হঠাৎ_বৃষ্টিতে⛈️ #Part_02 #Writer_NOVA

0
431

#হঠাৎ_বৃষ্টিতে⛈️
#Part_02
#Writer_NOVA

— কি হয়েছে আপনার?

নরম কন্ঠস্বর শুনে ত্রিবু দৌড় না দিলেও নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিলো। ত্রিবুর ধারণামতে এটা মানুষের গলার স্বর। ভূতের গলার স্বর হলে ভয়ানক ও গম্ভীর হতো। তাই সে পালালো না। ত্রিবু কাঁপা কাঁপা গলায় কিছু বলার আগেই অপরপাশ থেকে আবারো শুনা গেলো,

— এত রাতে এই পরিত্যক্ত বাস স্টেপে কি করছেন ম্যাডাম? মেয়েদের এতোরাতে বাইরে না থাকা ভালো। এমনি দিনকাল ভালো নয়। কখন কি হয়ে যায় তাতো বলা যায় না। তাই বলছিলাম আরকি!

তার কথা শুনে ত্রিবুর মনের ভয় পুরোপুরি না কেটে গেলোও কিছুটা কমলো। কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে কোন যুবকের গলা। কিন্তু কতটুকু সঠিক তাতে তার একটু সন্দেহ আছে। ভেজা শরীরে ত্রিবু থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ভীষণ শীত করছে তার। বৃষ্টির বেগ অনেকটা কমে এসেছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ফোঁটা পরলেও ঠান্ডা বাতাসের বেগ কমেনি। সেই সাথে আকাশ কাঁপিয়ে বিজলি চমকানো তো আছেই। ছেলেটার কথায় ত্রিবুর ভাবান্তর হলো না। নিষ্পলক চাহনিতে মাথা উঠিয়ে তাকালো। কিন্তু নিকেষ কালো আধারে একটা কালো অবয়ব ছাড়া কিছু আবিষ্কার করতে পারলো না। কানে বাতাসের শো শো শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। ত্রিবু মাথা নামিয়ে দৃষ্টি সামনের ঘন কালো অন্ধকারের দিকে দিলো। ছেলেটা কিছু সময় ত্রিবুকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর ত্রিবুর থেকে এক হাত দূরত্ব বজায় রেখে ভেজা বেঞ্চে বসে পরলো। পূর্বের মতো এখনো নিজের ও ত্রিবুর মাথায় ছাতা ধরা। ধীর কন্ঠে ত্রিবুকে বললো,

— বাসায় চলে যান। যে বৃষ্টিতে ভিজেছেন তাতে জ্বর চলে আসবে। এই বাতাসে বসে থাকলে কড়াদরে ঠান্ডা লাগবে। পনেরো দিনের আগে জ্বর ঠান্ডা ছাড়বে না।

ছেলেটার বকবকানিতে ত্রিবুর কপালটা বিরক্তিতে কুঁচকে এলো। বড্ড বেশি জ্ঞান বিতরণ করছে। কে বলেছে তাকে এখানে বসে জ্ঞান বিতরণ করতে? এবার কিছু না বললেই নয়। ঝাঁঝালো গলায় ত্রিবু বললো,

— আপনাকে এত কিছু ভাবতে হবে না। আমার যা খুশি তা হোক আপনার কি তাতে?

— যাক বাবা, আমি আবার কি করলাম? ভালো মনে বললাম ভালো লাগলো না। এর জন্য বলে কারো ভালো করতে নেই।

— আমি আপনাকে বলিনি আমার ভালো করতে।

— ভদ্রতার খাতিরে করছিলাম।

— দরকার নেই।

ছেলেটা মুখ টিপে হাসলো। বিনিময়ে কোন উত্তর দিলো না। এক সময় সেও সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলো। ত্রিবু ঠকঠক করে কাঁপছে। তাও জিদ করে সেখান থেকে সরছে না। আত্মহত্যা না করতে পারুক নিজেকে কষ্ট দিতে তো পারবে। সেই ধারণা নিয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে। পাশের এক ছোট্ট ডোবা থেকে এক নাগাড়ে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ আওয়াজ আসছে।নতুন পানি পেয়ে ব্যাঙ তাদের আনন্দ প্রকাশ করছে। তবে তাদের ডাকে ত্রিবু বিরক্ত হয়ে সেদিকে তাকালো। এই মুহুর্তে কোন শব্দ তার ভালো লাগছে না। একা থাকতে চায় সে। ছেলেটি ডান হাত থেকে বাম হাতে ছাতা নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো,

— অন্যের জন্য নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন?

