দর্পহরন #পর্ব-১০

0
350

#দর্পহরন
#পর্ব-১০

“কেমন আছো সালিম?”
“ভালো আপা। আপনার শরীর কেমন?”
নেত্রী মৃদু হেসে মাঝের চেয়ারে বসলেন। ও পাশের চেয়ারে রণ বসে আছে মুখে স্মিথ হাসি নিয়ে।
“আমার ভালো থাকাটা সম্পূর্ণ তোমাদের উপর নির্ভর করে। বয়স হয়েছে, যে কয়দিন বেচে আছি দেশের মানুষের জন্য কিছু করে যেতে চাই। আর সবচেয়ে বড় যে ইচ্ছা তা হলো সন্মান নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে চাই।”
সালিম সাহেব চুপ করে গেলেন। এসব কথার বিপরীতে কথা চলে না আর। নেত্রী ডাকলেন-“সালিম রণর সাথে তোমার আলাপ হয়েছে তো? আজ তোমাদের দু’জনের সাথে খোলাখোলি আলাপ করবো বলেই ডেকেছি। তোমাদের দু’জনার যদি দু’জনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে তাও শুনবো।”
রণ কথা বলে উঠলো-“ফুফু, আমার কোন অভিযোগ নেই। চাচা যথেষ্ট হেল্পফুল।”
নেত্রী সালিম সাহেবকে দেখলেন-“তোমার কথা বলো সালিম। ওকে নিয়ে কোন সমস্যা আছে?”
সালিম সাহেব চুপ করে থাকলেন। নেত্রী কি বুঝে বলে উঠলেন-“সালিম, দেখো তুমি হয়তো ভাবতে পারো তোমার জায়গায় ওকে কেন নমিনেশন দিলাম। তুমি দলের অনেক পুরনো সদস্য সেই বাবার সময়কার। আর তোমাকে খুব বিশ্বাস করি। তুমি এই দলের জন্য অনেক করেছ। তোমার ত্যাগ অনস্বীকার্য তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না সালিম, তোমার খুব বদনাম হয়েছে। আর এই বদনামের দূর্গন্ধ আমাদের দলের মধ্যে চলে এসেছে। যা আমাদের জন্য ভাবনার বিষয়। তোমাকে ছাড়া চলার কথা আমি ভাবতেও পারি না কিন্তু তোমার বদনামও আমার সহ্য হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে এই ব্যবস্থা আমাকে নিতে হয়েছে। রণ তোমার জায়গায় দাঁড়াবে আর তুমি কিছুদিন পরে হওয়া মেয়র নির্বাচনে। আমার মনেহয় এবার তোমার মেয়র পদে ইলেকশন করাটা ভালো হবে।”
সালিম সাহেব আকাশ থেকে মাটিতে পড়েন-“আপা আমি!”
নেত্রী হাসলেন-“দুইবছর পর মেয়র নির্বাচন হবে। ততদিনে রণ এলাকায় আমাদের দলের ভালো রেপুটেশন তৈরি করে ফেলবে। লোকে তোমার কাজ ভুলে যাবে। আশাকরি নির্বাচনে জিততে তোমার কোন সমস্যা হবে না। তুমি আর রণ মিলে একসাথে কাজ করলে আমিও চিন্তা মুক্ত থাকি। বুঝতে পারছো তো?”
সালিম কি বলবে ভেবে পেলো না। নেত্রী পুনরায় বললেন-“শোন সালিম, সামনে প্রচুর বিনিয়োগ আসবে তোমার এলাকায়। জাপানিজরা ওখানে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে চায়। রাস্তাঘাটের নকশা পরিবর্তন হবে। ঢাকা থেকে সরাসরি যাওয়ার জন্য ফ্লাইওভার হবে। নদী বন্দরটা নতুন করে ব্যবহারের উপযোগী করা হবে। বুঝতে পারছো কত বড় ধরনের সুযোগ আসছে সামনে? আর এসব কাজের শর্ত হলো কোন ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকা চলবে না এলাকায়। শান্তি বজায় থাকতে হবে। আর শান্তি বজার রাখতে নিজেদের মধ্যে একতা থাকা খুব জরুরি। ক্ষমতায় টিকে থাকা জরুরি। বুঝতে পেরেছ?”
সালিম মাথা দুলালেন। রণ অবশ্য কোন কথা বলছে না চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।
“রণ আর তুমি মিলেমিশে কাজ করবে। ছেলেটা নতুন এসেছে অনেক কিছু বুঝবে না তুমি ওকে সব বুঝিয়ে দেবে। আর রণ, যে কোন বড় কাজে তুমি তোমার সালিম চাচার মতামত নেবে তাকে সন্মান করবে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে ফুপু।”
“সালিম তোমার কিছু বলার আছে?”
“না আপা, আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে সব।”
নেত্রী সন্তুষ্ট চিত্তে জবাব দিলেন-“নির্বাচনের আগমুহূর্তে তোমাদের ডাকার কারন এটাই যে নির্বাচনের পর যেন কোন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে। আমি ওই এলাকাকে সবচেয়ে শান্তিপূর্ন এলাকা হিসেবে দেখতে চাই। তোমরা দু’জন বিবেচক তাই ভরসা করছি তোমাদের উপর। জানি আমার আশা পূরণ করবে তোমরা।”
রণ উঠে এসে মাথা নিচু করে সালাম করলো ফুপুকে-“দোয়া করবেন ফুপু আপনার ভরসার মান যেন রাখতে পারি।”
নেত্রী রণর মাথায় হাত রাখলেন। পুরো দৃশ্য সালিম সাহেবের হৃদয়ে জ্বালা ধরাল। উনি উসখুস করে উঠলেন। রণ দাঁড়িয়ে বললো-“আমি তাহলে যাই ফুপু। শেষ মুহূর্তের প্রচারনাটা শেষ করি।”
নেত্রী মাথা নাড়লেন। রণ দু’জনকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায়। ওর ঠোঁটের কোনের চোরা হাসি সালিম সাহেবের নজর এড়ায় না। নেত্রী আরও কিছুক্ষণ আলাপ করেছিলেন সালিম সাহেবের সাথে কিছু কোন কথাই মাথায় ঢুকছিল না তার। কোন আলাপে মন ছিল না।

