#ডেস্পারেট_লেখিকা
–Farhina Jannat
১.
“বিয়ে”
“কীহ্?”
“তোর এই সমস্যার স….বথেকে ভালো সমাধান হচ্ছে বিয়ে। তুই বিয়ে করে ফেল” হালকা টান দিয়ে কথাটা বলেই হাসিতে ফেটে পড়ল সায়মা।
চশমার পুরু কাঁচের ভেতর দিয়ে ভাসা চোখে কয়েক সেকেন্ড বেস্ট ফ্রেন্ডের দিকে তাকিয়ে থাকল মারজান। ঠিক তারপরেই সামনের লাল নয়নতারা গাছটার দিকে দৃষ্টি ফেরাল ও। দুহাতে ধরে থাকা উষ্ণ মগটায় ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে বলল, “ভালো বলেছিস তো! এটা তো আমার মাথায়ই আসেনি।”
সবে চায়ে প্রথম চুমুক দিয়েছিল সায়মা, মারজানের কথা শুনে জোর বিষম খেল। খক খক করে মাথা কপাল চাপড়ে কোনোমতে স্বাভাবিক হয়ে দুচোখ গোলগোল করে মারজানের দিকে তাকাল ও, “আর ইউ সিরিয়াস?”
***
“আব্বু, আমি বিয়ে করতে চাই” বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃসংকোচে বলল মারজান।
ঘরের ভেতর বোমা ফাটলেও বোধহয় এর থেকে কম অবাক হতেন আব্দুল মান্নান তালুকদার। হাতের পেপার মুখের সামনে থেকে নামিয়ে সায়মার মতোই চোখ বড়বড় করে মেয়ের দিকে তাকালেন। অপরিসীম বিস্ময় ঠিকরে বেরোচ্ছে তার দু’চোখ থেকে।
“কী বললে?” কোনমতে বিস্ময় কাটিয়ে বললেন তিনি।
“ঠিকই শুনেছো আব্বু। আমি বিয়ে করতে চাই।”
“ছেলেটা কে?” গম্ভীর হয়ে গেছে কণ্ঠস্বর।
“কোন ছেলে?” মারজানের কণ্ঠে এবার বিস্ময়।
“যাকে বিয়ে করতে চাও।”
“সেটা আমি কী করে জানব? ছেলে তো তোমরা পছন্দ করবে। তবে প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি কইরো আব্বু। আমি এজ সুন এজ পসিবল বিয়ে করতে চাই।”
এবার বিস্ময়ের মাত্রা সত্যিই সীমা ছাড়াল। মেয়ের অদ্ভুত সব শখের সাথে তালুকদার সাহেব অপরিচিত নন। তবে শখের মাত্রা যে বিয়ে পর্যন্ত চলে আসতে পারে, এটা তার সুদূর কল্পনাতেও কোনোদিন আসেনি। সবে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ছে মারজান। এ বয়সে খুব বেশি হলে ছেলেমেয়েদের প্রেম করার শখ জাগে, আর তার মেয়ের কিনা সোজা বিয়ের শখ হল?
