দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব #পর্ব_১০ #অনন্যা_অসমি

0
453

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_১০
#অনন্যা_অসমি

বেগুণী শাড়িতে এক রমনীকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে থমকে গেল সাফাইত। শুকনো ঢোক গিলে পরপর কয়েকবার পলক ফেলল। পাশ থেকে তার এক বন্ধু ফিসফিস করে বলল,

” এভাবে তাকিয়ে আছিস যে আজ প্রথম দেখছিস ওকে। এভাবে যে তাকিয়ে আছিস নজর লেগে যাবে তো।”

সেটা ফিসফিস করে বললেও আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ২/৩ জনের কানেও তা পৌঁছেছে। সবাই মিটিমিটি আসছে৷

ইশরা মিষ্টি হেসে সাফাইতের পাশে থাকা বাকিদের বলল, ” কেমন আছেন ভাইয়ারা?”

” আমরা বেশ ভালো আছি বোন। কিন্তু মনে হচ্ছে তোমাকে দেখে কারো বেহাল অবস্থা এখন।”

সাফাইতের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে লাজুকভাবে হাসল সে। কথা ঘোরানোর জন্য বলল,

” তোহা আপু কোথায়? ওনাকে দেখছি না যে? এখনো আসেনি?”

” এসেছে সে অনেক আগে। তার তো পারফরম্যান্স আছে, তাই সবার সাথে প্র্যাকটিস করছে। তোমরা থাকো, আমরা দেখি কারো কোন সাহায্য লাগবে কিনা।”

সবাই চলে গেল, সাফাইত এবং ইশরার মাঝে এখন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিছুসময় চুপ থেকে ইশরাই প্রথমে বলল,

” ওভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলে কেন? ভাইয়া গুলো কি ভেবেছিল।”

সাফাইত ইশরার হাত আঁকড়ে ধরে বলল,

” যা ইচ্ছে ভাবুক। আমি অন্য কারো জিনিসের উপর নজর দিচ্ছিলাম নাকি? তুমি আমার ব্যক্তিগত মানুষটা উপর নজর দিয়েছি।”

” ইদানীং একটু বেশিই প্রেমিক পুরুষের মতো কথা বলছ। তা কোন বই পড়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছো?”

” ইশরা নামক এক মানবীর হৃদয় পুস্তক পড়ে।”

তিন তলা থেকে দু’জনকে একদৃষ্টিতে দেখে চলেছে তোহা। আজ সেও কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। আজ তাদের ভার্সিটির শেষ বর্ষের বিদায় অনুষ্ঠান। তা নিয়েই সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিজের অনুভূতিকে পুনরায় যত্ন সহকারে লুকিয়ে রেখে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে স্টেজের পেছনে চলে গেল।

একে একে সবার পরিবেশনা শেষ হতে লাগল। এবার তোহার পালা। উপস্থাপিকা তোহার নাম ঘোষণা করতেই উত্তেজনায় তার হদস্পদন বেড়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে মঞ্চে উঠে এলো সে।

গান গাওয়ার পূর্বে একবার চোখ বুলিয়ে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে নিল তোহা। তার বন্ধুরা তাকে চেয়ার আপ করছে। সাফাইতের দিকে নজর পড়তে সে ইশরায় বেস্ট অফ লাক বলল। অবশেষে গলা ঠিক করে গানে মনোযোগ দিলো সে।

” কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া

চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে সখা, কত ভালোবাসি।”

খুব মনোযোগ দিয়ে গান গাইল তোহা। এই গানটা বর্তমানে তার ভীষণ প্রিয় একটা গান। মাঝেমাঝেই অজান্তেই গুণগণ করে গাইতে থাকে সে। তার মনে হয় তার মতো মানুষের এধরণের পরিস্থিতির জন্যই এই গান লিখা হয়েছে। গানের প্রতিটা লাইন যেন তার বর্তমান অবস্থার বহিঃপ্রকাশ৷

স্টেজ থেকে নামার পর ক্লাসমেট, ফ্রেন্ড, সিনিয়র, জুনিয়র সবাই তোহার কন্ঠের প্রশংসা করতে ভুলল না। সেও প্রতিবারের মতো হেসে সবাই ধন্যবাদ জানল৷ সাফাইতকে এড়িয়ে অন্যদিকে চলে যেতে চেয়েও পারল না তোহা। সাফাইত ঠিকই তার পথ আটকে দাঁড়াল।

