তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ২১.

0
334

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২১.
স্নিগ্ধ বাতাস, কালো চাদরে জড়ানো আকাশ আর পাশে প্রিয় পুরুষ! অন্তি চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করে। এই যে দিহান তার হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে আছে, সে ব্যথা পাচ্ছে, তবু ও নড়চড় নেই। ঐ শক্ত হাতের ছোঁয়ার মাঝেই ভালোবাসা খুঁজতে ব্যস্ত সে।
দিহান দূরত্ব ঘুচিয়ে আরো কিছুটা নিকটে টেনে নেয় অন্তিকে। অন্তির নাকে পুরুষালী গন্ধ ধাক্কা খায়। তড়িৎ চোখ মেলে চায় সে। চাঁদের অল্প আলোতে দিহানের মুখটা খুব ভালোভাবে দেখতে পায়। লোকটার চাহনি শক্ত। মুখে দারুন কঠিনতা এটে রয়েছে। এমন প্রেমময় পরিবেশেও কি লোকটা একটু পাগল প্রেমিকের মতো আচরণ করতে পারে না? সবসময় শক্ত খোলসে আটকে রাখে নিজেকে। অন্তি ভিষণ ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে,

‘একটু হাসবেন?’

ছোট্ট একটা আবদার, কিন্তু কত ব্যাকুলতায় ভরা! চোখ ভরা কৌতুহল মেয়েটার। প্রেমিক পুরুষটিকে শক্ত খোলস থেকে বের করতে কত অস্হিরতা তার! কিন্তু তাকে ভিষণ দুঃখি করে দিয়ে তার পুরুষটি কাঠকাঠ গলায় বলে ওঠে,

‘ছেলেটা কে ছিলো? এ মহল্লায় তো আগে কখনো দেখিনি!’

হতাশ চিত্তে বড় শ্বাস ফেলে অন্তি। দিহানের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে দাঁড়ায় মেয়েটা। মনে উথলে ওঠা প্রেমকে জলাঞ্জলি দিয়ে থমথমে দৃষ্টি ফেলে সামনে। রাগে পুড়ে ওঠা কাঠকাঠ গলায় শুধায়,

‘কি দরকার? হবে কেউ একজন। আপনার কেন জ্বলে?’

দিহান দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয়,

‘অন্যকারো জ্বলার কথা বুঝি?’

অন্তি কম কিসে? ঘুম থেকে জাগিয়ে ছাদে এনেছে এসব ছাইপাশ কথা শোনার জন্য! অসভ্য লোক। ক্লাস টু এর বাচ্চারাও এর থেকে ভালো বুঝে, হোয়াট ইজ প্রেম! কিন্তু এই লোক বুঝলো না। অন্তি ঝাঁঝালো জবাব দিলো,

‘অন্যকারো জ্বলার হাজার কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আপনার জ্বলার কারণ কি?’

অন্তির হঠাৎ এমন ফুঁসে ওঠা ব্যাপারটা দিহানকে অবাক করে। এইতো মেয়েটা দিব্যি আদুরে গলায় কথা বলছিল। এখন কি হলো? দিহান নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। বড়ো করে শ্বাস ফেলে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। গলার গম্ভীরতা ঢেকে নরম গলায় অন্তিকে ডাকে।

‘মেয়ে কাছে আসো।’

অন্তি চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। এক চুল ও নড়ে না জায়গা থেকে। দিহান আচমকা হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নেয়। দূরত্ব ঘুচিয়ে নেয় পুরোপুরি ভাবে। হঠাৎ টান সামলাতে দিহানের বুকের কাছে শার্টের অংশ আঁকড়ে ধরে অন্তি। হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসে তার। ধুমধাম শব্দে লাফাতে থাকে খাঁচায় আটকে থাকা হৃদযন্ত্রটা। চোখ আটকায় দিহানের এলোমেলো হয়ে যাওয়া সিল্কি চুলগুলোতে। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে দি সুন্দর দুলছে। অন্তির মন চায় হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু তার হাত দিহানের শার্টের অংশটুকু ছাড়তে নারাজ। অন্তি হাল ছাড়লো। দৃষ্টি নামিয়ে চোখ বারবার থামতেই দিহানের শান্ত দৃষ্টিতে জমে গেলো দৃষ্টি। অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করে নড়ে উঠতেই বাঁধন শক্ত হলো। অন্তি কিছু বলতে নিলেই তার পূর্বে দিহান তার মুখ খুললো। কিছু বলতে নিলে তার পূর্বেই অন্তি নাক মুখ কুঁচকে নেয়। বিরক্ত গলায় বলে,

‘সিগারেট খেয়েছেন? কড়া স্মেল পাচ্ছি।’

‘ওটা আমি সবসময় খাই। সেটা তুমি‌ জানো।’

‘অভ্যাস বদলানো যায়না? এখন থেকে….’

