ডেস্পারেট_লেখিকা –Farhina Jannat ১০.

0
157

#ডেস্পারেট_লেখিকা
–Farhina Jannat

১০.
শুধু ইজান নয়, ইজানের অনুপস্থিতিতে মারজানের দিনগুলোও যেন হয়ে উঠেছিল বিবর্ণ। ইজানদের দাওয়াতের খবরটা পাওয়ার পর থেকেই মনে হচ্ছে কেউ যেন চারিদিকে মুঠো মুঠো রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে।
সেই যে ইজান ওকে শাড়ি পরে দেখতে চেয়েছিল, সেই ইচ্ছা এখনও পূরণ করা হয়নি। তাই সেই সি গ্রিন কালারের হাফ সিল্ক শাড়িটা পরে আজ প্রথমবারের মতো ইজানের জন্য মন ভরে সাজল মারজান। কথায় কথায় ইজান বলেছিল যে অতিরিক্ত মেকআপ ওর ভালো লাগে না। তার উপর শশুর শাশুড়ী সবাই আসছেন। কোনো ফাউন্ডেশন, ফেস পাউডার ইত্যাদির আশ্রয় নিল না মারজান। চোখে চিকন করে কাজল দিল। ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক আর চুলের সামনেটা বিশেষ কায়দায় হালকা ফুলিয়ে পেছনে ছেড়ে দিল। ওর মনে হয় ওকে খোপার থেকে খোলা চুলেই বেশি মানায়। সাদা গাজরাটা পরেও আবার খুলে ফেলল। একটু বেশি বেশি লাগছে।

আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট হলেও ঢোক গিলল মারজান। সত্যি বলতে সুফিয়া বেগমের মুখোমুখি হতে হবে ভাবতেই ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইজানের বুয়েটের রেজাল্টের দিন ওকে ফোন দিয়েছিলেন তিনি। শুধু ওর ‘বিয়ের বাই’ উঠার জন্যই আজ তাঁর ছেলের জীবনের এই বিপর্যয়, ইত্যাদি নানা কথাই তিনি বলেছেন। কথার বিষাক্ত হুলে ক্ষতবিক্ষত করেছেন মারজানের কোমল হৃদয়। দুচোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ফেলতে ফেলতে চুপচাপ কথাগুলো শুনেছে মারজান। একটা জবাবও দিতে পারেনি। শেষে এই বলে তিনি ফোন রেখেছেন যে, তাঁর ছেলে যদি ভালো কোনো সাবজেক্ট আর ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে চান্স না পায়, তিনিও দেখবেন মারজান কীভাবে ইজানের সাথে সংসার করে। এই ফোনকলের কথা কাউকে বলেনি মারজান, ওর মা-কেও না। আল্লাহর অশেষ রহমত যে ইজান ঢাবিতে চান্স পেয়েছে। কিন্তু শাশুড়ীর কথাগুলো আজ ওর কানে ক্ষণে ক্ষণেই বেজে উঠছে। কলিংবেলের শব্দে চমকে উঠল মারজান। ত্রস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সবাই এসে গেছে নিশ্চয়ই।

***
ডেলিভারি নেয়ার মাঝপথেই মাগরিবের আজান দিয়ে দিল। পেমেন্ট ক্লিয়ার করে পাশের মসজিদে ঢুকে গেল ইজান। নামাজ শেষে পড়ল আরেক ঝামেলায়।মাগরিবের পরের এই সময়টা নাজিমুদ্দিন রোডের অন্যতম ব্যস্ত সময়। নাস্তা আর বিরিয়ানির দোকানগুলোতে মাছির মতো লোকজন ভীড় করে। এর মধ্যে খালি রিকশা পাওয়া অসাধ্য। ঘেমে যাবে জেনেও বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করল ইজান। খানিক বাদেই থমকে গেল।

আরে, ওইটা রাফায়েত ভাই না? হ্যাঁ, উনিই তো। ভুল হবার অবকাশই নেই। ডাক দিল ইজান। উনি শুনলেন বলে মনে হলো না। ফের ডাকতে ডাকতে এগোল ও সেদিকেই। একদম কাছে গিয়ে কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলে চমকে ওর দিকে তাকাল রাফায়েত। তার দিকে তাকিয়ে একটা ধাক্কামত খেল ইজান। কেমন যেন লাগছে রাফায়েত ভাইকে। বিষন্ন, বিদ্ধস্ত চেহারা; চোখে শূন্য দৃষ্টি। যেন রাজ্যের ঝড় বয়ে গেছে তার উপর দিয়ে।

