হইবে আপা। লাইনে দাঁড়ান।’

সেখানে আজ এত মধু মিশিয়ে কথা বলছে? নিশ্চই ব্যাটা ভালো মুডে আছে। অন্তি আর পাত্তা দিলো না। ব্যস্ত হলো খোশগল্পে। কিন্তু তাদেরকে দ্বিতীয় বারের মতো চমকে দিয়ে এক মিনিটের মাথায় দু প্লেট ফুচকা হাতে হাজির হলো লোকটা। অন্তির সাথে সাথে তন্নির চোখেও রাজ্যের বিষ্ময়। বিস্ময় কে আরো একধাপ এগিয়ে দিতেই লোকটা বিনয়ী স্বরে বললো,

‘আপা চেয়ার দেই? রোদ্দুরে খারাই আছেন, ছায়ায় আইসা বহেন?’

তন্নির মুখ এক ইঞ্চি পরিমান ফাঁকা হয়ে আ হয়ে আছে। অন্তি ফিসফিস করে বললো,

‘দোস্ত কোনোভাবে কি আমরা সেলিব্রিটি হয়ে গেছি?’

‘নো ওয়ে! আমরা তো টিকটক করি না!’

দুজনের মাঝের কৌতুহল এখানেই চাপা পড়লো। কিন্তু তাদের দমে যাওয়া কৌতুহল পুনরায় আবির্ভাব হলো বিল পে করার সময়। একশত টাকার নোট এগিয়ে দিতেই লোকটা চমকে বলে ওঠেন,

‘আপা টাকা লাগবে না। আপনেরা যান। আবার আসবেন। যখন মন চাইবে চইলা আসবেন।’

এ পর্যায়ে অন্তি আর তার মুখ বন্ধ রাখতে পারলো না।

‘বিল কেন লাগবে না মামা?’

লোকটার মুখের হাসিভাবটা ভোতা হয়ে এলো। কিছুটা আমতা করে বললো,

‘আপনাগো আমি মনে মনে সৎ বোন ভাবি তাই লাগবে না আপা। আপনারা এখন যান আপা। বাইরে রোদ্দুর খুব।’

লোকটা তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অন্তির ব্যাপারটা মোটেও সুবিধার লাগলো না। চেনেনা জানেনা কেউ তাকে মনে মনে বোন ভাবলেই কে হলো নাকি? অন্তি টাকাটা লোকটার পাশে রেখে বললো,

‘পরেরবার বিশ্বাসযোগ্য কোনো অযুহাত দিবেন। তখন ভেবে দেখবো।’

অন্তি আর তন্নি চলে গেল। তারা যেতেই লোকটা কাউকে কল করলো। খুব অস্বস্তি নিয়ে মিনমিন করে বললো,

‘ভাই ভাবী আসছিলো। আমি টাকা নিতে চাই নাই। জোর কইরা দিয়া গেল। যাওয়ার সময় বলছে, পরেরবার বিশ্বাসযোগ্য অযুহাত দিতে।’

দিহান সবটা শুনে ছোট করে বললো,

‘আচ্ছা।’

কল কেটে বিরবির করে বললো,

‘গোবরে তবে পদ্ম ফুটেছে! মাথায় বুদ্ধি তবে অল্প স্বল্প আছে! নট ব্যাড।’

দিহানের ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। তা দেখে নুহাশ কাতর স্বরে বললো,

‘দোস্ত যা খুশি কর কিন্তু ব্যাপারটা প্লিজ আমার জন্য জটিল করিস না। তোর প্রেমের উপর আমারটা ডিপেন্ড করছে। দোহাই লাগে তোর!’

____________

অন্তিদের বাড়িতে আজ তার মায়ের দুঃসম্পর্কের এক বোন এসেছে। সাথে এসেছে তার মেয়ে। নাহার তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভালো মন্দ রান্না হয়েছে। অন্তি সেই দুপুর থেকে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। সেই দূর আত্মীয়ের মেয়েটা তার রুমে আস্তানা গেঁথে বসে আছে। এতেই চরম বিরক্ত সে। শুধু বসে থাকলেও হতো কিন্তু এই মেয়ে রিতিমত তার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘আচ্ছা আপু তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?’

