হৃদয়ের_রং_জানে_না <প্রথম পর্ব> #ঈপ্সিতা_মিত্র

0
309

#হৃদয়ের_রং_জানে_না <প্রথম পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
শান্তিনিকেতনের সকালটা আজ বৃষ্টিতে ভেজা | ঝোড়ো হাওয়ায় এলোমেলো | রূপকথার ঘরের পড়ার টেবিলে রাখা ডাইরির পাতাগুলোও সেই ঝোড়ো হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মাঝে মাঝেই ওলোট পালট হয়ে যাচ্ছে | আজ রবিবার | ও যেই স্কুলটায় পড়ায় তার টিচাররা লেডিজ হোস্টেলটা ফাঁকা করে দিয়ে নিজের নিজের বাড়ি চলে গেছে কাল বিকেলেই | এখন আবার দুদিন স্কুল ছুটি | সোম মঙ্গল কাটিয়েই তাই সবাই ফিরবে | কিন্তু রূপকথা , এই ছুটির দিনগুলোতেও এই ফাঁকা হোস্টেলটা ছাড়েনি | আসলে ফিরে যাওয়ার ঠিকানা বলতে তো কিছু নেই ওর | ছোটবেলায়ই বাবা মা একটা একসিডেন্টে মারা গেছিলো | তারপর মামা মামীর কাছে বড়ো হয়েছে | কিন্তু তারা সব সময়ই ওকে বুঝিয়ে এসেছে যে ও হলো ভাগ্নি , পরের মেয়ে , নিজের সন্তান না | আর এই সত্যিটা বুঝতে বুঝতেই টান জিনিসটা কখনো রূপকথার তৈরী হয়নি ওদের ওপর , বা বলা যায় ওরাই তৈরী হতে দেয়নি , ইচ্ছে করেই | আসলে রূপকথার কাস্টাডিটা নিয়েছিল ওর মামা মামী টাকার লোভে | ব্যাঙ্কে রূপকথার বাবা একটা ভালো এমাউন্টের টাকা এম.আই.এস করে রেখেছিলো মেয়ের নামে | আর রূপকথার আঠেরো বছর হওয়ার আগে অব্দি ওর লিগ্যাল গার্জেন এই টাকাটা তুলতে পারতো প্রত্যেক মাসে | তাই কোর্ট থেকে ভাগ্নির কাস্টাডি নিতে বিন্দু মাত্র দেরি করেনি রূপকথার মামা | তবে রূপকথার আঠেরো বছর হওয়ার দিনই এই টাকার সম্পর্কটাও শেষ হয়ে গিয়েছিলো মামা মামীর সাথে | তখন থেকে এমন ব্যবহার শুরু করেছিল ওরা যেন তাড়াতে পারলেই বাঁচে ! আজও মাঝে মাঝে মনে পরে সেই দিনগুলো | রূপকথার জন্য অনেক সময়ে রান্না হতো না ওই বাড়িতে | কলেজের ক্যান্টিন , বা বাইরের হোটেলই ছিল তখন ভরসা | তারপর পুজোর সময় , মামা এক গাল হাসি মুখে কেনাকাটি করে ফিরতো বাড়ির সবার জন্য | ছেলে , মেয়ে , বৌ , এমন কি কাজের লোকটার জন্যও একটা কাপড় বরাদ্য থাকতো ওনার লিস্ট এ | শুধু বাদ পরে যেত রূপকথাই | এখনো ভাবলে ঘটনাগুলো মাঝে মাঝে চোখের কোণটা চিক চিক করে ওঠে রূপকথার , জলে | তবে সেইসব দিনগুলোতে এই মামা মামীর দেয়া কষ্টগুলো ছাড়াও একজন ছিল , যে ওর এই হঠাৎ ভিজে আসা চোখটা মুছে দিতো অনেক সময়ে , ভালো লাগার কিছু মুহূর্ত নিয়ে আসতো জীবনে | অনন্ত | পাশের বাড়ির ছেলেটা বয়সে ওর থেকে পাঁচ বছরের বড়ো হলেও সেই ক্লাস থ্রি থেকেই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড | আর ওদের বাড়িটা ছিল বলেই হয়তো মামা মামীর ওরকম বকাঝকা , বাজে ব্যবহার সহ্য করেও দিনের কিছুটা সময় রূপকথা একটু হলেও মন খুলে হাসতে পারতো | অনন্তর মা তো সত্যি রূপকথাকে নিজের মেয়ে ভাবতো | মামা মামীর বাড়িতে ওর জন্য রান্না না হলে ওর শুকনো মুখটা দেখে কত সময়েই কিছু না