#হৃদয়ের_রং_জানে_না <শেষ পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৫>
প্রায় এক মাস কেটে গেছে এরপর | আজ মঙ্গলবার | সকাল সকালই হাওড়া থেকে একটা ট্রেন ধরলো অনন্ত বোলপুর যাওয়ার জন্য | ব্যাস , আর কিছুক্ষনের অপেক্ষা | তারপর আবার সেই মেয়েটার মুখোমুখি | তবে আজ শুধু রূপকথাকে দেখার জন্যই না , রূপকথার মনে থাকা সেই অচেনা মানুষটাকে চেনার জন্যও অনন্ত বোলপুর যাচ্ছে | আসলে এই একটা মাস সহজ ছিল না অনন্তর কাছে | প্রত্যেকটা দিন , প্রত্যেকটা সেকেন্ড কেটেছে একটা হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে | বার বার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন এসে ভিড় করেছে , যে কে সেই ছেলেটা যার জন্য রূপকথা আর একবার কলকাতা ছেড়ে দিলো ! কি নাম তার ? কোথায় আলাপ ? কতদিন ধরে চেনা ? আর সে কি এমন করলো যার জন্য রূপকথার মনে এতটা জায়গা দখল করে রয়ে গেলো এতগুলো দিন ধরে ! একতরফা রূপকথা ওকে কখন এতটা ভালোবেসে ফেললো যে অনন্তর ভালোবাসা, ফিলিংসগুলো ওর আর চোখেই পড়লো না ! জিজ্ঞাসারা অনেক ছিল | কিন্তু উত্তর দেয়ার মতন কেউ ছিল না | এর মধ্যে মিথিলা আবার বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল ওকে | অনন্ত নাম্বারটা দেখে আর ধরেনি | সেদিন বিকেলে রেস্টুরেন্ট থেকে রূপকথা বেড়িয়ে আসার পর অনন্তও আর বেশিক্ষন থাকেনি মিথিলার সামনে | মিথিলা তার মধ্যেই অনেক কিছু বলার চেষ্টা করেছিল ওকে | অনেক কথা সাজিয়ে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল বোধ হয় | তবে ওর সেই মুহূর্তে কিছুই কানে ঢোকেনি আর | রূপকথার চলে যাওয়ার আগে যে শকটা অনন্তকে দিয়ে গিয়েছিলো , তার আফটার এফেক্টে ওর কান মাথা সব কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো প্রায় | যাই হোক, এরপর মিথিলা ওকে বার বার ফোন করে না পেয়ে একদিন সোজা হসপিটালে এসে হাজির হয়েছিল দেখা করার জন্য | অনন্ত চেম্বারের সামনে পেশেন্টদের লাইনের ভিড়ে হঠাৎ নিজের এক্সকে দেখে একটু ইতঃস্তত হয়ে গিয়েছিলো সেই মুহূর্তে | তবে আজ আর কিছু না বলে থাকা যাবে না এটাও বুঝেছিলো মনে মনে | তাই , মিথিলাকে সময় করে কিছুক্ষনের জন্য ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে বসেছিল | তারপর কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে একটু চুপ থাকার পর জিজ্ঞাসা করেছিল ,
” কি হয়েছে ? কি বলার আছে তোমার ?”
মিথিলার প্রশ্নটা শুনে একটু থেমে থেমে উত্তর দিয়েছিলো ,
” আর একবার নতুন করে শুরু করা যায় না ? আমি জানি আমি খুব খারাপ সময়ে রিলেশনটা ভেঙে দিয়েছিলাম | মা বাবা আমাকে চাপ দিয়েছিলো খুব | কিন্তু এখন আর কোনো প্রব্লেম নেই | তুমি যদি পুরোনো কথা ভুলে আর একবার !”