এরপরও আজ পর্যন্ত কয়েকবার দেখা হয়েছে রণর সাথে। রণ প্রতিবার বেশ নমনীয় হয়ে কথা বলেছে তার সাথে। তবুও কোথায় সুক্ষ জ্বলুনি টের পেয়েছে৷ এই নির্বাচনী এলাকা দীর্ঘ দিন ধরে তাদের পরিবারের ছিল। হুট করে সেটা নতুন একজন হস্তগত করবে এটা মেনে নেওয়া তার জন্য ভীষণ কষ্টকর। তার ও তার পরিবারের জন্য সন্মান হানিকর। সামনে এতো এতো কাজ হবে সবটাই ওই পুঁচকে ছেলেটা নিয়ন্ত্রণ করবে এটা ভাবতেই মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে যাচ্ছে। সে জানে নেত্রী তাকে শান্ত রাখতে, হাতে রাখতে মেয়র নির্বাচনের মুলো ঝুলিয়েছে। আর জানে বলেই মেজাজ আরও বেশি বিগড়ে যাচ্ছে। এই বয়সে এসে এরকম হাড় মেনে নেওয়া যায় না। অপমানবোধটা বড্ড খোঁচাচ্ছে তাকে। কিন্তু তার হাত পা বাঁধা। কিছু করতে পারছেন না কেবল নিজের মাথার চুল নিজে ছিঁড়ছেন। তা না হলে ওই রণকে রাস্তা দেখিয়ে দিতেন ঠিক যেমনটা ওর বাপকে দেখিয়েছিলেন বারো বছর আগে।

নিজের কামড়ায় বসে ভাবনায় ডুবে থাকা সালিম সাহেব হঠাৎ চোখ খুললেন। বাইরের ঘর থেকে হইচই এর আওয়াজ আসছে। বেশ একটা হুলুস্থুল পড়ে গেছে মনেহচ্ছে। সালিম সাহেব বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

★★★

দীর্ঘ দুই মাস অপহৃত থাকার পর শুভ্রা বাড়ি ফিরে এলো। মাকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো-“মা, শরীর কুটকুট করছে। গোসল করবো। আমার বাথরুমের গিজারটা ঠিক আছে তো?”
শুভ্রার মা রিমা মেয়েকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুভ্রার কথা শুনে বিহ্বলতা বাড়লো। আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে। সে ছুটে মেয়ের কাছে যেতে গিয়ে আচমকা পিছলে পড়ে মাথা ফা/টি/য়ে ফেললো। ডাইনিংএ সকালের প্রাতরাশ করতে বসা বাড়ির বাকি সকলে রিমার আর্তনাদ শুনে টেবিল ছেড়ে উঠে এসে শুভ্রাকে দেখে হতবাক। হতবাক অবস্থা কাটর আগেই রিমাকে দেখে আঁতকে ওঠে সোহেল আর শরীফ। তুলতুল শাশুড়ীকে জাপ্টে ধরে চিৎকার দিল। সোহেল আর শরীফ বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে।

