চিরবন্ধু #পর্ব৪ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0
207

#চিরবন্ধু
#পর্ব৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ধরাবাঁধা কোনো চাকরি-বাকরি না করলেও রাইডার হিসেবে ইতোমধ্যে অল্পসল্প পরিচিত লাভ করেছে আরিব। পাশাপাশি একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেও টুকটাক রোজগার করে। তা দিয়ে ইচ্ছেমতো যেখানে ইচ্ছে ঘুরেবেড়ায় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। রোজগারের টাকা থেকে ফিজার জন্য একটা ব্যাগ আর জন্মদিনের উপহার হিসেবে তাসনিয়ার জন্য একটা ঘড়ি এনেছে সে। যদিও ঘড়িটা জন্মদিন না হলেও সে আনতো। পাশাপাশি জন্মদিন হওয়ায় ঘড়িটা উপহার হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। ঘড়িটা দেখার পর মিনি তার হাতে পড়ে বসে আছে সারাদিন। তার হাতে সেটা হচ্ছিলো না তারপরও সে সেটা পড়বেই। ফিজা কেড়ে নেওয়ায় কি কান্নাকাটি তার। তার মায়ের জিনিস সে পড়বে না কেন? রাতে যখন তার বাবা বাড়ি ফিরলো সে বাবার কোলে উঠে ঘড়িটা নেড়েচেড়ে দেখালো। বলল, এটা গিফট। আরিব আঙ্কেল দিয়েছে । তুমি মাকে গিফট দিয়েছ?
গোফরান বলল, – না। তোমার মা কেক কাটলে রাগ করে। গিফট দিলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
মিনি বলল,
– কেন? গিফট দিলে হ্যাপী হয়।
– হয়। কিন্তু তোমার মা হবে না। কারণ তোমার মা মহীয়সী নারী। মহীয়সী নারীদের খুশি করা এত সহজ নয়। তাদের কি গিফট দেয়া যায় সেই ব্যাপারে আমার আইডিয়া নেই। আমার যখনি ভালো কোনো গিফটের কথা মনে পড়বে তখনি আমি দিয়ে দেব তোমার মাকে।
মিনি খুশি হয়ে বলল,
– সত্যি?
– তিন সত্যি।
– গুড বয়।
মিনি টুপ করে বাবার গালে চুমু খেয়ে কোল বেয়ে নেমে চলে গেল। জুবরান পানির গ্লাস নিয়ে এল ধীরপায়ে হেঁটে। সে রোজ এমন করে। জিপের শব্দ শোনামাত্রই রান্নাঘরে ছুটে যায় ঠান্ডা পানির জন্য।
পানি আনার সময় অনেকটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছে। তার হাত তরতর করে কাঁপছে। দৃষ্টিজোড়া গ্লাসের দিকে। গোফরান তার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে পানি খেয়ে টেবিলে রেখে দিতেই দেখতে পেল জুবরানের দৃষ্টিজোড়া টেবিলের উপর রাখা টুপিটাতে নিবদ্ধ হয়ে আছে। ছুঁতে চায় কিন্তু সাহস করে উঠেনা। এমনভাবে দৃষ্টি গেঁথে রেখেছে, যেন চোখ দিয়ে সে হাতে ছুঁয়ে দেয়ার মনোবাসনা যেন পূর্ণ করে নিচ্ছে।
গোফরান সেটি তার সামনে থেকে তুলে নিয়ে মাথায় পড়িয়ে দিল। জুবরান হতচকিত হয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দুহাত দিয়ে তার মাথায় পড়া টুপিটা ছুঁলো। গোফরানের দিকে চেয়ে একচোট হাসলো। অনুমতি চাইলো,
– মায়ের কাছে যাই?
গোফরান চোখ নিভিয়ে সায় দিল।
সম্মতি পেয়ে খুশিতে উত্তেজিত হয়ে জুবরান ছুটলো তার মায়ের কাছে। ছুটতে গিয়ে আচমকা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল দরজার কাছে। গোফরান বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো তাকে পড়ে যেতে দেখে। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
– সাবধানে।
জুবরান পড়ে গেল ঠিক, কিন্তু টুপিটা মাটিতে পড়তে দেয়নি। কনুই আর বুক মেঝেতে ঠেকে গেলেও বা-হাতটা উঁচা করে ধরে রেখেছে টুপিটা।

ফিজাকে মসলাপাতি দেখিয়ে দিচ্ছিলো তাসনিয়া।
জুবরানের ডাকে ফিরলো। জুবরান ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তাসনিয়া তাকে কোলে তুলে বলল,
– টুপিটা কোথা থেকে নিয়েছ?