অন্তির মুখ চেপে ধরে দিহান। কথা শেষ করতে পারেনা সে। দানবিয় হাতের আড়ালে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় মেয়েটার। দিহান কড়া শাসনের গলায় বলে,

‘ভুলেও এটা বলবে না যে, তুমি আর সিগারেটের মধ্য থেকে একটা বেছে নিতে হবে আমায়। জানে মেরে ফেলবো। দুটোই চাই আমার। কথা মাথায় ঢুকেছে?’

অন্তি দ্রুত উপর নিচ মাথা নাড়ায়। দিহান ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। বাঁধন মুক্ত হতেই বড়ো করে শ্বাস ফেলে অন্তি। চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে অশ্রুকণা। রাগে লাল হয়ে ওঠে মুখ। এই লোককে আদেও প্রেমিক বলা চলে? পাষাণ লোক। একটু হলেই দমবন্ধ হয়ে মরতে যাচ্ছিলো!
দিহান সেদিকে কেয়ার করলো কম। গমগমে গলায় পুনরায় বলে উঠলো,

‘উত্তর দাও রূপ। তোমার প্রেমিক মোটেই ভালো মানুষ নয়। এবার উত্তর না পেলে ভয়ংকর কোনো শাস্তি পেতে চলছো। আমি মোটেই তোমার উপর জুলুম করতে চাইছি না। কে ছিলো ছেলেটা? আমি জানি ওর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জাস্ট ছেলেটা কে সেটা জানতে চাইছি। তোমায় সন্দেহ করছি এ ধরনের চিন্তা যেন ভুলেও মাথায় না আসে।’

অন্তি দুঃসাহসীকতার কাজ করলো। দিহানের হুসিয়ারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে জেদ ধরে চুপ করে রইলো। সে ও দেখতে চায় এই লোক ঠিক কতটা কঠিন হতে পারে তার সাথে। অন্তির চাল ঠিক বুঝলো দিহান। এই মেয়ের নাকের ডগায় জেদ। এতটুকু পুঁচকি মেয়ে এত জেদ পায় কোথায়? দিহান বাঁকা হেসে এক হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অন্তির কোমর। অন্যহাতে অন্তির খোঁপা করা চুল খুলে দিয়ে হাত বুলায় চুলের গভীরে। অন্তি দিহানের প্রতিটা কাজ দক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। যতক্ষনে সে বুঝতে পেরেছে সরে যাওয়ার পূর্বেই আটকা পড়ে যায় দিহানের শক্ত বাঁধনে।

এরপর?

এরপর অন্তি জীবনে প্রথমবারের মতো দীর্ঘ এক চুম্বনে আবদ্ধ হয়। দমবন্ধকর দীর্ঘ এ চুম্বনে ভালো অনুভূতির তুলনায় খারাপ লাগার পরিমাণটা একটু বেশিই ছিলো। দিহান তার নিষ্ঠুরতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে চুমুকেই বেছে নিয়েছিল।
প্রথম দিকে অন্তি দূরে সরবার জন্য ছটফট করলেও পরে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। লম্বা চুম্বন শেষে দিহান অন্তির কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। বুড়ো আঙুল দিয়ে অন্তির গাল গড়িয়ে পড়া চোখের পানিটুকু পরম যত্নে মুছে নেয়। ছোট করে একটা‌ চুমু খায় লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগায়। কোমল গলায় শুধায়,

‘এটা শাস্তি ছিল। আমার অবাধ্য হওয়ার চেষ্টা করবে না। তুমি আমার বাধ্য থাকলে দ্বিতীয় সবকিছু ভালোবাসা দিয়ে হবে। প্রমিস!’

অন্তি জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে দিহানের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। দুর্বল শরীর টেনে নিজ ভরে দাঁড়াতে চায়। দিহান আঁটকে দেয় তাকে। ফিসফিস করে বলে,

‘এভাবেই থাকো। আমি আর অল্পকিছুক্ষণ আছি।’

অন্তি বাধ্য মেয়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়। দিহান তা দেখে ঠোঁট টেনে হাসে। বুক ভরে আসে। বিধাতার নিকট বারবার শুকরিয়া জানায়। এই মেয়েটা ছাড়া তার জীবন একদম চলবে না। দিহান মুখ নিচু করে অন্তির কানে ছোট করে বলে,

‘ধন্যবাদ রূপ।’