ত্রিবু কিছুটা চমকে তার পাশে তাকালো। এবারো ঘন কালো আঁধারে ছেলেটার দেহ বা মুখ কোনটাই চোখে পরলো না। ত্রিবুর মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, সে কি করে জানলো অন্যের জন্য নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে? থমথমে গলায় বললো,

— আমার ইচ্ছা!

— তা এই অদ্ভুত ইচ্ছা কেন জাগলো?

ত্রিবু দুই হাত মুঠ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,

— বড্ড বেশি প্রশ্ন করছেন আপনি!

☔☔☔

বিধ্বস্ত অবস্থায় হলুদের স্টেজের এক কোণায় বসে আছে হিমেল। রাগে তার কপালের রগগুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে। এতবড় সাহস মারিয়ার! বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। এর শাস্তি সে পাবে। পুরো স্টেজ লণ্ডভণ্ড হয়ে পরে আছে। সামনে থাকা চেয়ারটা হাতে নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে একটা আছাড় মারলো। প্লাস্টিকের চেয়ারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রইলো। হিমেলের মা এগিয়ে এসে অনেকটা কলা করে বললো,

— বাবা, প্লিজ একটু শান্ত হো। আমরা দেখছি বিষয়টা। তুই প্লিজ এমন করিস না।

হিমেল গগনচুম্বী হুংকার দিয়ে বললো,
— এখানে কি? যাও ভেতরে যাও।

— তুই আমার কথাটা শুন….

পুরো কথা শেষ করার আগে হিমেল আরেকটা চেয়ার তুলে আছাড় মারলো। হিমেলের মা ভয়ে কেঁপে উঠলো। তারপর দ্রুত পায়ে সেখান থেকে কেটে পরলো। হিমেল রাগে নিজের চুলে টেনে ধরে জোরে এক চিৎকার দিয়ে ভেজা মাটিতে বসে পরলো। ভেজা চুল থেকে টপটপ পানি গরিয়ে পরছে,চোখ দুটো অসম্ভব লাল। তাকে ভীষণ হিংস্র লাগছে।এই মুহুর্তে তার মারিয়া ও ত্রিবুকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মারিয়ার সাথে বিয়ে হলে ঘরভর্তি ফার্নিচার, একটা মোটরসাইকেল আর ইউ.এস যাওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা পেতো সে। যাকে এক কথায় বলে যৌতুক। সেটা হাতছাড়া হওয়ায় মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে হয়ে গেছে হিমেলের। মাথায় খুনের নেশা চেপেছে। মূলত যৌতুকের জন্য মারিয়ার মতো শ্যাম বর্ণের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলো। ত্রিবুর বাবার এতো যৌতুক দেওয়ার সামর্থ নেই।

অন্যদিকে…..

ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পরলো মারিয়া। বিয়েটা সে তার বাবার সহযোগিতায় অবশেষে ভেঙে দিয়েছে। যে ছেলে সাত মাসের সম্পর্ককে ভেঙে তাকে অপমান করে মারিয়ার সাথে বিয়েতে রাজী হতে পারে। সে যে মারিয়ার থেকে ভালো কাউকে পেলে তাকে ছেড়ে যাবে না তার বা কি গ্যারান্টি? হিমেলকে স্টেজ থেকে সরে যেতে দেখে তার পিছু নিয়েছিলো।ঝাউ গাছের আড়ালে লুকিয়ে সব কথা সে শুনতে পেয়েছে। ত্রিবু চলে যাওয়ার পর এক মিনিটও দাঁড়ায়নি। দ্রুত পায়ে স্টেজে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। মারিয়া বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। তার বাবা তার ডিসিশনকে তাই মানা করতে পারেনি।

☔☔☔

ত্রিবু দ্রুত পায়ে দুই হাতে নিজের বাহু ধরে কাপতে কাপতে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। ছেলেটা তার সাথে সাথে চলতে লাগলো। ত্রিবু বুঝতে পেরে পেছনে ঘুরে বললো,

— আমার পিছু নিয়েছেন কেন?