” কিরে তোহারাণী আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিস কেন? এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিস নাকি? দেখ তোহা আমাকে এড়িয়ে চললে কিন্তু ভালো হবেনা৷ চুল একটাও মাথায় থাকবে না।”

মনে মনে একটু ঘাবড়ে গেলেও বহিঃপ্রকাশ করল না তোহা৷ খানিকটা বিরক্তিভাব মুখশ্রীতে ফুটিয়ে বলল, ” সবসময় চুল ছিঁড়ে ফেলার কথা বলিস কেন? আমার চুল কি তোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি? যে ইচ্ছে হলে আর ছিঁড়ে ফেলবি।”

” না হলেও ছিঁড়ে তোকে টাকলু মাথা করতে বেশি সময় লাগবে না৷ এবার কথা না ঘুরিয়ে বল আমার সাথে কথা না বলে চলে যাচ্ছিস কেন? ২/৩ দিন ধরে লক্ষ্য করছি আমার থেকে কেমন দূরে দূরে থাকছিস। ক্লাসেও চুপচাপ, ফোন দিলে গুণে গুণে কথা বলে তাড়াহুড়ো করে কেটে দিস। আজও এসেছিস কত সময় পেরিয়ে গিয়েছে আমার সাথে একবারো কথা বলতে এলিনা। একটা ফোন দিয়েও জানতে চাইছিলিনা আমি এসেছি কিনা। কি ব্যপার বলত?”

তোহা চুপ হয়ে গেল। সে যে আসলেই সাফাইতকে এড়িয়ে চলার বৃথা চেষ্টা করছে সেটা সে বুঝতে পেরে গিয়েছে জেনে থতমত খেয়ে গেল সে। অস্বস্তি ঘিরে ধরল তাকে। তাও নিজেকে স্বাভাবিক রাখল যেন সাফাইতের সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত না হয়।

” আরে সাফু তুই এসব কি বলছিস। আমি কি তোকে এড়িয়ে যেতে পারি? আমাদের বন্ধুত্ব কি আজকের নাকি? সেই হাইস্কুল থেকে আমরা একসাথে আছি, আমি কি করে তোকে এড়িয়ে যাবো? সে সাহস কি আমার আছে নাকি?”

সাফাইত সন্দেহদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” সত্যি তো? আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছেনা।”

” আরে বাবা সত্যি সত্যি। তুই বল কেন আমি কোন কারণ ছাড়া তোকে এড়িয়ে চলব? আমাদের কি কোনপ্রকার ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্য হয়েছে? হয়নি তো, তাহলে? আসলে এ কয়েকদিন আমি গানের প্র্যাকটিস নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম, তাই তোর সাথে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারিনি৷ তাই তোর এরকম মনে হয়েছে।”

সাফাইত গম্ভীরমুখ করে বলল,

” তাই যেন হয়৷ আমার থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করলে কিন্তু খবর আছে তোর।”

” আরে বাবা এতোবছর যখন ছেড়ে যাইনি তখন ভবিষ্যতেও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। টেনশন নট।” আচমকা কিছু একটা খেয়াল হতে তোহা প্রশ্ন করল, ” কিরে সাফু ইশরা কোথায়? তোর সাথেই না ছিল। এতোসময় আমরা এখানে কথা বলছি ওর দেখা পাচ্ছিনা যে।”

” ও তো বলল ওয়াশরুমে যাবে। কিন্তু এতোটা সময় কেন লাগছে বুঝতে পারছিনা।”

” ফোন দিয়ে দেখ কোন সমস্যা হয়েছে কিনা।”

সাফাইত দ্রুত ইশরা ফোন দিল৷

” ইশু কোথায় তুমি? সেই যে কখন গেলে এতোটা সময় কি করছ?”

ইশরা কিছু সময় চুপ থেকে ধীর কন্ঠে বলল,

” তোহা আপু কি তোমার সাথে আছে?”

” হ্যাঁ আছে তো। দেবো ওকে?”

