#চিরবন্ধু
#পর্ব১
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
” বাবা যেওনা ” বলার পরও বাবা চলে গেল। নানাভাই ছোট্ট করে কানের কাছে বলেছে তোমার বাবা আবার বিয়ে করেছে। তোমার কাছে আর আসবে না।
তুশিবের বয়স তখন সবে পাঁচ কি ছয়। সেদিন মায়ের কান্না দেখে সেও কেঁদেছে। বাবা মায়ের কথা শোনেনি তার কথাও না।
তারপর থেকে প্রতিরাতেই মা কাঁদতো তাকে জড়িয়ে ধরে। সে কোনো প্রশ্ন করার সাহসও করে উঠতে পারতো না। মায়ের চোখের পানি দুহাত দিয়ে মুছে দিলে মা আরও বেশি করে কাঁদতো। তুশিবের মনে হতো সে মায়ের দুঃখ কোনোদিন কমাতে পারবে না। এই যে মা কাঁদছে তা তো বাবার জন্য। বাবা তো কোনোদিন ফিরবে না তাহলে মায়ের দুঃখও কি কোনোদিন কমবে না? মা সারাজীবন কেঁদেকেঁদে পার করবে?
একদিন কৌতূহল বশত সে নানাভাইয়ের কাছে জানতে চাইলো, – মায়ের দুঃখ কিভাবে কমবে? কি করলে মায়ের কান্না থামবে? বাবা ছাড়া কি মায়ের কষ্ট কমানো যায় না?
নানাভাই তার কথায় প্রচন্ড হেসেছিলেন সেদিন। হয়ত ভাবছিলেন এটুকুনি একটা ছেলের মাকে নিয়ে কি চিন্তা! নানাভাই তাকে বুঝিয়ে দিলেন,
– তোমার মায়ের কষ্ট কমবে তোমার বাবাকে ভুলতে পারলে। আল্লাহকে বলবে যাতে তোমার মা খুব তাড়াতাড়ি তোমার বাবাকে ভুলে যায়।
তুশিব নানাভাইয়ের সাথে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে রোজ মোনাজাতে বলতো, যাতে আল্লাহ মায়ের সব দুঃখ কমিয়ে দেয়, মা যাতে আর না কাঁদে। তার মা যেন সারাক্ষণ হাসে।
তুশিবের দোয়া যেন উপরওয়ালা ফিরিয়ে দিতে পারেননি। মা তারপর থেকে একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে লাগলো। আগের মতো কাঁদেনা কিন্তু বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। অল্প কথা বলে, ঘর থেকে বেরুতে চায় না, মাথায় চিরুনি দেয় না, চোখের কোটরে কালির স্তূপ জমে পড়তে লাগলো, মুখ সরু হতে লাগলো, কন্ঠের হাঁড় ভেসে উঠতে লাগলো। তুশিব বুঝলো মা আগের মতো নেই। তুশিবের বড্ড ভয় হতে লাগলো। তার মায়ের কি অসুখ করছে?
সে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকলে মা তাকে কোলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলে,
– বাবারা খুব খারাপ হয়। তাই আমার খোকার বাবাকে প্রয়োজন নেই।
তুশিব কথাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে শুনলো। তারপর নানা ভাইয়ের কাছে গিয়ে সেকথা বলতেই নানাভাই বললেন,
– তোমার মাকে বলো, আমার বাবার দরকার না হলেও বন্ধুর প্রয়োজন আছে।
তুশিব জানতে চাইলো,
– বন্ধু কেমন হয়?
– যেমন ধরো, সে তোমার মায়ের আর তোমার সব দুঃখ কমিয়ে দেবে, সারাক্ষণ তোমাদের হাসাবে, সারাক্ষণ তোমাদের দেখভাল করবে, তোমাদের সাথে সাথে থাকবে, তোমাদের ভালোবাসবে।
তুশিব হঠাৎই খুশি হয়ে গেল তা শুনে। প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলো,
– এমন বন্ধু কোথায় পাওয়া যায় নানাভাই?