“রাফায়েত ভাই! কী হয়েছে আপনার?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল ইজান।

“আবার সব শেষ হয়ে গেছে রে ইজান” অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বলল রাফায়েত। হাসিটা কান্নার থেকেও অধিক বিষাদময়। বুকের ভেতর ধক করে উঠল ইজানের।

“কেন? কী হয়েছে ভাই?” রাফায়েত ভাইয়ের এমন চেহারা, এমন কণ্ঠ, ইজানের বিশ্বাস হচ্ছে না।

“তুই আমার কথা ওইদিন শুনতে চেয়েছিলি। আজকে বলব। সময় হবে তোর?” একই রকম বিষাদমাখা কণ্ঠে বলল রাফায়েত।

মুহূর্তের জন্য অপেক্ষারত মারজানের মুখটা দোলা দিয়ে গেল ইজানের মনের কোণে। “অবশ্যই হবে ভাই। আপনার জন্য আমার সময় হবে না, এটা আপনি বলতে পারলেন? চলেন, ফাঁকা কোথাও গিয়ে বসি” বলল ও। রাফায়েত ভাইয়ের এমন চেহারা দেখার পর কোনো দ্বিধা চলে না।

রাফায়েতকে নিয়ে নদীর পারে নিরিবিলি একটা অংশে এসে বসল ইজান। ভাগ্যক্রমে একটা রিকশা পেয়েছিল। এক ফাঁকে বাবাকে ফোন আর মারজানকে টেক্সটও করে দিয়েছে যে, ইমার্জেন্সিতে আটকে গেছে, যেতে দেরি হবে। এদিকে রাফায়েত যেন অন্য কোনো ভুবনে আছে। পুরো রিকশায় একটা কথাও বলেনি। কিন্তু বসার পরেই শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হলেও বোধহয় এতটা চমকাত না ইজান। স্থবির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল রাফায়েতের কান্না থামার। এত বড় একজন মানুষ এভাবে কাঁদলে কী বলে সান্ত্বনা দিতে হয়, ও জানে না।

***
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে সবাই বিদায় নিল মারজানদের বাসা থেকে। ইজান না আসলেও গল্পগুজব, খাওয়াদাওয়া, কোনো কিছুতেই ব্যাঘাত ঘটেনি। তাছাড়া ইজান যে সেন্সিবল ছেলে, এতে কারোই দ্বিমত নেই। একমাত্র বিশেষ ইমার্জেন্সি না হলে যে এমন একটা প্রোগ্রামে সে অনুপস্থিত থাকবে না, সে ব্যাপারে সবাই সুনিশ্চিত। তাই ওকে নিয়ে কেউই কোনো দুশ্চিন্তা করেনি।

কিন্তু অন্য এক দুশ্চিন্তায় পড়েছে মারজান। ফোনের সুফিয়া বেগম আর আজকের সুফিয়া বেগমের ভেতরে যেন কোনো মিল নেই। ওই ফোনকলটা যেন তাদের মাঝে সংঘটিতই হয়নি। আগের মতোই আদর আহ্লাদে মারজানকে ভরিয়ে রাখলেন পুরোটা সময়। অস্বস্তি আর অবিশ্বাসে কাঁটা হয়ে রইল মারজান। নাইট ডিউটি থাকায় আজকের প্রোগ্রামে থাকতে পারেনি মারজানের জা নিশীতা। নাহলে হয়ত শাশুড়ীমার ছোটো বউয়ের প্রতি আদরের বাড়াবাড়ি দেখে বদহজম হয়ে যেত।

এদিকে মনোয়ারার মনের সব মেঘ দূর হয়ে গেছে। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা হওয়া মা মাত্র‍ই স্বাভাবিক। তাই মারজানকে ওইরকম কথা বলেছিলেন বলেই মনে হলো তার। আর এখন তো ইজান ভালো জায়গায় চান্স পেয়ে গেছে। আর কোনো সমস্যা তো থাকারই কথা না। তিনি মনপ্রাণ খুলে বেয়াই বাড়ির আদর আপ্যায়ন করলেন।

