মোহ মুক্তি ~ ১২
লেখা : Azyah(সূচনা)
সমস্ত বাস জুড়ে হইহুল্লোড়।সবাই যারযার সিট থেকে ঘুরে বসে আছে।কেউ গিটার বাজাচ্ছে,কেউ গান করছে।কেউ তাদের সাথে গলা মেলাচ্ছে।সেখানে অন্যমনস্ক অরণ্য।সেও পছন্দ করে এসব।অন্যান্য ট্রিপে সেও তাদেরকে যোগ দিত।আজ ভিন্ন। আসার পথে ঠিকমতো বিদায়টাও নেওয়া হয়নি।এই অস্থিরতাটাই পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলছে তাকে।কাউকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয় না।আপনাআপনি হয়ে যায়। অপরপক্ষের থেকে চাওয়া পাওয়া বাড়ে। আকাঙ্ক্ষা আকাশচুম্বী হয়। সন্ধ্যা সেই সব পথে দাড়ি একে দিয়েছে।এরপর যাওয়ার পথ খোলা রাখেনি। অপরাধবোধ হচ্ছে অন্তত আজ এসব বিষয়ে তর্ক না করলেও চলতো।এসে সুন্দরভাবে একটা আলাপ করা যেতো।সেই সুযোগটা অরণ্য নিজ হাতে নিঃশেষ করে দিয়েছে।বারবার সন্ধ্যার বলা কথাগুলো কানে বাজছে।তাহলে কি সে কোনোদিন স্বাভাবিক হবে না?সে স্বাভাবিকটা তার কাছে অস্বাভাবিক।
হঠাৎ মন থেকে আওয়াজ আসলো, “ভেঙে গুড়িয়ে দিতে হবে।যেদিন কান্নার বন্যা বইবে সেদিন ইচ্ছেরাও পূর্ণতা পাবে”
মিড ব্রেকে বাস থেমেছে।এখানে সবাই ফ্রেশ হবে।হালকা খাওয়া দাওয়া সেরে নিবে।তাদের উপেক্ষা করেই অরণ্য বাহিরে। সারিসারি বাসের পাশে একটু ছোট চায়ের দোকান।একের পর এক সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছে।খাবারের ক্ষিদে যেনো সিগারেটে মেটাচ্ছে।এই নিকোটিনের ধোঁয়া তার টেনশনকে উড়িয়ে নিয়ে সক্ষম?
অরণ্যকে খুঁজতে খুঁজতে আবিদ তার কাছে এসে দাঁড়ায়।বলে,
“তুই না খেয়ে এখানে কি করছিস? বাসে বসেও খেলি না।”
“ক্ষিদে নেই”
“সিগারেট খেলে পেট ভরবে?উঠে আয়।”
“বললামতো আবিদ ক্ষিদে নেই।জোর করিস না”
অরণ্যকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে আবিদ।পাশে এসে বসে।হাত থেকে অর্ধেক খাওয়া সিগারেট টেনে নিয়ে বলল,
“আজ বলেই ফেল তোর কি সমস্যা?আমি এতটুকু জানি তোর এমন অবস্থার কারণ সন্ধ্যা।বাকিটা শোনা ”
দু হাতে চুল মুঠ করে ধরে আছে অরণ্য। মাথাটা ঝুঁকিয়ে চোখ বুজে আছে।একই ভাবে বসে থেকে বললো,
“তোকে বললে সমস্যার সমাধান হবে না।আর আমার সমস্যা আমারই সমাধান করা দরকার।”
“সে কথাও ঠিক আছে।তুই কি পুরো ট্রিপ এভাবেই থাকবি?একটু ইনজয় কর”
“চেষ্টা করবো”
এই চেষ্টা কতটুকু সফল হবে সেটা অরণ্য নিজেও জানে না।সফল না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।যেখানে মন টেকে না সেখানে আনন্দ করা যায়?সামান্য হাসিটাওতো বিতৃষ্ণা লাগে।বাকি দুটো দিন এখানে বন্দির মতন কাটাতে হবে ভেবেই শিউরে উঠছে অরণ্য।
___
গগন জুড়ে নীলচে আভা।প্রভাতের প্রারম্ভিক অংশ।একটু পরেই হবে সূর্যোদয়। পশ্চিমাকাশে নিজের রশ্মি ছড়িয়ে উদ্ভাসিত করবে ধরণীকে।অথচ এই তমাসাছন্ন রাতটাই নিশিই শ্রেয় লাগছিলো সন্ধ্যার কাছে। চারিদিকের অস্পষ্টতা মনে ধরেছিলো।রাত শেষ হয়েছে। কোথায় লোকাবে এখন দুর্বহ হৃদয়কে? বক্ষের ঠিক বামপাশটায় যে আবেগহীন হৃদপিণ্ড আছে তার হটাৎ করে অস্থির হয়ে যাওয়াকে কিভাবে আটকাবে?
