ডেস্পারেট_লেখিকা –Farhina Jannat ৯.

0
126

#ডেস্পারেট_লেখিকা
–Farhina Jannat

৯.
কাকে বলবে বুঝতে না পেরে শেষে মায়ের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছে মারজান। ওর কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে ছিলেন মনোয়ারা। কালে কালে চুল তো আর তাঁর এমনি পাকেনি। শাশুড়ির কথার পেছনের ‘কিছু একটা’ মারজান না বুঝলেও তিনি ঠিকই বুঝেছেন। ইজানের সাথে বিয়ে হওয়ায় এতদিন যে একটা স্বস্তির অনুভূতি মনের ভেতরে ছিল, সেটা যেন নড়বড়ে হয়ে গেল।

মায়ের মুখ দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল মারজান। ভাবল, মাকে বলেও ভুল করল নাকি?

“আম্মু, কী হলো? তুমি কি রাগ করলে?”

“না, মা” মেয়েকে আশ্বস্ত করলেন মনোয়ারা। মেয়েকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। “মা তো, তাই ভাবী ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছেন। আর যেহেতু এখন তুইও ওর ভবিষ্যতের সাথে জড়িয়ে গেছিস, তাই তোর সাথে শেয়ার করেছেন। একটা কথা বলি, মা। বিয়ের পরের এই সময়টা তোদের জীবনে আর ফিরবে না ঠিকই। কিন্তু তোরা তো দুজনেই যথেষ্ট বড়। আর স্ত্রী হিসেবে তোর দায়িত্বটাও অনেক। ইজানের জীবনেও এই সময়টা অনেক ক্রিটিক্যাল। এই মুহূর্তে ও যদি পড়াশোনায় মন না দেয়, ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। আর একজন সফল পুরুষের পেছনে যেমন একজন নারী থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে অসফল হওয়ার পেছনেও ওই নারীই থাকে। এখন আমার মেয়ে তার স্বামীর জীবনে ঠিক কোনটা হতে চায়?” কথা শেষ করে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন তিনি।

“বুঝেছি, আম্মু” মাকে জড়িয়ে ধরল মারজান।

***
মায়ের কাছে টাকা চাইতে এসে কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেল ইজান। টাকা তো দিলেন, কিন্তু হঠাৎ করেই ইজান বেশি টাকা খরচ করছে সেটাও শক্ত মুখে বললেন। ও ভেবেছিল মারজানের সাথে ওর দেখা সাক্ষাৎ নিয়ে কারো কোনো আপত্তি থাকবে না। যেহেতু বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে। কিন্তু আজকে মায়ের কথায় যেন অন্য সুর শুনতে পেল ইজান। খানিকটা মন খারাপ নিয়েই বাইরে এলো ও। মারজানের সাথে দেখা হতেই অবশ্য সব কর্পুরের মতো উবে গেল।

আজকে যে কফিশপটায় ওরা এসেছে, সেটা মোটামুটি ফাঁকাই। দু’জন কোণার একটা টেবিলে বসে প্রথমে দুটো কোল্ড কফি অর্ডার করল। সাথে কিছু খাবে কী না জিজ্ঞেস করায় মারজান বলল ওর ক্ষিধে নেই। কিন্তু ইজানের ক্ষিধে লেগেছে। তাই মারজানের আপত্তি কানে না তুলে একটা শর্মা আর একটা ডাবল চিজ চিকেন বার্গার অর্ডার দিল। ওয়েটারকে বলল দুটোই হাফ করে দিতে। মারজান মনযোগ দিয়ে দেখছিল সবটা। ওর ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠল।

“তারপর বলো, কী খবর লেখালেখির?” ওয়েটার চলে গেলে বলল ইজান।

“চলছে তো” ছোট করে উত্তর দিল মারজান। ইজানকে কীভাবে কী বলবে এখনো জানে না ও। ইজানের সাথে হুটহাট কথা বলা, মাঝেমধ্যে দেখা করা, দিনগুলো যেন স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর করে কাটছিল। এগুলো বাদ দিলে ও নিজেই বা কী করে থাকবে?

