#ডেস্পারেট_লেখিকা
–Farhina Jannat
৬.
পড়াশোনার চাপ আরও বেড়ে যাওয়ার আগে মারজানের সব লেখা পড়ে শেষ করবে, পণ করেছে ইজান। গত এক সপ্তাহ ধরে সেই ম্যারাথন চলছে। অলমোস্ট শেষ হয়ে এসেছে। পড়তে পড়তে মারজানের ভেতরের অনন্য এক সত্তাকে আবিষ্কার করেছে ইজান। আবিষ্কার করেছে এক অন্য জগত, যে জগতের রূপকার মারজান। সেখানকার সবকিছু যেন একেবারে জীবন্ত। প্রতিটা চরিত্রকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছে যে পড়ার সময় যেন চোখের সামনে দেখা যায় তাদের। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না অনুভব করা যায় অন্তর থেকে। ওদের সাথে ইজানও হাসে, কাঁদে, আনন্দ লাভ করে, ব্যথা পায়। লেখার মাঝে আরও আবিষ্কার করেছে মারজানের ঘরে থাকা জিনিসগুলোর অস্তিত্ব। কোনো গল্পের নায়কের ক্যালিগ্রাফি করার শখ আছে, কোনো চরিত্র আবার সূচিশিল্প দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
গল্প লেখার জন্য কাজগুলো শিখেছে নাকি শেখা জিনিসের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা লেখায় তুলে ধরেছে, ঠিক বোঝা যায় না। তবে যে মেয়ে লেখার জন্য বিয়ে করতে পারে, তার কাছে এগুলো তো নস্যি।
একটা উপন্যাসে মারজানের সাথে মিল আছে এমন একটা চরিত্র পেল ইজান। সেই চরিত্রের যে নায়ক, সে আবার উদ্ভট উদ্ভট সাজপোশাক পরে নায়িকাকে চমকে দিতে ভালোবাসে। এই যেমন এক জায়গায় লিখেছে,
‘তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখল ইশিকা। রাগে ব্রম্ভতালু জ্বলে যাচ্ছে ওর। হিমুর মত হলুদ পাঞ্জাবি পরেছিস ভালো কথা, তার সাথে হলুদ পায়জামা আর টুপিও পরতে হবে! একটা মিনিমাম কমনসেন্স তো থাকা উচিত মানুষের!
ঠিক এই সময় মানুষটা ইশিকার দিকে তাকিয়ে ভুবনজয়ী একটা হাসি দিল। মুহূর্তের মধ্যে মাথার সমস্ত রাগ বাস্প হয়ে উড়ে গেল। এক মুহূর্তে বদলে গেল যেন সবটা। এখন যেন এই উদ্ভট পোষাকেই নিশানকে স্বপ্নে দেখা রাজপুত্রের মত লাগছে ওর”
বিষয়টা চিন্তায় ফেলে দিল ইজানকে। মারজানও কি তাহলে এরকম কিছু পছন্দ করবে?
যেই ভাবা সেই কাজ। রাস্তার মানুষজনের হাসি উপেক্ষা করে পরদিন হলুদ পায়জামা পাঞ্জাবি পরে শশুড়বাড়িতে হাজির হলো ইজান। ওদের বাসার দারোয়ান কাম মালী চাচা পর্যন্ত ওকে দেখে হেসে দিলেন। মনটা বেজার হলেও আশা ধিকিধিকি জ্বলছে, মারজান কী বলে ওকে দেখলে।
***
শেষ বিকেলের রোদ গায়ে মেখে মারজান বসে আছে বারান্দায়। প্রতিদিন সূর্যাস্ত দেখতে ভীষণ ভালো লাগে ওর। ঘন্টা ভরে আকাশে চলে রঙের খেলা। তারপর সব খেলা সাঙ্গ করে বারান্দার কোণাটা দিয়ে কেমন টুপ করে ডুবে যায় সূর্যটা। ভাগ্যিস বুড়িগঙ্গাটা ছিল বলে, নইলে এমন বাধাবিঘ্ন হীন সূর্যাস্ত দেখা কি আর কপালে জুটত?
তবে আজ ওর মুখটা ভার। ইজান যখন পেছন থেকে ওর চোখদুটো ধরল, মুখের মধ্যে রাজ্যের সব হাসি যেন একসাথে ফুটে উঠল। তবে হাত দুটো সরিয়ে পেছনে তাকাতেই হাসিগুলো মুছে গেল মুখ থেকে।
“ও, তুমি!”
