#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
২৭.
পড়ন্ত বিকেল। আকাশে সোনালী রঙের মিষ্টি রোদ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাহিরে ছোট ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটি আর হকারদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। অন্তির রুমের জানালা খোলা। অন্তি খোলা জানালা থেকে বাহিরে চোখ রেখে বসে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। দীর্ঘসময় ধরে এক ভদ্রলোক তাকে ডেকে চলছে সেদিকে লক্ষ নেই তার। অধৈর্য হয়ে ভদ্রলোক স্কেল দিয়ে টেবিলে শব্দ করে আঘাত করতেই অন্তি চমকে তাকায়। ভদ্রলোকের মুখ থমথমে। সামনে খুলে রাখা বই বন্ধ করে দু হাত বুকে ভাঁজ করে বসেন তিনি। রয়ে সয়ে বলেন,
‘তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমি যতটুকু জানি তুমি একজন ভালো স্টুডেন্ট। শুরুরদিকেও তোমার প্রতিভা দেখেছি আমি। এখন কি সমস্যা হচ্ছে? পড়াশোনায় মন নেই কেন?’
অন্তি মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে। জবাব দেওয়ার মতো ভাষা নেই তার কাছে। অন্তিকে চুপ থাকতে দেখে ভদ্রলোক ভারী নিঃশ্বাস ফেলেন। পুনঃরায় বলেন,
‘কিছুদিন বাদে পরীক্ষা। তোমার পড়াশোনায় ফোকাস করা উচিত। আজেবাজে সকল চিন্তা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। দরকার হলে খানিক ব্রেক নাও। কোথাও বেড়াতে যাও। তারপর পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করো। আমি তোমার বাবাকে এ ব্যাপারে জানাবো।’
অন্তি তখনো চুপ করে নিচমিচ তাকিয়ে থাকে। সে কিভাবে স্যারকে বলবে যে, তার পরিবার তার জন্য সবকিছু আরো কঠিন করে ফেলছে। সাময়িক ব্রেক তার কোনো কিছুই পরিবর্তন করতে পারবে না।
টেবিলে খুলে রাখা চশমাটা চোখে পড়ে ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। এক পলক অন্তিকে দেখে নিয়ে বলেন,
‘আমি তোমাকে এ সপ্তাহে পড়াতে আসবো না। এই সপ্তাহ কোথাও বেড়াতে যাও। মাইন্ড ফ্রেশ করে এসো। আজ আসি।’
অন্তি মাথা নাড়িয়ে কেবল সম্মতি জানায়। পরপর স্যারের পিছু পিছু দরজা অবদি যায়। স্যার চলে যেতে ছোট ছোট পায়ে রুমে এসে ফোন হাতে ছাদে উঠে যায়। ছাদের লোহার গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ করে চেয়ার টেনে বসে। মিষ্টি রোদ তখন বিলিনের পথে। হালকা বাতাসে শীত শীত গন্ধ। মাথার উপর থেকে দু একটা কাক উড়ে যাচ্ছে। ছাদের রেলিংয়ে পাশের ছাদ থেকে উড়ে আসা দুটো পায়রা বসে। ধবধবে সাদা রঙের দুটো পায়রা। পাশাপাশি বসে ডানা নাড়ছে। ওরা কি প্রেমিকযুগল? সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে কিছুটা একান্ত সময় কাটাতেই এখানে এসেছে বোধহয়। অন্তি চট করে একটা ছবি ক্লিক করলো। এমন সুন্দর নিরব প্রেমিকযুগলকে ফ্রেমে বন্দী করতে মন চাইলো খুব। প্রেম সুন্দর! সেটা হোক অবলা কোনো প্রাণীর মাঝে!
আকাশের আলোটুকু ফুরিয়ে এসেছে। বিশাল আকাশ কালো চাদরে ঢেকে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। শেষ আলোটুকু ফুরিয়ে যাওয়া অবদি অন্তি অসহায়ের ন্যায় চেয়ে রইল আকাশ পানে। কোনো কারণ ছাড়াই আকাশ পানে এমন করে চেয়ে থাকতে ভালো লাগে তার। মন খারাপের এই সময়টা তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই আকাশটাই রয়েছে কেবল।
হুর হুর করে ছুটে আসা শীতল বাতাসে কেপে কেপে উঠছে শরীর। অন্তি গায়ের ওড়না দিয়ে ভালোভাবে শরীর পেঁচিয়ে নেয়। শরীর সাথে সাথে বুকের ভেতরটাও শীতলতায় ছেয়ে গেছে তার। হৃদয়টা বোধহয় বরফের ন্যায় জমে গেছে। উষ্ণতা দেওয়ার মানুষটা যে হারিয়ে গেছে! অন্তি খুব করে চায় মানুষটা ফিরে আসুক। সেদিনের মতো তাকে চমকে দিয়ে ছাদে আসুক। জড়িয়ে নিক উষ্ণ ভালোবাসায়।
ছটফটে হৃদয় নিয়ে দিহানের নম্বরে ডায়াল করে অন্তি। এই বুঝি কেটে যাবে কল, রিসিভ হবে না! ভাবনায় ঢিপঢিপ করতে থাকে ছোট্ট হৃদয়। অন্তির ছুটতে থাকা শ্বাসকে রোধ করে ওপাশ থেকে পুরুষালি রুষ্ট কন্ঠস্বরটা বলে উঠলো,
‘কে রূপ?’