উপন্যাসের নতুন পর্ব নিয়ে আলোচনার এক ফাঁকেই খাবার চলে এলো। মারজান ঠিক করল কথাটা একদম শেষে বলবে।

“হলুদ পায়জামা পাঞ্জাবি কোথায় পেয়েছিলে?” এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করল মারজান। নেকাবের ভেতরে মুচকি মুচকি হাসছে ও।

থমকে গেল ইজান। একরাশ লজ্জার ছায়া চেহারায় নেমে এল ওই দিনের কথা মনে পড়ায়।

“আমাদের পাড়ার ক্লাব থেকে কিছুদিন আগে হুমায়ূন আহমেদের হিমু আর রূপাকে নিয়ে একটা ছোটো নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। সেই সময় হলুদ পাঞ্জাবি কেনার দায়িত্ব যার ছিল, সে বুঝতে পারেনি। আসল কালারেরটা না কিনে এই ক্যাটকেটে কালারের কিনে ফেলেছিল। পরে কাঁচা হলুদ কালারের একটা পাঞ্জাবি আবার কেনা হয়েছিল। আর এটা পড়েই ছিল ক্লাবঘরে” নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ইজান।

“তুমিও নাটকে ছিলে নাকি?” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল মারজান। গল্পের নতুন আইডিয়া মাথার মধ্যে অলরেডি কিলবিল করতে শুরু করেছে।

“আরে না। আমি তো ক্লাবে ক্রিকেট খেলি। ক্রিকেট টিমের কয়েকজন ছিল। আমি ওদের সাথে মাঝেমধ্যে রিহার্সেল দেখতাম।“

“ও আচ্ছা” কণ্ঠের উত্তেজনা মিইয়ে গেল মারজানের।

“নিজে পার্টিসিপেট না করলেও ইনফরমেশন দিতে পারব। ডোন্ট ওরি, মেরি জান!” এতদিনে বউকে এতটুকু ঠিক চিনে ফেলেছে।

“থ্যাংক ইউ” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল মারজান। “কিন্তু আমার সেদিনের প্রশ্নের একটা জবাবও তো দিলানা।“

“কোন প্রশ্নের?” বুঝেও না বোঝার ভান করে কফির স্ট্রতে মনযোগ দিল ইজান।

“তোমার কী চাই আর সব বাদ দিয়ে হলুদ পায়জামা পাঞ্জাবিই কেন?”

“কী জানি, অন্য কিছু পরলে লেখিকা আপার চোখে যদি না পড়ে? তাই এমন কিছু পরেছিলাম, যাতে চোখে পড়েই পড়ে। কিন্তু এই শেষ। যা হেনস্তা হয়েছি, আর না বাবা!” দুহাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলল ইজান।

চট করে প্রথম রাতের কথা মনে পড়ে গেল মারজানের। সেদিনও মানতাশাকে টিকলি ভাবায় এই সেইম ভঙ্গি করেছিল ইজান। ভীষণ অন্যরকম একটা সৌন্দর্য আছে ভঙ্গিটার, ভালো লাগে, ভাবল মারজান।

“বেশ লাগছিল কিন্তু তোমাকে” মুচকি হেসে বলল ও।
“হ্যাঁ, পুরো জোকারের মতো” নাক-মুখ কুঁচকে বলল ইজান।

“সে হিরোরা মাঝে মাঝে জোকার টোকার সেজেই থাকে। এ আর এমন কী?”
“হিরো? কীসের হিরো?” চমকে উঠে বলল ইজান।

“ঘোড়ার ডিমের। প্রথম প্রশ্নের উত্তর দাও” কটমটে দৃষ্টি হেনে বলল মারজান।

“না না, তুমি আগে বলো কীসের হিরো”
“জানিনা। তুমি বলবা, নাকি না?”
“তুমি না বললে আমিও বলব না” একগুঁয়ের মতো বলল ইজান।
“ফাইন! বইল না” মারজানও রণে ভঙ্গ দেয়ার বান্দি নয়।

মনের মধ্যে অদ্ভুত পুলক অনুভব করছিল ইজান। অবশ্য সেটা মারজানের সামনে প্রকাশ করা যাবে না। ওর মুখ থেকেই কথাটা বের করতে হবে।

