দর্পহরন #পর্ব-৭

0
361

#দর্পহরন
#পর্ব-৭

ইব্রাহিম পরিবার এখনো যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যৌথ পরিবার বলতে সালিম সাহেবরা তিন ভাই একত্রে থাকা আর কি। বাবা গত হওয়ার পর মা বিছানাগত। এতোদিন ইব্রাহিম মোর্শেদের স্ত্রী এ বাড়ির বড় বউ মিনু পরিচালনা করতো সংসার। রিমা তার সাথে সাথে থাকতো। গত মাসখানেক সে কানাডায় তার বড় মেয়ের কাছে গেছেন। মেয়ের বাচ্চা হবে সেই উপলক্ষে। তারপর থেকে রিমার উপর সংসারের দায়িত্ব চেপেছে।

এ বাড়ির বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে। মোর্শেদের এক মেয়ে যার বিয়ে হয়েছে বাড়ির কাছেই আর সালিমের ছেলে সোহেল বাদে দুই ভাইয়ের বাকী চার ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে থাকে। কেউ পড়াশোনা করছে কেউ পড়া শেষে চাকরি করছে। তাদের কারো মধ্যেই দেশে ফেরার টান নেই কিংবা বলা যায় দেশে ফিরতে চায় না।

ইব্রাহিম সালিমের ছোট ভাই ইব্রাহিম তাহের এখনো ব্যাচেলর। বিয়ে করেনি, দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়, টুকটাক লেখালেখি করেন শখের বসে। কিছুটা আলাভোলা স্বভাবের মানুষটা বেশিরভাগ সময় ঢাকাতে নিজের ফ্লাটে নির্জনে থাকে। কালেভদ্রে বাবার তৈরি করা বাড়িতে আসেন। আসলে তিনি এই বাড়িতে এসে থাকতে পারেন না। দমবন্ধ হয়ে আসে তার। মনেহয় এ বাড়ির প্রতিটা ইট অভিশপ্ত। যে অন্যায় তার দুই ভাই করে তা স্বচক্ষে দেখা তার পক্ষে সম্ভব না। আবার ঠেকানোও সম্ভব না সম্পর্ক নষ্ট হবে এই ভয়ে তিনি এসব থেকে দূরে থাকেন। তার বৈরাগী জীবনে বেঁচে থাকার রসদ বলতে তার ভাইয়ের বাচ্চারা। এরা সবাই তাদের ছোট চাচাকে অত্যন্ত পছন্দ করে। তাদের জীবনের যাবতীয় সিক্রেট তাদের ছোট চাচা জানে।

সে জানা থেকেই তাদের মেঝ ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে শারমিন শুভ্রা তাকে ফোন করেছিল সপ্তাহ খানেক আগে। দেশে ফিরবে সে বাবা মাকে না জানিয়ে। তার পঁচিশতম জন্মদিন সে বাবা মায়ের সাথে স্পেশাল ভাবে কাটাতে চায়। সেই হিসেবে তার ফ্লাইট ছিল দিন পাঁচেক আগে। তাহের ভাতিজীকে বরন করার সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু আসল সময়ে ভুলে বসে থাকলেন। যখন মনে পড়লো তখন শারমিনের ফ্লাইট ল্যান্ডের সময় পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। তবুও ভাতিজীকে বারবার ফোন দিলেন। এয়ারপোর্টে এসে খোঁজ নিলেন কিন্তু কোন ভাবেই শারমিনের কোন হদিস পেলেন না। ভীষণ চিন্তিত হয়ে গেলেন তিনি। নানা জায়গায় ফোন করেও যখন কোন কুল কিনারা পেলো না তখন সত্যি সত্যি ভীত হলেন। গেল কোথায় মেয়েটা? বাড়িতে যায়নি তো? এটা ভেবেই
বাড়িতে ফোন দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে ভাবির সাথে আলাপ করে বুঝলেন শারমিন বাড়িতেও যায়নি। এবার হাত পা ঘামতে শুরু করলো। ভাইকে ফোন দিয়ে জানাবেন সেই সাহস করে উঠতে পারলেন না সোহেলের ঝামেলা শুনে। কেন যেন মনে হলো সামনে বিরাট এক ঝড় আসতে চলেছে তাদের জীবনে। সেই ঝরে তার পরিবার লন্ডভন্ড হবে।