“আপনি সারারাত ঘুমাইলেন না।এখন একটু শুইয়া পড়েন”
রেহানা খালার কন্ঠস্বর।অনেক করে না করার পরও কাল রাতটা সন্ধ্যার সাথে থেকেছে।মায়া জন্মে গেছে অল্পদিনেই সন্ধ্যার প্রতি তারও।সেও অবাক হয় সন্ধ্যার স্বভাবে।তবে মুখ ফুটে কিছু বলে না।
“না খালা সকাল হয়েছে এখন আর ঘুমিয়ে কি করবো।একটু পরই বাবা আসবেন”
“তাইলে আমি নাস্তা বানাই”
উঠে দাড়ালো সন্ধ্যা।দুইহাতে চুল খোঁপা করে কফির মগটা হাতে তুলে নেয়।এই কফি তার নির্ঘুম রাতের সাক্ষী। সঙ্গীও বটে।সে বললো,
“আমিই বানাই।আপনি ঘরটা গোছাবেন?”
“আচ্ছা দিতেছি”
বাবার কল এসেছে।আধ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।বিয়ের পর এই প্রথম আসছেন তিনি।তার খাতির যত্নে কয়েকপদ নাস্তা রেডি করছে।বিয়ের আগে তার হাতের চা না খেলে বাবার সকালই শুরু হতো না।এইকটা দিন কিভাবে কাটিয়েছেন কে জানে?প্রশ্ন করলেতো উত্তরও দেন না। শুধুই আশ্বাস দেন ভালো আছেন,ঠিক আছেন।শুধুই আশ্বাস। মিথ্যে আশ্বাস!
সারারাতের জার্নি শেষে মাত্রই হোটেলে এসেছে অরণ্য।নিজেকে শান্ত রাখতে ঘুমকে বেছে নিয়েছিলো।এক ভয়ংকর স্বপ্ন সেই ঘুমটাও কেড়ে নেয়।নিজেকে আর স্বাভাবিক করা হলো না। সন্ধ্যাকে মনে করার পাশাপাশি হারানোর ভয় এবার মন মস্তিষ্কে চড়াও হয়েছে।আনচান করছে বারবার।নিজের ইগোর কাছে হার মেনে সারারাত কল করেনি।এখন ভাবলো বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।নিজের সাথেই জুলুম হচ্ছে। দ্রুত ফোন হাতে নেয়।নাম্বার ডায়াল করতেই ঘরে এসে ঢোকে রাফসান,আবিদ এবং আরেকজন। ফোনটাও কেড়ে নিলো।
আবিদ বললো, “প্রকৃতি দেখতে এসেছি এখানে ফোন নট অ্যালাউড”
“একটা ইম্পর্ট্যান্ট কল করবো”
রাফসান এরই মধ্যে বললো, “এখন কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কল না।চলেন দ্রুত বাহিরে ব্রেকফাস্ট রেডি”
এতগুলো মানুষের বিপক্ষে কথা বলা হয়ে উঠে না।তাদের কথা মেনে নিয়ে বাহিরে চলে গেছে।নাস্তার টেবিল জমজমাট।বড় টেবিলে সবাই একসাথে খেতে বসেছে।সবার মুখে একটা জিনিস লক্ষণীয়।হাসি।এদের দেখে মনে হয় কারো কোনো চিন্তা নেই।জীবনে কোনো সমস্যা নেই।অরণ্য বোধহয় নিজেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।এখানে বসেও অনেকবার চেষ্টা করেছে আবিদের কাছ থেকে ফোনটা নেওয়ার।পেলো না!রাগ দেখানোর সুযোগ নেই।অযথা পরিবেশ নষ্ট হবে। উসখুস করতে থাকা অরণ্য কোনো রকমের নাস্তা করেছে।গলা দিয়ে কাল রাত থেকেই খাবার নামছে না।
সারাদিন আশপাশ ঘোরা শেষে রুমে এসেছে অরণ্য।টিভি অন করে দিব্যি ক্রিকেট ম্যাচে মনোনিবেশ করে আছে আবিদ।হুট করে রিমোট নিয়ে টিভি বন্ধ করে দেয় অরণ্য।বলে,
“এবার মোবাইলটা দে অন্তত!”