নানাভাই বললেন
– আমি খুঁজে এনে দেব ভাই। আমার কাছে ওরকম একটা বন্ধুুর খোঁজ আছে। কিন্তু তোমার মাকে আমার ভয় করে তাই বলতে পারিনা।
তুশিব জানে নানাভাই মাকে ভয় পায়। শুধু নানাভাই নয় বাড়ির ঝি-রাও মাকে ভয় পায়। আগে পেত না। বাবা মাকে এই বাড়িতে রেখে যাওয়ার পর থেকে মা হুট করে পাল্টে গেল আর সবাই মাকে ভয় পেতে শুরু করলো।
তাই সে ভাবলো, সে নিজেই মাকে ওই বন্ধুর কথা জানাবে। কিন্তু তারও আজকাল মাকে ভয় করে। মনে হয় মা খুব কষ্ট পাবে তার কথায়। কি করে সে বলবে?
মায়ের একটা চাকরিও হয়েছে। একটি বেসরকারি হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষিকা হিসেবে। মা তাকে ওই স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। মাকে যারা ম্যাম বলে ডাকে তারা সবাই তার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে চেয়েছিলো। কত আদর করেছে সবাই তাকে। ওই স্কুলে গেলে তার খুব ভালো লাগে। মায়ের মনও তখন ভালো থাকে। তুশিব ভাবলো সে মাকে তখন কথাটা বলবে।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে মা খুব হাসিখুশি ছিল। তাকে হাওয়ায় মিঠাই কিনে দিয়েছিলো। সে হাওয়ায় মিঠাই খেতে-খেতে মাকে বললো,
– তোমাকে একটা বন্ধু এনে দিলে তুমি আগের মতো হাসবে মা?
তার কথাটায় মা কি কষ্ট পেল? হঠাৎ মায়ের ঝলমলে সুন্দর মুখশ্রী অন্ধকারে ছেয়ে গেল। এমনভাবে তার দিকে মা চেয়ে রইলো যেন তিনি আকাশ থেকে পড়েছেন। সাথে মায়ের চোখদুটোও জ্বলজ্বল করে উঠলো নোনা পানিতে। ধমকে বলেছিলো,
– কে বলেছে এসব ফালতু কথা? এসব মুখেও এনো না। খুব মারবো তুশিব।
তুশিব মায়ের ধমকানি শুনে কেঁদে ফেললো প্রায়। মা তার সাথে আর কথা বলেনি। তার কান্নাও থামায়নি। বাড়িতে আসার পর তার সাথে একটা কথাও বলেনি। কিন্তু সে শুনেছে মা নানাভাইয়ের সাথে খুব চেঁচামেচি করছিলো আর চেঁচামেচি শেষে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে খুব কাঁদছিলো। তুশিব আর নানাভাই দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে মায়ের ফোঁপানির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো। নানাভাই চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন
– নিজের কথা না ভাব, অন্তত বাচ্চাটার কথা ভাব। ওর একটা ভবিষ্যৎ আছে। ওর একটা সুস্থ পরিবেশ দরকার। ও সারাক্ষণ বলে মা কষ্টে আছে। মায়ের কষ্ট কমিয়ে দাও। ওর কথা একটু ভাব।
মা দরজা খুলে চট করে তুশিবকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। আর ধমকে জিজ্ঞেস করলো,
– এসব বলেছ তুমি? সত্যি বলেছ? আমি যথেষ্ট নই তোমার জন্য? আমিই তোমার বন্ধু। আমিই তোমার সব। মা ছাড়া কেউ বন্ধু হয় না খোকা। আর কখনো বন্ধুর কথা বলবে কাউকে?
তুশিব ঘনঘন মাথা নেড়ে মায়ের গাল মুছে দিতে দিতে কাঁদলো। মাকে কথা দিল ঠিক কিন্তু ওই বন্ধুর কথা মাথা থেকে সরেনি তার।
সত্যিই কি অমন বন্ধু আছে যে মা আর তার সব কষ্ট দূর করে দেবে?