না, মিথিলার কথাটাকে আর শেষ হতে দেয়নি অনন্ত |ওকে মাঝখানে থামিয়ে খুব দৃঢ় গলায় বলে উঠেছিল ,
” আর একবার সম্ভব না | আসলে আমরা যদি দুজনে দুজনকে সত্যি ভালোবাসতাম তাহলে বাড়ির হাজার ঝামেলা থাকলেও তুমি আমায় ছেড়ে ওই সময়ে যেতে পারতে না , আর আমিও তোমাকে সেই সময় একবার হলেও আটকানোর চেষ্টা করতাম | এতো সহজে ভাঙতে দিতাম না কিছু | কারণ আমাদের মধ্যে যেটা ছিল সেটা কিছুদিনের এট্রাকশন , একে অপরকে বাইরে থেকে দেখে | ব্যাস | আর সেই এট্রাকশনটাও কিছুদিন বাদে কেটে গেছিলো বোধ হয় | তখন তো মনে হতো এটা রিলেশন না , রোজের একটা নিয়ম রক্ষা | ওই মাসে একদিন সময় করে দু ঘন্টার জন্য রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া , দিনের শেষে দশ মিনিট ফোনে কথা , ঐটুকুই | আর সেই জন্যই হয়তো আমাদের ব্রেকআপের পর আমি তোমাকে কখনো মিস করিনি আর | ভুলেও তোমার ফোন নাম্বারটা ডায়েল করিনি কখনো ! ” …কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে অনন্ত এবার থামলো | কিন্ত খেয়াল করলো এর মধ্যে মিথিলার মুখটা কেমন অন্ধকার হয়ে গেছে ওর সামনে | তবে ওর চুপ করে গেলে হবে না | তাই কিছু কথা ভেবে আবার বলে উঠলো ,
” আমি জানি তোমার মা বাবা খুব তাড়াতাড়ি তোমার বিয়ে দিতে চায় | আর এরেঞ্জ ম্যারেজের থেকে তুমি আমার মতন অনেকদিনের চেনা কাউকেই বিয়ে করতে কম্ফোর্টেবল | আর তার ওপর আমি তো আবার সুস্থ হয়ে গিয়েছি , প্র্যাকটিস শুরু করেছি | তোমার মা বাবারও তাই আর আপত্তি থাকার কথা না | আর সেই জন্যই তুমি আবার যোগাযোগ করেছো | তবে কি বলো তো ভালোবাসা এতো হিসেব করে হয় না | এটা আজ আমি বুঝি | কারোর জন্য অপেক্ষা , তাকে পাওয়ার চেষ্টা , না পাওয়ার যন্ত্রনা , হারিয়ে ফেলার আক্ষেপ , সবটাই এখন আমি বুঝি | যাই হোক, আমি চাই তুমি নিজের জন্য খুব ভালো একটা লাইফ পার্টনার খুঁজে পাও | আর খুব ভালো থাকো | তবে সেই মানুষটা আমি নোই |”
কথাটা শেষ করেই অনন্ত এবার উঠে যাচ্ছিলো মিথিলার সামনে থেকে | তবে ওর আচমকা একটা প্রশ্নে থেমে গেলো |
” তুমি কি রূপকথাকে ভালোবাসো ?” কথাটা সেই মুহূর্তে অনন্তর চোখের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করেছিল মিথিলা | তবে অনন্ত এর কোনো উত্তর না দিয়ে চোখটা নামিয়ে নিয়েছিল চুপচাপ | মিথিলা তখন একটু জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলেছিলো ,
” বুঝেছি | ইট’স টু পার্সোনাল , তাই উত্তর দেবে না | তবে নীরবতা কিন্তু সম্মতির লক্ষণ | যাই হোক, যদি ভালোবেসেই থাকো তাহলে সেটা মনে না রেখে বলে দিয়ো | আসলাম | আর কখনো ফোন বা ম্যাসেজ করে যোগাযোগ করবো না আমি | এই শেষ | তুমিও ভালো থেকো |”
কথাগুলো বলেই সেইদিন মিথিলা চলে গিয়েছিলো | তবে ইচ্ছে থাকলেও অনন্তকে পুরো সত্যিটা বলে যেতে পারেনি ও , যে দু বছর আগে মিথিলাই রূপকথাকে কলকাতা ছাড়তে বলেছিলো | অনন্তর চোখে নিজেকে আর ছোট করতে পারবে না আসলে |
কিন্তু মিথিলা চলে যাওয়ার পরও অনন্ত সেই মুহূর্তে চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারেনি | বেশ কিছুক্ষন একা একা ক্যান্টিনে বসে একটা কথাই ভাবছিলো যে, মিথিলাও বুঝে গেলো অনন্তর ভালোবাসাকে ! শুধু যার বোঝার সে ই চোখ বন্ধ করে রইলো | আচ্ছা , রূপকথার সেই চোখ কি অনন্তর জন্য কখনোই খুলবে না আর !