এবার নিরবতার মাঝেই খাওয়া শেষ হয়ে এলো। অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে খেয়েছে ওরা। আজকের সময়টা যেন প্রলম্বিত করতে চাইছে দুজনেই।

মারজান ভাবছে ও যেটা বলতে এসেছে সেটা ইজানকে বলবে কী না। এদিকে ইজানও ভাবছে প্রায় একই কথা। এই প্রথমবার মারজান নিজে থেকে দেখা করতে চেয়েছে। আজকেই যদি বলে যে এখন থেকে আর বেশি আসতে পারবে না, টেস্ট অনেক কাছে চলে এসেছে, ও যদি অন্য কিছু মিন করে?

শেষমেষ মুখ খুলল মারজানই।
“তোমার প্রথম এক্সাম তিন তারিখে না?”
“হুম”
“আমার হাফ ইয়ার্লি তিরিশ তারিখ থেকেই। ভালো হয়েছে, তোমার এক্সামের সময় ডিস্টার্ব কম হবে“
“কেন?”
“আরে, আমাকে পড়তে হবে না? তাই এক্সামের সময় গল্প অফ থাকবে।“
“ওহ, তাই বলো”
“আর তুমিও ভালো করে প্রিপারেশন নাও। এর আগে কোচিং মিস দিয়ে আমাকে নিতে এসেছ বেশ কয়েকবার। এখন আর এমন কোরো না, কেমন? এক্সামের পর আমরা অনেক অনেক ঘুরব।”

মারজানের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল ইজান। তারপর অত্যন্ত আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলল, “জো হুকুম, মেরি জান”

***
মোটামুটি জামাই সাজে সেজেছে ইজান। বাহ্যিকভাবে শেরওয়ানি পাগড়ি দেখা যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু সাদা পাজামার সাথে সোনালী সুতোর কাজ করা মেরুন রঙের পাঞ্জাবিতে ওকে নতুন জামাইয়ের মতোই লাগছে। সেলুনেও এক দফা ঘুরে এসেছে দুপুরের আগ দিয়ে। চুল কাটলে ছেলেদের কিছুদিন চোর চোর লাগে, ওর ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। কারণ গত দুই মাসে সেলুনে চক্কর দিয়েও সময় নষ্ট করেনি ইজান। সুগন্ধি আতর মেখে রিক্সায় ওঠার পর থেকেই ওর ভেতরে একটা বিশেষ ভাবের উদয় হয়েছে। শুধু শশুরবাড়ি যাচ্ছে বলে নয়, এতদিন পর নিজের বউকে, ওর জানেমানকে দেখতে পাবে বলে।

মারজানদের বাসায় আজকে ওদের সবারই দাওয়াত। সবাই ওদিকেই রওনা দিবে আর কিছুক্ষণ পর। শুধু ও-ই যাচ্ছে উল্টোদিকে।

এই উটকো ঝামেলাটা যেন আজই ঘাড়ের উপর পড়ার ছিল। অবশ্য ঝামেলা একদিক দিয়ে ও সেধেই মাথায় নিয়েছে। মারজানকে শাড়ি গিফট করার ইচ্ছে ওর অনেক দিনের। তাই একটা অনলাইন পেইজ থেকে শাড়ি, চুড়ি আরও নানান জিনিস মিলিয়ে একটা কম্বো সেট অর্ডার দিয়েছিল ও। আর তাতেই যেন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। অনলাইন থেকে কেনাকাটা করার ওর অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। তার উপর এডমিশন টেস্টের ব্যস্ততায় এত বেশি খোঁজাখুঁজি করার সময়ও ছিল না। যেটা পছন্দ হয়েছে, সেটাই অর্ডার করে ফেলেছে। এখন পড়েছে ঝামেলায়। শেষ মুহূর্তে এসে ওরা বলছে, পুরান ঢাকার এত ভেতরে এসে অলিগলি খুঁজে ডেলিভারি দিতে পারব না। সামনে এগিয়ে এসে নিয়ে নেন। ওকে এখন সেই চানখারপুল গিয়ে নাকি ডেলিভারি নিতে হবে।