অন্তির শ্বাস আটকে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। চোখ থেকে ঝুম ধারে জল গড়ালেও মুখ থেকে একটা শব্দ বের হলো না। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। এতদিন বাদে প্রিয় কন্ঠস্বরটা শোনার পরও কেন তার এমন শূন্য অনুভব হচ্ছে? মনে হচ্ছে এক রাশ দুঃখ তাকে আলিঙ্গন করেছে। এই কন্ঠটা এতশত দুঃখ বয়ে আনলো কেন? কেন মাদকতা নেই এই কন্ঠে? অন্তির নিরবে ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দটা ওপাশের মানুষটা অনুভব করলো হয়তো। এজন্যই মানুষটার কন্ঠে চঞ্চলতা প্রকাশ পেলো।
‘রূপ! কাঁদে না। এই মেয়ে? না করেছি না? শুনতে পাচ্ছ আমায়? থামো। কান্না থামাও। কথা বলো আমার সাথে। এমন করলে কল কেটে দিব কিন্ত। চাও সেটা?’
লক্ষী বাচ্চার মতো চুপ করে যায় মেয়েটা। শান্ত হয় সময় নিয়ে। দিহান ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে তার প্রেয়সীর শান্ত হওয়ার। কান্নার আঁচ কমে এলে সে নরম গলায় বলে,
‘কাল আমি যখন সামনে আসবো তখন কাঁদবে। তুমি কাঁদবে আমি তোমায় দেখবো। কান্নাটা কালকের জন্য তুলে রাখ।’
দিহানের এমন হেঁয়ালি কথা অন্তির ভালো লাগে না। সে চাচ্ছিলো লোকটা তাকে স্যরি বলুক। এতদিনের জন্য অনুশোচনা করুক। কিন্তু তার মাঝে তেমন লক্ষণ নেই। যা অন্তিকে আহত করছে। খানখান করে দিচ্ছে হৃদয়। কতশত অদৃশ্য ছুড়িঘাতে রক্ত ঝড়ছে তার হৃদয় থেকে তা এখনো বুঝতে পারছে না লোকটা। অন্তির খুব দুঃখ হয়। অভিযোগ করতে নিলেও যেন শব্দরা আটকে যায়।
ওপাশ থেকে দিহান তার নিরবতায় ধৈর্য হারা হয়। প্রেয়সীর কোমল গলার স্বর শোনার জন্য ব্যস্ত হয় সত্তা। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে দিহান গম্ভীর স্বরে বলে,
‘কথা বলছো না কেন? তোমার নিরবতা আমার পছন্দ না রূপ।’
‘আপনার অবহেলাটাও আমার পছন্দ না দিহান। তবুও কেন এত অবহেলা করেন আমায়?’
এমন অভিযোগে দিহানের কষ্ট হলো না। ঠোঁট কোণে হাসির দেখা মিললো। এই অভিযোগের আড়ালে লুকিয়ে থাকা যত্নটুকু সে খুব করে অনুভব করছে। তাইতো উত্তরে বলে,
‘তোমার ভালোবাসাকে খাটি করে নিতে। বুঝেছ মেয়ে?’
অন্তি ডানে বায়ে মাথা নাড়ায়। সে বোঝেনি। কিন্তু মুখে জবাব দেয় না। চোখ থেকে তখনো অনর্গল জল গড়াচ্ছে। মান অভিমানের পাঠ শেষ হলে অন্তি কান্না ভেজা গলায় আবদার করে বলে,
‘দিহান! দেখা করবো।’
‘উহু। কাল।’
অন্তি জেদ করে। একরুখে ভাবে বলে,
‘এখন। আমি এখন আপনাকে দেখতে চাই। আপনি না আসা অবদি আমি ছাদে অপেক্ষা করবো।’
‘মেয়ে! ভরসা করো না আমায়? কাল আসবো। সত্যি।’
‘আবার হারিয়ে যাবেন না তো?’
দিহান মলিন হাসে। সে তো কখনোই হারাতে চায়নি। সে বাধ্য হয়েছে। তার এ জীবনে পুরোপুরি ভাবে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা তীব্র। তবুও সে চায় হারিয়ে যাওয়ার আগ অবদি এই ছোট্ট মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। নিজ থেকে প্রেম কুড়িয়ে আনা এই মেয়েটার হাত ছাড়তে খুব ভয় হয় তার। এজন্যই তো নিজের বিনাশ জেনেও স্বার্থপরের মত আঁকড়ে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দিহান মুচকি হেসে মিথ্যা ভরসায় আবদ্ধ করে অন্তিকে।
‘এবার আঁকড়ে ধরার জন্য আসছি। হারিয়ে যাওয়ার অপশন নেই। তুমি কেবল আমার হতে নিজেকে প্রস্তুত করো।’
_______________
‘মাহবুব? মেয়েটার খোঁজ পেয়েছো?’