অন্য কোনো বাবা হলে হয়তো কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু মারজান কখনোই অহেতুক কোন কথা বলেনা। ও কিছু করতে চায় বলার মানে সেটা সিরিয়াসলিই করতে চায়, এর মধ্যে কোন ভনিতা নেই।
ক্লাস থ্রিতে মারজানের শখ হল সে একটা বিড়াল পালবে। ব্যক্তিগতভাবে পশুপাখি ঘরে রাখা একদমই অপছন্দ হলেও আদরের মেয়ের আব্দার, কিনে দিলেন তালুকদার সাহেব। দুই দিন পরেই যে মারজানের শখ মিটে গিয়েছিল, তা কিন্তু নয়। ও অত্যন্ত আদর যত্ন করতো তুষারের। বিড়ালছানাটার নাম তুষার দেয়ার কারণ একেবারে তুষারের মত ধবধবে সাদা লোমে ঢাকা ছিল ওর ছোট্ট শরীরটা। এত আদুরে ভঙ্গিতে মিঁয়াও মিঁয়াও করতো, কিছুদিনের মধ্যে বাসার সবাই ভালোবেসে ফেলে ওকে। বিড়ালটা দুই বছর পর হঠাৎ মারা গেলে কষ্টে প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছিল মারজান। আরেকটা বিড়াল কিনে দিতে চেয়েছিলেন তালুকদার সাহেব, কিন্তু রাজি হয়নি ও।
এরপর কখনও হাতের কাজ শেখা তো কখনও সাইকেল চালানো। আবার কখনও ডিবেট কম্পিটিশনে নাম দেয়া তো কখনও ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায়। এ মেয়ের নিত্যনতুন শখের যেন শেষ নেই। সব জায়গাতেই কমবেশি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে সে। তাই ইসলামে অননুমোদিত কিছু না হলে এখন আর কোন কিছুতে মানা করেন না তালুকদার সাহেব। তবে বর্তমানে তার মেয়ে মজে আছে ফেসবুকে লেখালেখি নিয়ে, এ খবর তার কাছে আছে। যেনতেন লেখিকা নয় সে, তার পেজের ফলোয়ার গেল মাসে লাখ ছাড়িয়েছে। একটার পর একটা গল্প-উপন্যাস লিখে যাচ্ছে মেয়েটা। পড়াশোনা আর নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম ছাড়া বাকি সময় তাকে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে থাকতেই দেখা যায়। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন পরবর্তী শখ হিসেবে বই ছাপানোর আব্দার আসবে। তার বদলে বিয়ে! আরও চিন্তার বিষয় হল, এক ইচ্ছার মধ্যে আরেক ইচ্ছার অনুপ্রবেশ এর আগে দেখা যায়নি। তাহলে এবারে লেখালেখির ভুত না ছাড়তেই বিয়ের ভুত কেন চাপল ওর মাথায়?
তালুকদার সাহেব স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করতে গেলে হাঁ হাঁ করে উঠলেন মনোয়ারা। বাবার প্রশ্রয় পেয়ে মেয়ে দুনিয়ার যত আজগুবি কাজ করে বেড়ালেও এসব তার একদম পছন্দ না। বাড়ির একটা কাজ জানে না, রান্নার র-ও পারে না, এই মেয়ে কিনা করবে বিয়ে! বাপ-মায়ের ইজ্জত তো ধুলোয় লুটিয়ে ছাড়বে। তিনি কোনোমতেই সেটা হতে দিবেন না, সাফ বলে দিলেন। এরপর তালুকদার সাহেব কথা বলতে গেলেন ছেলে মিরাজের সাথে। মিরাজ মারজানের থেকে দশ বছরের বড়। তাই দুই ভাইবোনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আর গড়ে উঠেনি, শ্রদ্ধা আর স্নেহের জায়গাতেই থেকে গেছে। বাবা-মায়ের মতই বোন চোখের মনি মিরাজের। তাই মায়ের কথাতে সুর মেলাল সেও। এই অপরিণত বয়সে বিয়ে করলে নানান ঝামেলায় পড়তে হবে মারজানকে, ও শুধু বয়সেই বড় হয়েছে, মনে নয়। তাই এই অদ্ভুত আব্দারে কান দেয়াটাই বোকামি।
তালুকদার সাহেব অবশ্য স্ত্রী আর ছেলের সাথে একমত হতে পারলেন না। তাঁর মনে হল, মেয়ে যখন বলেছে এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন না কোন কারণ আছে। তিনি তার সুসময় আর দুঃসময়ের একমাত্র বন্ধু রেজোয়ানুল হক কে ডেকে পাঠালেন বাসায়। চিন্তিত মুখে সমস্যার কথা বলতেই হো হো করে হেসে উঠলেন হক। বললেন, “এই ব্যপার! এর সমাধান তো হাতেই আছে।”
বোকা বোকা চোখে তাকালেন তালুকদার, “হাতেই আছে মানে?”
“ইজানকে কেমন লাগে তোর?”
“ইজানকে কেমন লাগে মানে?” পরমুহূর্তেই কথার অর্থ ধরতে পারলেন তিনি। “তুই ইজানের সাথে…..?”