— এতো রাতে একটা মেয়েকে আমি একা যেতে দিতে পারি না। আপনি এখন আমার রেসপনসেবলিটি। তাই আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিবো।

ত্রিবু কোন উত্তর দিলো না,ছেলেটার দিকে তাকালো। হঠাৎ বিজলি চমকে উঠলো। সেই আলোতে ছেলেটার মুখ দৃশ্যমান হলো। লাল টুকটুকে একটা ছাতা হাতে নিয়ে একটা ছেলে গভীর চোখে তাকে দেখছে।ত্রিবু নিষ্পলক চোখে ছেলের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। আবারো বিজলি চমকালো। সেই আলোতে আবারো ছেলেটার মুখ দেখলো সে। মুখটা তার মনে এক পলকে গেঁথে রইলো। চাহনিটা কি নিষ্পাপ। কোন বদমতলব নেই সে চোখে। ত্রিবু আবার পথ ধরলো। ছেলেটা চলতে চলতে মুচকি হেসে বললো,

— অন্যের জন্য নিজের ক্ষতি করা বোকামি। আর আপনি তো আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন।

ত্রিবু অবাক কন্ঠে বললো,
— আপনি কি করে জানলেন?

ছেলেটা ত্রিবুর কথায় থতমত খেয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললো,

— আপনাকে দৌড় দিয়ে এদিক দিয়ে যেতে দেখছি। ব্রীজে দাঁড়িয়ে ঝাপ দিবেন কিনা দিবেন না তা ভাবছিলেন। আমি এখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। আপনি যদি ঝাপ দিতেন তাহলে আমি বাঁচাতাম। কিন্তু আপনাকে দ্বিধাদ্বন্দে থাকতে দেখে আমি এগুলাম না।

— ওহ!

— আপনার কি হয়েছে তা কি বলবেন? যদি আপনার বলতে ইচ্ছে হয় আরকি। আমার মনে হচ্ছে আপনি খুব ডিপ্রেশনে আছেন। বন্ধু ভেবে বলতে পারেন। আপনার দুঃখ লাঘব করতে না পারলেও আপনার মনের দুঃখগুলো কিছুটা কমবে।

ত্রিবু বড় করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। তার খুব ইচ্ছে করছিলো কাউকে মনের কথাগুলো বলতে। সে যদি সব বলতে পারতো তাহলে মনটা কিছু হলেও হালকা হতো। কিছু সময় থেমে সে বললো,

— আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসতাম। তার নাম হিমেল। সে সম্পর্কে আমার চাচির ভাইয়ের ছেলে। গত সাত মাস ধরে আমার তার সাথে সম্পর্ক ছিলো।সবাই বলতো ছেলেটা খারাপ। তাই আমি তার সাথে সম্পর্কে জড়াতে রাজী হয়নি। দুই সপ্তাহ ঘুরে সে আমাকে কনভিন্স করে ফেলেছে। আমার প্রতি ওর ভালোবাসা দেখে আমিও ভেবেছিলাম জীবনে এমন কেউ এলো যে আমাকে সত্যিকারে ভালোবাসে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। সে শুধু আমার সাথে টাইম পাস করেছে। তার সুক্ষ্ণ অভিনয় আমি ধরতে পারিনি। আজ তার হলুদ ছিলো। সে আজ আমাকে ভীষণভাবে অপমান করেছে। সাথে আমার মা-কেও চরিত্রহীন বলেছে। আমার গায়ের রং নিয়ে কথা শুনিয়েছে। আমি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে এসেছিলাম। কিন্তু সাহসে কুলালো না।