“কী ব্যাপার? আমাকে দেখে মন খারাপ হলো?”
“আসলে সায়মা এমন করে সবসময়। তাই আমি ভাবলাম….”
“তোমাদের ঝগড়া এখনো মিটেনি?” দুচোখ কপালে তুলে বলল ইজান।
“ঝগড়া হলে না মিটবে। শুধু শুধু রাগ করে বসে আছে। কেন যে রাগ করেছে, সেটাও বলছে না। আমাকে যেন সহ্যই করতে পারছে না। দেখো, কালকে কী মেসেজ পাঠিয়েছে”
‘যখন তোমার কেউ ছিল না, তখন ছিলাম আমি; এখন তোমার বর হয়েছে, পর হয়েছি আমি’ মারজানের পাশে বসে মেসেজটা পড়ল ইজান।
বর্ষার মেঘের ঘনঘটা মারজানের চেহারায়। এখনি যেন জোর বর্ষণ শুরু হবে। এই অভিজ্ঞতা ইজানের এই প্রথম। এর আগে মারজানকে কাঁদতে তো দূরের কথা, মুখ ভার করতে পর্যন্ত দেখেনি।
“আচ্ছা! হঠাৎই? আমাকে নিয়ে কিছু হয়েছে তোমাদের মধ্যে?”
“কই, আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না”
“আচ্ছা, শেষ যেদিন কথা বলেছিলে, সেদিন কিছু বলে কষ্ট দাওনি তো?”
“না। আমি কেন কিছু বলে কষ্ট দিতে যাব?”
“আচ্ছা, এটা বলো, বিয়ের পর তুমি ওর সাথে আলাদা কোনো আচরণ করেছো?”
“কই, নাতো। আলাদা আচরণ করার মতো কথাবার্তাই তো হয়নি ওর সাথে। ও আমার সাথে এর আগে কখনো এমন করেনি”
উঠে দাঁড়ালো ইজান। “চলো, প্রব্লেম সলভ করি”
“মানে?” চোখ তুলে তাকাল মারজান।
“সায়মার বাসা কাছেই না? চলো গিফটস নিয়ে বান্ধবীর বাসায় যাবে এবং তার মান ভাঙাবে।“
উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারজানের চেহারা।
“ভালো বলেছ তো। আমি তো এটা ভাবিইনি” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল ও।
কাছের একটা সুপার শপ থেকে সায়মার পছন্দের চকলেট আর আইসক্রিম কিনে রওনা দিল ওরা।
“আমি ওর বাসায় খুব একটা যাই না। ও-ই বেশি আসে আমার এখানে। তাই আমার একথা মাথায়ই আসেনি” খানিক বাদে বলল মারজান।
“কেন?” একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করল ইজান।
প্রশ্নটার উত্তর সাথে সাথে দিল না মারজান।
“এমনিই। ও-ই আমার কাছে আসতে পছন্দ করে” একটু সময় নিয়ে বলল ও।
***
দরজা খুলতেই সায়মাকে জড়িয়ে ধরল মারজান।
“আ’ম স্যরি, দোস্ত। আমি জানি না আমি তোরে কীভাবে কষ্ট দিসি, কিন্তু প্লিজ আমাকে মাফ করে দে। তোর এত অবহেলা আমি আর নিতে পারতেসি না।”
“আয়, ঘরে আয়।” নিজেকে ছাড়িয়ে দরজা বন্ধ করল সায়মা।
“আগে আন্টিকে সালাম দিয়ে আসি চল।” বলল মারজান।
