মোহ মুক্তি ~ ৮
লেখা : Azyah(সূচনা)
“আমি বাড়ি যাবো”
প্রচণ্ড রকমের মাথা ব্যথা নিয়ে ঘরে বসে ছিলো অরণ্য। সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলল,
“কেনো?”
“অনেকদিন হলো।মা যেতে বলছিলো।আপনার কথাও বলেছিলো।কিন্তু আপনিতো যাবেন না।”
বিস্মিত চোখজোড়া আবারো তুলে দেয় সন্ধ্যার পানে।যাবে কি যাবে না সেটা জিজ্ঞেসও করলো না?নিজে থেকেই ভেবে বসে রয়েছে?সন্ধ্যার দিকে চেয়ে ভাবছে এক লাইন বেশি বুঝে নেওয়া হয়তো নারী জাতির স্বভাব।তার মাও ঠিক এমনি করতো।
“ঠিক আছে।”
“বিকেলে যাবো?”
“কার সাথে যাবেন?”
“একাই যেতে পারবো ”
মস্তিষ্কে অনেক কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।ইচ্ছে হচ্ছে আচ্ছামত কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে।একা যাবে!কত সহজেই বলে ফেললো।ছেলে হয়ে সামাজিকতা বুঝে অরণ্য। সন্ধ্যার সেটা আরো আগে জানার কথা।তাছারাও সে একবারও হ্যা অথবা না বোধক কোনো উত্তর দেয়নি।কিন্তু সেই কথাগুলো বলার হয়তো অধিকারটা নেই।কিছু সময় ব্যয় করে,
“আমি গিয়ে দিয়ে আসবো”
“আচ্ছা”
মাথা ব্যাথাটা চড়ে বসলো।একটা মানুষ এতটা শান্ত কিভাবে হতে পারে?কেনো কথার পৃষ্টে সে কোনো কথা বলে না?প্রশ্ন করে না!কথা বাড়াতেই চায় না সে।এত কিসের তাড়া?প্রথমে রাগ হতো তার উপস্থিতিতে।এখন রাগ হয় তার চুপচাপ থাকা স্বভাবে।
মোবাইলের আওয়াজ বেজে উঠলে ফোন হাতে তুলে নেয় অরণ্য।আবিদ গতকাল প্রোগ্রামের ছবিগুলো সেন্ড করেছে।ছবিগুলো চেক করতে করতে একটা ছবিতে আটকে যায়।অরণ্য আর সন্ধ্যার ছবি।ছবিটি দেখার সাথেসাথে মাথায় আসলো আবিদের সেই কথাটি।তুই যা বর্ণনা দিয়েছিস সন্ধ্যা দেখতে ততটাও খারাপ না।এটার বাছ বিচার করতে হবেতো নাকি? জুম করে নেয় সন্ধ্যার মুখশ্রী।প্রথমেই প্রখর দৃষ্টি স্থাপন করেছে তার চোখে। ঘন পাঁপড়ির নিচে ঢাকা পড়া এক জোড়া ডাগর ডাগর চোখ।যেখানে ডার্ক সার্কেল বড্ড বেমানান।কপালের মধ্যভাগে কালো টিপটা দারুন মানিয়েছে।তারপর পুরো মুখটাই ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেয়।মন খারাপের ছাপ পুরো মুখ জুড়ে।ছবি তোলার জন্য হয়তো চিকন ঠোঁট জোড়ায় এক চিলতে হাসি ফুটেছে।মন খুলে হাসলে বোধয় আরো ভালো লাগতো।
অরণ্য নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো, “এসব আগে খেয়াল করা হয়নি কেনো?”
