তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ১৯.

0
509

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৯.
রাত ঘন হয়েছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিম ধরা ডাক যেন রাতের পরিবেশকে আরো গম্ভীর করে তুলেছে। এখন মধ্যরাত। চারপাশ ভিষণ নিরব। হাইওয়ে তাদের বাসা থেকে বেশ খানিক দূরে। এজন্য মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ির হর্ন ব্যাতীত কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এই মধ্যরাতে অন্তি ছাদে চুল খুলে দিয়ে বসে আছে। ঘনকালো চুলগুলো রাতের আঁধারের সাথে মিশে আছে। রাতে মেয়েদের একা ছাদে উঠতে নেই, চুল খোলা রাখতে নেই, জিনে আঁচর করে। এসব তার মায়ের মুখে শোনা কথা। তার নানার বাড়ির দিকে এসব কথার প্রচলন খুব বেশি। শহরের দিকে এসব ব্যাপারে খুব একটা শোনা যায় না। এমন না যে সে এসবে বিশ্বাস করে না। তবে চার ধারণা গ্রামের সতেজ পরিবেশ রেখে জিন ভূত কখনোই শহরের ধুলামাখা এ পরিবেশে আসবে না। ভূত হলেও মাথায় ঘিলু তো আছে তাই না! তবুও কেন জানি মনের কোথাও একটা ভয় লাগছে। যদি হঠাৎ করেই ভয়ংকর চেহারার কেউ একজন এসে তার পাশে বসে? কেমন হবে ব্যাপারটা? অন্তি নাক চোখ কুঁচকে নিলো। নিজেই উত্তর দিলো,

‘ভিষণ জঘন্য ব্যাপার।’

খুলে দেওয়া চুলগুলো তৎক্ষণাৎ হাত খোপা করে কাঠের তৈরি চুলে পড়ার কাঠি গুঁজে দিলো তাতে। গায়ে জড়িয়ে রাখা ওড়নাটা দিয়ে ভালোভাবে মাথা ঢেকে নিয়ে একইভাবে বসে রইল। ভয় কিছুটা লঘু হলো বোধহয়!

সময়ের কাটা যখন তিনটার ঘরে থামলো অন্তি ব্যস্ত হাতে কাঙ্খিত মানবটিকে কল করলো। এটাই সময় তার সাথে কথা বলার। দু বার রিং হতেই কল রিসিভ হয়। অন্তি শক্ত হাতে ফোন কানে চেপে ধরে। নিদারুণ উত্তেজনায় তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হতে চায় না। কতশত কথা বলার আছে তার তবুও শব্দগুলো গলার কাছে এসে আটকে থাকে। শক্ত হয়ে আসা মনটা নিমিষেই ভেঙে পড়ে। কান্নায় লেপ্টে যায় চোখ। ওপাশের মানবটা তখনও নিশ্চুপ। অন্তির কষ্ট হয় খুব। লোকটা তাকে কাঁদতে শুনেও কিভাবে চুপ করে আছে? তার ভেতর সত্তা তৎক্ষণাৎ তাকে কল কেটে দিতে উৎসাহ দেয়। এমন পাষাণ পুরুষকে ভালোবেসে নিজেকে বলি দেওয়ার থেকে আরাবের মতো সুপুরুষকে বিয়ে করে সংসার করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু অন্তির হাত অবাধ্যতা করে। শক্ত হয়ে ফোন কানে আঁকড়ে ধরে থাকে। ওপাশের মানবটির নিস্তব্ধতা তার মনের কষ্টকে যেন বাড়িয়ে তুলছে দ্বিগুণ হারে। কেটে যায় কয়েকটা মুহূর্ত। অন্তির কান্না থেমে এসেছে। দুর্বল হয়ে আসা ডহৃদয় কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার জোগাড় করতেই অপাশের মানবটি কথা বলে উঠলো,

‘নিচে দাঁড়িয়ে আছি। আসবে?’