“কি করবি?”
“কল করবো”
“কাকে?”
চুপ বনে গেলো অরণ্য।মুখ ভোতা করে চেয়ে আছে আবিদের দিকে।আবিদ হেসে বললো,
“সন্ধ্যাকে কল করবি?”
“হুম”
“কেন করবি? ও তোর কিছু হয়?”
“ফাজলামো করিস না। ফোনটা দে!”
“তোকে আমি ফোন দিবো না।দেখি তুই কতটা কাতরাতে পারিস।”
__
সময়ের পাল্লা ভারি করে দুটো দিন কেটে গেছে।আবিদ নাছোড়বান্দা।একটা বারের জন্য ফোন হাতে দেয়নি অরণ্যকে।মাঝেমধ্যে আবিদকে দেখে অরণ্য ভাবে সেকি আসলেই তার ভালো চায় নাকি খারাপ চায়?কখনো বোঝায়।আবার কখনো টিটকারী করে। সন্ধ্যার পক্ষ হয়ে কথা বলে আজ তার থেকেই দুর করে রেখেছে অরণ্যকে। আবিদকে বোঝাটাও অনেকটা কঠিন। গিরগিটির মতন রং বদলায় মুহূর্তে মুহূর্তে।হোটেল থেকে একটু দূরে,সামান্য উচু পাহাড় চূড়ায় ঠান্ডা ঘাসে শুয়ে আছে অরণ্য।রাতের আধারে আকাশের নক্ষত্রগুলো হীরের মতন চমক দেখাচ্ছে।ঝলমলে!সুন্দর! ছাইফাস গিলে হুশ আছে না থাকার মতই। কখনো চোখজোড়া বন্ধ করে।আবার সেই বন্ধ চোখে বিদঘুটে আঁধার নেমে এলে চোখ খুলে ফেলে।এই প্রক্রিয়া পাশেই বসে দেখছে আবিদ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে ফোনটা বের করে এগিয়ে দিলো।
বললো, “কথা বলে নে।আর হ্যাঁ সব শটআউট করবি।এর আগে কথা যেনো শেষ না হয়।আমি ওই পাশটায় গেলাম”
গলাটা বারবার শুকিয়ে আসছে। চোখটাও ঝাপসা।নেশা মাত্রারিক্ত চড়েনি। তারপরও যেনো বোধ হচ্ছে ঘুরছে ভূমি আর এই আকাশ।নেত্র দ্বারে জমে থাকা পানির কনা একটু খানি বেয়ে পড়লো। রক্তিম চক্ষু আগুনের মত জ্বলছে। ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নেয় অরণ্য।
বুকটা কেঁপে উঠে সন্ধ্যার।অনেক রাত হয়েছে।ভুল করেও দিনে কখনো অরণ্য কল করেনা।রাতের বেলা প্রশ্নই আসেনা।মানুষের মস্তিষ্ক অযথাই খারাপটা সর্বপ্রথম ভাবে।ফোনটা ধরেই বললো,
“হ্যালো”
অন্যপাশ থেকে কোনো উত্তর আসেনি।ঘন এলোমেলো শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।চিন্তা বাড়লো। সন্ধ্যা নিজের অবাঞ্ছিত অস্থিরতা নিয়ে ভাবতে না বসেই চট জলদি প্রশ্ন করে বসে,
“কি হয়েছে?কোনো সমস্যা?কথা বলছেন না কেনো?”