মায়ের সাথে স্কুল যাওয়ার পথে একদিন হঠাৎ বাবার সাথে তাদের দেখা হয়ে গেল। তুশিব বাবা বলে চিৎকার দিয়ে ছুটে গেল বাবার কাছে। মা তাকে কত ডাকলো সে শুনলো না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো সে। কান্নার ভাষায় যেন বুঝাতে চাইলো, আমি আর মা ভালো নেই। একটুও ভালো নেই।
বাবা চুপ করে ছিলেন। তারপর তার হাত ধরে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মাকে খুবই কঠোর ভাষায় কয়েকটা কথা বলে তার সাথে একবারও কথা না বলে সোজা চলে গেলেন। মা চুপ হয়ে বাবার যাওয়া দেখছিলো। আর কি যেন ভাবছিলো। তুশিবও বাবার পথযাত্রায় তাকিয়ে ভাবলো, সে আর কখনোই বাবাকে দেখলে ছুটে যাবে না। বাবাকে তার খুব মনে পড়ে, কান্না পায়, বাবার পায় না? তবে কি মায়ের কথা সত্যি? বাবারা খুব খারাপ হয়?
তার মায়ের নাম তাসনিয়া। বাবা ডাকতেন তাসনু বলে। মাকে জিজ্ঞেস করায় মা সেদিন হেসে বলেছিল,
– তোমার বাবা এটা ভালোবেসে ডাকে। যেমন তোমাকে ভালোবেসে সোনা ডাকে ঠিক তেমন।
তুশিব অবাক হলো এটা ভেবে, – বাবা সেদিন মাকে তাসনু বলে ডাকেনি। তাসনিয়া বলে ডেকেছিলো। তারমানে বাবা এখন মাকে ভালোবাসে না?
মায়ের সাথে সে যখন স্কুলে যায় না তখন বাড়ির কাজের ঝি শাপলা তার দেখাশোনা করে। শাপলা বলেছে তাকে যেন ছোট খালাম্মা বলে ডাকে। তুশিব একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার বাবুর আব্বু নেই?
– ক্যান? আছে তো।
– ও তোমাকে কি নামে ডাকে?
– শাপলা কয়, মাঝেমধ্যে শাপলুও কয়। ক্যান বাপ?
– বাবা আগে মাকে তাসনু বলতো এখন তাসনিয়া বলে ডাকে।
শাপলা কপাল চাপড়ে বলল,
– ধুরর ব্যাটা। তোর ওই বদমাশ বাপের কথা ছাড়। সে তো আরেকডা বিয়া করছে। বেয়াদব লোক। এমন ফুটফুটে একটা বাচ্চা রেখে কেম্নে যে মানুষ আবার সংসার বাঁধে আমার বুঝে পায় না।
তুশিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– বাবা বিয়ে করেছে কেন?
– কেন আবার? তোমার মায়ের লগে ভালা নাই তাই আরেক বেডি জুটাইছে।
– বাবাও ভালো নেই?
– ওইরকম লম্পট ব্যাটা কারো সাথে ভালো থাকতে পারবো না। তুমি তোমার মায়েরে কও আরেকডা বিয়া করতে। সে ক্যান একা থাকবো?
– বিয়ে করলে কি হয় খালাম্মা?
– বিয়ে হইলে তুমি একডা বাপ পাইবা, তোমার মা একটা বর পাইবো। তহন ভালা থাকবা। ওই বেডা তো আর খারাপ হইবো না। হক্কলে খারাপ হয় না।
– বিয়ে হলে মা আগের মতো হাসবে?