সবাই চলে গেলেও সাজপোশাক খুলল না মারজান। নিজের ঘরে দরজা আটকে চুপচাপ বসে রইল। ওর বিশ্বাস, যত রাতই হোক, ইজান আসবে। ইজান ওকে কথা দিয়েছে যে আজ ওদের দেখা হবে। ও তো কথা দিয়ে কথা না রাখার ছেলে নয়। ভালোবাসার এ এক অদ্ভুত শক্তি। এমন সব বিশ্বাস মানুষের মনে এনে দেয়, যা ভালোবাসা বিনে আশা করা যায় না।

অন্যদিন হলে এত ক্লান্তির পর ঘুমে ঢলে পড়ত মারজান। কিন্তু আজ ঠাঁই বসে রইল। রাত প্রায় সোয়া একটার দিকে ফোন বাজল ওর। “দরজা খোলো” কথাটা শুনতেই দরজার দিকে ছুটে এল মারজান।

সামনে দাঁড়ানো ইজানকে দেখে মনের ভেতরে অচেনা এক স্বস্তির বাতাস বয়ে গেল। এ স্বস্তি ভালোবাসার মানুষকে অনেকদিন পর সামনে পাওয়ার নয়, এ স্বস্তি ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস সত্যি হওয়ার। আলো না জ্বালিয়েই দরজা খুলেছে মারজান। অন্ধকারে কয়েকটা মুহূর্ত পেরিয়ে গেল নীরবে।

কিন্তু পুলকিত ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে মারজানের ডান কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিল ইজান। যেন ভীষণ ক্লান্ত পথিক বিশ্রাম চাইছে। বিস্মিত মারজান আলতো হাতে ইজানকে স্পর্শ করল। আস্তে করে দুহাত দিয়ে ওর কোমর পেঁচিয়ে ধরল ইজান। সহজাত সংকোচে তড়িতে এদিক ওদিক তাকাল মারজান। না, কেউ নেই। সবাই শুয়ে পড়েছে। আর ইজান কলিংবেল চাপেনি বলে কেউ জেগে উঠে বেরিয়েও আসেনি। “ঘরে চলো” ফিসফিস করে বলল মারজান।

নিজের ঘরে এসে দরজাটা লাগাতেই ওকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ইজান। কেঁপে উঠল মারজান। কেমন যেন মনে হলো ইজানও কাঁপছে। উত্তরোত্তর বিস্ময় বাড়ছে মারজানের। ইজানের হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে আস্তে করে পেছন ফেরল ও। কিন্তু ওকে ছাড়ল না ইজান। এবার সামনে থেকেই ওর কাঁধে মুখ গুজল। কিছুক্ষণ ওভাবেই ইজানকে থাকতে দিল মারজান। তারপর আস্তে করে ওর মুখটা ধরে উপরে তুলল। চমকে উঠল ও।

বিবর্ণ চেহারা ইজানের। প্রচন্ড বেদনায় কাতর চোখমুখ, ঠোঁট দুটো শুকনো। মনে হচ্ছে যেন অনেক কষ্টে নিজেকে আটকে রেখেছে, সহ্যের অতীত হলে হঠাৎই চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসবে।

“ক..ক্ক…কী হয়েছে ইজান?” কণ্ঠ কেঁপে গেল মারজানের।

কিছু বলতে পারছে না ইজান। ওর মনে হচ্ছে, ও কিছু বলতে গেলেই কেঁদে ফেলবে। রাফায়েত ভাইয়ের জন্য ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এত কষ্ট কারও জন্য কোনোদিন অনুভব করেনি ও।

মারজান যেন বুঝতে পারল ইজানের অবস্থা। ওকে বিছানায় বসিয়ে আগে কিচেনে গেল খাবার আনতে। নিশ্চিত ওর কিছুই খাওয়া হয়নি। খেয়েদেয়ে স্বাভাবিক হলে ইজান নিজে থেকেই বলবে যে কী হয়েছে। নাহলে নিশ্চয়ই এত রাতে ও মারজানের কাছে আসত না।