প্রশ্নটা মনে আসতেই হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি লাগলো শরীরে | ট্রেনটা এতক্ষনে বোলপুর স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে | আর অনন্তও সেই পুরোনো ফ্ল্যাশব্যাক থেকে বর্তমানে ফিরে এসেছে | সত্যি, চলন্ত ট্রেন , তার পাশে চলে যাওয়া দুরন্ত রাস্তারা , ধানক্ষেত , লাল মাটি যে কত পুরোনো দিন মনে করিয়ে দিতে পারে , সেটা একমাত্র জানলার ধারের সিটে বসে থাকা একলা মানুষটাই জানে |
যাই হোক , অনন্ত আর সময় নষ্ট না করে বর্তমানে এগিয়ে গেলো এবার | স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্সায় উঠে কুড়ি মিনিটের মধ্যে লাল মাটির আঁকা বাঁকা রাস্তা পেরিয়ে ও এসে হাজির হলো রূপকথাদের স্কুলের সামনে | তারপর মোবাইলটা বার করে সেই চেনা নম্বরটা ডায়েল করলো প্রায় এক মাস বাদে | হ্যাঁ, এতদিন অনন্ত রূপকথার সাথে একবারও যোগাযোগ করেনি | আসলে রূপকথা যে ওকে ভালোবাসে না , রূপকথার জীবনে ওর থেকেও বেশি অন্য কেউ ইম্পরট্যান্ট এই সত্যিটা ও কিছুতেই একসেপ্ট করতে পারছিলো না ভেতরে ভেতরে | তবে রূপকথার জন্য জমে থাকা ফিলিংসগুলোকে ভোলাও যে ওর পক্ষে সম্ভব না সেটাও এই এক মাসে খুব ভালো করে বুঝে গেছে অনন্ত | তাই নিজের মনের সাথে অনেক পরামর্শ করে আজ এখানে আসা | দুজনের একসাথে থাকার জন্য একজনের ভালোবাসাই তো যথেষ্ট | রূপকথার মনে যে ই থাক , জীবনে অনন্ত থাকুক | আর কতদিন একতরফা ভালোবেসে একা একা এইভাবে এই শান্তিনিকেতনে পরে থাকবে ও ! যেই মহান ছেলেটা ওর জন্য কখনো ভাবলোই না ! ওর ইম্পর্টেন্সটাই বুঝলো না , তার জন্য এইভাবে নিজের লাইফটা কেন শেষ করবে রূপকথা ! অনন্ত ওকে আজ বোঝাবে | এতদিনের জমাট ভালোবাসাকে এক্সপ্রেস করবে রূপকথার সামনে , যেটা সেইদিন ওই কফি শপে বলতে পারিনি , আজ সেটা এই শান্তিনিকেতনে বলে দেবে | জানে , রূপকথা হয়তো কখনোই ওকে ভালোবাসা ফেরত দিতে পারবে না | সারা জীবন ও শুধু একটা ভালো বন্ধুর জায়গায়ই থাকবে | কিন্তু তা ও এট লিস্ট সঙ্গে তো থাকবে | আর দিনের পর দিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে অনন্তর ভালোবাসা , ফিলিংসগুলো দেখতে দেখতে , হয়তো রূপকথাও কখনো ওকে ভালোবেসে ফেলতে পারে ! বিয়ের জন্যও রাজি হয়ে যেতে পারে ! আর যদি সেসব না ও হয় , তাহলেও রূপকথা অন্তত এটা তো জানবে যে এই পৃথিবীতে এমন একজন আছে যে শুধু রূপকথার জন্যই ভাবে | যার জীবনটা রূপকথা ছাড়া ইনকমপ্লিট | এই জানাটাও তো দরকার | তাতে যদি ওর একাকীত্বটা দূর হয় ! অনন্ত যদি এটুকুও করতে পারে , তাহলেই বা কম কি ! তাই আর এই লুকোচুরি খেলা না | বন্ধুত্বের আড়ালে নিজের আসল মনটাকে আর লুকিয়ে রাখবে না অনন্ত | রূপকথাকে জানিয়ে দেবে ওর সব কথা , ওর মনের গোপনটা |