__
তিন চাকার রিকশায় চড়ে যাচ্ছে সন্ধ্যা অরণ্য।বাইকটা এখনও ঠিক হয়নি।ছোট রিকশায় কিভাবে যেনো দুজনের মধ্যে এক বিশাল দূরত্ব।দূরত্ব বজায় রেখেছে সন্ধ্যা।ঠিক গতরাতের মতন।দৃষ্টি আশপাশের প্রকৃতির দিকে।বরাবরের মতই নিস্তব্ধ পরিবেশ।মাঝেমধ্যে অরন্য মুখ ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সন্ধ্যার মতিগতি।নাহ!সে আগের মতই অন্যমনস্ক।
আধ ঘন্টার মধ্যে এসে পৌঁছায় সন্ধ্যাদের বাড়িতে।শেষ এখানে আসা হয়েছিলো বিয়ে করতে।দরজার বাহিরে বিশাল বাগানবিলাস এর ছাউনী।নেমপ্লেটে বড়বড় অক্ষরে লেখা “সন্ধ্যাতারা”।আজ হঠাৎই কেনো যেনো সেখানে চোখ যায়।সদর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় সন্ধ্যার মা আসিয়া বেগমকে।মেয়ে আসবে বলে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন হয়তো।ধীরে সুস্থে হাটা সন্ধ্যার পায়ের গতি বেড়ে গেলো।দ্রুত গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ায়। আসিয়া বেগম কোনোকিছু না ভেবেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। সন্ধ্যা ঠিক মায়ের মাথার উপরে হাত দিয়ে রেখেছে।এই দৃশ্যে অরণ্য ভাবলো বাবা মায়েরা সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দেয়,শান্তনা দেয়।এখানে পুরোটাই ভিন্ন! জামাইকে আসতে দেখে শাড়ির আঁচলে চোখ জোড়া মুছে নিলেন।অস্রু বিলীন হয়ে মুখে হাসি ফুটলো।তার হাসি বলে দিচ্ছে অরণ্যকে দেখে সে ভীষণ খুশি। আসিয়া বেগমকে সালাম জানিয়ে ভেতরে এসেছে তারা তিনজনই।
সন্ধ্যার ঠোঁটের কোণেও হাসি ঝুলে আছে।আজ মলিন হাসি নয়,নাই অনিচ্ছার হাসি।এটা প্রশান্তির হাসি।যেটা এতদিন ছিলো না।মাকে দেখে বোধহয় অন্তরে শান্তি পাচ্ছে?
সন্ধ্যা বলে উঠলো, “বাবা কোথায় মা?”
আসিয়া বেগম প্রতফুল্লতার সাথে উত্তর দিলেন,
“তোর বাবা তুই আর জামাই আসবে শুনে পাগল হয়ে গেছে।এক ঘন্টা হলো বাজারে গেছে।মনে হয় পুরো বাজারটাই তুলে আনবে।”
সন্ধ্যার বাবা জয়নাল সাহেব এসেছেন।হাতে বাজারের ব্যাগ।তার পেছনে আরো একজন আছেন।তার নাম শফিক।তার হাতও বাজারের ব্যাগে ভর্তি।এসে কোনো রকমে হাত ধুয়ে মেয়েকে সেও জড়িয়ে ধরেছে।বারবার সন্ধ্যাতারা বলে ডেকে যাচ্ছে সন্ধ্যাকে।অরণ্য সবটা দেখছে।ভাবছে তার ঘরে সন্ধ্যা একজন অবহেলার পাত্র আর এখানে?পুরো বাড়িটাই তার নামে।আর বাড়ির মানুষগুলো একান্তই তার।এখানে সর্বত্র রাজত্ব তার।তারপরও কোনো চঞ্চলতা নেই কেনো?শুধু এক টুকরো প্রফুল্ল এর হাসি ছাড়া।
খাওয়া দাওয়া পর্ব সেরে বিদায়ের পালা।অনেক অনুরোধ করেছিলেন অরণ্যের শশুর শাশুড়ি আজ রাতটা থেকে যাওয়ার জন্য কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।আজ অফিস কামাই করেছে। কাল একদিনের কাজ শেষ করে অফিসে যেতেই হবে।মায়ের কথায় সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেছে সন্ধ্যা অরন্যকে বিদায় দিতে। দ্বিধা নিয়ে!যদি রেগে যায়?