জুবরান হেসে সেটি তার মায়ের মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বলল
– উনি দিয়েছেন।
তাসনিয়া হেসে তার গালে চুমু খেল। ফিজা বলল,
– মিনুখালা দেখে কিনা দেখো। মা ছেলের আদর খাওয়া বের করে দেবে।
তার কথা শুনে তাসনিয়া হেসে উঠলো। জুবরানও হাসলো।

আরও পনের দিনের মতো কাটিয়েছে তারা রাঙামাটিতে। এই পনের দিন তারা অনেক জায়গায় ঘুরাঘুরি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। দায়িত্ব পড়েছিলো আরিবের উপর। গোফরান জানে সে এসবে ওস্তাদ। তাই আরিবের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে কর্মস্থলে নিশ্চিন্তে ছিল।
কাপ্তাই হ্রদ, শুভলং ঝরনা, ধুপপানি ঝরনা, ফুরোমন পাহাড়, ঝুলন্ত সেতু, রাজবন বিহার, পলওয়েল পার্ক সব ঘুরে ঘুরে দেখা হয়ে গেছে তাদের।
ঘুরাঘুরির ফাঁকে হরেকরকমের মজাদার খাবার যেমন, মুরগীর গুঁতাইয়া, বাঁশ কোড়ল, এঁচোড় নিরামিষ,গুটি বেগুনের ভর্তা, তাবা তোন, পাজন, সিদল দিয়ে সবজি সিদ্ধ, আনারস, বাঁশে বসানো দই রাঙামাটির জনপ্রিয় সব মুখরোচক খাবার তারা খেয়েছে। তাসনিয়া জীবনে এই প্রথমবার এক নাগাড়ে এতগুলো জায়গায় ঘুরাঘুরি করেছে। জুবরানও প্রথম। বুদ্ধি হওয়ার পর সে প্রথম কক্সবাজার গিয়েছিলো ঘুরতে বাবা মায়ের সাথে। টানা পনেরদিন ঘুরাঘুরি এই প্রথম। মিনির যদিও আগে অনেক ঘুরাঘুরি হয়েছিলো তার মায়ের সাথে। নানু আর মামাদের সাথে। নতুন মায়ের সাথে এই প্রথম ঘুরাঘুরি। সাথে তার নতুন বন্ধু। ভীষণ উপভোগ করেছে সে দিনগুলো। পনেরটা দিন রাঙামাটিতে খুব আনন্দে কেটেছিলো সবার। আরিবের ছোট্ট ক্যামেরায় সবার অসংখ্য ছবি বন্দী হয়েছে স্মৃতি হিসেবে। বিয়ের পর সে আর ফিজা কোথাও ঘুরতে যায়নি। তাই বিশেষ করে তাদের জন্য আর তাসনিয়ার জন্য সুযোগটা করে দিয়েছিলো গোফরান।
দেয়ালে তারা চারজনের যে ফ্যামিলি ফটোটা ঝুলানো আছে সেটা শেষদিনের তোলা। পলওয়েল পার্কে গোফরান তাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলো সেনানিবাস থেকে। সেখানে একসাথে খাওয়া দাওয়া আর ছবি তোলা হয়েছিলো। ফিজা সব ছবির মধ্যিখান থেকে সেই ছবিটা নিয়ে নিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ছবিতে বাচ্চাদের সামনে রেখে সে আর গোফরান সিদ্দিকী পাশাপাশি দাঁড়ানো। বাস্তবিক অর্থে তাদের মনের অবস্থান এতটা কাছাকাছি কখনো না এলেও তার আশপাশে আছে।
ধরা নেই ছোঁয়া নেই, চাওয়া নেই পাওয়া নেই তারপরও একটা অমীমাংসিত সম্পর্কটা গড়িয়ে চলছে দিনের পর দিন এতে দু’জনের কারোর অসন্তুষ্টি নেই। বরঞ্চ ভালো লাগায় মুড়িয়ে আছে বেশ। কাজ থেকে ফিরে এক কাপ চা খেতে খেতে কথাবার্তার ফাঁকে সুকৌশলে একে অপরকে খোঁচা মেরেও তারা শান্তি পায়, রাগে-অভিমানের কোনো জায়গা নেই, উচিতও না, কেউ এসে অভিমান ভাঙাবে তাও আশা করে না। তারপরও ভুল করে রাগ করে, ভুল করে অভিমান জন্মায়। আবার কথায় কাজে তারা একে অপরের রাগ অভিমান ভাঙায় তাও নিজেদের অজান্তেই। এভাবেই তৈরি হচ্ছিলো এই অমীমাংসিত, বিকারহীন সম্পর্কের সমীকরণ। তার কাছে কিছু চাওয়ার নেই বলার পরও পেয়ে বসা, এ যেন পুরোনো ক্ষতে মালিশ!