গম্ভীরতায় ঘেরা স্নিগ্ধ কথাটুকু কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ মাত্র চমকে উঠলো অন্তি। প্রিয় পুরুষটির থেকে এমন লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে তার উথাল মন নিমিষেই শান্ত হয়ে এলো। কি হবে? কি হতে পারে? সেসব প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে অন্তি প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিলো,

‘আসছি।’

কল কেটে গেল। দিহান বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেট রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল। জ্বলতে থাকা লাল আগুন নিভিয়ে গেলো নিমিষে। দু মিনিটের মাথায় অন্তি নেমে এলো। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোতে সে মেয়েটার ভেঙে যাওয়া মুখখানা দেখলো। বুকের বা পাশটা খানিক জ্বলে উঠলো। কেমন মলিন হয়ে এসেছে আদুরে মুখটা। চঞ্চল চোখদুটো কেমন ডেবে গেছে। দিহানের মুখ শক্ত হয়ে আসে। সাহেদ নওয়াজ খানকে সে অবশ্যই এর সুন্দর সাজানো জবাব দিবে।
দুদিন বাদে মানুষটাকে চোখের সামনে দেখতেই কান্নার ভেঙে পড়ে অন্তি। আশপাশে না তাকিয়ে এক ছুটে এসে বিশাল দেহী শক্ত বুকে আছড়ে পড়ে। দুহাতে শক্ত করে পিঠের শার্ট আঁকড়ে ধরে। দিহান শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁধা দেয়না তবে আঁকড়েও নেয় না। পাঁচ মিনিটের মাথায় অন্তি শান্ত হয়ে আসে। তবে মাথা তোলে না বুক থেকে। নড়াচড়া না করে ওভাবেই বুকের সাথে লেগে থাকে। দিহান হাত ঘড়িতে সময় দেখে। তিনটা বেজে বত্রিশ মিনিট। তার শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা ছোট্ট শরীরটাকে সরাতে চাইলে তা সরতে চায়না। দিহান দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করে না। কেবল ভারী শব্দে বলে ওঠে,

‘এভাবে আমাকে পাবে না তুমি রূপ। আমাকে পেতে হলে তোমাকে আমাকে জয় করতে হবে। আমাকে জয় করা তোমার জন্য মোটেই সহজ হবে না। আমার গোটা তোমাকে চাই। তোমার প্রতিটা অংশে আমি আমাকে চাই। তোমার জীবনে আমার আগমনটা অন্য সবার মতো হবেনা রূপ। আমি ধ্বংসের আগুন। যে কোনো সময় প্রলয় ঘটাতে পারি। তুমি কি নিশ্চিত আমায় সবভাবে গ্রহণ করতে পারবে তুমি?’

অন্তি মাথা উঁচু করে দিহানের চোখে তাকায়। এত ভারী শব্দ বোঝার ক্ষমতা তার নেই, তবে এই পুরুষটার প্রতি তার ভরসা আছে। এজন্যই তো সে এতো ভালোবাসে। বারবার অবহেলা পাওয়ার পরও ভালোবাসে। অন্তি নাক টেনে জবাব দেয়,

‘আমি অলরেডি আপনাকে গ্রহণ করেছি। আপনার নাক উঁচু স্বভাবের কথা জেনেও গ্রহণ করেছি। আর কি চাই?’

না চাইতেও দিহান হেসে ফেলে। মুচকি হেসে বলে,

‘এবার ঠিক আছে। এতক্ষণ তোমাকে অপরিচিত লাগছিলো। এখন মনে হচ্ছে না আসলেই তোমায় চিনি আমি। আমার হরিণ চোখি রূপরাণী!’

প্রিয় মানুষদের ডাকা প্রতিটা নাম সুন্দর। সবথেকে সুন্দর দিহানের ডাকা এই রূপ নামটি। যা সবার থেকে তাকে আলাদা করে রাখে। তাকে এ নামে কেউ ডাকে না। নিঃসন্দেহে লোকটার সাইকোলজি সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে।

‘এভাবেই জড়িয়ে ধরে থাকবে? তোমার এখন বাসায় যাওয়া উচিত। আর নয়তো আমাকে সাথে নিয়েই চলো!’

অন্তি সাথে সাথে দিহানকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। সে বেমালুম ভুলে বসেছিলো যে সে দিহানকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ লজ্জা না পেলেও এখন ভিষণ লজ্জা লাগছে। দিহান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসে। বাকা চোখে তাকিয়ে বলে,

‘তুমি ভয়ংকর মেয়ে রূপ। নিজ থেকে কাছে এসে নিজেই লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাও। আমার বুঝি লজ্জা নেই?’

অন্তি মুখ বাঁকিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকটা তাকে লজ্জা দিতে দিতে মেরেই ফেলবে। সুযোগ সন্ধানী লোক কিনা! সুযোগ পেতেই জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে। অসভ্য লোক।

_____________

অন্তিদের বাড়িতে যে মেয়েটা কাজ করে ওর নাম পারু। ঘরের কারো সাথেই তার তেমন সখ্যতাপূর্ন সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে নাহারের সাথে। প্রতিদিন টুকটাক ঠুকোঠুকি লাগবেই। এতসব জেনেও সাহেদ ওকে কাজের জন্য রেখে দিয়েছে। তার মতে মেয়েটা একটু অকাজের হলেও মন ভালো। মানুষ হিসেবে সৎ। কিন্তু তার সেই আস্থাকে ভেঙে দিয়ে পারু দিহানের গুপ্তচর হয়ে কাজ করছে। ঘরে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার সবটাই তো তার জানা। সেই কথা কাউকে বলায় যদি মোটা অংকের টাকা মেলে তাতে দোষের কি?