লাস্ট মোমেন্ট না হলে ডেলিভারি নিতেই যেত না ইজান। টাকা গচ্চা যায় যাক, অন্য কিছু কিনে ফেলত পাশের মার্কেট থেকে। কিন্তু এখন আর সেই সময়টা নেই। তাছাড়া শাড়ির মিষ্টি কালারটা ওর খুবই পছন্দ হয়েছে। সেজন্যই মূলত এই হ্যাপা পোহানো। কিন্তু যেই প্যারা দিচ্ছে, ভেতরে আদৌ সঠিক জিনিস থাকবে কী না আল্লাহ মালুম। ভাবলেই মনটা বেজার হয়ে যাচ্ছে ইজানের। নাহ, আজকের এই সুন্দর দিনে নেগেটিভ কিছু আর ভাববে না ও। ইন শা আল্লাহ ভেতরে সব ঠিকঠাক থাকবে, আল্লাহ ভরসা।

তবে আজকের এই সুন্দর দিনটা যে খুব সহজেই ওর জীবনে চলে এসেছে, সেটা বলা যাবে না। গত দুই মাসের ঘটনাগুলো একের পর এক মনে পড়তেই সরু একটা দীর্ঘশ্বাস ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ইজানের।

মারজানের সাথে করা প্রমিস ভালোভাবেই রেখেছিল ইজান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বাবা মায়ের স্বপ্নের ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পায়নি ইজান। বুয়েট আর রুয়েটের এক্সাম হয়েছিল সবার আগে। বুয়েটের এক্সাম দেয়ার সময় ভালো মনে হলেও বের হয়ে দেখা গেল মোটামুটি সবার এক্সামই ভালো হয়েছে। অথচ ওর মনে হয়েছিল প্রশ্ন বেশ কঠিন হয়েছে। সবার এক্সাম ভালো হয়েছে দেখে ওর ভেতরে নিশ্চিন্ত ভাবটা আর ছিল না। দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই রাজশাহী গিয়ে রুয়েটের এক্সামও দিয়ে এল। এটায় আরও সাড়ে সর্বনাশ। প্রশ্ন এত কঠিন হয়েছে যে ও নিজেই বুঝতে পারল, এখানে হবে না। ভীষণ রকম দমে গেল ইজান। মনটা আরও খারাপ হলো, যখন দেখল একজন সহপাঠী খুব উত্তেজিত কণ্ঠে বাসায় এক্সাম ভালো হওয়ার খবর দিচ্ছে। ছেলেটার রোল ক্লাসে ওর থেকে অনেক কম ছিল। ইজান মিথ্যে বলতে জানে না। যেমন হয়েছে, তেমনই বলল বাসায় সবাইকে। সবাই সান্ত্বনা দিল, সমস্যা নেই, বুয়েটের এক্সাম তো ভালো হয়েছে, ওখানেই হয়ে যাবে।

বাসায় ফিরে মায়ের থমথমে মুখ দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে যায় ইজানের। পুত্রকে নিয়ে খুবই আশাবাদী ছিলেন সুফিয়া বেগম। তিনি ভাবতেই পারেন না, তার ছেলের কোনো পরীক্ষা খারাপ হতে পারে।

রুয়েটের এক্সাম পরে হলেও রেজাল্ট আগে হলো। যা ভেবেছিল তাই, চান্স হয়নি। দুরুদুরু বক্ষে বুয়েটের রেজাল্ট এর অপেক্ষা করতে থাকল সবাই। কিন্তু সবাইকে নিরাশ করে দিয়ে বুয়েটেও ফলাফল তথৈবচ।
বজ্রাহতের ন্যায় রেজাল্টের দিকে তাকিয়ে ছিল ইজান। এটা কি সত্যিই ওর গত কয়েক মাসের অবহেলার ফল? ও কি সবখানেই এভাবে ফেইল করবে? এত অসহায় কখনো বোধ করেনি ও। বাসার বাকিরাও সম্ভবত নিশ্চিত ছিল যে ইজান বুয়েটে চান্স পাবেই পাবে। তারাও যেন এতটাই নিরাশ হলো যে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা পেল না কেউই।