বিরক্তি, অবিশ্বাসী মনের এককোণায় দৈবাৎ দেখা পাওয়া কোনো শুভ্র আলোড়ন।
আমার কাউকে প্রয়োজন নেই বলার পরেও দিনশেষে চোখবুঁজার জন্য একটা বিশ্বাসযোগ্য বক্ষঃস্থল, জ্বরে পুড়ে যাওয়া তপ্ত ললাটের উপর একটা নরম হাত যে আসলেই দরকার তা বুঝতে দেরী হলেও এটাই যে ধ্রুব সত্যি মুখফুটে স্বীকার না করলেও, বেলাশেষে ভালোবাসার আকন্ঠ মুগ্ধতায় ডুবে থাকতে চাওয়া মন তা অনায়াসে স্বীকার করে। স্বীকার করতে বাধ্য।
ঘরবিমুখী ঘর বাঁধতে না চাওয়া পাখিও বেলাশেষে একটা নীড়ের জন্য কেঁদে মরে।

শহরে ফিরে আসার পর বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসা আর নিজের স্কুল নিয়ে ব্যস্ত ছিল তাসনিয়া। পাশাপাশি হওয়ায় সে একসাথে বেরোতো। আবার বাচ্চাদের ছুটি হলে গাড়িতে তুলে দিত। রাঙামাটি থেকে তারা যখন চলে এসেছিলো, গোফরান সিদ্দিকী তখন বর্ডারে। প্রায় দুইমাস বাড়ি ফিরতে পারেননি তিনি। রাতের শেষভাগে একটা কল ছুটে আসতো। ঝিমুতে থাকা তাসনিয়া ফোনকলের শব্দে চমকে উঠতো। চোখ কান মস্তিষ্ক সবটা স্বাভাবিক করে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে গিয়েও মনে হতো সে কিসব যেন বলে ফেলছে। কারণ ওপাশের দরাজ হাসিটায় স্পষ্ট বুঝা যেত তার অবিন্যস্ত, এলোমেলো শব্দগুচ্ছের প্রতিক্রিয়া।
সীমান্তঘেঁষে বিশেষ কাজে নিয়োজিত কর্নেলের যেখানে সামনে মৃত্যু দেখেও এগিয়ে যেতে হয়, ডান-পা গেলে বাম পা অব্দি চলতে হয়, অমন পরিস্থিতিতেও রাত্তিরের শেষভাগটা উনার কাছে বিশেষ মূল্যবান। ঘুমজড়ানো কন্ঠে সর্বদা ডাঁট বজায় রেখে চলা লৌহমানবী কি মধুর সুরে কথা বলে সে কি জানে?