আর নিজেও শুনবে রূপকথার কথা | যেই কথাগুলো ও এতদিন কাউকে বলতে পারেনি | দু বছর আগে সেই ছেলেটা ঠিক কি এমন করেছিল , যার জন্য একটা মেয়ে এইভাবে একা হয়ে যেতে পারে ! ইশ , ওই সময় তো অনন্ত নিজেও নিজের কেরিয়ার , মিথিলা এইসব নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতো যে রূপকথাকে ফোন করারও সময় পেতো না দিনের পর দিন | নিজেই তো রূপকথার সঙ্গে যোগাযোগটা কমিয়ে দিয়েছিলো | তাই হয়তো রূপকথা কখনো ওই ছেলেটার ব্যাপারে কোনো কথা শেয়ার করতে পারেনি অনন্তকে | দোষটা তো ওরই | যদি তখন ও রূপকথাকে শক্ত করে ধরে থাকতো , তাহলে একটা বাইরের ছেলে কখনোই ওকে এতটা হার্ট করতে পারতো না | ও যদি সেই সময় নিজের মধ্যে হারিয়ে না যেত, রূপকথার পাশে থাকতো আগের মতন , তাহলে হয়তো এই মাঝের দুবছর ওদের জীবনে আসতোই না কখনো ! আজকাল তো অনেক সময় এটাই মনে হয় অনন্তর , যে ভাগ্যিস ওই এক্সিডেন্টটা হয়েছিল ওর লাইফে | নইলে তো রূপকথা সত্যি আর কলকাতা ফিরতো না | সারা জীবনে এই মেয়েটার সাথে আর কখনোই দেখা হতো না ওর | যাই হোক , এইসব ভাবনার ভিড়েই কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপার থেকে সেই চেনা গলাটা ভেসে এলো অনন্তর কানে ,
” হ্যালো , তুমি ! কেমন আছো ? রাগ কমলো তাহলে ?” —– রূপকথা বেশ অবাক হয়েই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করলো একসঙ্গে |
অনন্ত দু সেকেন্ড চুপ থেকে উত্তর দিলো ,
” তোর ওপর রেগে থাকা সম্ভব নয় এটা জানিস | যাই হোক , এখন দেখা করা যাবে ? আমি তোদের স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে |”
রূপকথা এবার সত্যি আকাশ থেকে পড়লো যেন ! অনন্ত এখানে চলে এসেছে ! আর একবার ওকে সামনাসামনি দেখতে পাবে ! কথাটা ভেবেই নিজেকে একটু এলোমেলো লাগছিলো ওর | যাই হোক, এসব ভাবনার ভিড়েই কিছু কথা সাজিয়ে বললো ,
” তুমি এতো দূর চলে এলে আর আমাকে আগে একবারও ফোন করে জানালে না ! তাহলে আজ আমি ছুটি নিতাম | যাই হোক , আমি দারোয়ানকে পাঠাচ্ছি | ও তোমাকে হোস্টেলে আমার ঘরে নিয়ে যাবে | আসলে এখন একটা ক্লাস নেয়ার আছে | তুমি একটু ওয়েট করো হোস্টেলে | ক্লাসটা শেষ করেই আমি আসছি |”