বলতেই বুঝে যেত যে ও কিছু খায়নি | তারপর নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দিতো রূপকথাকে | পুজোর সময়ে ,পয়লা বৈশাখে নিজের বাড়ি না হোক , অনন্তর বাড়ি থেকে একটা নতুন ড্রেস হতোই সব সময়ে রূপকথার | আবার ওর স্কুল প্রজেক্ট , পরীক্ষার আগের ইম্পরট্যান্ট নোটস , রেফারেন্স বই অনেক কিছুই কিছু না বলতেই জোগাড় করে দিতো অনন্ত | আজ দু বছর বাদেও তাই ওই ফেলে আসা মুখটা চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায় রূপকথা | খুব স্পষ্ট ভাবে | চঞ্চল দুটো চোখে শান্ত একটা মুখ | অনন্ত |
আচ্ছা সত্যিই কি কোনো ঠিকানা বাকি নেই আর রূপকথার ! অনন্তর বাড়ির দরজা তো সব সময়েই খোলা ওর জন্য | কাকিমা তো আজও ওকে দেখলে হাসি মুখে জড়িয়ে ধরবে | তা ও কেন আর ওই ঠিকানায় ফেরা হয় না রূপকথার ! তা ও কেন দু বছর বাদেও একা হোস্টেলের ঘরটাকেই নিজের মনে হয় ! শান্তিনিকেতনের এই একাকীত্বটাকেই আঁকড়ে ধরে ও ! তাহলে কি মনের দূরত্ব এতটাই বেশি যে দু বছরেও ফিরে যাওয়া যায় না , ফেলে আসা সময়ের কাছে | না কি যাকে ভালোবেসেও দূর থেকে অন্যের হতে দেখতে হয় , সেই কষ্টটার কাছে এই একাকীত্বটাই অনেক সুখের | আজ আবারও এইসব এলোমেলো ভাবনাগুলো বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ার সাথে রূপকথার মনে এসে জমা হলো | আর আজ আবারও নিজের কথাগুলো কাউকে বলতে না পেরে ডায়রিতে লিখে রাখলো রূপকথা | নিজের লোক নেই , কেউ শোনার নেই , আর ওর কাউকে কিছু বলারও নেই | নিজের বলতে শুধু এই শব্দগুলোই তো আছে ওর কাছে | যাদের আঁকড়ে ধরে এক একটা দিন শেষ হয়ে যায় শান্তিনিকেতনে | ভেবে আবারও চোখটা ভিজে এলো | আর এই মুহূর্তেই খোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগলো ওর মুখে আর, আরএকবার আড়াল করে দিলো চোখের জলটা | তখনই হঠাৎ খুব জোড় একটা মেঘ ডেকে উঠলো আকাশে , কিন্তু সেই আওয়াজে রূপকথার ফোনের রিংটোনটা ঢেকে গেলেও আলোটা জলে উঠলো , রূপকথা খেয়াল করলো একটা আননোন নাম্বার ওর মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে | আজকের এই ছুটির দিনে স্কুলের চেনা লোক ছাড়া তো কারোর আর ফোন করার কথা নয় ওকে ! তাহলে এখন হঠাৎ কার মনে পড়লো ! ভেবেই ফোনটা ধরলো রূপকথা , আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকে গেলো |
” রূপকথা ! আমি বলছি | চিনতে পারছিস ? কেমন আছিস মা ?” …… কথাগুলো কানে আসতেই রূপকথার ভেতরটা আবার এলোমেলো হয়ে গেলো যেন | পুরোনো সময় হঠাৎ এসেছে ওর কাছে , নিজে থেকে | কিন্তু কি অদ্ভুত ! দু বছর বাদেও কাকিমার গলার স্বরটা একদম নতুন লাগলো না | মনে হলো যেন কালই কথা হয়েছে ! তাহলে কি এতটা সময় কিছুই না দূরে সরে আসার জন্য ! তাহলে কি ও পারেনি এতোদিনেও মনের দূরত্বটাকে শক্ত করে বাঁধতে ! এসব ভাবতে ভাবতেই উত্তর দিলো , ——- ” কাকিমা ! আমি ভালো আছি | তুমি কেমন আছো ? ”