পুরুষ কন্ঠটা যখন বলে,
– আপনি ঘুমাচ্ছেন। ফোনটা তাহলে রাখি।
সেকথা বলার সাথে সাথে নারীকন্ঠ দৃঢ় প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,
– আমি ঘুমাচ্ছিনা।
আর তা বলার পরপরই নিজের কথায় সে নিজেই অপ্রতিভ হয়ে পড়ে।
এই দুটো মাসে কেউ কাউকে চোখের দেখায় না দেখলেও অস্বীকার করার উপায় নেই, এই দুটো মাসেই সেইসব সংকোচ, তাদের সম্পর্কের উপর অবিশ্বাস- ভয়ভীতি, নিজেদের মধ্যকার জড়তা ধীরেধীরে মসৃণ হয়ে এসেছিলো।
এক বাড়িতে এক ঘরে থাকার পরও তাদের যতটা না কথা হয়নি তার চাইতে শতগুন কথা হয়েছে মুঠোফোনটির মাধ্যমে। যেন সদ্য প্রেমে পড়া একজোড়া চড়ুই। কিচিরমিচির শব্দে কেটে গিয়েছে কয়েকটা নির্ঘুম রাত, বারান্দায় দাঁড়িয়ে কখনো বা বৃষ্টির শব্দ শোনা হতো ফোনটা চুপচাপ কানে ধরে রেখে, কখনো বিজলির দ্রুম দ্রুম শব্দে কেঁপে উঠে রক্তবর্ণ ধারণ করা আকাশের দিকে চেয়ে, কখনো বা অন্তরআত্মা কাঁপিয়ে দেয়া বর্ডারঘেঁষে বোমা হামলার বিকট শব্দে শুনে।
এই ছোটখাটো না নাম জানা অনুভূতিগুলো কোনো এক শুভক্ষণে পুতঃ ভালোবাসার জন্ম দিয়েছিলো দুই কঠিন মানব-মানবীর মনে। অতি উত্তেজিত কৌতূহল বিদ্ধ মনের মধ্যে তারপরও প্রশ্ন বিঁধে ছিল। দূর থেকে সবটা সুন্দর কিন্তু কাছে এলে সবটা আবারও ফিঁকে হয়ে যাবে, তিক্ত হয়ে উঠবে, সম্পর্কে ছিঁড় ধরবে এইসব ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকা দুটো হৃদয় ক্রমশ দূরে সরে থেকেছিল এই ভয়ে। সম্পর্কের জটিলতা কাটিয়ে উঠার মতো সম্পর্কের মাপকাঠি মুঠোফোনের কয়েকটা কথায় যে নির্ভর করে না সে সম্পর্কে তারা বিদিত ছিল। তাই এতগুলো দিনশেষে দেখা হওয়ার পর সম্পর্কের সমীকরণটা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে বিস্তর ভাবনার ভীড়ে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছিলো দুজন।

দু-আড়াই মাসের ব্যবধানে বাচ্চাদের ঘর আলাদা হয়েছে। দুজনের পাশাপাশি দুটো ঘর। মাঝখানে রিডিং রুমে তাদের বইখাতা, চেয়ার টেবিলের পাশাপাশি জুবরানের সাইকেল, ক্রিকেট-ফুটবল, ব্যাডমিন্টের সরঞ্জামের দোকান বসেছে। সাথে রয়েছে মিনির কয়েকটা পুতুলের সংসার। দেয়ালে দেয়ালে রঙপেন্সিলের আকাঁআকি, ঘরের কোণায় কোণায় ঝুলে থাকা অদক্ষ হাতে আঁকিবুঁকি করা পেইন্টিং। জুবরানের হাতে আঁকা যুদ্ধের পোশাকে তার সুপারম্যান, মিনির হাতে আঁকা লাল রঙের শাড়ি পড়া, কানের কাছে ফুলগুঁজা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুল মাস্টারনি মা। যার সাথে তার সম্পর্কের সমীকরণটা নেহাতই একটা চুক্তির উপর নির্ভর করে শুরু হলেও এখন সেই সম্পর্ক পুরোপুরি বিশুদ্ধ ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। মা এখন আদর না করে সারাক্ষণ বকাবকি করলেও মিনির মনে হয় না মা তাকে ভালোবাসেনা। মা বকলে, বিরক্ত হলে সে অভিমানে গাল ফুলিয়ে থাকে, চোখের কোণে জল টলমল করে, কথা না বলে এড়িয়ে চলে, মা তার রাগ না ভাঙিয়ে উল্টো নিজেই রাগ করে বসে থাকে, কথা বলে না কিন্তু তারপরও মা কখনো চলে যায় না। যেখানে গেলে আর ফিরে আসবে না। মায়ের অসুখ হলে সে শিয়রে বসে