রূপকথার কথাটা শেষ করে ফোনটা রাখার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই স্কুলের একজন দারোয়ান এসে হাজির হলো অনন্তর সামনে | হোস্টেলটা স্কুলের থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ | দারোয়ানের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে বলতেই সেটায় চলে এলো | রূপকথার ঘরটা দোতলায় | দারোয়ান গিয়ে ওর ঘরের তালাটা খুলে দিলো অনন্তর বসার জন্য | আর অনন্ত অবশেষে এতদিন বাদে দেখতে পেলো রূপকথার দু বছরের ঠিকানাটা | ছোট্ট একটা ঘর | সামনে খোলা জানলা | ফার্নিচার বলতে , একটা তক্তপোষ , একটা চেয়ার টেবিল , আর পুরোনো আমলের একখানা আলমারি , ব্যাস | এইটুকুর মধ্যে রূপকথা এতদিন ধরে কাটিয়ে যাচ্ছে নিজের জীবন ! কলকাতার ভিড় ছেড়ে শান্ত, চুপচাপ একটা জীবন ! এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরের এদিক সেদিন ঘুরছিলো অনন্ত |
আর তখনই হঠাৎ টেবিলে রাখা একটা গোলাপি রঙের ডায়রির দিকে চোখ পরে গেলো ওর | এটা সেই পুরোনো ডায়রিটা না ! অনেকবার এই ডায়রিটা লিখতে দেখেছে ও রূপকথাকে | তবে অনন্তকে সামনে আসতে দেখলেই লেখা বন্ধ করে দিতো সব সময় | যেন কিছু একটা লুকোনোর চেষ্টা করতো ডায়রিটায় ! কথাগুলো মনে আসতেই হঠাৎ আর একটা কথাও মাথায় এলো ওর | আচ্ছা , এই ডায়রিতে ওই অচেনা ছেলেটার ব্যাপারে কিছু লেখা নেই তো ! অনন্তর মনে এতদিন ধরে যেই প্রশ্নগুলো ছিল , তার উত্তর এই ডায়রির পাতায় নেই তো ! কথাটা ভাবা মাত্রই অনন্ত টেবিল থেকে ডায়রিটা তুলে নিলো সঙ্গে সঙ্গে | তারপর অনেক প্রশ্নের ভিড়ে ডায়রির প্রথম পাতা খুলে বসলো | এরপর পাতার পর পাতা যত উল্টোতে থাকলো, রূপকথার ইনকমপ্লিট একতরফা গল্পটা যেন অনন্তর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভাসতে শুরু করলো | সেই অষ্টমীর সকাল , নীল রঙের শাড়ি , লক্ষি পুজোর সন্ধ্যে , মিথিলার সাথে আলাপ , রূপকথাকে মিথিলার সেই একটা ফোন কল , ওর কলকাতা ছাড়ার ডিসিশন , শান্তিনিকেতনে এই চাকরি , সব কিছুর মাঝে অনন্ত ! রূপকথার একতরফা ভালোবাসার নাম অনন্ত ! এতগুলো দিন ধরে চুপচাপ নিঃশব্দে তার মানে রূপকথা এই যন্ত্রটা সহ্য করে গেছে ওর ভুলের জন্য | নিজের গালে নিজেকেই একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে অনন্তর এখন | এতটা ইনসেন্সিটিভি , এতটা অন্ধ ও ঠিক কবে হলো যে রূপকথাকে এতো কাছ থেকে দেখেও ওর ইমোশনগুলো বুঝতে পারলো না একবারও ! এইভাবে দিনের পর দিন হার্ট করে গেলো ওকে | ওর চুপচাপ থমকে যাওয়া জীবন , গুমরে গুমরে থাকার কারণ সবটাই অনন্তর জন্য | কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ওর চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো হঠাৎ জলে , আর তখনই রূপকথার গলার আওয়াজ কানে এলো ,