“হ্যাঁ, বন্ধু। সত্যি বলতে, আমি আর তোর ভাবী অনেক আগে থেকেই মারজানকে পছন্দ করে রেখেছি ইজানের জন্য। ভেবেছিলাম সময় আসলে কথা পাড়ব। কিন্তু এখন তো দেখছি আমাদের চিন্তার আগেই সময় এসে গেছে।”
বন্ধুর হাসি বিগলিত চেহারা দেখে কিঞ্চিৎ রাগ উঠল তালুকদারের। “আমি তোর কাছে ওর মাথা থেকে ভুত ছোটানোর পরামর্শ চাইতে আসলাম আর তুইও মারজানের কথায় তাল মেলাচ্ছিস?”
“দেখ বন্ধু, আমি আগেরদিনের বাবাদের মতো গোঁড়া নই, কড়াও নই। মারজান মা নিজে মুখে বিয়ে করতে চেয়েছে এটা মোটেও লজ্জার কিছু না। বরং লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করার থেকে অনেক উত্তম কাজ করতে চেয়েছে। আমাদের উচিত ওর ইচ্ছাকে সম্মান করা আর এই হালাল কার্য উত্তমরূপে সম্পন্ন করে দেয়া”
“কিন্তু ইজান নিজেও তো মাত্র এইচএসসি দিল। এই বয়সে ও কি বিয়ে করতে চাইবে?”
“আরে ধুর বেটা! তুই সেটা আমার ওপর ছেড়ে দে। তুই শুধু বল তোর কোন আপত্তি আছে কিনা আমার ছেলেকে জামাই করতে।”
“কি যে বলিসনা, ইজান কে নিজের ছেলের মতোই চিনি আমি। ওকে অপছন্দ করতে যাব কোন দুঃখে? কিন্তু সবকিছু বড্ড তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে কিনা ভাবছি।”
“ভাবাভাবি বাদ দাও বন্ধু, সামায় আগায়া হ্যায়, চালো আব ইয়ে দোস্তি কো রিশতেদারি মে বাদাল দেতে হে।” বন্ধুর পিঠ চাপড়ে ফূর্তিবাজ কণ্ঠে বললেন হক সাহেব।
****
হক সাহেবের মতো এত সহজভাবে বিষয়টা নিতে পারলেন না সুফিয়া বেগম, ইজানের মা। আঁইগুঁই করতে করতে একসময় সাফ বলেই ফেললেন, যে মেয়ে নিজ মুখে বিয়ে করতে চায় সে মেয়েকে এখন আর নিজের ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করতে পারছেন না তিনি। কথাটা শুনে বিরক্ত হলেন হক সাহেব। বন্ধুর মতো স্ত্রী কেও বোঝালেন, বিয়ে করতে চাওয়া মোটেই কোন অন্যায় কাজ নয় বরং একটা উত্তম কাজ। এ সম্পর্কিত বুখারী শরীফের সেই হাদীসটার কথাও শোনাতে ভুললেন না তিনি, যেখানে এক মহিলা রাসূল(স) এর নিকট নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। হযরত আনাস (রা) এর মেয়ে সেখানে তাঁর সাথে উপস্থিত ছিলেন আর ওই মহিলার প্রস্তাব শুনে মহিলাকে নির্লজ্জ আখ্যা দিয়ে বসেন। তখন তাঁর পিতা বলেন যে, ওই মহিলা তাঁর(তাঁর মেয়ের) থেকে উত্তম। সে রাসূল (স) কে বিবাহের আকাঙ্খা পোষণ করেছে বলেই প্রস্তাব দিয়েছে। এটা তার দোষ নয় বরং গুণের পরিচায়ক। আর এখানে মারজান তো নিজে একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে এসে বলেনি যে সে তাকে বিয়ে করতে চায়। পাত্র পছন্দের দায়িত্ব বাবা-মাকেই দিয়েছে, এখানে দোষটা কোথায়?