” হুম।”

সাফাইত ফোনটা তোহার দিকে এগিয়ে দিলে সে কিছুটা অবাক হলো। সাফাইত ইশরায় তাকে নিতে বলল।

” হ্যাঁ ইশরা বলো।”

” আপু তুমি প্লিজ একটু তিনতালার গার্লস ওয়াশরুমে আসবে? একটু তাড়াতাড়ি এসো।” অস্থির কন্ঠে বলল সে। তোহা বুঝতে পারল ইশরা কোন সমস্যা আছে৷ সে আসছি বলে ফোনটা সাফাইতকে ফেরত দিল।

” তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

” তুই যেখানে যাচ্ছিস সেখানে।” বোকার মতে বলে বসল সাফাইত।

” গার্লস ওয়াশরুমে তুই গিয়ে কি করবি? তুই এখানে থেকে দেখে কারো কোন সাহায্য লাগবে কিনা। অনুষ্ঠানে কাজের অভাব নেই৷ আমি যাচ্ছি।”

” কিন্তু…. ”

তোহা আশ্বস্ত করে বলল, ” চিন্তা করার কিছু হয়নি। আমি আছি তো।”

তোহা আর কথা বাড়ালো না। দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে চলে এলো। প্রতিটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ধীর কন্ঠে ইশরার নাম ধরে ডাকতে লাগল। তার কন্ঠ শুনে ইশরার প্রাণে যেন পানি এলো। দ্রুত ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সে।

পেছন ফিরে তোহা দেখল ইশরার শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে৷ ছেড়ে দেওয়া আঁচলটা এখন কাঁধে তোলা, যেটা সে শক্ত করে ধরে আছে।

তোহা এগিয়ে এসে জানতে চাইল,

” কি হয়েছে ইশরা? তোমার এ অবস্থা কেন? মুখটাও কেমন শুকিয়ে গিয়েছে।”

ইশরা আশেপাশে তাকিয়ে নিচু কন্ঠে বলল,

” আমার পেছনে ব্লাউজের ফিতে খুলে গিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁধতে পারিনি৷ একটু বেঁধে দেবে?”

” আরে বোকা মেয়ে আগে বলবে না। এতোটা সময় শুধু শুধু যুদ্ধ করেছ। ওয়াশরুমে আসা কাউকে দিয়ে বেঁধে নিতে পারতে।”

” না আমি অপরিচিত কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা। আমি তো জানিনা মানুষটা কেমন। যদি বাইরে গিয়ে তিলকে তাল করে বলে তখন আমার সম্মানহানী হতে সময় লাগবেনা৷ কেউ কেউ তো তাল থেকে তাল গাছ করে ফেলবে। তখন চরিত্র নিয়ে কথা উঠতে সময় লাগবেনা।”

কথার মাঝে ইশরা তোহার ফিতে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে।

” নাও হয়ে গিয়েছে। এতটুকু মেয়ে তুমি আর চিন্তা এতোদূর। ভাবা যায়!”

ইশরা মুচকি হেসে বলল,

” না করে কি উপায় আছে? আমাদের আশেপাশের পরিস্থিতি বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে৷ তাই যাকে তাকে বিশ্বাস করতে মন টানে না।”

” বুঝেছি। এসো তোমার কুচিটা ঠিক করে দি, এলোমেলো হয়ে গিয়েছে অনেক। দেখতে ভালো লাগছেনা।”

শাড়ি ঠিক করে নীচে নেমে এলো দুজনে। তাদের দেখে সাফাইত দূরে এলো।

” কোথায় ছিলে তোমরা? ওয়াশরুমে কি মুভি চলছে নাকি? প্রথমে ইশরা গিয়ে আটকে ছিল এরপর তুই। কি করছিলি এতোটা সময়।”

দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে হেসে একসাথে বলল,

” এটা আমাদের পার্সোনাল ব্যপার। কোন ছেলেকে বলা যাবে না।”

এরপর তোহা বলল,

” তোর ভাষার গার্লস টক৷ তোকে বলা যাবে না। এবার যা আমাদের জন্য কিছু নিয়ে আয়। অনেক খিদে লেগেছে। ইশরা এসো আমরা অনুষ্ঠান দেখি।”

তোহা এবং ইশরা কথা বলতে বলতে স্টেজের দিকে চলে গেল৷ সাফাইত বোকা বোকা চাহনিতে তাদের যাওয়া দেখতে লাগল।

” কি হলো এটা?”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here