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অরণ্য নিজে থেকে বলে উঠলো, “আসি”
“জ্বি”
অরণ্য হাঁটছে, হাটতে হাটতে অনেক দূর এগিয়ে যায়।যতটুকু রাস্তা পাড় হচ্ছে ততই ভার হচ্ছে চিত্ত।আকষ্মিক এক ঢের মন খারাপেরা ভিড় করতে শুরু করেছে।মুখে আপনাআপনি মলিনতা ঝাঁক বেঁধে ঝুঁকে পড়ছে। গলির মোড়ে গিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরণ্য।পেছন ফিরে তাকানোর তাগাদা দিচ্ছে মস্তিষ্ক।এর আগে কোনো জোর চললো না। সর্বাঙ্গে ঘুরে তাকায়। সন্ধ্যা দাড়িয়ে।এখনও দাড়িয়ে আছে সে।সাথেসাথে ঘুরে দ্রুত হাটা শুরু করে দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গেলো।
__
“ঘরে বউ নেই নিজেকে আবার ব্যাচলর মনে হচ্ছে তাই না বন্ধু?”
আবিদ কল করেছে।ইতিমধ্যে জেনে গেছে সন্ধ্যা বাড়ি নেই।মার বাড়িতে গিয়েছে।দুষ্টুমির ছলে একটার পর একটা কথা বলেও যাচ্ছে।অথচ ওপর প্রান্তে থাকা অরণ্য চুপ। বিনা শব্দে আবিদের খোচা মারা কথা শুনছে।যতটুক তার ধৈর্য ক্ষমতা সায় দেয়।
আবিদ আবার বললো, “ভালোই হয়েছে।তুই তো চাইতিস একটু একা থাকতে। সন্ধ্যারও একটু হাসিখুশি থাকার অধিকার আছে।তোদের দুজনের জন্যই ভালো হলো!”
আবিদের পাশে থাকা রুমানা বারবার স্বামীকে না করে যাচ্ছে উল্টোপাল্টা বলতে।আবিদ কোনো কথাই শুনলো না।একটার পর একটা গায়ে লাগিয়ে কথা বলে যাচ্ছে।
“আমি আসি বন্ধু? দুজন মিলে আড্ডা দিবো, চিল করবো?”
মুখ খুললো অরণ্য, “আমার বউ বাড়ি গেছে।তোরটা তোর সাথেই আছে।তুই বরং তোর বউকে সময় দে। আমি একাই ঠিক আছি”
অবাক হওয়া সুরে আবিদ প্রশ্ন করলো, “কি বললি তুই?”
“কি বলেছি শুনিস নি?”
“প্রথম লাইনটা কি বলেছিস বলতো?”
“ফোনটা রাখ আবিদ।”
“এই না শোন! তুই কি বলেছিস আমার বউ?”
“হ্যা তো?”
“সন্ধ্যাকে নিজের বউ হিসেবে মানিস?”
এই প্রশ্নের উত্তর অরণ্য দিবে না।জানে আবিদ। ভেবেছিলো ফোনটা কেটে দিবে নয়তো রাগ দেখাবে।তেমন কিছুই হলো না। জনাব মুখে তালা এটে বসেছেন। হুটহাট চুপ হয়ে যায় এখন।তার চুপ হয়ে যাওয়ার স্বভাবটা অন্যকারো চোখে না লাগলেও আবিদের চোখে ঠিকই লাগছে। সন্ধ্যার ভূত চেপেছে হয়তো।তার মতই নিস্তব্ধতায় সময় কাটানো আয়ত্ব করে নিচ্ছে নিজের মধ্যে।আবিদ কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দেয়।অরণ্যকে সময় দেওয়া উচিত।নিজেকে নিয়ে ভাবার জন্য সময়। সন্ধ্যাকে নিয়ে ভাবার জন্য কিছু নীরব সময়।
ফোন রাখতেই আবিদের স্ত্রী খানিকটা রেগে বললো,
“তোমার এই স্বভাবটা কবে যাবে বলোতো? হ্যা অরণ্য ভাই তোমার বন্ধু।তাই বলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কথা বলবে তুমি? এতোটা রাইট তোমার নেই”
আবিদ হেসে রেগে যাওয়া বউকে বুকে জড়িয়ে নেয়। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“সোজা হাতে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাকাতে হয়। বাকা হাতে ঘি তুলে আগুনে ঢালছি যেনো দাউদাউ করে জ্বলে উঠে”
“তুমি আর তোমার কথা!বুঝিয়ে বলোতো!”
