পথ_হারা_প্রজাপতি(৬) #Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

0
333

#পথ_হারা_প্রজাপতি(৬)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

অতীত,
দুপুরের রান্না শেষে মনোয়ারা বেগম পুকুর ঘাটে গিয়েছেন হাড়ি পাতিল ধোঁয়ার জন্য। ধুয়ে এসে রোদে শুকাতে দিয়ে সাফিরার কাছে গেলেন। সাফিরা পেয়ারা গাছে বসে পেয়ারা খাচ্ছিলো। তার স্কুল কোচিং সবকিছু বন্ধ তাই আরাম করে গাছের ডালে বসে আছে, পাশে রুমানার সাথে গল্প করছে। মনোয়ারা বেগম বাঁশ ঝাড়ের থেকে একটা কঞ্চি নিয়ে সাফিরা কে ভয় দেখিয়ে বলে, নিচে নামবি নাকি এটা দিয়ে তোকে ফিডামু? (পিটাবো) বেইন্নাবেলা থেইক্কা কাম করতাছি, (সকালবেলা থেকে কাজ করতেছি) আমার আতে আতে একটু কাম করবি তা না, (আমার হাতে হাতে কাজ)
ট‌ই ট‌ই করে পাড়া বেরাচ্ছিস! আমি তোর এসব সহ্য করতাছি, পরের মায় পিছা দিয়া বাইরাইয়া কাম করাইবো দেখিস। ( শাশুড়ি মা ঝাড়ু দিয়ে মেরে কাজ করাবে।) সাফিরা মায়ের ভয়ে উপরের ডালে উঠে দাঁড়ায়। আর বলে, কালকে থেকে তোমার হাতে হাতে সব কাজ করে দিব আম্মা।
মেয়ের কথা শুনে আরো রেগে গেলেন মনোয়ারা বেগম। বললেন, তোর কালকে আর জীবনে আইতো না। তোদের বাপ তো সারছে! এই বলে চোখের পানি ফেলে ঘরের দিকে চলে গেলেন।

সাফিরা একটু অলস প্রকৃতির মেয়ে। প্রায় সময় বলে মাকে সাহায্য করবে কিন্তু সেই দিন আর মনোয়ারা বেগমের ভাগ্যে জুটে না।
মনোয়ারা বেগম চোখের পানি মুছে ঘথের কাছে গিয়ে দেখেন দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা। দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বললেন, এই সিনথিয়া ঘরো কি করতাছোস তুই? দরজা বন্ধ করছোস কেন? দরজা খুল।
অনেকক্ষণ ধরে ডাকার পরেও যখন সিনথিয়া দরজা খুললো না তখন মনোয়ারা বেগম বিলাপ করতে শুরু করেন। আর্তনাদ শুনে সাফিরা দৌড়ে আসে, আসেপাশের প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসে।
তারপর সাফিরার পাশের ঘরের চাচারা এসে কাঠের দরজা কেটে ঘরে ডুকে। সিনথিয়া কে খুঁজতে দ্বিতীয় রুমে গিয়ে দেখে ফ্যানের সঙ্গে ফাঁ/স দিয়ে আত্মহ/ত্যা করেছে মেয়েটা! মেয়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো মনোয়ারা। সাফিরা আপু বলে চিৎকার। এই খবর বাতাসের মতো ছড়িয়ে গেল এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম। খবর পেয়ে কয়েক গ্রামের মানুষ বাড়িতে চলে এলো।
মনোয়ারা বেগমকে কেউ শান্ত করতে পারছেন না। মেয়ের জন্য পাগল প্রায় তিনি। শেষে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
গ্রামের মানুষ পুলিশকে খবর দিলেন। ঘন্টা খানেক পর পুলি/শ চলে এলো, এসে গ্রামের মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো, সাফিরা কে জিজ্ঞেস করলো কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না। শুধু যা দেখেছে তাই বলল।
তারপর পুলিশ সিনথিয়ার লা/শ নিয়ে চলে গেল।
মৃত্যুর সঠিক কারণ জানার জন্য ময়নাতদন্ত বা পোস্টমর্টেম করা হয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখে জানা যায় সিনথিয়া তিন মাসের গর্ভবতী ছিল! এ ব্যাপারে মনোয়ারা বেগম বা সাফিরা কিছু জানতো না। তাই গ্রামের মানুষজন শুনে সিনথিয়ার পরিবারকে যা-তা কথা বলতে শুরু করল। বলল,
সিনথিয়া ন/ষ্টা, বিয়ের পূর্বেই অবৈধ সম্পর্ক করে পেটে বাচ্চা পয়দা করছে! আরো কত কথা। এসব কথা সহ্য করতে না পেরে মনোয়ারা বেগম স্ট্রোক করে মৃত্যু বরণ করেন!
সাফিরার বাবা হাই স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। খুব সুন্দর ভাবে চলছিল তাদের জীবন। একটা রোড এক্সিডেন্ট এ তিন বছর আগে সাফিরার বাবা মারা যান, তারপর থেকে মনোয়ারা বেগম মেয়ে দুটো কে আগলে জীবন পার করেন। আফরোজা বেগমের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো আলহামদুলিল্লাহ। তাই বোনকে যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করেন এবং কি সিনথিয়া কে ছেলের বউ করবেন বলে ঠিক করেন। কথা হয় করিম সাহেব এবং আফরোজা বেগম হজ্জ পালন করে এসে তাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করবেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে হলো তার উল্টো বড় মেয়ের আত্মহত্যা, গ্রামের কিছু মানুষের কটুক্তি মেনে নিতে না পেরে মনোয়ারা বেগম পরপারে পাড়ি জমান।