মাথা নেড়ে মায়ের ঘরের দিকে এগুলো সায়মা। পেছনে মারজান। ঘটনার আকস্মিকতায় সায়মা হতভম্ব। ও নিজে মারজানের আলোকিত জীবনের ছোঁয়াটুকু গায়ে মাখে, কিন্তু ওর অন্ধকার জীবনের কোনো ছায়া বান্ধবীর গায়ে পড়তে দিতে চায় না। সেজন্যই ও মারজানকে নিজের বাসায় আনতে আগ্রহ দেখায় না। ব্যাপারটা মারজানও বুঝে কখনো পীড়াপীড়ি করে না।
সায়মার মা মারজানের সালামের উত্তর দিলেন অস্পষ্ট আওয়াজে। সাথে আরও কিছু বললেন, বোধগম্য হলো না ওর। সাহায্যের আশায় সায়মার দিকে তাকাল ও।
“মা জিজ্ঞেস করছেন তুই কেমন আছিস।”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি। আপনি এখন কেমন আছেন?” চিরাচরিত পাল্টা প্রশ্নটা করেই মারজান বুঝতে পারল, বাজে একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে। বিছানায় পড়ে থাকা প্যারালাইজড একজন মানুষকে কেউ এই প্রশ্ন করতে পারে? ছিহ! মা ঠিকই বলে, ওর বোধবুদ্ধি কিচ্ছু হয়নি।
ওর বিব্রতভাব কাটাতেই যেন কিছু একটা বলে উঠলেন সায়মার মা।
“আম্মু বলছে, আম্মু ভালো আছে। তুই এসেছিস বলে অনেক খু্শি হয়েছে।”
সায়মার মধ্যস্থতায় আরও কিছু কথাবার্তার পর ওরা এসে বসল সায়মার ঘরে। মারজানের ঘর যতটা উজ্জ্বল আর রঙচঙে, সায়মার ঘর ঠিক ততটাই অনুজ্জ্বল। মান্ধাতার আমলের খাট, রঙচটা স্টিলের আলমারি, আলনা আর নড়বড়ে কাঠের চেয়ার-টেবিল। এই দিয়েই ছোট ঘরটা মোটামুটি ভরে গেছে। এইটুকু ঘরে একটা সময় ওরা পাঁচ বোন থাকত, দেখলে ঠিক বিশ্বাস হয় না।
“বল, কী খাবি?” মারজানকে ওর ঘর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখে অপ্রস্তুত গলায় বলল সায়মা।
“আইসক্রিমটাই নিয়ে আয়, দুজনে মিলে খাই।”
আইসক্রিম নিয়ে এলে মুখে না তুলেই মারজান বলল, “আন্টির অবস্থা কি আগের থেকে খারাপ হইসে?”
“না”
“আংকেল নতুন কিছু নিয়ে তোকে বিরক্ত করতেসে?”
“না”
“তাইলে তুই আমার সাথে এমন করতেসিস কেন?”
“কী করতেসি?”
“আমারে এড়ায়ে চলতেসিস, অবহেলা করতেসিস”
বাঁকাভাবে হাসল সায়মা। “অবহেলা আমি করতেসি, নাকি তুই?”
“আমি আবার কখন তোকে অবহেলা করলাম? তুইই তো কলেজে আমাকে যেন দেখতে পাস না” চোখ কপালে তুলল মারজান।
“কলেজে, আর বাসায়? সেখানে তুই বুঝি আমাকে আগের মতো দেখতে পাস?” বিদ্রুপের স্বরে বলল সায়মা।
“আমি তোরে বাসায় দেখব কী করে? আমাদের তো মেসেঞ্জারে কথা হয়। সেটা তো তুই ঠিকই বলতেসিস। কিন্তু কলেজে এমন করতেসিস কেন?”
“তাই? কথা হয়? নাকি তুই খালি আমাকে গল্প পোস্ট করার সময় গল্পটা পাঠায়ে বলিস যে পোস্ট করতে আর আমি খালি পোস্ট করি। এর বাইরে কোনো কথা হইসে আমাদের মধ্যে তোর বিয়ের পরে?”