কথাটা শুনে যেন অনন্তর মার গলার আওয়াজটা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেলো | খুব আস্তে গলায়ই বললো , —— ” আছি ! একরকম |”
এবার আর রূপকথা উদাসীন হয়ে থাকতে পারলো না | এইভাবে কেন উত্তর দিলো কাকিমা ! কথাটা মনে আসতেই জিজ্ঞেস করে উঠলো , —– ” কি হয়েছে তোমার ? গলাটা এরকম কেন শোনাচ্ছে ?”
প্রশ্নটা করেও ফোনের ওপার থেকে কিছুক্ষনের জন্য নিঃস্তব্ধতা ভেসে এলো | তারপর কান্না ভেজা গলায় অনন্তর মা বলে উঠলো , ——– ” অনেক কষ্টে তোর নাম্বারটা জোগাড় করেছি তোর এক কলেজের বন্ধুর কাছ থেকে | জানি হয়তো যোগাযোগ রাখতে চাস না | তা ও ফোন করলাম | আসলে তুই যদি আসিস তাহলে হয়তো অনন্ত একটু ঠিক হবে | একটু হয়তো কথা বলবে আবার আগের মতন | তাই !”
রূপকথা কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গেলো ! কি সব বলছে কাকিমা ? অনন্ত ঠিক হবে মানেটা কি ! ভেবেই আবার জিজ্ঞেস করে উঠলো , —— ” তুমি কি বলছো ? অনন্তর কি হয়েছে ? আর তুমি কাঁদছো কেন ?”
কথাটা শুনে আবারও কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো অনন্তর মা | রূপকথা বুঝলো কান্নাটাকে কোনোভাবে নিজের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা করছে এই সময়ে | তারপর আবার একটু কথা সাজিয়ে বলে উঠলো , ——– ” অনন্তর ছ মাস আগে একটা একসিডেন্ট হয়েছে রূপকথা | ও আর চলতে পারে না | এখন সারাদিন হুইল চেয়ারে নিজের ঘরেই জীবনটা কাটছে ছেলেটার | দরকার ছাড়া বাইরের কেউ তো দূরে থাক , আমার সাথেও খুব একটা কথা বলে না ও | কেমন যেন নিজের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রত্যেক দিন | তাই তোকে একবার জানালাম | একটা সময় তো তুই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলিস | হয়তো তুই আসলে একটু নর্মাল হবে ছেলেটা ! তাই যদি পারিস তাহলে একবার দেখা করে যাস | না , জোর করছি না | যদি পারিস , তাহলেই |” … কথাটা বলেই অনন্তর মা আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিলো | রূপকথা তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে | কান থেকে ফোনটা ছাড়তে পারেনি | যেন কিছুক্ষনের জন্য পাথর হয়ে গেছে ও | কিছু ভাবতে পারছে না ! এতদিন বাদে এ কি খবর এলো ওর কাছে ! যাকে এতো ভালোবাসতো , তাকে তো সব সময় ভালোই দেখতে চেয়েছে রূপকথা | দূরে থেকেও সব সময় এটাই চেয়েছে যে অনন্তর মুখে যেন রোজ হাসি থাকে | তাহলে হঠাৎ এসব কি হলো ! ওই প্রাণবন্ত ছেলেটা আজ হুইল চেয়ারে ! কথাটা ভেবেই রূপকথা আঁতকে উঠলো | ভয়ে চোখটা বন্ধ করে ফেললো | আর তখনি চোখের সামনে ভেসে এলো সেই পুরোনো মুখটা , আবার | সেই চঞ্চল চোখ দুটো যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে এখন | রূপকথা এরপর আর এক সেকেন্ডও দেরি করলো না | আলমারি থেকে ব্যাগটা বার করে কিছু জামা কাপড় আর পার্সটা ঢুকিয়ে ফাঁকা হোস্টেলটাকে পুরোপুরি ফাঁকা করে বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো , পুরোনো ঠিকানার উদ্দেশ্যে |