মনে মনে প্রসন্ন না হলেও বুঝলেন সুফিয়া বেগম, এ লোকের মনে যেটা এসেছে এখন সেটা আর বদলাতে পারবেন না তিনি। শেষ ভরসা ছেলে ইজান, ওর এখন জীবন এনজয় করার বয়স। সেখানে এই বয়সে বিয়ে করে সাধ করে হাঁড়িকাষ্ঠে গলা কেউ দিতে চায়? মনে মনে নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে যে ছেলেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সম্মান করেন হক সাহেব, তিনি কিছুই ওর উপর চাপিয়ে দিবেন না।
***
মাগরিবের আজানের পনেরো মিনিট আগে ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়ে বাসায় ঢুকল ইজান। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে নিয়মিত পাড়ার ক্লাবে খেলছে ও। এমন না যে, ভবিষ্যতে জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলার স্বপ্ন দেখে, খেলতে ভালো লাগে তাই খেলে। বসার ঘরে সোফায় বসে পা থেকে প্যাড খুলছিল ইজান, সেসময় সেখানে আবির্ভূত হলেন সুফিয়া বেগম।
“তোর বাবার মাথায় যে নতুন ভুত চেপেছে জানিস?”
“তাই নাকি? কী ভুত চাপল?” মুখে হাসি টেনে বলল ইজান, এখনো ব্যস্ত প্যাড খুলতে।
“তোকে নাকি বিয়ে দিবে”
হাত থেমে গেল ইজানের। চোখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল ও, উচ্চারণ করল একটাই শব্দ, “হোয়াট!?”
মাগরিবের নামাজের পর বাসায় ফিরে নাস্তা সামনে নিয়ে বসলে কথাটা পাড়লেন হক সাহেব, যেটা ইজান আগেই মায়ের থেকে শুনে নিয়েছে। মায়ের ওই কথার কারণে আজকে নামাজে মনযোগ সরে যাচ্ছিল। এটা একটা কথা? এই বয়সে কোনো ছেলে বিয়ে করে? কী বলবে সবাই শুনলে?
বাবা-মার সাথে তর্কাতর্কি বা বেয়াদবি করবে এমন ছেলে ইজান নয়। কিন্তু তাই বলে এ বয়সে বিয়ে করার পাত্রও সে নয়। বাবাকে নরম সুরে বোঝাতে লাগল যে সে এখন বুয়েটসহ বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির এডমিশন এর জন্য পড়াশোনা করছে। এ সময় অন্য দিকে মন দিলে ওর নিজের ক্যারিয়ার হ্যাম্পার হবে। ওর বাবাও মনযোগ দিয়ে ওর যুক্তিগুলো শুনলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি শুধু আমাকে বলো, তোমার কি নিজস্ব কোন পছন্দ আছে? দেখো, আমরা কিন্তু ছেলেমেয়ের পছন্দকে রেস্পেক্ট করি। তোমার ভাইয়া কিন্তু নিজেই প্রথমে তোমার ভাবির খবর দিয়েছে। আমরা বাকি খোঁজখবর নিয়ে বিয়ে দিয়েছি। তাই তেমন কিছু হলে নিঃসংকোচে বলে ফেলো” হালকা রক্ত জমল ইজানের চেহারায়, তবে শ্যামলা বর্ণের হওয়ায় ঠিক বোঝা গেল না।
“না, বাবা। এমন ব্যাপার মোটেই না”
“তাহলে ঠিক আছে। আমি একটা অনুরোধ করি? বন্ধুকে মুখ ফুটে বলে ফেলেছি তো। তুমি একবার চলো আমাদের সাথে। মারজানকে দেখে যদি তোমার পছন্দ না হয়, ফাইন। আমি আর বিয়ের কথা বলব না”
রাজি হল ইজান। তবে ও যেটা জানত না সেটা হল, বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হলে ওর মারজানকে দেখতে না যাওয়াই উচিত ছিল।
(চলবে)
আসসালামু আলাইকুম। যেহেতু মাত্র চারটা পর্ব পোস্ট করেছিলাম, তাই আবার শুরু থেকে দিচ্ছি। আমার ধারণা এতদিনে সবার ভুলে যাবার কথা। তাই আপনারাও নাহয় শুরু থেকেই শুরু করুন। আর নতুন যারা পড়বেন, কেমন লাগছে, অবশ্যই জানাবেন।