করিম সাহেব আর আফরোজা বেগম হজ্জ পালন করতে সৌদি আরব গিয়েছেন। তাই এমন পরিস্থিতিতে সাফিরা একা হয়ে পড়ে। খবর পেয়ে রাযীন আসে। খালাম্মার দাফন কাফন শেষ করে সাফিরা কে সাথে করে নিয়ে যেতে চায় ঢাকা তাদের বাসায়। তখন গ্রামের মানুষ বাঁধা দিয়ে বলল, তোমার বাপ মা হজ্জ করতে গেছে তাই একটা যুবতী মেয়েকে এভাবে নিয়ে যেতে পারবে না! রাযীন তখন রুক্ষ গলায় বলল,
–” আমি নিয়ে না গেলে ও কার কাছে থাকবে এখানে? থাকলেও ওর সিকিউরিটি কে দিবে?
তখন গ্রামের মানুষজন বলল, তুমি যে ওর কোন ক্ষতি করবা না সেটা কিভাবে বুঝবো? তোমার বাসায় বাপ মা নাই তাই এই পরিস্থিতিতে আমরা এভাবে যেতে দিতে পারুম না।
তখন রাযীন বলল,
–” তাহলে কি চান আপনারা? আমি ওকে এখানে একা রেখে চলে যাই?
মেম্বার সাহেব গ্রামের মানুষজনের সাথে একমত হয়ে বললেন,
–” তুমি মাইয়াটা কে বিয়ে করো! তাহলেই সমাধান হবে।
রাযীন বিয়ে করতে রাজি হয় না। তখন গ্রামের মানুষ একরকম জোর করেই রাযীনের সাথে সাফিরার বিয়ে দিয়ে দেয়!
তারপর রাযীন সাফিরা কে নিয়ে ঢাকা তাদের বাড়িতে যায়। হজ্জ পালন করে করিম সাহেব আর আফরোজা বেগম এসব শুনে কষ্টে ভেঙ্গে পড়েন। তারপর ধীরে ধীরে ভাগ্য কে মেনে নেন। রাযীন কে বুঝান সাফিরা কে মেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু ওরকম ভাবে জোর করে বিয়ে দেওয়ায় মেনে নিতে পারে না রাযীন।
.
.
এক‌ই সাথে দুটো অন্যায় দুনিয়ার বুকে করে গেল সিনথিয়া। না পেল ইহকাল আর না পাবে পরকাল।
যার কারণে হাসিখুশি পরিবারটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ঘরে ভাতি (লাইট) দেওয়ার ও কেউ র‌ইলো না। দোরগোড়ায় তালা ঝুলে গেল চিরস্থায়ী।
অধৈর্য মানুষকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে যায়। মানবজীবনে ধৈর্যের চেয়ে কল্যাণকর আর কিছু নেই। ধৈর্যের মাধ্যমে অনেক কঠিন বাস্তবতাকে সহজে মেনে নেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা হলো যারা ধৈর্যশীল তাদের সঙ্গে আল্লাহর বিশেষ সঙ্গ থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘হে মুমিনরা!
তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। [১]

একবার রাসুল (সা.) আনসার সাহাবিদের কিছু লোককে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধরে, তিনি (আল্লাহ) তাকে ধৈর্যশীলই রাখেন। আর যে অমুখাপেক্ষী হতে চায়, আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত রাখেন। ধৈর্যের চেয়ে বেশি প্রশস্ত ও কল্যাণকর কিছু কখনো তোমাদের দান করা হবে না। [২]
.
.
বর্তমান,
তামান্নার বাবা মা তাকে আর করিম সাহেবের বাসায় রাখতে চাইছিলেন না। তামান্না দের বাড়ি কলেজ থেকে প্রায় তিন ঘন্টার পথ। তাই করিম সাহেবের বাসায় থেকে পড়াশোনা করার জন্য তার মা দিয়েছেন। মেয়ের স্বভাবের জন্য তারা পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু করিম সাহেব আর আফরোজা বেগম তাদেরকে বুঝিয়ে তামান্না কে আবার নিয়ে আসেন।
অন্যদিনের মতো স্বাভাবিক চলছিল সবকিছু। রিমা কিছুদিন থেকে শশুর বাড়িতে চলে গেছে। সাফিরা আর তামান্না কলেজে আসা যাওয়া করে। রাযীন অফিস করে, রাতের বেলা সাফিরা কে পড়াশোনায় সাহায্য করে। করিম সাহেব অবসর সময়ে ইসলামিক বই পড়েন। আফরোজা বেগম ঘরের টুকটাক কাজ সবার খেয়াল রাখেন। এখন সাফিরা আর তামান্না ও তাকে কাজে সাহায্য করে।
.
একদিন কলেজ শেষে তামান্না বাসায় চলে আসে। কিন্তু সাফিরা আসে না। আফরোজা বেগম মনে করেন হয়তো মিমের সাথে তাদের বাসায় গিয়েছে। কিন্তু মিম কে কল করে জানতে পারে তাদের বাসায় যায়নি তারচেয়ে বড় কথা মিম একটু অসুস্থ বলে কলেজে যায়নি। এ কথা শুনে আফরোজা বেগম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে অথচ সাফিরার আসার নাম নেই। করিম সাহেব কলেজ পর্যন্ত যায় কিন্তু পায় না সাফিরাকে। আফরোজা বেগম রাযীনকে কল করে কিন্তু রাযীন কল রিসিভ করে না.……

#চলবে ইনশা আল্লাহ।

রেফারেন্স:
[১] (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫৩)
[২] (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭০)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here