বেকুবের মতো কিছুই না বুঝে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মারজান।
“বিয়ের পরে মানুষ ইডিয়ট হয় শুনতাম, এখন তোরে দেখতেসি। তোর কথায় এখন আমার আরও বেশি রাগ উঠতেসে। আর এরপর আমি তোর গ্রুপ আর পেইজ রিলেটেড কোনো কাজও করমু না। আমারে সরায়ে তোর বরকে মডারেটর, না মডারেটর না, সব জায়গায় এডমিন বানায় দে। বাকি কাজ যদি তোর প্রাণের বর করতে পারে, এটাও পারবে। ওরে দিয়ে করাইস।”
“দোস্ত, আমি না এখনো কিছু বুঝতেসি না। ইজান কই থেকে আসল এখানে?” আমতা আমতা কণ্ঠে বলল মারজান।
“ও আল্লাহ! আমারে ধৈর্য দাও। এই গাধাটাই কি এত বড় বড় ডিপ মিনিংয়ের উপন্যাস লেখে?” নিজের মাথা দুই হাতে ধরে বলল সায়মা।
মারজান আরও কিছু বলার আগেই পাশের ঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে ছুটে গেল সায়মা। এই সুযোগে ইজানকে ফোন দিল মারজান। এই বিপদ থেকে একমাত্র ও-ই পারবে বাঁচাতে। ফোন ধরেই অস্থির কণ্ঠে ইজান জানতে চাইল আর কতক্ষণ লাগবে। ওদের কথপোকথন খুলে বলতেই সব বুঝে ফেলল ইজান।
“আরে বোকা, তুমি আগে সব কিছুতে ওকে ফোন দিতা। ও ছিল তোমার সকল প্রব্লেম সলভার। কিন্তু বিয়ের পর থেকে তুমি সবকিছু আমার সাথে শেয়ার করা শুরু করেছ, ওকে আগের মতো আর ইম্পর্ট্যান্স দিচ্ছ না। তাই বেচারির অভিমান হয়েছে। এবার প্লিজ তাড়াতাড়ি ওর অভিমান ভাঙাও আর বেরিয়ে এসো। আমি আর সঙ সেজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না”
“আচ্ছা, আচ্ছা, আসছি” বলে ফোন কাটল মারজান।
এবার আর মান ভাঙাতে বেশি সময় লাগল না। কাঁচুমাচু কণ্ঠে নিজের দোষ স্বীকার করতেই অনেকটা নরম হয়ে গেল সায়মা। আর যখন শুনল যে ইজানই মারজানকে এখানে নিয়ে এসেছে ওদের মধ্যে মিটমাট করাতে, তখন উল্টো আরও খুশি হয়ে গেল।
মারজান ওকে আশ্বস্ত করল, ওর জীবনে সায়মার যে জায়গা, সেটা ইজান কেন, কেউই কখনো নিতে পারবে না।
***
সায়মার বাসার উল্টোদিকে একটা গাছের নিচে বাইক রেখে দাঁড়িয়ে আছে ইজান। পাশেই একটা চায়ের দোকান। সবগুলো মানুষ ওর দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। রাস্তা দিয়েও যে-ই যাচ্ছে ওর দিকে তাকিয়ে হেসে দিচ্ছে। ও নিজেও জানে ওকে কী পরিমাণ কিম্ভূতকিমাকার লাগছে। কিন্তু ও কী আর জানত যে ওকে আজকে এইখানে আসতে হবে? ইভেন মারজানের মন খারাপ দেখে তো ভুলেই গিয়েছিল যে ও কোন বেশে আছে। এইখানে আসার পর যখন মানুষেরা হাসতে লাগল, তখন ওর খেয়াল হয়েছে। তারপর আর কী? এতগুলো মানুষের মজার খোরাক হচ্ছে এতক্ষণ ধরে। ধুর, মারজান আসছে না কেন?
সায়মাদের বিল্ডিং থেকে বেরিয়েই মারজানের চোখ পড়ল ইজানের উপর। কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল যে ও যা দেখছে, তা সত্যি কী না। তারপর নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়ল নেকাবের ভেতর দিয়ে। ইজানের দিকে এগিয়ে আসলেও ওর হাসি থামছিল না। ইজান অবশ্য ওর চোখ দেখেই বুঝে ফেলল যে ও হাসছে। রাগের চোটে কোনো কথা না বলে মোটরসাইকেলে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। মারজান এসে পেছনে বসতেই এক্সিলারেটর ঘোরাল ইজান।
পথে কোনো কথা হলো না ওদের মধ্যে। মারজানকে নিয়ে ইজান সোজা এসে দাঁড়াল ওদের বাসার নিচে।
“উপরে আসবে না?” ইজানকে নামতে না দেখে জিজ্ঞেস করল মারজান।
“না।” শক্ত মুখে জবাব দিল ইজান।
“কেন?” বিস্মিত কণ্ঠ মারজানের।
“একদিনের জন্য যথেষ্ট জোকার হয়েছি, আর না। আসছি। আল্লাহ হাফেজ।”
বলে মারজানের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বাইকে টান দিল ইজান।
(চলবে)