বাসর রাতের মতো বিছানায় দস্তরখান বিছিয়ে খেতে বসল দুজনে। প্রথমে গলা দিয়ে খাবার নামছিল না ইজানের। কিন্তু ক্ষিধে তো আর কম পায়নি। আস্তে আস্তে খেতে শুরু করল। আর সত্যি সত্যিই খেতে খেতে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এল ইজান।

খাওয়ার পর এশার নামাজ পড়ল ইজান। তারপর কয়েল জ্বালিয়ে বারান্দায় এসে বসল ওরা। মারজানের হাত ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল ইজান। তারপর হঠাৎই বলল,
“তোমার বারান্দায় শুধু এই এক ধরণেরই ফুল কেন?”

“নয়নতারা আমার খুবই পছন্দের একটা ফুল। ঘ্রাণ নেই ঠিকই, কিন্তু কী সুন্দর সুন্দর কালার! দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। জানো, আমার কালেকশনে পনেরো কালারের নয়নতারা আছে, আরও অনেক কালারের হয়। আমি সব একদিন সংগ্রহ করব, ইন শা আল্লাহ। তবে আমার বারান্দায় শুধু এগুলো থাকার কারণ আরেকটা। নয়নতারার পরিচর্যায় খাটনি কম। শুধু নিয়মিত পানি আর অকেশনালি একটু সার দিলেই হয়। খাটনিওয়ালা সব গাছ মালী চাচার তত্ত্বাবধানে।“ স্বভাবগত উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল মারজান।

চুপচাপ শুনে গেল ইজান। মারজানের কথা আদৌ শুনতে পেয়েছে, এমন কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখা গেল না ওর মধ্যে।

“মারজান! তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো?” আবারও মিনিট কয়েক বাদে আকস্মিক বলে উঠল ইজান।

এত অসহায়ত্ব আর আকুতি মেশানো ছিল কথাটায়, মারজানের দুচোখে পানি জমে গেল। “কেন যাব আমি? কোথায় যাব? কী হয়েছে তোমার ইজান?”

“রাফায়েত ভাইয়ের স্ত্রী, উনার ভালোবাসা, উনাকে ছেড়ে চলে গেছে। উনার পাগলপ্রায় দশা। আমি উনার কাহিনী নিজের কানে শুনে হতভম্ব হয়ে গেছি। আর উনার অবস্থা, কী বলব? নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবার মতো না”

রাফায়েতের সম্পর্কে এর আগে ইজানের কাছে শুনেছে মারজান। জানে, সিনিয়র এই ভাইকে কতটা শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার চোখে দেখে ইজান। ইজানের বাবা-মার সাথে এই আরেকজন মানুষের খুব আশা ছিল ইজান বুয়েটে চান্স পাবে। কারণ তিনিও বুয়েটিয়ান। এ বছরই সেখানের ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগ দিয়েছেন। ইজান বুয়েটে চান্স পেলে দুজনের সম্পর্ক নতুন এক সমীকরণ পেত।

এরপর পরবর্তী ঘন্টা খানেক ধরে ইজান মারজানকে শোনাল রাফায়েতের সাথে কী কী হয়েছে। কীভাবে একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে, আর সেই ভালোবাসাকে পদদলিত করে, ঠকিয়ে, নিঃস্ব করে কীভাবে মানুষ চলে যেতে পারে। শুনে শিউরে উঠল মারজান।

শেষের দিকে ইজান আর বলতে পারছিল না। ওর কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিল। মারজানও নিজের চোখের পানি আটকে রাখতে পারেনি। ইজানকে দুহাতে আকড়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে মারজান। অন্যের কষ্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ দুজন মানুষ যেন নীরব প্রতিজ্ঞা করে, কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না, একজন আরেকজনকে এরকম কষ্ট কখনোই দেবে না। সেই নীরব প্রতিজ্ঞার সাক্ষী হয়ে রইল রাতের আকাশে ঝুলে থাকা এক টুকরো চাঁদ, আসন্ন শীতের হিম হিম বাতাস, আর আঁধারেও ফুটে থাকা সারি সারি নয়নতারা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here