শাপলা মেঝে মুছতে মুছতে বলতে লাগলো
– হয় হয় খুব হাসবো। তুমিও হাসবা। তোমার নানাও হাসবো। তোমাগো হাসি দেইখা আমিও হাসবো।
তুশিব ভীষণ খুশি হয়েছিলো তখন। আলতাফ উদ্দিনকে গিয়ে জানালো – নানাভাই মাকে বিয়ে দাও। তাহলে মা খুব হাসবে।
নানাভাই খবরের পাতা পড়ছিলেন। মুখের উপর হতে পাতা সরিয়ে চশমাটা ঠিক করে তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। তুশিব গেল। উনি নাতিকে কোলে তুলে নিয়ে খবরের কাগজে একটা যোদ্ধার পোশাক পরিহিত মানুষের ছবি দেখিয়ে বললো,
– ও হবে তোমাদের বন্ধু। তোমার মা আর তোমার বন্ধু।
তুশিব ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখলো। সেটি নানাভাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে নিল। তারপর ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে বারংবার দেখলো। অনেক পুরোনো কাগজ! ছবির নীচে নামটা অনেক কঠিন। তারপরও সে লেখাটা বানান করে পড়লো।
নানাভাই তাকে বারণ করে দিয়েছে মাকে কিছু বলা যাবে না। মা খুব রাগ করবেন। তাই তুশিব মাকে কিছু বলেনি। বাড়িতে হঠাৎ মানুষের আসা-যাওয়া বেড়ে যাওয়ায় তাসনিয়া কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো। শাপলার কাছ থেকে পুরো সত্যটা জানার পর সে অবাক হয়ে গেল বাবার কান্ড দেখে। উনি কি করে তার অমতে এতদূর গড়িয়ে গেলেন?
কিছুতেই সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না জানিয়ে দিল। বাবা কোনমুখে তাকে আবারও একটা পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে বলে? হেসেহেসে যে পুরুষ মানুষ তার বুকে ছুরি বসিয়েছে সেই পুরুষমানুষকে আবারও বিশ্বাস সে করতে পারবে না।
সেদিন অনেক কথা কাটাকাটি হলো মা আর নানাভাইয়ের মধ্যে। তুশিব শাপলা খালাম্মার হাতে খেয়েদেয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়েছিল।
তাসনিয়া ঘরে এসে তাকে ঘুমোতে দেখলো। বিছানায় বসে তাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে গালে ঘনঘন চুমু খেল। তুশিব চোখ মেলতেই দেখতে পেল মা কাঁদছে। তাকে চোখ খুলতে দেখে তাসনিয়া চোখ মুছে ফেললো। বলল,
– তোমার মা তোমাকে খুব ভালোবাসে। যা আর কেউ বাসতে পারবে না। নানা ভাইয়ের কথা শুনবে না।
তুশিব সুযোগ পেয়ে বলল,
– বন্ধুটা সুপারম্যান। সুপারম্যানরা কাউকে কষ্ট দেয় না মা। সুপারম্যানরা বাবার মতো হয় না। দেখবে, সুপারম্যান তোমাকে তাসনু বলে ডাকবে না, তাসনিয়া বলেও ডাকবে না।
তাসনিয়া তার কথা শুনলো তবে কানে নিল না। তাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– তোমার বাবা একসময় আমার কাছে সুপারম্যান ছিল। এখন আমি তাকে ঘৃনা করি।
______
আলতাফ সাহেব হঠাৎ করে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাবাকে অসুস্থ হতে দেখে তাসনিয়া পুরোপুরি ভেঙে পড়লো। আলতাফ সাহেবকে দেখার জন্য তাসনিয়ার মামা আর খালাম্মারা এলেন। আলতাফ সাহেব উনার অসুস্থতার অজুহাতে তাসনিয়াকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হতে বললেন। পীড়াপীড়ি দেখে তাসনিয়া বলল,
– আমাকে আবারও মারতে চাও বাবা? আমি আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে শান্তিতে বাঁচতে চায়। আমার নিজের সুখের কোনো দরকার নেই বাবা। তুমি জানো কত মা সন্তানের মুখ চেয়ে একা একা লড়াই করছে। আমি আমার সন্তানের ভালোর জন্য এই বিয়েটা করতে পারব না।
আলতাফ সাহেব বললেন,
– তোর জন্য না। তোর সন্তানের ভালোর জন্য বিয়েটা কর। ও ওর সমবয়সী একটা বন্ধু পাবে। তুই একজনের মা হবি, সে তোর ছেলের বাবা হবে। শুধু ওরজন্য বিয়েটা কর। একটা মেয়ে তার একটা মা পাবে, আর একটা ছেলে তার বাবা পাবে।
– পর কখনো আপন হয় না বাবা। আমি শুধুই তুশিবের মা। আমি আর কারো মা হতে পারব না। এ অসম্ভব!
