তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ১৩.

0
529

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৩.
শাড়িতে নারী! কথাটা আসলেই সত্যি। নারীর সৌন্দর্য শাড়িতেই প্রকাশ পায়। অন্তি চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে আয়নায় নিজেকে দেখছে। কলাপাতা রঙের শাড়িটা তার শ্যাম শরীরে বড্ড মানিয়েছে। তন্নি তা দেখে দাঁত বের করে হাসে। চোখে মুখে দুষ্টুমি খেলে ওঠে। এগিয়ে এসে পেছন থেকে অন্তিকে জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

‘সুন্দর লাগছে তোকে পাখি। আজ তোর গুন্ডা সাহেব তোকে দেখলে নির্ঘাত ফিট খাবে। এ ব্যাপারে একশত পার্সেন্ট না হলেও নব্বই পার্সেন্ট সিওরিটি দিতে পারি আমি। তাকে হসপিটালাইজড্ করার জন্য অগ্রিম একটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে রাখা দরকার! কি বলিস?’

অন্তি মুখ বাঁকায়। ঐ অসভ্য লোক এসব সৌন্দর্যের কদর করতে জানে না। কেবল পারে চোখ মুখ কুঁচকে ধমক দিতে।
আয়না থেকে চোখ সরিয়ে তন্নির দিকে তাকাতেই তার চোখ কুঁচকে আসে। অবাক গলায় বলে,

‘একি তোর ও না সেম কালারের শাড়ি পড়ার কথা?’

তন্নির মুখটা ছোট হয়ে আসে। তার পরনে হালকা নীল রঙের একটা জামদানী। এটাই সেদিন পার্সেল এসেছিলো। সে তো অন্তির সাথে মিল রেখে কলাপাতা রঙের মায়ের শাড়িটা পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু ঐ খারাপ লোকটা সকাল সকাল টেক্সট করে বললেন,

‘আমার দেওয়া শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বের হবে। ইটস্ আ অর্ডার।’

তন্নির সাহস নেই দ্বিমত করার। আবার কেমন শাস্তি দিবেন তা তো বলা যায় না!

তন্নিকে চুপ থাকতে দেখে অন্তি মুচকি হেসে বললো,

‘তোকে কিন্তু দারুণ লাগছে তনু। একদম পরীর মতো।।’

তন্নি ও উত্তরে লাজুক হাসলো। অন্তির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

‘তোকে কিছু বলার আছে। মানে আবার রাগ করবি কিনা!?’

অন্তি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,

‘তুই কি আমাকে প্রপোজ করতে চাচ্ছিস? ডোন্ট ডু দ্যাট। আই অলরেডি হ্যাভ সামওয়ান!’

_____________

কলেজ প্রাঙ্গনে আজ রমনীদের মেলা বসেছে। খিলখিল হাসির ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে পরিবেশ। রাস্তায় চলার পথে সকলে আগ্রহভরা দৃষ্টিতে উঁকি দিচ্ছে কলেজ গেটের ভেতরে। অন্তিদের রিকশা এসে থামে কলেজ গেটে। সমস্যা বাঁধে রিকশা থেকে নামতে যেয়ে। শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই দুজনের কারোর। কষ্ট করে একজনের সাহায্যে অন্যজন উঠতে পারলেও নামার সময় এটা চ্যালেন্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তির চোখ মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়েছে। হাত দিয়ে পেটের কাছের শাড়ি চেপে ধরে রেখেছে। এত কষ্ট করে পড়া শাড়ি যদি মাঝরাস্তায় পায়ের নিচে পড়ে খুলে যায় লজ্জার সাথে কষ্টের পরিমানটাও সমানুপাতিক ভাবে বাড়বে। শাড়ি খুলে যাওয়ার চিন্তায় ইতিমধ্যে অন্থির চোখে মুখে বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে। অসহায় দৃষ্টিতে তন্নির দিকে তাকাতে তার দৃষ্টি আরো ঘোলাটে হলো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠ ধরে তন্নি বললো,