এক ভিন্নরকম ব্যাকুলতা ভরা কণ্ঠে সময় নিয়ে জবাব এলো,
“সবসময় আমিই বলি।আজ শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে”
সন্ধ্যা থামলো।ভাবলো এরপর উত্তর দিলো, “এভাবে কথা বলছেন কেনো?”
“সন্ধ্যা!আমার কিছুই ভালো লাগেনা”
“প্রকৃতির সৌন্দর্য আপনার মন ভালো করতে পারেনি?”
“আজকাল সৌন্দর্যে মন টানে না”
“ঘুমিয়ে পড়ুন”
ঝিমুতে থাকা চোঁখগুলো হঠাৎই সজাগ হয়ে গেলো। ফোনটা কানের সাথে চেপে বললো, “আমি সবকিছুর সমাধান চাই”
“হ্যা সমাধান আছে।”
আগ্রহী কণ্ঠে অরণ্য প্রশ্ন করলো, “বলেন কি সমাধান?”
“আপনার জীবনে ভালোবাসা নামক জিনিসটা দরকার।”
হাসি ফুটে অরণ্যের মুখে।অস্থির শ্বাস প্রশ্বাস ক্ষ্যান্ত হলো। প্রশান্তি ছুঁয়ে দিতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা তার অভ্যন্তরের অনুভূতিগুলোকে নাম সহকারে বলে ফেলেছে।নিজের প্রটফুল্লতাকে দমিয়ে বললো,
“অনেক দরকার হয়তো”
ঝড়ো নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেলো যান্ত্রিক ফোনের ওপাশ থেকে।সন্ধ্যা বললো,
“আর এই ভালোবাসাটা আমি আপনাকে দিতে পারছি না।চাইলেও পারবো না।না আমি আপনাকে চোখের প্রশান্তি দিতে পারবো নাই মনের প্রশান্তি।আপনার অধিকার আছে!আপনার জীবনে ভালোবাসার মানুষ থাকার প্রয়োজন আছে।সুখ দুঃখ ভাগ করার জন্যও!…..আপনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন।আরেকটা বিয়ে করে নিন।আজ থেকে আপনাকে মুক্ত করলাম”
মাথায় তুলে আছড়ে ফেলার অনুভূতি কেমন হয়?সেটা অরণ্য বুঝতে পারছে।শেষ দুটো লাইন সন্ধ্যার। বজ্রপাতের মতন কর্ণকুহরে এসে পৌঁছেছে।কান ভেদ করে হৃদয়ে আঘাত করেছে সরাসরি। অদৃশ্য রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে।স্পন্দনের মাত্রা বাড়িয়ে হৃদয় থেকে জেদি উত্তর আসলো,
“দ্বিতীয় বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না।করবো না!একদম করবো না!”
“সমাজের ভয়ে নিজের জীবন নষ্ট করবেন না”
“আমি আপনার কাছ থেকে মুক্তি চাই না”
“মোহ,মায়া আর ভালোবাসার তিনটের আলাদা সংজ্ঞা হয়।আপনি গুলিয়ে ফেলছেন।……আমি রাখছি”
নিরুদ্যম সর্বাঙ্গে এক তেজী অনুভূতি কম্পন ধরিয়ে দিয়ে গেলো। দাউ দাউ করে জ্বলছে এক অন্তর্হিত শিখায়। বিছানার চাদর টেনে ফেলে দিলো জমিনে।উত্তম ডাগর ডাগর আঁখিতে।ভারী নিঃশ্বাস ছাড়ছে বারবার।নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অরণ্যকে যেই কথাগুলো বলেছে?সেই জেদটা কার উপরইবা ঝাড়বে?নিজের উপর?নিজেকে অনেক আগেই হারিয়েছে সন্ধ্যাতারা। জ্বলেপুড়ে ছাই হয়েছে অনেককাল পূর্বে।নিজের কণ্ঠের চেয়ে অন্যের রূপের ঝংকার কানে এসে অত্যাধিক মাত্রায় বারি খায়।নিজের কন্ঠকেওতো খুঁজে বেড়াচ্ছে অনেকদিন যাবত।
লিখে ফেললো এক বিদারক বাক্য,
“এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় মুক্তি দেবো”
চলবে…