দুইদিন অপেক্ষা করলেন। হাজার বার শারমিনের নাম্বার ডায়াল করলেন। কিন্তু বন্ধ শুনতে শুনতে কান বন্ধ হওয়ায় উপক্রম। অবশেষে মনস্থির করে লন্ডনে থাকা শরীফকে ফোন দিলেন। সব ঘটনার বিস্তারিত জানালেন। শরীফ জানালো সে খবর নিয়ে জানাচ্ছে। পরেরদিন শরীফ যখন জানালো
শারমিনের ইউনিভার্সিটিতে উইন্টারের ছুটি শুরু হয়েছে। সে তেরো তারিখ রাতে ফ্লাইটে উঠেছিল। দুবাইতে ট্রানজিট ছিলো সাতঘন্টা। সেই হিসেবে পনের তারিখ সকালে তার বাংলাদেশে ল্যান্ড করার কথা। আজ আঠারো তারিখ। শারমিনের ফোন বন্ধ। শারমিন বাসায় যায়নি তাহলে গেছে কোথায়? কোথাও না গেলে শারমিনের সাথে কি হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আঁচ করে চাচা ভাতিজা দু’জনেই ঘামতে শুরু করেছে। দু’জনেই জানে, এই ঘটনা সালিম সাহেবের কানে গেলে কেয়ামত ঘটে যাবে। শরীফ চাচাকে অভয় দিল, সে রাতেই ফ্লাইটে উঠবে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। বাবাকে এখনই কিছু জানাতে মানা করে। সে এসে বাবার সাথে কথা বলবে।

মাঝে আরও একদিন কেটে গেছে। শরীফ এলো বিশ তারিখ বিকেলে। তাহের শরীফকে নিয়ে ইব্রাহিম ভিলায় পা রখলো রাত এগারোটার কিছু পরে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে সালিম, মোর্শেদ, সোহেল আর রিমা। সে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আঁচলে চোখ মুছছে। সালিমের ব্যক্তিগত সহচর তুহিন দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সকলের চেহারা অন্ধকার, পুরো বাড়ি থমথমে। চাচা ভাতিজা দু’জনেই দু’জনকে দেখলো। ওদের ভেতরে ঢুকতে দেখে সকলেই অবাক হলো। বিশেষ করে শরীফকে দেখে। সালিম সাহেব বলেই ফেললেন-“তুমি হঠাৎ দেশে এলে? তোমাকে কে খবর দিলো?”
শরীফ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে-“কিসের খবরের কথা বলতেছেন? আপনাদের সবার কি হয়েছে? মা কাঁদছে কেন?”
রিমা শরীফকে দেখে দৌড়ে এলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো-“ও শরীফ, শারমিনরে কে জানি অপহরণ করছে। তুইল্লা নিছে আমার শারমিনরে। ও আল্লাহ কি হইলো এইসব?”
শরীফ আর তাহের দু’জনেই চমকে উঠে একে অপরকে দেখলো।

★★★

একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল রণর। মেয়েলি ডাকে চমকে উঠলো। সামনে সদ্য গোসল করে আসা শুভ্রা দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে হাফ হাতা গেন্জি আর ঢিলেঢালা প্যান্ট। চুল থেকে এখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে, মুখটা টলটলে হয়ে আছে। চোখ দুটো ম্রিয়মান। ফর্সা উন্মুক্ত বাহু নেশা ধরায়। রণ নজর সরিয়ে বললো-“আপনাকে এসব পোশাক পরতে নিষেধ করেছিলাম।”
শুভ্রা চেয়ার টেনে সামনে বসলো-“শুনুন, পোশাকটা একদম নিজস্ব পছন্দ আর আরামের ব্যাপার। কাজেই এ ব্যাপারে কারো কোন কথা বলা উচিত না। আপনি যেমন সুন্দর শার্ট প্যান্ট পরে আছেন এখন কেউ যদি আপনাকে শর্টস আর স্যান্ডোগেন্জি পরে থাকতে বলে তাহলে ভালো লাগবে বলেন?”
রণ জবাব দিলো না দেখে শুভ্রা পুনরায় বললো-“আপনার শর্ত অনুযায়ী কাজ শেষ করেছি। চেক করে নিন।”
“পরে করবো। এখন খেয়ে নিন।”
রণ খাবার প্লেটে বেড়ে শুভ্রার সামনে দিলো। আয়োজন খুব সামান্য। সাদাভাত, ডাল, ডিম ভাজি আর আলুভর্তা। শুভ্রা প্রায় হামলে পড়লো খাওয়ার উপরে। কিন্তু কয়েকগ্রাস খাওয়ার পরেই ওর রুচি নেমে গেলো। পেট মুচড়ে উঠলো। গলার ব্যাথাট বেশ ভোগাচ্ছে তাঁকে, শরীরও শীতে কাঁটা দিচ্ছে। মনেহচ্ছে আবারও জ্বর আসছে। সে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো। রণ কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“খাবেন না?”
“নাহ। গলাটা খুব ব্যাথা করে আর জ্বর আসছে আবার।”
রণ জবাব না দিয়ে খাবার গুছিয়ে রাখলো। শুভ্রা ওষুধ মুখে দিয়ে রণকে ডাকলো-“আমি তো আপনার শর্তে রাজি আছি। চেয়ারে বাঁধার প্রয়োজন আছে?
“আপনি চাইলে বিছানায় থাকতে পারেন।”
“ধন্যবাদ।”
রণ ফিরে আসতেই শুভ্রা ডাকলো-“শুনুন, আমার সময় কাটানোর কোন বন্দোবস্ত করুন। এভাবে থাকতে কষ্ট হয়। কখনো এমন বন্দী থাকিনি বুঝতেই তো পারছেন।”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো-“টিভি তো নিজেই ভাঙলেন। অবশ্য থাকলেও যে দেখতে পেতেন এমন না।”
শুভ্রা বিরক্ত হলো-“আমাকে বরং কিছু বই এনে দিন।”
রণ জবাব দিলো না। শুভ্রা গায়ে কম্বল চেপে চোখ বুঝলো। আর চোখ খুলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে।