‘আমরা কি আজ এভাবেই পিকনিক শেষ করব পাখি? এই মুহূর্তে একটা বফের খুব প্রয়োজন বোধ করছি। পৃথিবীতে এতশত অফারের মাঝে বফ সংক্রান্ত কোনো অফার নেই? আমি দুই মিনিটের অফারটা নিতে চাই।’

অন্তি কিছু বলতে নিবে তার আগেই কোথা থেকে হাওয়ার গতিতে এগিয়ে নুহাশ। পড়নে তার নীল রঙের পাঞ্জাবি। রিকশার কাছে এসে এক গাল হেসে উঠলো।

‘আরে ভাবী যে! কতদিন বাদে দেখা।’

নুহাশ অন্তির সাথে কথা বললেও তার চোখ ব্যস্ত অন্তির পাশে জুবথুব হয়ে বসে থাকা রমনীর দিকে। তাকে দেখতেই মেয়েটা কেমন গুটিয়ে গেছে।

অন্তি গাল ফুলিয়ে বললো,

‘ভাবী ঠেকেছেন যখন একটু হেল্প করুন। রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াতে…..’

অন্তি কথা শেষ করার আগেই নুহাশ এসে তন্নির দিকে হাত বাড়ালো। ছোট করে হেসে বললো,

‘নেমে আসুন বেয়াইন। আপনার সেবায় এই বান্দা হাজির।’

তন্নির দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। ফেঁসে গেছে সে। এই মুহূর্তে এই লোকটার হাত না ধরেও উপায় নেই। তন্নি নেমে গেল। অন্তি সেদিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নুহাশ মুচকি হেসে বললো,

‘বন্ধুর পার্মিশন ছাড়া তো তার বউয়ের হাত ধরতে পারিনা! বন্ধুর থেকে পার্মিশন পেলেই তোমায় নামাবো।’

অন্তির মেজাজ চটে গেলো। রুক্ষ কন্ঠে শুধালো,

‘একদম আমায় ঐ অসভ্য লোকের বউ বলবেন না। তার সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। ইহজনমে সম্ভব ও নয়। আপনার বন্ধু অতিব মাত্রায় অসভ্য একজন মানুষ। আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন, রূপন্তি নওয়াজ খান এখন আর আবেগে বশীভূত হয়ে তার মতো অসভ্য মানুষকে পছন্দ করার মতো ভুল করবে না।’

অন্তি এতগুলো কথা বলে শ্বাস ফেলল। বহুদিন পর মনের সব তিক্ততা বের করতে পেরে খুব হালকা লাগছে নিজেকে। সে পারলে এই লোকটার অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে নাই করে দিত। কিন্তু পারছে না বলেই তো চুপ করে আছে।

‘অসভ্য ব্যক্তিত্বের মানুষের জন্য কেঁদে কেটে সাগর মহাসাগর বানানোর পেছনের থিওরিটা জানতে চাই আমি।’

অন্তি চকিত দৃষ্টিতে সামনে থাকায়। দিহান বুকে দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে তার কালো রঙের পাঞ্জাবি। লোকটা সবসময় কালো পড়ে নয়তো সাদা। এছাড়া কি পৃথিবীতে কোনো রং নেই? বুকপকেটে ঝুলে আছে কালো রঙের রোদচশমা। চোখ দুটো কুঁচকে আছে সামান্য। যেন সে সত্যিই উত্তরটা জানতে আগ্রহী। অন্তি চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে আশপাশে তাকালো। এভাবে হাঁটে হাঁড়ি ভাঙার কি দরকার ছিল? শুধুই কি অন্তি তাকে অসভ্য বলে? এর পেছনে যথাযথ কারণ রয়েছে।

অন্তিকে চুপ দেখে দিহান বাঁকা হাসে। এগিয়ে এসে রিকশা ওয়ালার হাতে দুশো টাকার একটা নোট গুঁজে দেয়। অন্তির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ঠোট কামড়ে হাসে। বলে,