– আমি তোকে বিয়েটা করতে বলব না। জোরাজোরিও করব না। তুই শুধু একটিবার দেখা কর ওর সাথে। ও তোর মতোই এক হতভাগা।
তাসনিয়া বাবার অনুরোধ ফেলতে পারলো না। ফোনে সেই মানুষটার সাথে সে কথা বললো। সবটা বুঝিয়ে বলার পর লোকটা বললো, তিনি দেখা করতে চান। তাসনিয়া বিরক্ত হলেও রাজী হলো। লোকটা বুঝতে পেরেছে সে বিয়েটা করতে চায় না তারপরও দেখা করতে চাওয়ার বিষয়টা তার কাছে নিতান্তই বেকার লেগেছে। তারপরও সে রাজী হলো।
সেদিন মায়ের সাথে তুশিবও ছিল। মা যখন লোকটার জন্য অপেক্ষা করছিলো তখন সেও অপেক্ষা করছিলো ওই ছবির সুপারম্যানকে দেখার জন্য। কিন্তু সে খুব হতাশ হলো যখন দেখলো, ছবির মতো পোশাক পড়েনি লোকটা। আর মুখটা খুব গম্ভীর, ঠিক মায়ের মতো। না মায়ের চাইতেও কঠিন। আসামাত্রই বুদ্ধিদীপ্ত ভুরু দুটো নাচালো তার সাথে। তুশিব কথা বলতে চাইলো কিন্তু লোকটা নিজেই আগ্রহ দেখালো না।
তুশিবের কথা বলতে ভয় করলো। বন্ধু নিশ্চয়ই এমন হয় না?
তাসনিয়া লোকটাকে একপলক দেখে চোখ নামিয়ে নিয়ে তুশিবের দিকে তাকিয়ে ছেলের হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
– আমার হাতে সময় কম। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।
লোকটা তাসনিয়ার মুখোমুখি বসে সোজা কথায় চলে গেল। বলল,
– আমি সোজাসাপটা কথায় বিশ্বাস করি। এন্ড ভেরি কনসার্নড এবাউট টাইম। তাই বেশি সময় নেব না। আপনার বাবা বলেছেন, আপনার ছেলের একজন বন্ধু দরকার। আমার সেটা আছে। আর আমার মেয়ের একজন মা আর বন্ধু দরকার। যেটা আপনার আছে। যেহেতু আমাদের অতীতের
তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে সেহেতু আমরা দুজনেই চাইবো না আরও একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হোক। সো আমরা একটা পরিমিত ডিসটেইন্স মেইনটেইন করে চললে বোধহয় সেই অভিজ্ঞতাটা আর হওয়ার চান্স থাকবে না। আমি বলছিনা আপনি আমি স্বামী স্ত্রী হবো না। আমরা অতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যাব না যতদূর অব্দি গেলে সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে। আপনার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে তাই আপনাকে আর বুঝিয়ে বলতে হচ্ছে না। আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি থাকবে আমাদের বেবিরা। যাতে তারা ভালো থাকে, সুস্থ একটা পরিবেশ পায়, হাসিখুশি আনন্দে থাকে। আপনাকে আমার ভীষণ দরকার মনে হলো তাই আরও একবার ভেবে দেখতে বলছি। আজ উঠি।
বলেই উনি উঠে পড়লেন। তুশিবের চুলগুলো পুনরায় নেড়ে দিয়ে বললেন,
– মাকে বুঝাও। হ্যা? তোমার জন্য একটা বন্ধু অপেক্ষা করে আছে।
তুশিব মাথা নেড়ে হাসতেই উনি পকেট থেকে চকলেট বের করে বাড়িয়ে দিলেন। তুশিব নিতেই উনি তার চুলগুলো আবারও এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
– গুডবয়।