‘জ্বি না স্যার।’
‘দ্রুত খোঁজ নাও। বেশরম ছেলেটার একটা ব্যবস্থা না করলে সত্যিই শান্তি পাচ্ছি না।’
‘স্যার একটা কথা বলবো?’
‘হুম বলো।’
আপনার আর ছোট সাহেবের ভিতর অনেক মিল আছে।’
রেজওয়ান মির্জা কপাল থেকে হাত সরিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,
‘কেমন মিল?’
মাহবুব সাহেব সরল হেসে জবাব দেয়,
‘আপনারা দুজনেই খুব স্পষ্ট ভাষী। কথা বলতে কিছুর পরোয়া করেন না। যেমনটা ছোট সাহেব আজ বললেন। আমি হলে আমার বাপের সামনে লজ্জায় ওমন কথা তুলতে পারতাম না।’
‘বয়স কতো তোমার?’
মাহবুব সাহেব খানিক চমকায়। তার চাকরির এত বছর জীবনে কেউ তার বয়স জানতে চায়নি। এই বয়সের ব্যাপারটা তার কাছে ভিষণ অস্বস্তিকর বিষয়। তাছাড়া কারো কাছে তার বয়স জানতে চাওয়াটা ম্যানারসের বাহিরে। রেজওয়ান মির্জা এখন সেই ম্যানারলেস প্রশ্নটাই তাকে করেছে। মাহবুব সাহেব ভিষণ দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন,
‘এইতো চল্লিশ পেরুলো বোধহয়।’
রেজওয়ান মির্জা ভিষণ অবাক হয়ে বললেন,
‘বিয়ে শাদি কবে করবে আর?’
মাহবুব সাহেব একটু লজ্জা পেলেন। নরম করে বললেন,
‘এইতো বাপজান বললেই করে ফেলবো।’
রেজওয়ান মির্জা বড়ো করে শ্বাস ফেলে বলেন,
‘আমার ছেলের নির্লজ্জতা এখন আমার কাছে গর্বের ঠেকছে। আমি গর্বিত যে আমি একটা নির্লজ্জ বাঘের বাচ্চা জন্ম দিয়েছি।’
নুহাশ বিষন্ন মনে ছুড়ি দিয়ে আপেল স্লাইস করছে। হাতের কাজের দিকে তার মনোযোগ নেই। পাশেই দিহান আড়চোখে তার কাজ পর্যবেক্ষণ করছে। যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা বশত নুহাশের হাত কেটে যেতে পারে। এক পর্যায়ে দিহান চট করে তার হাত থেকে ছুড়ি কেড়ে নেয়। এক স্লাইস আপেল গালে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলে,
‘দেবদাসেন ভন নিছোস কেন? কি সমস্যা?’
নুহাশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘তুই শিওর রূপন্তিকে ছাড়ছিস না?’
দিহান খাওয়া থামিয়ে গভীর চোখে তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
‘ধরা ছাড়ার কথা কেন আসছে?’
নুহাশ চেয়ার টেনে দিহানের কাছে আগায়ে আসে। দিহানের হাত থেকে আপেলের প্লেট টেনে নিয়ে পাশের টেবিলে রাখে। মুখভাব সিরিয়াস করে বলে,
‘সোজা পয়েন্টে আসি। আমাদের জীবনের নিশ্চয়তা নেই। তোর উপরের হামলা থেকে তো বুঝতেই পারছিস। যখন তখন লাশ হয়ে ফিরতে পারি। এমন জীবনে ওদের জড়ানো ঠিক হবে?’
দিহান সাবলীল জবাব দিলো,
‘পৃথিবীর কারো জীবনেরই নিশ্চয়তা নেই। জন্ম যখন নিয়েছি মরতে হবেই। তাই বলে ভয় পেয়ে সব ছেড়ে দেবদাস হওয়ার মতো থার্ডক্লাস লজিকে আমি বিশ্বাসী নই।’
দিহানের জবাব নুহাশকে হতাশ করলেও এক ফোঁটা আশার আলোয় জ্বল জ্বল করে ওঠে মুখ। নিঃসন্দেহে দিহানের কথায় লজিক আছে। না বুঝে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ না দিহান। তারও উচিত তার জীবনের সবকিছুকে আঁকড়ে ধরা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অন্তত যা কিছু তার সেসব কিছু তার হওয়া চাই। নুহাশ হঠাৎ করেই উৎসাহ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দিহান আড়চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
‘কি সমস্যা?’
নুহাস হাসে। পকেট থেকে বাইকের চাবি বের করে আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,
‘কোনো উইস আছে তোর? কয়েক মুহূর্তের জন্য আমাকে জিনি ভাব। আমি তোর একটা উইস পুরোন করবো। ফর ইউর এক্সিলেন্ট ওয়ার্ডস।’
চলবে………….