থাকে, কপালে আঙুল বুলিয়ে দেয়, হাত-পায়ের আঙুল টেনে দেয়, জ্বরে পুড়তে থাকা বুকে উম খুঁজে নেয়। সে অসুস্থ হলে তারপরের দিন সকালে দেখে মায়ের চোখের কোটরে জমে যাওয়া কালি। মায়ের ভালোবাসাগুলো সে দেখে বকাবকির পর গুমোট হয়ে বসে থাকা মায়ের মুখে, চোখ রাঙিয়ে ধমক দেয়ার অনেকক্ষণ পর শীতল হয়ে আসা মায়ের চোখে, বারণ না শুনলে পিঠের উপর পড়া কড়া চড়ের পর নরম হাতে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয়া হাতের ভাঁজে, রাগলে ধুরছাই করে তাড়িয়ে দেয়ার পর রাগ কমলে আগলে ধরে চেপে ধরা বুকের গন্ধে। মিনির খুব বুঝ হয়েছে আজকাল। মায়ের কাছে থাকলেই সে বাবাকেও পেয়ে যায়।

এই কয়েকটা মাসে সুপারম্যানকে ভীষণ মিস করেছে জুবরান। যখন রাত্তিরে মা ঘুম থেকে ডেকে উঠিয়ে বলতো, উনি ফোন দিয়েছেন। তোমার সাথে কথা বলতে চান। জুবরান তখন কাঁপা-কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে দু’হাতে ফোনটা চেপে ধরতো কানে। ওপাশ থেকে উনি যখন “হাই ম্যান” বলতেন জুবরানের চোখদুটো ঝাপসা হয়ে উঠতো অমনি । মিনি আর মায়ের সম্পর্কটা একটা পরিণতি পেলেও তার আর সুপারম্যানের সম্পর্কটার কোনো গতিবিধি হয়নি। কেমন একটা গোলকধাঁধায় সেটি আটকা পড়া ছিল।
তারপর একদিন এল সেই দিনটা।
মেঘলা আকাশে ছেয়ে থাকা ২৬শে মার্চ। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্কুলে খেলাধূলা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। জুবরানও ছিল দৌড় প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করা খেলোয়াড়দের একজন। যখন দৌড়ে যাওয়ার জন্য চারিদিকে বাঁশি বেজে উঠেছিলো তখন প্রস্তুতি নিয়ে থাকা জুবরান দেখেছিলো স্কুল গেটের সামনে দিয়ে জিপ থেকে নামা তার সুপারম্যানকে। দুমাস পর নিজের আইকনকে চোখে দেখার অদম্য কৌতূহলের দরুন
কি এক দুর্দম্য শক্তি ভর করেছিলো তার পায়ে। সে ফার্স্ট হওয়ার পর যখন সবাই একসাথে হাততালি দিচ্ছিলো তখন হাততালি দেয়া মানুষগুলোর ভীড়ে সুপারম্যানও ছিল।
পুরস্কার নেয়ার পর তাকে যখন প্রথম বিজয়ীর আসনে দাঁড় করিয়ে সকলেই প্রশংসায় মেতে উঠেছিলো তখন ঝুপঝুপ করে আকাশ ছিঁড়ে বৃষ্টি নেমে এসেছিলো তল্লাটে। ওই তিন সিঁড়ির মতো আসনটি হতে নেমে পুরস্কারটি হাতে নিয়ে সে বৃষ্টি হতে বাঁচতে ছুটে এসেছিলো সুপারম্যানের কাছে। কিন্তু ততক্ষণে তার পা জোড়া থমকে গিয়েছিলো অদৃশ্য একটা বাঁধায়। কাঁদামাটিতে ডুবে যাওয়া তার পায়ের সাদা কেডস, বৃষ্টিতে ভিজে উঠা গায়ের সাদা শার্ট, নেভি-ব্লু ব্লেজার আর প্যান্ট। বৃষ্টির গতি বেড়ে যাওয়ায় হাঁপানি উঠে গেল তার। সেই হাঁপানির চোটে কান্নার হেঁচকি উঠলো। পুরস্কারটি হাতে ধরে দুঠোঁট ফুঁড়ে “বাবা” ডাকটি মুখ ফস্কে বেরোতেই দমকে-দমকে কান্নার বেগ বেড়ে গেল তার। আর ঠিক তখনি হাত বাড়িয়ে সুপারম্যান তাকে ডেকেছিলো। অনুমতি পেয়ে সে আর অপেক্ষা করেনি। ছুটে গিয়ে বুকে আছড়ে পড়েছিলো উত্তাল সমুদ্রের অপ্রতিরোধ্য ঢেউয়ের মতো। গা কাঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে জিজ্ঞেস করেছিল,
– আমি একবার বাবা ডাকতে পারবো?