” সরি অনন্ত , অনেকক্ষন ধরে অপেক্ষা করতো হলো না ! আসলে ক্লাসটা শেষ হতে একটু দেরি হলো আজ , তাই !”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলতে বলতে ও দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এখন | তবে কথাগুলো এই মুহূর্তে আর শেষ করতে পারলো না ঠিক | অনন্তর হাতে নিজের ডায়রিটা দেখে ও থমকে গেলো হঠাৎ | অনন্তর চোখগুলোও এখন একদম স্থির | দৃষ্টিতে কেমন অন্য | নিস্পলকভাবে রূপকথার দিকে তাকিয়ে এখন ও | যেন রূপকথা নিজের মনের আয়নাটা ধরে আছে ওর সামনে , যেখানে আজ সব স্পষ্ট | কথাটা ভেবেই রূপকথার কেমন এলোমেলো লাগছে নিজেকে | তার মানে কি অনন্ত ডায়রিটা পরে ফেলেছে ! ওর এতদিনের তৈরী আড়ালটা ভেঙে গেছে আজ ! সবকিছু জেনে ফেলেছে ও ! কথাগুলো মনে আসতেই ও দরজা থেকে দৌড়ে এসে অনন্তর হাত থেকে ডায়রিটা কেড়ে নিলো | তারপর আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো | মনে হচ্ছে অনন্তর থেকে নিজেকে যদি কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারে , তাহলে বোধ হয় খুব ভালো হয় | কারণ সব জেনে অনন্ত তো ওকে ভালোবাসবে না , উল্টে ওর একতরফা ভালোবাসার জন্য সিম্প্যাথি দেখাবে হয়তো | খুব করুণ চোখে তাকাবে ওর দিকে এরপর | যেটা রূপকথা কিছুতেই মেনে নেবে না | তাই করিডোরটা দিয়ে জোরে পা চালালো এই সময়ে | কিন্তু থমকে গেলো আবার অনন্তর গলার আওয়াজ শুনে | ——- ” দাঁড়া রূপকথা | কোথায় যাচ্ছিস তুই ? প্লিজ , আমাদের এখন কথা হওয়াটা খুব দরকার | আমার তোকে কিছু !”
না , রূপকথা আর অনন্তর কথাটাকে কমপ্লিট করতে দিলো না | তার বদলে নিজেই দৃঢ় গলায় বলে উঠলো , ” আমাদের আর কোনো কথা নেই | তুমি এই ডায়রিতে যা পড়েছো সব ভুলে যাও | আমি ভালোবেসেছিলাম , আমার প্রব্লেম ছিল সেটা | এতে তোমার কখনোই কিছু করার ছিল না | তাই এই ডায়রির সব কথা তুমি ভুলে যাও | আর তুমি আর মিথিলা ভালো থেকো আমি এটা চাই | আর একটাই রিকুয়েস্ট , আমার সঙ্গে এস না এখন | তুমি কলকাতা ফিরে যাও | “….. কথাগুলো শেষ করেই রূপকথা আর দাঁড়ালো না করিডোরে | অনন্তর গলার আওয়াজ , ওর অস্তিত্ব সব কিছুর থেকে মনে হচ্ছে দূরে চলে যায় কোথাও ! তাই যতটা সম্ভব জোরে পা চালালো | তবে ফাঁকা করিডোরে অনন্ত দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ ,আবছা চোখে | না , ও এখান থেকে আর কোথাও যাবে না রূপকথাকে ছাড়া | এতদিন রূপকথা অপেক্ষা করেছে | আজ ও অপেক্ষা করবে | শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে |
<১৬>
সেইদিন এই অপেক্ষা প্রায় রাত অব্দি চলেছিল অনন্তর | তখন ঘড়িতে ৯টা | রূপকথা এলোমেলোভাবে এদিক ওদিক ঘুরে সেই ওর পুরোনো ঠিকানায়ই ফিরেছিল অবশেষে | ইচ্ছে করেই আজ দেরি করেছে ও | জানে , এতক্ষন নিশ্চই কেউ ওর জন্য অপেক্ষা করবে না ! আর রূপকথা নিজেও তো আর মুখোমুখি হতে চায় না কখনো | তাই সে চলে গেলেই ভালো | এইসব ভাবতে ভাবতেই ধীর পা এ হোস্টেলের দরজার সামনে এগোচ্ছিল , তখনই আবার সেই সকালের মতন চেনা গলার আওয়াজটা ওকে হঠাৎ থামিয়ে দিলো | অনন্ত এই মুহূর্তে বেশ দৃঢ় গলায় পেছন থেকে এসে বললো ,
” দাঁড়া রূপকথা | তোকে আমার সাথে কথা বলতেই হবে | নইলে আমি কোথাও যাবো না এখান থেকে , বুঝলি |”
রূপকথা এবার পেছনে ঘুরে অবাক না হয়ে পারলো না ! একটু বিদ্ধস্ত চেহারায় সেই ছেলেটাই ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে এখন | তার মানে অনন্ত সকাল থেকে এখন অব্দি অপেক্ষা করছিলো এখানে ! যায়নি কলকাতা ফিরে ! কিন্তু কেন ? কি বলার আছে ওর ! আর কি বা কথা থাকতে পারে রূপকথার সাথে ! কিছুই বুঝতে পারছে না | তবে সকালের মতন আর পালিয়েও যেতে পারছে না অনন্তর সামনে থেকে | তাহলে কে বলতে পারে , সারা রাতই হয়তো এই হোস্টেলটার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে ছেলেটা ! এইসব ভাবনার ভিড়েই কেমন পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে রূপকথা | তখন অনন্তই বলে উঠলো আবার ,
” মিথিলাকে আমি ভালোবাসি না | আমি প্রথম থেকে আজ অব্দি শুধু তোকেই ভালোবেসেছি | কখনো না বুঝে , তো কখনো বুঝে , শুধু তোর জন্যই ফিল করেছি | তোর কথাই ভেবেছি | আর আজ এই কথাটা বলার জন্যই আমি শান্তিনিকেতন এসেছিলাম | শুধু তোর জন্য শান্তিনিকেতন এসেছিলাম | তোর লাইফে নিজের জন্য একটু জায়গা চাইতে এসেছিলাম |”
অনন্তর কথার রূপকথা কোনোই মানে খুঁজে পেলো না এখন ! সব যেন হিসেবের বাইরে লাগছে ওর | হঠাৎ এতদিন বাদে এইসব কেন বলছে আজ অনন্ত ! ওর ডায়রি পড়েছে বলে ! কথাটা মনে হতেই রূপকথা বলে উঠলো , ———- ” কেন এসব বলছো তুমি ? আমি জানি তুমি প্রথম থেকে মিথিলাকেই তো ভালোবাসতে | আমি তো কখনো ছিলামই না তোমার কাছে আলাদা করে | তাহলে আজ হঠাৎ !”