‘আপনাকে প্রতি দশ মিনিটের জন্য একশত করে টাকা দেওয়া হবে। আপনার কাজ সামনের চায়ের দোকানে বসে মনের সুখে চা খাওয়া। চাইলে সাথে অন্যকিছু ও খেতে পারেন।’

লোকটার চোখ চকচক করে ওঠে। বিনা বাক্যে সে রাজি হয়ে যায়। দশ মিনিটে রিকশা চালিয়ে একশত টাকা ইনকাম করা অসম্ভব সেখানে বসে বসে চা নাস্তা খেতে খেতে ইনকিম হলে আপত্তি কিসে?
দিহান ঠিক কি করতে চাচ্ছে বোধগম্য হলোনা অন্তির। সে কেবল ড্যাবড্যাব করে দেখতে লাগলো। তবে তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠেছে। এই অসভ্য লোক তার অসভ্য মস্তিষ্ক নিয়ে নিশ্চই কোনো ঝটলা পাকাতে চলেছে। চোখ ঘুরিয়ে তন্নির দিকে তাকালে দেখা গেলো সে মাথা নিচু করে মুর্তির মতো নুহাশের থেকে স্বল্প দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তি রাগে দাঁত চিবিয়ে তন্নিকে ডাকলো। সে বিপদের মাঝে আটকে আছে আর এই মেয়ে দেখো পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

‘হাত ধর। সং সেজে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

অন্তির ধমকে তন্নি ঠোঁট উল্টায়। পা আগাতে গেলেই টান অনুভব করে। নুহাশ তার শাড়ির আঁচল হাতে পেঁচিয়ে রেখেছে। তন্নি চেয়েও পাড়লো না সামনে আগাতে। অন্তির দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই অন্তি চোখ রাঙালো। তন্নি পড়লো বিপাকে। সে কিভাবে অন্তিকে বলবে যে সে নিজেও ফেঁসে আছে!

দিহান একটা ছেলেকে ডাকলো হাতের ইশারায়। কথা বার্তায় জানা গেলো ছেলেটার নাম রাকিব। পেশায় সে দিহানের ভক্ত! অন্তি এটা চট করেই বুঝে ফেলেছে। কারণ ছেলেটা দিহানের কথার আগায় মাথায় ‘জ্বি ভাই’ ‘আচ্ছা ভাই’ এভাবে রিপ্লাই করে যাচ্ছে। অন্তি মুখ বাঁকিয়ে বিরবির করলো,

‘ভাই না ছাই!’

অন্তিকে শেষ বারের মতো চমকে দিয়ে দিহান ছেলেটাকে বললো,

‘চোখে চোখে রাখবি এই যে অতি সুদ্ধ একজন নারী বসে আছে রিকশায়, তাকে যেন কেউ ওখান থেকে নামতে হেল্প না করে। মাইন্ড ইট!’

ছেলেটা অতি উৎসাহে জবাব দিলো,

‘জ্বি ভাই! নো চিন্তা। আমি আছি।’

এটা কি হলো? অন্তি চকিত হয়ে তাকিয়ে রইল। দিহান অন্তির দিকে তাকানোর নূন্যতম প্রয়োজন বোধ করলো না। সে দিব্যি হেলে দুলে উক্ত স্থান থেকে প্রস্থান করলো। ইতিমধ্যে নুহাশ তন্নির আঁচল ছেড়ে হাত আঁকড়ে ধরেছে। তাতে তন্নির প্রাণ যাই যাই অবস্থা। ভূমিকম্পের ন্যায় তার সর্বশরীর কাঁপছে। এত অত্যাচার কেন তার প্রতি? হাতের বাঁধন ছাড়াতে পারবেনা যেনেও সে ব্যর্থ চেষ্টা করেছে দুবার। এতে করে নুহাশ গলার স্বর খাদে নামিয়ে চরম দুটো ধমক দিয়েছে। তন্নি পুনরায় সে কাজ করার সাহস করেনি। নুহাশ এতে মজা পায়। নিরবে হাসে। বোকা মেয়েটা কেবল তাকে ভয় পেয়েই গেলো। একবারো এসব কাজের পেছনের মোটাভ বোঝার চেষ্টা করলো না! করলে হয়তো সেই শুরুতেই নুহাশ নামক ধোঁয়াশা তার নিকট স্বচ্ছ পানির ন্যায় হতো। কিন্তু তার রমনী যে বোকা! বড্ড বোকা! এই অতি সামান্য সমীকরণ মেলানোর মতো পর্যাপ্ত বুদ্ধি‌ তার‌ নেই।