<২>
ট্রেনটা এখন বোলপুর স্টেশন পার করে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে | চলন্ত রাস্তা , ধানক্ষেত , গাছপালা গুলো দেখতে দেখতে রূপকথার হঠাৎ মনে হচ্ছে সময়ও কত তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় চোখের পলকে |এই ট্রেনের জানলায় দেখা দৃশ্যগুলোর মতন জীবনটাও কেমন বদলে যায় মিনিট সেকেন্ডে | এই যেমন সেই কলকাতায় থাকা দিনগুলোর সময় | রূপকথা কত বেহিসেবি ছিল | ভাবনাগুলো বাস্তব থেকে দূরে যেন কোনো রূপকথার দেশেই ঘুরে ফিরে বেড়াতো | তখন মামা মামী যতই খারাপ ব্যবহার করুক , সারাক্ষন এইভাবে মন খারাপ হয়ে থাকতো না ওর | আসলে মনে হতো এতো খারাপের ভিড়ে একটা ভালো তো সব সময় আছে সঙ্গে , যার নাম অনন্ত | যার সাথে সারাদিনে দশ মিনিট কথা হলেও ভালো লাগা ছড়িয়ে যায় মনটায় | এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না অনন্তর এই এক্সিডেন্টটার কথা ! ওকে গিয়ে সত্যি একটা হুইল চেয়ারে বসে থাকতে দেখতে হবে ! ওই ছেলেটাই তো আর কিছুটা সময় আগেও কত একটিভ ছিল | এখনো মনে আছে রূপকথার মাস্টার্স এর জন্য ফর্ম তোলার দিনের কথাটা | এক ইউনিভার্সিটি থেকে আরেক ইউনিভার্সিটি , সমানে দৌড়েছিলো ছেলেটা ওর সাথে | রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে লাইন দেয়া থেকে শুরু করে ফর্ম জমা দেয়ার দিন অব্দি , সব সময় পাশে ছিল ওর | নিজে তখন এম.বি.বি.এস শেষ করে এম.ডি তে সবে ঢুকেছে | কিন্তু তা ও নিজের পড়াশুনা ছেড়ে শুধু রূপকথার জন্য তিনটে দিন নষ্ট করেছিল অনন্ত | তবে সারাদিন অতো দৌড়াদৌড়ির পর রূপকথা যখন একটু ইতঃস্তত করে ওকে বলেছিলো , —— ” তুমি আর আমার জন্য কত করবে বলো তো ? তুমি সঙ্গে না থাকলে তিনটে ইউনিভার্সিটির ফর্ম একদিনে কখনো জমা দিতে পারতাম না | সত্যি |” … তখন অনন্ত একটু সময় নিয়ে ভেবে হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিলো , ——– ” এমনি এমনি তো করিনি | তোর থেকে পাওয়ানাটা আমি ঠিক বুঝে নেবো | এই রবিবার আমাদের বাড়িতে কষা মাংসটা তুই রাঁধবি , ওকে | সত্যি বলছি , ওই ফার্স্ট জানুয়ারির দিন করেছিলিস , আজও মুখে লেগে আছে | ওটা খাওয়ার জন্যই তো এতো দৌড়াদৌড়ি করলাম |”…সেইদিনের মতন আজও কথাটা মনে হতেই রূপকথার মুখে একটা হালকা হাসি চলে এলো এখন | আর ট্রেনটা তখনই গুশকরা স্টেশনে এসে থামলো | রূপকথা আবার অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো যেন | তবে এই থমকে যাওয়া স্টেশনটাকে দেখে আরেকটা ঘটনা মনে পরে গেলো হঠাৎ আবার | যেইদিন অনন্তর বাবার হার্ট এটার্কটা হলো ! সেইদিন অনন্তও তো এইভাবে যেন থমকে গেছিলো কয়েকদিন | মেডিক্যাল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারটা সবে শেষ হয়েছিল ওর | রূপকথার তখন ক্লাস নাইন | ওদের