সুফিয়া বেগমের সবার সম্মুখে ধরে রাখে মুখোশটাও খুলে গেল তখন। ইজানকে এই অসময়ে বিয়ে দেয়া নিয়ে এত ধরণের কথা তিনি ইজানের বাবাকে শোনালেন, যেগুলো ইজান কোনো দিন ভাবেনি যে তার মা বলতে পারে। মারজানও ছাড় পেল না। তাকে নিয়েও যা নয় তাই বললেন তিনি। সব মিলিয়ে ইজান চান্স না পাওয়ার জন্য দুঃখ করবে নাকি মায়ের এহেন আচরণে স্তম্ভিত হবে ভেবে পেল না। তবে এটুকু বুঝতে পারল, অন্তত ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স না পেলে ওর আর মারজানের জীবনে ভয়ংকর কিছু নেমে আসবে।
অবশ্য এতসব ভাবাভাবির সময়ও ছিল না। ঢাবির ‘ক’ ইউনিটের এক্সাম ছিল মাত্র তিন দিন পর। এটার জন্য এবার জীবন মরণ চেষ্টা করার কথা। কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে আর করার কী আছে? মারজানও যেন ওকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা পেল না। শুধু বলল, “তোমার রেজাল্টের জন্য আমি অপরাধী হয়ে গেলাম। কেন যে আব্বু এই সময়ে তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিল!”

ঢাবির এক্সাম দিয়ে কাউকে কিছু জানাল না ইজান। তিনদিনের জন্য নিজেকে ঘরে ঘরবন্দী করে ফেলল। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ফর্মগুলো বিষন্ন মনে নাড়াচাড়া করছিল সেই সময়। ওদের ফ্যামিলির কেউই ভ্রমণপ্রেমী নয়। তাই এত বড় হয়েও ঢাকার বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি ইজানের। তাই ভেবেছিল, সব ভালো ইউনিভার্সিটির একটা করে ফর্ম তুলবে। চান্স যেখানেই পাক, এক্সাম দিতে যাবে সবগুলোতেই। এই উসিলায় জায়গাগুলো ঘোরা হয়ে যাবে।

কিন্তু মারজানের সাথে বিয়ে হওয়ার পর ওকে ছাড়া ঘুরতে যাওয়ার আর কোনো আকর্ষণ ওর ভেতরে ছিল না। তাই ভেবেছিল ফর্মগুলো বেকারই কেনা হয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এগুলোর কোনো একটাতে চান্স পেয়ে হলেও নিজের মান সম্মান বাঁচাতে হবে। মারজানের থেকে হয়ত অনেক দূরে থাকতে হবে। কিন্তু এছাড়া আর উপায় কী? এসব তো ওরই কর্মফল!

এতকিছু আর হয়নি শেষমেশ। ভালো পজিশনেই ঢাবির ‘ক’ ইউনিটে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে ইজান। মাইক্রোবায়োলজি ফার্স্ট চয়েস দিয়েছে ইজান। ওর ধারণা, পেয়ে যাবে।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ঢাবিতে চান্স পাওয়ায় এক অদ্ভুত শান্তি পেয়েছে ইজান। পরে ভেবে দেখেছে, ওর আসলে মনের গহীনে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার তেমন কোনো ইচ্ছা ছিল না। বাবা মার জোরাজুরিতেই মূলত ওইদিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু ও নিজে মনে মনে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন দেখত। ও ভেবেছিল, ঢাবিতে যদি চান্স হয়, আব্বু আম্মুকে কোনোভাবে রাজি করিয়ে ও এখানেই ভর্তি হবে, ইঞ্জিনিয়ারিং এ নয়। এখন বরং আর সেটা করার প্রয়োজন হয়নি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।

রিংটোনের শব্দে ভাবনার অতল গভীর থেকে বেরিয়ে এল ইজান। কানে ধরতেই বুঝল, ডেলিভারি ম্যানের ফোন। মহাশয় চানখারপুল মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে এখনো যাচ্ছে না কেন? মেজাজ খারাপ করে গালি দিতে ইচ্ছে হলো ইজানের। মুখে সেসব না বলে অপেক্ষা করতে বলল। আর দুই মিনিট, ও পৌঁছেই গেছে প্রায়।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here