অন্তি ঘাড় উঁচু করে দিহানের পানে চায়। কথা না বললেও চোখের ইশারায় কারণ জানতে চাইলে দিহান বলে,

‘কিছুনা। এখন সোজা রুমে চলে যাও। আমি তোমাকে যেতে দেখে ফিরে যাব।’

____________

অন্তির ঘুম ভাঙে বেলা করে। মাথার উপর যান্ত্রিক ফ্যানটা শব্দ করে ঘুরছে। অন্তির সমপরিমাণ বয়স ফ্যানটার। এজন্য শব্দ করলেও অন্তি ফ্যানটা বদলাতে দেয়না। একটা মায়া কাজ করে। হামি ছেড়ে উঠে বসে অন্তি। ঘড়িতে চোখ পড়তেই আতকে ওঠে। বারোটা বিশ বাজে। বালিসের তলা থেকে ফোন বের করতে সেখানে তন্নির বিশটা কল উঠে রয়েছে। কল ব্যাক করতে নিয়েও ফোন পূর্বের জায়গায় রেখে থম মেরে বসে রইল। গতরাতের ঘটনা মনে পড়তেই গাল গরম হয়ে ওঠে। কি ভয়ংকর কান্ড! লজ্জা লজ্জা! অন্তি দ্রুত পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ঠোঁট লাল হয়ে ফুলে আছে। অতিরিক্ত ঘুমের ফলে ফোলা ভাবটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। এই মুখ নিয়ে মানুষের সামনে কিভাবে যাবে সে? এ চিন্তা ছোট্ট মাথায় হানা দিতেই দিহানের উপর আক্ষেপে ফেটে পড়ে মেয়েটা।

সবার নজর থেকে বাঁচতে অন্তি সর্বক্ষণ রুমে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। দুপুরের খাবারটাও সে নিজ রুমে বসেই খেলো। নাহার জিঙ্গাস করলে উত্তর হিসেবে সে জানিয়েছে শরীর খারাপ করছে। নাহার গায়ে কপালে হাত দিয়ে চেক করতে গেলেই অযথা রাগ দেখিয়ে রুমের দরজা লাগিয়েছে। কি একটা বিশ্রি অবস্থা। এই অবস্থার জন্য অন্তি দিহানকে দোষারোপ করে চলছে। বিকেলে স্যার পড়াতে আসলেও অন্তি দরজা খুললো না। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে স্যারকে ফেরত পাঠিয়েছে। মেয়ের ব্যাবহারে নাহার অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে স্যারকে বলেছেন,

‘মেয়েটা সকাল থেকে অদ্ভুত আচরণ করছে। সারাদিন বাহিরে আসেনি। দুপুরের খাবারটাও নিজের ঘরে বসে খেলো। শরীরটা বোধহয় ভালো নেই। আপনি কিছু মনে করবেন না।’

ভদ্রলোক রাগ করেছে কিনা তা বোঝা গেলো না। কিন্তু গম্ভীর ভাবে বললেন,

‘ও ব্যাপারনা। এমন হয়। অল্প বয়সের তো!’

স্যার চলে যেতেই নাহার ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো হামলে পড়েছেন মেয়ের ওপর। দরজা বন্ধ থাকায় তার সবকথা অন্তির কান অব্দি না পৌঁছালেও এটুকু বুঝেছে আজ বাবা ফিরল বিচার বসবে। বড় করে তপ্ত শ্বাস ফেলে মোবাইল হাতে নেয় সে। দিহানের নম্বরে চট করে একটা ম্যাসেজ পাঠায়।

‘এই যে প্রেমিক!
আপনার শাস্তির দরুন বাড়িতেও শাস্তি পেতে চলছি। এটা তো ফেয়ার নয় তাই না? তাই জরিমানা হিসেবে আপনার
জন্যও শাস্তি ধার্য করা হয়েছে। আপনি রাজি কিনা‌ বলুন?’

প্রায় সাথে সাথেই জবাব আসলো।

‘শাস্তি হিসেবে যদি রূপবতী কন্যার নরম ঠোঁটের তপ্ত ছোঁয়া পাওয়া যায়, তবে আমি দিহান বারবার শাস্তির জন্য তাহার নিকট মাথা নোয়াবো।’

ম্যাসেজ পড়া মাত্র অন্তির কাঁশি উঠে যায়। কি সাংঘাতিক মাত্রায় অসভ্য লোক। গম্ভীরতার আড়ালে লোকটার এই অসভ্য রূপটা ঢেকে ছিল এতদিন। আস্তে আস্তে খোলস মোচন হচ্ছে যেন!

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here