ত্রিবু কথা শেষ করে হু হু করে কেঁদে উঠলো। তারপর সমাজের কথা, হিমেলের বলা কথা সব খুলে বললো। তার মায়ের জন্য, তার গায়ের রঙের জন্য কতশত কথা শুনতে হয় তাও বলা বাদ রাখলো না।তার কথা শুনে ছেলেটা বললো,

— জীবন অনেক সুন্দর মিস। এটাকে এমন হেলাফেলা করে নষ্ট করে দিয়েন না। সমাজ নানা কথা বলবেই। এরা শুধু সুযোগ খুঁজে আপনার ইচ্ছা, আগ্রহ, স্পৃহাকে গুড়িয়ে দিতে। আপনি যখন সব বাঁধা পেরিয়ে সাফল্যের চূড়ায় আহরণ করবেন তখন এরাই আপনারা বাহবা দিবে। চেহারা কোন মেটার নয় মিস। কোন মানুষ পারফেক্ট হতে পারে না। আল্লাহ সবাইকে একভাবে না একভাবে অসম্পূর্ণ রেখে দেয়। আপনি জানেন কি কালো রঙের মানুষদের মনটা ভীষণ সুন্দর।সবার জীবনে বড় আঘাত পাওয়া জরুরি। তাহলে আপনি ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। সব ভুলে পড়াশোনা শুরু করেন। ঘুড়ে দাঁড়ান।

ছেলেটার কথায় ত্রিবু মনে জোর পেলো। তাই তো অন্যের কথায় সে কেনো নিজের ক্ষতি করবে? সে অবশ্যই ঘুড়ে দাঁড়াবে। কোন পিছুটান রাখবে না। মুগ্ধ চোখে ছেলেটার দিকে তাকালো।বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেছে। যার দরুন রাস্তার পাশের আলোকবাতি গুলো জ্বলে উঠেছে।সেই আলোতে দুজন নীরবে হাঁটতে লাগলো। বাসার সামনে আসার পর ত্রিবু বললো,

— আমি এসে পরেছি। কষ্ট করে আপনাকে আর যেতে হবে না। আমি একায় চলে যেতে পারবো। ধন্যবাদ, আমার মনে সাহস যুগানোর জন্য।

ছেলেটা হাতের ছাতা এগিয়ে দিয়ে বললো,
— এটা নিয়ে যান।

— না না দরকার নেই। আমি এমনি ভিজে গেছি। এটার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি সাথে রাখুন। আপনার এটা লাগবে। তাছাড়া আপনাকে আমি ছাতা ফেরত দিবো কি করে? আপনাকে তো আমি চিনি না। আমার যতদূর মনে হয় আপনি এই এলাকারও নয়।

— হ্যাঁ, আমি এই এলাকার নয়। সামনের এক বাসায় বেড়াতে এসেছি। বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে বের হয়েছিলাম। তারপর আপনার সাথে দেখা। প্লিজ ছাতাটা আপনি রাখুন। সেই সুবাদে আপনার সাথে আবার দেখা হবে।

ত্রিবু বিস্মিত হয়ে বললো,
— কবে?

— হঠাৎ বৃষ্টিতে!

“হঠাৎ বৃষ্টিতে” কথাটা ত্রিবুর কানের সামনে লো ভয়েজে বললো। সাথে শব্দ করে সূদুরে এক বাজ পরলো। ছেলেটার লো ভয়েজের কথা ও বাজের শব্দ দুটোতেই ত্রিবু কেঁপে উঠলো। ছেলেটা এক প্রকার জোর করে তার ছাতাটা ত্রিবুর হাতে দিয়ে দিলো। ত্রিবু না চাইতেও ছাতাটা নিয়ে নিলো। বিদায় জানিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। কয়েক কদম এগিয়ে ত্রিবুর মনে হলো ছেলেটা কোন বাসায় উঠেছে তার নামটাই জানা হয়নি।নাম না জানলে ছাতা ফেরত দিবে কি করে? নাম জানার জন্য পেছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। সেখানে কেউ নেই। ত্রিবু অবাক চোখে পেছনে তাকিয়ে রইলো।এত দ্রুত এখান থেকে যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে ছেলেটা গেলো কি করে?

~~~নিজেকে ভালবাসুন। যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে না সে কখনো অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে না 💙।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here