অনন্ত এবার একটু অধৈর্য হয়েই রূপকথাকে থামিয়ে দিলো | তারপর আরো দৃঢ় গলায় বললো , ———- ” আজ হঠাৎ একদিনে নয় রূপকথা | দু বছর ধরে | তুই কলকাতা ছেড়ে চলে আসার পর থেকেই | রোজ , প্রত্যেকদিন , শুধু তোর কথাই ভেবেছি | তোকে কতভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছি জানিস ! তোর ইউনিভার্সিটি , যে-কটা বন্ধুকে আমি চিনি তাদের প্রত্যেকের বাড়ি গিয়ে , যত রকমভাবে চেষ্টা করা যায় , করেছি | এমন কি আমার এক্সিডেন্টের পর আমি কতবার সুইসাইড করতে গিয়েও করতে পারিনি | শুধু তোকে দেখবো বলে | হাতে ব্লেড নিয়েও বসে থেকেছি রাতের পর রাত জেগে , একটা পঙ্গু জীবনকে সঙ্গে করে | শুধু তোর সাথে আর একবার কথা বলবো বলে | তোর গলার আওয়াজটা আর একবার শুনবো বলে | আর তারপর যখন তুই সত্যি এলি কলকাতায় , তখন মনে হয়েছিল হারানো সব কিছুকে আবার ফিরে পেয়ে গেছি , একদম বিনা নোটিশে | তোকে এইসব কিছু তো আমি সেইদিনই কফিশপে বলতে চেয়েছিলাম | কিন্তু বলতে পারিনি , মিথিলা চলে এসেছিলো তাই | ” … কথাগুলো বলে এবার অনন্ত থামলো একটু | রূপকথা এখনো ওরকম মূর্তির মতনই দাঁড়িয়ে | এতো দিন বাদে যে এইসব কথা শুনবে সেই ছেলেটার কাছ থেকে , এটা তো স্বপ্নেও ভাবেনি ! তাই কোনো কথা , কোনো শব্দ আসছে না মুখে | ব্যাপারটা খেয়াল করে অনন্তই আবার বলে উঠলো ,
” আমি জানি না সত্যি যে তুই আমাকে আর নিজের লাইফে আসতে দিবি কি না ! আমার মতন ইনসেন্সিটিভি , চোখ থাকতেও অন্ধ একজন মানুষকে আর ভালোবাসবি কি না ! তবে আমি অপেক্ষা করবো | আজকের মতন প্রত্যেকটা দিন অপেক্ষা করবো | আই প্রমিস .. ”
কথাটা শেষ করেই অনন্ত এবার চুপ করে গেলো | না , ওর আর বলার মতন মুখ নেই আজ কিছু | আসলে যেই মেয়েটা এতদিন ধরে ওর জন্য এতো কষ্ট পেয়েছে , তার কাছ থেকে সত্যি আর কি মুখ নিয়ে ভালোবাসা চাইবে ! আজ হয়তো রূপকথার ‘ না ‘ বলার দিন | ওর মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার দিন | অনন্তর এইসব বেহিসাবি ভাবনার ভিড়েই হঠাৎ চারিদিকের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে রূপকথা আস্তে গলায় বলে উঠলো ,
” তোমাকে যেতে দিলাম কবে আমার জীবন থেকে যে আবার নতুন করে আসতে দেব ! তুমি তো সব সময় আমার সঙ্গেই ছিলে | ওই ডায়রির পাতাগুলোর মধ্যে | মনের গোপনে |”
কথাটা শেষ করেই ও সব দূরত্ব ভেঙে অনন্তর দিকে এগিয়ে এসে ওকে আঁকড়ে ধরলো আজ শক্ত করে | সারা জীবনের জন্য | আর অনন্ত হঠাৎ এই মুহূর্তে অবাক ! কাঁচের দেয়ালটা যে অবশেষে ভেঙে যাবে সত্যি সত্যি , এটা ও কল্পনাও করেনি | ওর মুখে হাসি | এতদিনের অপেক্ষার পর কাউকে ফিরে পাওয়ার হাসি | ওই ইনকমপ্লিট গল্পটা কমপ্লিট হওয়ার হাসি |
হয়তো আমাদের সবারই এই মনের গোপনটা থাকে , যেখানে খুব যত্ন করে সাজিয়ে রাখি আমরা একজনকে | ভালোবাসি চুপচাপ , নিঃশব্দে | আর অপেক্ষা করি রোজ, ওই অসমাপ্ত গল্পটার পূরণ হওয়ার অপেক্ষা |
<সমাপ্ত >