দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব #পর্ব_০৭ #অনন্যা_অসমি

0
447

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_০৭
#অনন্যা_অসমি

সাফাইতের এক্সিডেন্টের খবর শুনে ধরফর করে শোয়া থেকে উঠে বসল তোহা। কোনভাবে পোশাকটা পাল্টে হসপিটালে ছুটে এসেছে সে। সাফাইতের বাবা-মা থেকে জানতে পারল তার জন্য এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। যেহেতু আগেও সে সাফাইতকে রক্ত দিয়েছিল তাই এবারো সে দেবে বলে ঠিক করল।

রক্ত দিয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিল তোহা। সাফাইতের সাথে দেখা করবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলো সে। বেশকিছু সময় চিন্তা করার পর সিদ্ধান্ত নিলো সে যাবে। সাফাইতের জন্য বরাদ্দ কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল তোহা। দরজার অপর পারের দৃশ্য দেখে হৃদয় থমকে গেল তার। সাফাইতের বুকে মাথা দিয়ে আছে ইশরা। তোহা আবারো দ্বিধায় পড়ে গেল। ভাবতে লাগল তার যাওয়া উচিত হবে না। সাফাইতকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে নিঃশব্দে ভিতরে প্রবেশ করল। ইশরার সামনে এসে বুঝতে পারলো সেও ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। চোখের কোণে জল শুকিয়ে তার ছাপ সৃষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এই দৃশ্য দেখে তোহার একদিকে কষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে সাফাইত ভালো আছে ভেবে খুশিও হচ্ছে। হালকা হাতে সাফাইতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। বেরিয়ে আসার পর তার নজর পড়ল ইশরার গলায় থাকা লকেটটার দিকে। সূক্ষ্ম চোখে তা পরখ দেখে দেখে বুঝতে পারল এটা তাকে সাফাইত দিয়েছে। কারণ বেশ কিছু মাস আগে সে এটার ছবি সাফাইতের ফোনে দেখেছিল তবে সাফাইত তাকে এই বিষয়ে কোন কথা বলেনি। ঠোঁটে কষ্টমাখা রেখে তোহা বিরবির করে বলল,

” তোদের মাঝে আমার উপস্থিতি না চাইলে আমি আসবো নারে। এতে বরং আমারই ভালো, এই বিরহের দহনে কম পুড়তে হবে। মিথ্যা বলব না, তোদের একসাথে দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে ইশরাকে হিংসেও হয় বটে। তবে যাইহোক না কেন, আমি যতই না পাওয়ার বেদনায় তলিয়ে যাই তাতে কোন সমস্যা নেই৷ আমার একটাই চাওয়া তুই যেন ভালো থাকিস। সেটা যার সাথেই হোক।”

পুনরায় আরেকবার সাফাইতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নীরবে স্থান ত্যাগ করল তোহা। হসপিটালে আর বেশিক্ষণ থাকলে সে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে।
.
.

ঘুম থেকে জেগে সাফাইতকে চোখের সামনে দেখে ভড়কে গেল তোহা৷ প্রথমে ভেবেছিল হয়তো অতিরিক্ত তার ব্যপারে ভাবার ফলে ভূল দেখছে কিন্তু যখন মাথায় ঠোকা পড়ল তখন নিশ্চিত হলো আসলেই সাফাইত তার সামনে উপস্থিত আছে। অবাক কন্ঠে বলল,

” কিরে তুই এখানে এই সময় কি করছিস?”