তাসনিয়া দেখলো লোকটা যেই গতিতে এসেছে সেভাবেই চলে গেল। বাবার মুখ থেকে শুনেছে তিনি একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। স্ত্রী-র সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে ভীষণ বিপাকে পড়েছেন। পরিবার থেকে বিয়ে করার চাপ দিচ্ছে কিন্তু তিনি চান উনার মেয়ের জন্য একটা মা।
আলতাফ সাহেব মেয়ের জবাব পাওয়ার আশায় ব্যাকুল হয়ে ছিলেন। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে উনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। উনাকে চমকে দিয়ে এক সন্ধ্যায় তাসনিয়া বললো সে বিয়েটা করতে রাজী।
তার মতামত শোনার অপেক্ষায় ছিলেন উনি। বিয়ের বন্দোবস্ত করতে দেরী হয়নি। ওইপক্ষের অনেক মানুষ সেদিন বাড়িতে এসেছিলো। তুশিবও সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। যারা এসেছে তারাও তুশিবকে দেখছে। তাকে সবাই ডাকছিলো কিন্তু সে যায়নি। মায়ের ঘরেও তাকে যেতে দেয়া হলো না।
সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলো সেই সুপারম্যানকে। উনার গলা জড়িয়ে ধরে লেপ্টে আছে পুতুলের মতো একটি মেয়ে। কেমন গাল-ফুলিয়ে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটি।
মায়ের ডাক পড়তেই তুশিব মায়ের কাছে চলে এল। দেখলো মাকে কি সুন্দর লাগছে! মা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই সে ঝাঁপিয়ে পড়লো মায়ের কোলে। ওই মেয়েটির মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে আচমকা।
তাসনিয়াও কাঁদতে লাগলো। কবুল বলার আগ-মুহূর্তে সে লোকটার নাম এবার স্পষ্ট শুনতে পেল।
গোফরান সিদ্দিকী।
নানাভাইকে ছেড়ে যেতে তুশিবের খুব কষ্ট হচ্ছিলো। মায়ের চাইতে সে বেশি কেঁদেছে নানাভাইকে ছেড়ে যাওয়ার সময়। ওই পিচ্চি মেয়েটা তার দিকে পিটপিট করে তাকিয়েছিলো আর বধূবেশে মায়ের দিকে আঙুল তাক করে বারবার কি যেন জিজ্ঞেস করে মিটমিট করে হাসছিলো। তুশিবের খুব রাগ হচ্ছিল তখন।
নতুন বাড়িতে যখন তারা পা দিল তখন মেয়েটা তার মায়ের পাশ ঘেঁষে বসে রইলো। আর বারবার মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলো। তাসনিয়া তা খেয়াল করলো কিন্তু কিচ্ছু বললো না। বাড়িভর্তি অনেকগুলো মানুষ একে একে মিষ্টিমুখ করানোর পর একজন মধ্যবয়স্ক লোক তাকে মিষ্টিমুখ করিয়ে বলল
– তোমাকে আমি ছোটবৌ ডাকবো। আমি তোমার ভাসুর। তোমার জা কাল কোমর ভেঙেছে এই বিচ্ছুর সাথে ছুটতে গিয়ে। তাই নীচে আসতে পারছেনা।
মেয়েটা কিচিরমিচির করে উঠলো তখুনি। বলল,
– আমার নতুন বন্ধুমাকে পঁচা কথা বলছো কেন?
পেছনে যারা দাঁড়িয়েছিলো সবাই একসাথে হেসে উঠলো।
তাসনিয়া সবাইকে এক এক করে দেখছিলো। হঠাৎ সেই লোকটা এসে বলল,
– সবাই ভীড় কমাও। এই তোরা ছবি তোলা বন্ধ কর। আপনি আসুন। ঘর দেখিয়ে দিই। মিনি তোমার বন্ধুর সাথে কথা বলো।
মেয়েটা তুশিবের হাত ধরলো। বলল,
– বন্ধু তোমার মাকে মা ডাকতে দেবে?
চলমান….