পাড়ায় একটা বিয়ে বাড়ি ছিল সেই রাতে , এখনো মনে আছে রূপকথার | সুস্থ সবল হাসি খুশি মানুষটা ওর সামনেই বিয়ে বাড়ি খেয়ে এলো | তারপর রাতে হঠাৎ বুকে ব্যাথা | কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব শেষ | অনন্ত মুখাগ্নি করে এসে ওই সাদা কাপড়টা জড়িয়ে কেমন যেন থম মেরে বসেছিল ওদের সেই চিলেকোঠায় | এলোমেলো চুল, স্থির দৃষ্টি , দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো ঝড় থেকে উঠে এসেছে | সেদিন বাড়ির একটা লোকের সঙ্গেও কোনো কথা বলেনি ছেলেটা | কান্নাটাও যেন আসছিলো না ওর | রূপকথার সেই দৃশ্য দেখে জীবনে প্রথম একটা ভয় এসে জড়ো হয়েছিল মনে | অনন্তকে হারিয়ে ফেলার ভয় | ওর কথাগুলো , ওর হাসি , ওর রাগ সবকিছুকে হারিয়ে ফেলার ভয় | সেইদিন তাই রূপকথা ওই চিলেকোঠার ঘরটায় অনন্তর পাশে এসে বসেছিল | চুপচাপ |তারপর খুব শক্ত করে অনন্তর হাতটা আঁকড়ে ধরেছিলো | কোনো কথা , কোনো স্বান্তনা আসছিলো না ওর | শুধু মনে হচ্ছিলো আজ অনন্তর যা হারিয়েছে , সেটা অনেকদিন আগেই রূপকথার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে | বাবা , মা জীবনে কতটা জায়গা জুড়ে থাকে , সেটা রূপকথা নিজের ফাঁকা জীবনটা দিয়ে রোজ বুঝতে পারে | অনন্তও তাই হয়তো আর কারোর সাথে কোনো কথা না বললেও শুধু রূপকথাকেই বলেছিলো প্রথম , ———- ” বাবাকে ছাই হয়ে যেতে দেখলাম চোখের সামনে | তারপর ভাসিয়ে এলাম | আমার সত্যি আজ সব শেষ হয়ে গেলো রূপকথা | সব কিছু |”
কথাগুলো শুনে রূপকথার সেদিন আর কোনো কথা আসছিলো না যেন | শুধু চোখের সামনে মাঝে মাঝে নিজের মা বাবার আবছা মুখ দুটো ভেসে আসছিলো , বার বার | চোখটা জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো ওর | রাগ , কষ্ট , খারাপ লাগা সব কিছু এসে একসাথে জড়ো হচ্ছিলো মনে | যেই যন্ত্রটাকে ও রোজ নিজের মধ্যে নিয়ে বাঁচে , আজ থেকে সেই যন্ত্রটা অনন্তকেও ভোগ করতে হবে | এটা ভেবেই চোখটা জলে ভিজে যাচ্ছিলো | আর সঙ্গে একটা ভয় হচ্ছিলো শুধু , যে এই শেষটা দেখে অনন্ত নিজে শেষ হয়ে যাবে না তো ! ও যদি আর কক্ষনো সামলে উঠতে না পারে ! এলোমেলো হয়ে যায় ! তাহলে কি হবে ! কথাগুলো মনে হতেই তাই সেদিন শক্ত করে ধরে রেখেছিলো ও অনন্তর হাতটা, নিজের হাতের মধ্যে | তারপর প্রায় এক মাস অনন্তর পাশে ছায়ার মতন ছিল রূপকথা | অনন্ত তো প্রথম দু দিন কিছুই খায়নি এরপর | একটা ভাতও মুখে তোলেনি | সবাই জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারেনি ওকে | তবে তিন দিনের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ খেয়াল করেছিল রূপকথার শুকনো মুখটা | কেমন যেন ফ্যাকাসে লেগেছিলো মেয়েটাকে | হঠাৎ তাই নিজের কষ্টটা ভুলে সেই মুহূর্তে রূপকথার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল , ——- ” তোকে এরকম কেন লাগছে ? তোর মামা মামী কালও কি রান্না করেনি তোর ?”