তার আদুরে-আবদার শুনে হেসে উঠেছিলো গোফরান। জড়িয়ে ধরে রেখে বলেছিলো,
– আমি তোমারই বাবা।
বৃষ্টির ঝাঁপটা থেকে বাঁচতে ছাতার নীচে আশ্রয় নেয়া মা মেয়ে সেই দৃশ্যটি দেখছিলো দূরে দাঁড়িয়ে। অপূর্ব!

এই দুই মাসের দূরত্ব জুবরানকে উপহার দিয়েছিলো প্রিয় বাবা, মিনিকে শিখিয়েছে বাবাকে ছেড়ে থাকার সংযম আর তাসনিয়া পেয়েছে বদ্ধঘরে, বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধানো কর্নেলের জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীরের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন, শুষ্ক ঠোঁটের দুটো সিক্ত চুমু। তারপর হুট করে কোথা হতে উড়ে আসা লজ্জা, জড়তা-সংকোচ, অতীত স্মরণ, পুরোনো ব্যাথা মনে পড়তেই আবারও বেড়ে যাওয়া একহাত দূরত্ব রেখে বিছানায় দুইপ্রান্তে দুজন শুয়ে ভাবলো তারা এখনো পরস্ত্রী আর পরস্বামী হয়ে রয়ে গিয়েছে। মুঠোফোনটার মতো সাবলীল হতে গেলে আরও কথা বলা দরকার। সামনাসামনি, মুখোমুখি, পাশাপাশি, কাছাকাছি বসে কথা দেয়া-নেয়া উচিত।
ভালোবাসি না বললেও ছেড়ে যাওয়া যাবে না। মুখে বলা ভালোবাসার সাথে অন্তর আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করা, লালিত করা ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই, একটুও না। একফোঁটাও না।

– তোমার দূরসম্পর্কের বউ বলেও তো কেউ একজন বাড়িতে আছে। তার জন্য হলেও মাসে একবার এসে দেখা দিয়ে যেও।
বড় ভাবি, মা, ভাই সবার কাছ থেকে এমন হাজারটা খোঁচা শুনে ফের কর্মস্থলে ফিরে গিয়েছিলো গোফরান। সাত পাউন্ডের একটা কেক, এক্সক্লুসিভ ডেকোরেশন, লাখ টাকার উপহার দিয়েও একজনকে খুশি করানো যায়নি, আর সেখানে ভেঙে যাওয়া একটা কেক, দুটো সস্তা মোমবাতি নিভিয়েও কেমন চমৎকার হাসিটা লেপ্টে ছিল ওই মেয়েটির মুখে সে তা দেখেছিলো ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকার সময়। আর তখনি মনে হয়েছিলো জীবন তাকে সুন্দর একটা সুযোগ দিয়েছে। সে এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করবে না।

অতঃপর কাছাকাছি বসে কথা দেয়া-নেয়ার লেনদেনটা পাকাপোক্তভাবে মীমাংসা হয়েছিল রাঙামাটির সেই বাড়িটিতেই। মিথ্যে বলে তাকে রাঙামাটির বাড়িটাতে নিয়ে এসে বোকাবোকা একটা হাসি দিয়ে,
– আমার কিচ্ছু হয়নি।
বলা মানুষটার উপর যতটা রাগ ছিল সবটা তার গুমোট চেহারার আড়ালে হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা দেখার পর উবে গিয়েছিলো তাসনিয়ার।
কাঁদতে গিয়ে সে যখন হেসে দিল তখন তাকে অন্যরকম একটা মানুষ মনে হয়েছিলো গোফরানের। এই মেয়েটা গোমড়ামুখো পরস্ত্রী মিনির মা হয়ে উঠা বুদ্ধিমতী, সংযমী তাসনিয়া তানজিম নয়। মুঠোফোনে আলাপ হওয়া কলকলিয়ে হাসা তার চঞ্চল কোমলমতি প্রেমিকা। তারপর দুটো শরীর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার মতো একটা শক্তপোক্ত আলিঙ্গন, কয়েকটা এলোপাতাড়ি চুমু আর কড়াপড়া আঙুলের ছোঁয়ায় তাসনিয়ার গালটা যখন রাঙা হয়ে উঠছিলো তখন তার মনে হলো,
– জন্মদিনের উপহার এর চাইতে ভালো আর কি হতে পারে?

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here