সাফাইত ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

” এক মহারাণীকে দেখতে এলাম। তার তো এখন আর পাত্তা নেই। আমি তো আবার একজনের বেলায় প্রচন্ড রকমের বেহায়া। তাই থাকতে না পেরে বেহায়ার মতো ছুটে এলাম তার খোঁজ নিতে।”

তোহা কাঁথা ভাজ করতে করতে শান্তভাবে ভাঙা কন্ঠে বলল,

” একটু অসুস্থ ছিলাম তাই যোগাযোগ করা হয়নি। বাইরে আয়, মাকে বলছি তোকে কিছু রান্না করে দিতে।”

তোহা বেরিয়ে যাবে সেসময় সাফাইত তার হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দিল। চোখের পলকে নিজেও উঠে বসল এবং তোহার কপালে, গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরখ করে দেখল।

” এখন তো মোটামুটি ঠিক আছে। জ্বর বাঁধালি কি করে? গলা তো ভেঙে একেবারে অবস্থা খাবার।”

” ও কিছুনা৷ সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার কারণে একটু ঠান্ডা লেগেছে৷ ঠিক হয়ে যাবে।”

” হুম জানি কতটা ঠিক হবে। একমাসের আগে যে তোমার কাশি যাবে না তা আমার জানা আছে। কে বলেছে ভিজতে? ছাতা আমাদের দিয়ে ওভাবে চলে এলি কেন? ফোন দিলাম, ধরলিও না।”

” আরে বুদ্ধু আমি তোমাদের একটু একান্ত সময় দিয়েছিলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, ঠান্ডা বাতাস, এক ছাতার নিচে তোরা দু’জন। উফ… কি রোমান্টিক!”

” কচু রোমান্টিক। এসবের চক্করে যে তুই অসুস্থ হয়ে গেলি। না জানি এবার সারতে কতদিন লাগে।” চিন্তিত কন্ঠে বলল সে।

তোহা কথা ঘুরানোর জন্য বলল, ” আরে এসব বাদ দে। এটা বল তুই এখন কেমন আছিস? হসপিটাল থেকে কখন ছেড়েছে? আর এসব হলো কি করে?”

” আর বলিস না। ভোরের দিকে একটা কাজে বাইক নিয়ে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়াতে রাস্তা ঠিক মতো দেখতে পাইনি।”

” আচ্ছা তুই বস, আমি মুখ-হাত ধুয়ে আসছি।”

মুখ হাত ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম সামনে এগোতেই অসাবধানতাবশত স্লিপ খেয়ে পড়ে যেতে নিলে সাফাইত তার হাত টেনে ধরল। তাকে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে ধমক দিয়ে বলল,

” তোর বোধবুদ্ধি কখন হবে বলতো? এরকম ভেজা পা নিয়ে যে টাইলস করা ফ্লোরে নায়িকাদের মতো হাঁটছিস তো তুই পড়বি না তো কি আমি পড়ব?”

” আরে ভুলে গিয়েছিলাম পা মুছতে।”

” চুপ কর ইউিয়েট মেয়ে।” পুনরায় ধমক দিয়ে বলল সে। এবার তোহাও তাকে উল্টো ধমক দিয়ে বলল,

” নিজে যেন কত সচেতনবান ব্যক্তি। আপনি যে হিরোদের মতো বৃষ্টির মধ্যে বাইক চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে পড়ে ছিলেন তার বেলায়?”

” তুই হসপিটালে এসেছিস, এমনকি রক্ত দিয়েছিস। আমার সাথে দেখা করে যাসনি কেন?”

অস্বস্তিতে পড়ে গেলে তোহা। চোখের সামনে ভেসে উঠল সাফাইতের বুকে ইশরার মাথা রাখার দৃশ্যটি।

” তোকে বলেছে? আমি যাইনি হসপিটাল।”

” মিথ্যা বলবি না তোহা, চুল টেনে ছিঁড়ে দেবো। ইশরা আমাকে বলেছে ও তোকে রক্ত দিতে দেখেছিল। জানিস মেয়েটা তোর জন্য কত সময় অপেক্ষা করেছিল। তোর জন্য খাবার এনে রেখেছিল, আমাকে দেখতে এলে যত্নসহকারে তোকে খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। কিন্তু তুই তো একেবারেই উধাও হয়ে গেলি। মেয়েটা মন খারাপ করেছিল সারাদিন।”

তোহা খানিকটা অবাক হলো৷ ইশরা যে তাকে দেখেছে এটা সে জানতো না।

” সত্যি বলছিস তুই?”