রূপকথা কথাটা শুনে একটু থেমে উত্তর দিয়েছিলো , —– ” করেছিল |” ..
অনন্ত এবার একটু অবাক হয়েই বলেছিলো , —— ” তাহলে তোকে এরকম কেন লাগছে ? তুই খাসনি ?”
রূপকথা এটা শুনেও একটা শব্দেই উত্তর দিয়েছিলো , —— ” না |
অনন্ত এবার আরো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল , ——- ” কিন্তু খাসনি কেন ?”
রূপকথা এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো , ——– ” তুমি খাওনি , তাই খাইনি |”
না , এরপর আর সেদিন অনন্ত কোনো প্রশ্ন করেনি ওকে | শুধু রূপকথার হাতটা শক্ত করে ধরে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে এসেছিলো | তারপর মা কে ডেকে বলেছিলো , —— ” আমাদের দুজনকে খেতে দাও | আর সরি | এরপর আর কখনো এইভাবে না খেয়ে থাকবো না |” … আসলে সেদিন অনন্ত কথাগুলো মা কে শুনিয়ে রূপকথাকেই বলেছিলো | হয়তো ও বুঝেছিলো যে ওর ভালো খারাপ থাকার ওপর রূপকথার ভালো খারাপ থাকাটা নির্ভর করে | আচ্ছা , অনন্ত কি সত্যিই কখনো বুঝেছে রূপকথাকে ! ওর পছন্দ , অপছন্দ , মন খারাপ , আনন্দ সব কিছু বুঝলেও ওকে কি কখনো বুঝেছে ! আজও মাঝে মাঝে প্রশ্নটা এসে মনে ভিড় করে রূপকথার | আর উত্তরে শুধু একটা ‘না’ ই ভাবতে হয় ওকে | আর সত্যিই তো , বুঝলে কি আর এই দু বছর এতো দূরে থাকতে হতো রূপকথাকে !কথাটা মনে হতেই আনমনে খেয়াল করলো ট্রেনটা গুশকরা স্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা দূর , অনেক্ষন আগেই | তবে রূপকথা এখনো যেন ওই থমকে যাওয়া স্টেশনের মতন সেই থমকে যাওয়া পুরোনো দিনগুলোতে আটকে আছে ,বহু সময় ধরেই |
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে কাল। এইরকম নানান স্বাদের ভালোবাসার গল্প পড়তে চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন আমার সম্পূর্ন নতুন দুটি উপন্যাস ‘ শহরের উষ্ণতম দিনে ‘ এবং অগোছালো মন। দুটো বই এর পিডিএফ সংগ্রহ করলে মূল্য ১০০ টাকা। আর যে কোনো একটি বই এর পিডিএফ সংগ্রহ করলে মূল্য ৫০ টাকা মাত্র। পেমেন্ট ডিটেলস জানার জন্য এবং বইয়ের পিডিএফ সংগ্রহ করার জন্য মেসেজ করতে পারেন আমার হোয়াটস অ্যাপ নাম্বার 089103 33272 তে। পেমেন্ট করে একটা স্ক্রিন শট পাঠিয়ে দিলে বইয়ের পিডিএফ পাঠিয়ে দেয়া হবে হোয়াটস অ্যাপে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here