________________

আকাশে রোদ উঠেছে খুব। তীর্যক রোদে শরীর থেকে জল গড়াচ্ছে। অন্তি অতিষ্ঠ ভঙ্গতে কপাল, নাক মুছলো। রাগে তার নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। একটা মানুষ এতটা খারাপ কিভাবে হতে পারে? বিরক্ত দৃষ্টিতে গেটের সামনে চেয়ার পেতে বসে থাকা দিহানকে দেখে সে। লোকটা কেমন নির্লপ্ত ভঙ্গিতে ফোন টিপছে। এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ এমন ঠান্ডা মস্তিষ্কে কিভাবে বসে থাকতে পারে?
অন্তি আশপাশে নজর বুলায়। আশপাশে তাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তন্নি সেই কখন নুহিশের সাথে ভেতরে চলে গেছে। কতবর বেঈমানি করলো মেয়েটা তার সাথে ভাবা যায়? রাকিব নামের ছেলেটা ঘুরে ঘুরে নজরদারি করছে। যেন কোথা থেকে কেউ এসে ছো মেরে অন্তিকে নিয়ে যাবে। এসব কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে অন্তি নিজ থেকেই নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চেষ্টা ছাড়া এ পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কেউ সফল হতে পারেনি। কবি বলেছেন, একবার না পারিলে দেখো শতবার। সে নাহয় একবার চেষ্টা করে দেখলো!
শাড়ির কুচি শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে লাফ দিতে নিলেই দিহান‌ এসে তার সামনে দাঁড়ায়। চাপা কন্ঠে বলে,

‘এনার্জি কেন নষ্ট করছো? সুন্দর ভাবে আমাকে বললেই হয়!’

অন্তি ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায়। দাঁত চেপে বলে,

‘আই ডোন্ট নিড ইয়োর হেল্প।’

‘বেশ! তবে বসে থাকো।’

অন্তি শক্ত জবাব দেয়,

‘আমি একাই নামতে পাড়বো!’

‘আমি সেটা হতে দিব না!’

‘কেন করছেন এমন?’

দিহান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,

‘ইচ্ছা হলো!’

অন্তি শান্ত চোখে তাকায়। দু সেকেন্ডের মাঝে হাত বাড়িয়ে দিহানের কাঁধ ছোঁয়। দিহান চমকে ওঠে। বুকের ভিতর ছলৎ করে ওঠে। অন্তি শক্ত ভাবে তার কাঁধ আঁকড়ে ধরেছে। দিহান আশা করেনি অন্তি এভাবে মেনে যাবে। দিহানকে নির্লপ্ত দেখে অন্তি বলে,

‘কি হলো? নামিয়ে দিন?’

দিহান নিজেকে ধাতস্থ করে। সে ভুলে বসেছিলো যে এটা অন্তি! যাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। কেবল তার নিকট পরাজয় স্বীকার করাই কাম্য!
অন্তির ঠোঁট কোণে হাসি খেলে যায়। ব্যাটা রাগি কুমরা আসছে তাকে হেনস্থ করতে! এত সহজ নাকি? এই রূপন্তি নওয়াজ খানকে হেনস্থা করার জন্য দিহান মির্জাকে দ্বিতীয় বার জন্ম নিতে হবে। এ জীবনে সেটা অ স ম্ভ ব!

চলবে……..

(বি.দ্র :- ১৪ তম পর্বটা আমার গ্রুপে পোস্ট করা হবে। পরবর্তী পর্ব গুলো যথা নিয়মে পেজেই পোস্ট করবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here