“অরণ্য এখনও সন্ধ্যার মর্মটা বুঝছে না।আমি ওকে বোঝালে বুঝবে কিন্তু সেই বুঝের মেয়াদ কতদিন?ওকে আমি চেস করছি।উল্টোপাল্টা বলছি যেনো ওর মধ্যে সন্ধ্যাকে নিয়ে যে সুপ্ত অনুভূতি দেখা যাচ্ছে তার জাগরণ হয়।দেখো না সন্ধ্যার কথা বলায় কেমন রিয়েক্ট করলো। মানে অরণ্য এখন ঠিক লাইনে হাঁটছে!”
রাত তিনটে,
কোনার ঘরটায় দাড়িয়ে বেলি গাছটায় পানি দিচ্ছে অরণ্য।রাত বিরাতে পাগলের কারবার!কিন্তু সে করছে।সমস্ত মুখে গাম্ভীর্যতা মেখে গাছে পানি দিয়েই যাচ্ছে।পায়ে পানি পড়তেই হুশ ফিরে।এতটাই পানি দিয়েছে যে টব বেয়ে জমিনে পড়তে শুরু করেছে। বিরক্ত হয়ে কিচেন থেকে কাপড় এনে সঙ্গেসঙ্গে মুছে নেয়। টবের অতিরিক্ত পানিগুলোও অতি যত্নে ফেলে দেয়।এটা সন্ধ্যার সখের গাছ।নষ্ট করার উদ্দেশ্য নেই তার।গুনেগুনে পাঁচটি বেলি ফুটেছে।একদম সাদা! সুবাস ছড়াচ্ছে সারা কামরায়। মেটে রঙের টবটার মধ্যেও নানান কারু কার্য করা।অবশ্যই অবসরে বসে সাজিয়েছে।সুন্দর!এসবের মধ্যে আরো একটা কথা মনে পড়ে যায়।সেদিন এমন ভারী টব অরণ্যের চেঁচামেচির কারণে সন্ধ্যার পায়ে পড়েছিল। কথাটি ভাবতেই কেপে উঠে অরণ্য। টব আর মাটির ভার মিলিয়ে ওজন অনেক হবে! নিশ্চই অনেকটা ব্যাথা পেয়েছিলো?আর কেনো পায়ের দিকে একবার চেয়ে দেখা হয়নি।ভুলে গেছে হয়তো অরণ্য। সন্ধ্যার কোনো মূল্য নেই।তাই আর মনে রাখার প্রয়োজনটাও বোধ করেনি।
নিজের ভাবনাকে সাইডে রেখে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।আজ অন্যদিনের তুলনায় কেনো থমথমে পরিবেশ? আগেওতো সন্ধ্যা তার পরেই ঘরে আসতো।বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়ে।ঘন্টাখানেক হলো ঘুমের নাম গন্ধ নেই।অশান্তি লাগছে!চারিদিক কেমন চুপচাপ।এমনটা একাকিত্বইতো চেয়েছিলো অরণ্য।তাহলে?নিজের উপরই বিরক্ত হয়।উঠে চলে যায় কোনার রুমটায়।শুয়ে পড়ে।ফুলের সুবাসে মত্ত হয়ে ঘুমেরাও এসে ধরা দেয় নেত্র-মধ্যেতে।
চলবে..