” আরে আমি মিথ্যা কথা কেন বলব? আমরা দু’জন কত সময় তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এসময় দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জেগে উঠে দেখি দুপুর হয়ে গিয়েছে। ইশরা তোকে বেশ কয়েকবার খুঁজেছিল, ফোনও তো তুই ধরিসনি।”

” ওই আসলে, আমার খারাপ লাগছিল তো। তাই দ্রুত চলে এসেছিলাম। এমনিতেও তোকে নিয়ে সবাই চিন্তিত ছিল আমার অসুখের কথা বলে আর ঝামেলায় ফেলতে চাইনি।”

” তুই এভাবে বলতে পারলি তোহারাণী। আমি না তোর বেস্টফ্রেন্ড, তোর সমস্যা আমাকে কেন ঝামেলায় ফেলবে? আমি আগে জানলে তোকেও আমার কেবিন ভর্তি করিয়ে দিতাম।”

তোহা পা উঁচু করে সাফাইতের কাঁধে কনুই ঠেকিয়ে বলল,

” তাহলে তুই আর ইশরা প্রেম করতি কি করে?”

সাফাইত গালে হাত দিয়ে বলল,

” তাও ঠিক।”

” ইশ… কি নির্লজ্জ।” সাফাইতের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল সে।

” হাসিতামাশা পরে করা যাবে। এখন বাইরে আয়, কিছু খেয়ে নে। আমারো অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।”

” তুই যা আমি আসছি।”

” তুই আবার কোথায় যাবি?”

” আরে ওটা ছেলেদের ব্যক্তিগত সমস্যা তুই বুঝবিনা, যা যা।”

যেতে যেতে তোহা নিজেকে বলল,
” এতোদিন শুনেছি মেয়েদের ব্যক্তিগত সমস্যা থাকে, এই পাগল না জানি কোথা থেকে ছেলেদের ব্যক্তিগত সমস্যা তৈরি করেছে।”

বেশ কিছুসময় তোহার সাথে কাটানোর পর এবার সাফাইতের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তোহা তার সাথে গেট পর্যন্ত গেল। সাফাইত হাত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

” সাবধানে থাকিস আর এখন ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই৷ আরো কয়েকদিন রেস্ট নে। নোট নিয়ে চিন্তা করিস না, ওটা আমি দিয়ে দেব।”

তোহা মজা করে বলল,

” কি বলেছিস শুনে পাইনি। আবার বলতো।”

” বলেছি ক্লাস নিয়ে চিন্তা করিস না, নোট আমি দিয়ে দেব।”

তোহা জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগল। কোনমতে হাসি আটকে রেখে বলল,

” গিনিস ওয়ার্ল্ডের উচিত তোকে এওয়ার্ড দেওয়া, জোক’স অফ দ্যা ইয়ারের। তুই নিজেই ক্লাস ঠিক মতো করিস না আমাকে কি নোট’স দিবি?” বলে আবারো হাসতে লাগল সে। সাফাইত রেগে তোহার চুল ধরে টান ছিল।

” এই বাঁদর চুল ছাড়।”

” আমি ক্লাসও করব আর তোর থেকে ভালো নোট’সও করব।”

” আচ্ছা ঠিক আছে দেখা যাবে। সাথে আমাকে পড়াও বুঝিয়ে দিতে হবে।”

সাফাইত বাইকে বসে মুখ ভেঙিয়ে বলল,

” ঠিক আছে চ্যালেঞ্জ এক্সেপটেড। তোর থেকেও ভালো বোঝাবো আমি।”

বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে তোহা বলল, ” দেখা যাবে সাফাইত সাহেব।”

সাফাইত কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল তোহা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল,

” পাগল একটা৷ কবে যে ভালো হবে।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here