মেয়েটার কথায় দারুন বিরক্ত হয়ে অন্তি বললো,

‘থাকলেও বা কি?’

‘তেমন কিছু না। আমার বয়ফ্রেন্ড ছাত্রলিগের সাথে জড়িত। তোমার কোনো সাহায্য লাগলে আমি ওকে বললেই হয়ে যাবে তাই আর কি।’

অন্তির মুখ আ হয়ে গেছে। অবাক হয়ে বললো,

‘তুমি কোন ক্লাসে পড়ো যেন?’

এ কথায় মেয়েটা কিছুটা বিরক্ত হলো। বললো,

‘এই নিয়ে তিনবার বলছি, ক্লাস স্যাভেন।’

অন্তি ভেবে পায়না এটুকু একটা মেয়ের ও বয়ফ্রেন্ড আছে! পরক্ষণে মনে হয় এতদিনে তার প্রেমটাও হয়ে যেত যদি দিহান মানুষ হিসেবে আর পাঁচটা স্বাভাবিক পুরুষের মতো হতো। কিন্তু লোকটাতো একটা পাষাণ। হৃদয়হীন মানুষ।

‘বলোনা তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?’

‘না।’

‘আমি খুঁজে দিব একটা?’

এ পর্যায়ে অন্তি মেয়েটাকে ধমক দিলো। মেয়েটা তৎক্ষণাৎ সুর সুর রুম থেকে বের হয়ে গেল। সে যাওয়া মাত্র অন্তি বড় করে শ্বাস ফেলল। এমন বিচ্যু মেয়ে কিভাবে সামলায় আন্টি আল্লাহ জানেন।

বাহিরে মুষোল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কাঁচের জানালায় ফোটা ফোটা বৃষ্টিকণা জমে আছে। বেশ কিছুদিন ধরেই রাতের দিকে এমন বর্ষণ হয়। অন্তির চোখে ঘুম নেই। রুম অন্ধকার করে বসে আছে। মনের মধ্যে অদ্ভুত অশান্তি হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে। দিহানকে ছাড়া তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় আজকাল। মানুষটা কেমন মনের সাথে রক্তেও মিশে গেছে। বিছানা হাতড়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দিহানের নম্বর ডায়াল করলো। এটা তার নতুন নম্বর। দিহান রিসিভ করলো একটু সময় নিয়ে। রিসিভ করেই তার চিরচেনা গম্ভীর স্বরে শুধালো,

‘কি চাই?’

অন্তি কিছু বললো না। চুপ করে ওপাশের মানুষটাকে অনুভব করতে চাইলো। দিহান তখন ল্যাপটপে কিছু একটা করতে ব্যস্ত। কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে থাই দেওয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এক হাতে সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে তাতে আগুন লাগালো। তখনো ওপাশের মানুষটা নিরব। দিহান তপ্ত শ্বাস ফেলল। ধীর গলায় শুধালো,

‘কতদিন এভাবে লুকোচুরি করবে? কাল মিট করো।’

ঐভাবে ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি অন্তি। সোজা হয়ে বসে শক্ত করে ফোন কানে চেপে রাখলো। মিনমিন করে বললো,

‘কিভাবে বুঝলেন?’

দিহান ঠোঁট কামড়ে হাসে।

‘দিহান মির্জাকে কল করে চুপ করে থাকার মতো সাহস একটা পিচ্চি মেয়ে ছাড়া কেউই করে না।’

অন্তি নাক ফুলায়। গলার স্বর চড়াও করে বলে,

‘আমি পিচ্চি না। যথেষ্ট বড়।’

কথাটা বলে খানিক থেমে আবার বলে,

‘আপনিকি একজন্যই আমায় ইগনোর করছেন?’

কথাটা বলার সময় তার গলা কাঁপে অল্প। দিহান ছোট করে উত্তর দেয়,

‘না।’

‘তাহলে? প্রেমিকা আছে আপনার?’

চঞ্চল স্বর বলে উঠে অন্তি। দিহান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,

‘প্রেমিকা নেই তবে বউ আছে। তুমি জানতে না?’