‘বইলেন না ভাইজান! আফারে চাচি যেমনে কয়দা থাপ্পর মারছে আফায় মাতা ঘুরাই পইরা গেলো। আফায় শক্ত মানুষ। আফার জায়গায় আমি থাকলে প্রত্তম থাপ্পরেই ফিট খাইতাম।’

‘পুরোনো কথা বাদ। নতুন করে কি হইছে সেইটা বল।’

‘নতুন কইরা আর কি হইবো। আফার বাইরে যাওন বন্দ হইছে। এইডা অবশ্য ভালোই হইছে। মাইয়া মানুষের বাইরে না যাওন ভালো।’

দিহান বিরক্ত হয়ে বলে,

‘ভালো খারাপ আমি বুঝবানি। ফোন রাখ। দরকার ছাড়া কল দিবিনা। নয়তো থাপ্পরের আগায় মাথায় তোকে ফিট খাওয়াবো।’

পারু কিছু না বললেও মুখ বাঁকায়। শুধু কয়টা টাকা পায় বলে কিছু বলেনা নয়তো মানুষ হুমকি ঝুমকিকে পারু ভয় পায়না। হুহ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই যে সে দারুণ খবর জানালো তাতে কোনো শুকরিয়া নেই মানুষদের।
তখনি নাহার ডাকলো তাকে।

‘পরাটা করতে হবে জলদি ময়দা মেখে নে তো পারু। আমি ভাজি বসায় দিচ্ছি।’
.
.
তন্নির দিন খুব খারাপ কাটছে। অন্তিকে‌ ছাড়া একা একা তার দিন কখনোই ভালো কাটে না। এই যে আজ সে একা একা ব্যাচে গেলো, কোনো ম্যাথ তার মগজ অবদি পৌঁছায়নি। সবকিছু মাথার দু ইঞ্চি উপর থেকে চলে গেছে। ব্যাপারটা নিঃশন্দেহে ভয়ানক। অন্তির বিয়ে শাদি হয়ে গেলে তার কি হবে? আর যাই হোক একজন গ্রাজুয়েট মা হতে গেলেও তাকে অন্তত পড়াশোনা করে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। কিন্তু এভাবে চললে তার কিভাবে হবে?

এসব ভাবতে ভাবতেই কল করলো অন্তিকে। অন্তি তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। তন্নির কল দেখে ফোনটা ওভাবেই ফেলে রাখলো। কিন্তু তন্নি থেমে যাওয়ার মেয়ে নয়। সে আবারো কল লাগালো। অন্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন তোলে।

‘দোস্ত কলেজে আসতেছিস তো? পেটের মধ্যে গ্রুম গ্রুম করছে। তুই না আসলে হচ্ছে না।’

‘কি হচ্ছে না? ওয়াশরুমে যা। পেটের ময়লা ফেলে দে। আর গ্রুম গ্রুম করবে না।’

‘এটা ওয়াশরুমে ফেলা চলবে না দোস্ত। পেটে কথা জমে আছে। চাইলেও ওয়াশরুমে ফেলতে পারছি না। কলেজে চলে আয়।’

‘হুম। এখন কল রাখ।’

সকাল সকাল ফুরফুরে মেজাজে জল ঢেলে খুব গদগদ ভাবে কল কাটলো তন্নি। অন্তি আস্তধীরে বিছানা ছেড়ে নামলো। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়লো। তার রাগি কুমরাটা ফাইনালি তার কাছে ধরা দিলো! এই খুশিতে তন্নিকে একটা ট্রিট দেওয়া যেতেই পারে।

অন্তিকে হাসিখুশি ভাবে নাস্তার টেবিলে বসতে দেখে নাহার খানিক অবাক হলো। মেয়ে তো তার দেবদাসী হওয়ার পথে ছিলো। হঠাৎ এ পরিবর্তন কিসে? কিন্তু মেয়ের মুখে হাসি দেখে সে এসব ভাবনা দূরে ঠেলে দিলেন।

‘পরাটা দেই? নাকি নুডুলস করে দিবো?’

‘যেটা আছে সেটাই দাও।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here