মিহির খানিকটা গম্ভীর হয়ে আছে। রণ জানতে চাইলো-“কি হয়েছে?”
“ক্যালকুলেশন উলট পালট হয়ে গেলো না? ওই সাংবাদিকের মেয়েটাকে বিয়ে করবে এইটা তো বুঝি নাই।”
“আমি ভেবেছিলাম। ওনার পক্ষে সবই সম্ভব। তবে এই কাজ সে নিজের ইচ্ছায় করে নাই। দলের চাপে করেছে। না করলে খুব খারাপ ইমেজ হতো দলের। ওনার একার জন্য সার্বিকভাবে দল ক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা কেউ মানবে না।”
রণর কথায় মিহির সন্তুষ্ট হলো। একটু গম্ভীর হয়ে বললো-“ভাই, এই কয়েকদিনে ওরা অন্য সব ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত ছিলো বলে এইদিকে নজর পড়ে নাই। এখন যখন জেনে গেলো সাবধান থাকা লাগবে। আর আপনের পরিচয় প্রকাশ হলে আরও বেশি ঝামেলা। আপনার উপর রিস্ক বাড়বে।”
“সমস্যা কি? তুই আছিস, রাজিব আছে, দিলশাদ আসবে। আরও কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়ে যাবো আশাকরি। সবচেয়ে বড় কথা স্বয়ং ফুপি আছে সাথে।”
মিহিরের গাম্ভীর্য কমলো না-“ভাই, মাঠে আপনার ফুপু কিছু করতে পারবে না এটা আপনিও ভালো জানেন। উনি অনেক বেশি খারাপ। এখন যা কিছু করতেছে তার জের তুলবে ভবিষ্যৎ এ নিশ্চিত থাকেন।”
“এইজন্যই তো ওনার সবচেয়ে দূর্বল জায়গাটা হাতে এনেছি। নির্বাচন পর্যন্ত নিশ্চিত আছি। তারপর কি হবে তখন দেখা যাবে। এতো ভাবিস না। আচ্ছা, এখন এসব বাদ দিয়ে বল আজকের আপডেট কি? চিঠি পাঠাইছিস?”
মিহির মাথা দুলায়-“হ্যা। সবাই চুপচাপ খুব বেশি চুপচাপ। যদি কেউ কোনভাবে টের পায়?”
মিহির চুপ করে গেল। রণ হাসলো-“টের পাওয়ার কোন উপায় আছে? পাঁচটা বছর ধরে প্রস্তুতি নিছি তাও যদি ঠিক মতো কাজ না করতে পারি তাহলে জীবন বৃথা। বাদ দে। এতো ভাবিস না। কাল আবার দলের মিটিং। দেখা যাক কি হয়। শুনতেছি পরশু নমিনেশনের ঘোষণা আসবে। শোন, তুই ওইদিকে একটু নজর রাখ। কি করে দেখ।”
“নজর আছে। এখনো কোন আপডেট নাই। ওরা হয়তো এমন কিছু কল্পনাও করে নাই। সারাজীবন যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে নেওয়া মানুষকে যদি কেউ তুলে নেয় তাহলে সে কি করবে? আমার মনেহয় ওরা বুঝেই পারতেছে না কি করবে। শরীফ দেশে আসছে আজকেই।”
“ও জানলো কিভাবে?” রণ অবাক হলো।
“তা জানি না। না জানলে তো আসার কথা না। বাপকে দেখতে পারে না তবে বোনকে ভালোবাসে।”
রণ উঠে দাঁড়ায়-“আমি গেলাম। দেরি হইলে মা রাগ করবে।”
মিহির মাথা দুলায়। মিহির টের পেলো রণর চেহারায় দুশ্চিন্তার ছায়া।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here