অন্তি জবাব দিলো না। খট করে কেটে দিলো কল। দিহান থতমত খেয়ে গেল। আবার কি হলো? খানিক সময় মোবাইলে দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। এসব পিচ্চি পাচ্চা মেয়ের সাথে কি আদেও প্রেম করা যায়? জাস্ট ইমপসিবল! এই প্রেম তাকে দিয়ে হবে না।

অন্তি কল কেটে রাগে ফুঁসছে। লোকটা আবারো তাকে মিথ্যা বলছে। পাষাণ লোক! আর কখনো সে কল করবে না অসভ্য লোকটাকে। অন্তির মাঝে মধ্যে মনে হয় এই মানুষটা পৃথিবীর সবচাইতে বিরক্তিকর একজন মানুষ। রস-কষ হীন তেতো একটা মানব। যার প্রতিটা কথায় মুক্তর বদলে নিমের ফল ঝরে। কখনো তো তার ইচ্ছা হয় লোকটার কান টেনে ধরে বলতে,

‘আজ থেকে ফ্রিতে টিউশন দিবো আপনায়। তিন বেলা নিয়ম করে সুন্দর করে কথা বলতে শিখবেন। নয়তো নর্দমার মাঝে কান ধরিয়ে দাড় করিয়ে রাখবো।’

মানে একটা মানুষ কতটা অসহ্য হলে এমন কাঠ কাঠ কথা বলতে পারে! অন্তি হাতের ফোন বেডে ছুঁড়ে মারলো। বিরবির করে বললো,

‘তোর আর তোর বউয়ের একটা একটা করে চুল ছিঁড়বো আমি। যাস্ট ওয়েট। অসভ্য লোক!’
___________

দিনটা শুক্রবার। আকাশে আজ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। বৃষ্টি শেষে এমন ঝলমলে দিন যেন সকল ক্লান্তি দূর করতে যথেষ্ট। কি সুন্দর রূপ প্রকৃতির! চায়ের দোকানে আড্ডা বসেছে। নাহিদ নামের ছেলেটা দারুন গান গায়। ভার্সিটিতে থাকা কালিন এভাবে গোল হয়ে বসে কতো গান গেয়েছে! আজ সে দিনগুলোর কথা ভিষণ মনে পড়ে। জীবন কিভাবে কোন দিকে মোড় নিলো খুঁজে পায়না নুহাশ। দিহান ছিলো ডিপার্টমেন্টের টপ স্টুডেন্ট। ওর ব্রাইট ফিউচার নিয়ে সকলেই আশাবাদী ছিলো। কিন্তু শেষে এসে কি হলো? টেনেটুনে পাশ করা নুহাশ আর সে একই চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন। যেখানে তাদের মহৎ কোনো কাজের জন্য পোষ্টারে, খবরের কাগজে তাদের নাম ওঠার কথা,‌সেখানে তাদের নাম হয়েছে গুন্ডা! এমনটা না হলেও তো পারত!
নুহাশের চোখ ঘোলাটে হয়ে আসে। পাশ থেকে সুমন হাত দিয়ে তাকে ঠেলা দেয়। মজা করে বলে,

‘কি মামা! মোন কই গেছে? আমাদের বলো, খুঁইজা আইনা দেই।’’

নুহাশ শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘তিন রাস্তার মোড় থেকে বা হাতে নাক বরাবর চলে গেলে নীল রঙের তিনতলা একটা বাড়ি আছে। ঐ বাড়ির মালিকের ছোট মেয়ের কাছেই আছে। যা নিয়া আয়।’

সুমন দাঁত বের করে হাসে। চোখ টিপে বলে,

‘শুধু মোন আনলেই হবে? নাকি মাইয়াও লাগবে!’

নুহাশের মেজাজ খারপ হয়। দাঁত খিচে দিহানের দিকে তাকায়। দিহান অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোয়াচ্ছে। নুহাশ পুনরায় সুমনের দিকে তাকিয়ে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সাবধানি কন্ঠে বলে,

‘এসব বাজে ইঙ্গিত দ্বিতীয়বার আমায় দিবি না। ভুলেও না।’

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here