সালিম সাহেব বাইরে বেড়িয়ে শুভ্রাকে দেখে চমকে উঠলেন। শুভ্রা কখন এলো? পুরো পরিস্থিতি বুঝতে তিরিশ সেকেন্ড লাগলো তার। তিনি অবাক হয়ে একবার বউ আরেকবার মেয়েকে দেখলেন। শুভ্রা তার দিকে তাকালো-“বাবা, তুমি ভালো আছো?”
মানুষটা জবাব দিলো না। শুভ্রা বললো-“আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি। পেট চোচো করছে, খেতে হবে আমার।”
রিমাকে ফিরেও দেখলো না শুভ্রা। বাবার জবাবের অপেক্ষা করলোনা। খুব স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে নিজের রুমে গেলো। পুরোটা সময় ইব্রাহিম সালিম মেয়েকে দেখলেন তাকিয়ে তাকিয়ে। তার ভ্রু কুঁচকে আছে। তিনি মেয়ের ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে এগিয়ে এলেন রিমার কাছে। রিমাকে ধরাধরি করে নিচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তুলতুল আছে সাথে। শরীফ আর সোহেলকে হতভম্ব দেখাচ্ছে। সালিম সাহেব ধমক দিলেন-“আহাম্মকের মতন চাইয়া আছোস কেন? তোর মার লগে যা। এইদিকে আমি দেখতাছি।”
ছেলে দু’টো মাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো। সালিম সাহেব মেয়ের বন্ধ কামড়ার দিকে তাকালেন। শুভ্রা কোথা থেকে কিভাবে এলো এই সকালে? গতকাল নির্বাচন হয়ে গভীর রাতে এই এলাকার ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। ভোররাত পর্যন্ত এলাকায় আনন্দ মিছিল, আতশবাজি আর খাওয়া দাওয়া হয়েছে। আজ সকালে তাই চারিদিক নিরব। এরমধ্যেই শুভ্রার আগমন। প্রতিপক্ষ ভীষণ চতুর এতে কোন সন্দেহ নেই। তারা জানে আজ চারিদিক নিরব থাকবে, কেউ টের পাবে না কিছু। কোন প্রত্যক্ষদর্শী থাকবে না। সালিম সাহেব তুহিনকে ডাকলেন। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তুহিন এগিয়ে এলো-“আপামনি গাড়িতে আইসা নামছে স্যার। সিসিটিভি ক্যামেরায় দেইখা মজিদ আমাকে ডাকছিল। উবারের গাড়ি। আমারে কইলো এয়ারপোর্ট থিকা উঠছে আপামনি।”
“তার মানে কোন ক্লু নাই?”
“নাহ। একমাত্র আপামনিই যদি কিছু বলে।”
সালিম সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন-“যদি কিছু বলে মানে কি তুহিন? লুকাছাপা না কইরা ক কি কইতে চাস?”
তুহিন কেঁপে উঠলো। সত্যি বলতে ভয় পাচ্ছে সে।
“চুপ কইরা আছোস কেন?”
তুহিন কিছু বলতে চাইলো তখনই শুভ্রা বের হলো রুম থেকে। তার চুল ভেজা, চেহারায় স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে ক্লান্তির ছাপ। শুকিয়ে গেছে অনেক, চেহারায় কমনীয়তার জায়গায় রুক্ষতা। তুহিনকে দেখে হাসলো-“তুহিন ভাই, আপনার হাতের ভুনা খিচুড়ি খেতে মন চাইছে সাথে কষা গরুর মাংস।”
তুহিন থতমত খেল। সালিম সাহেবকে দেখে নিল একবার। মৃদুস্বরে বললো-“কখন খাবেন আপামনি?”
“সন্ধ্যায়। এখন নাস্তা করে একটা ঘুম দেব। অনেকদিন ধরে ঘুমাই না। আজকে নিজের রুমে শান্তির ঘুম দেব। ঘুম থেকে উঠে আপনার হাতের খিচুড়ি খাবো।”
“আচ্ছা, আপামনি।”
শুভ্রা টেবিলে বসে প্লেটে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করেছে। টেবিলে থাকা সব খাবার নিয়ে প্লেট ভর্তি তার। সালিম সাহেব তুহিনকে ইশারায় চলে যেতে বলে নিজে গিয়ে মেয়ের কাছে বসলেন-“আম্মু, কোথা থেকে আসলা এতো সকালে?”
শুভ্রা রুটি চিবাতে চিবাতে ঘড়ি দেখলো-“সকাল কোথায় আব্বু? সাড়ে এগারোটা বাজে।”
“আম্মা, কোথায় ছিলা এতদিন?”
শুভ্রার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। হাতের গ্রাস প্লেটে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়-“আমি যাই আব্বা। খুব ঘুম পাচ্ছে।”
শুভ্রা উঠে এলোমেলো পা ফেলে রুমে চলে গেলো। সালিম সাহেব তাকিয়ে দেখলেন, কি বলবেন ভেবে পেলেন না। মেয়েটাকে খানিকটা অস্বাভাবিক লাগছে তার কাছে। ওর সাথে কি খারাপ… না না কিছুতেই হতে পারে না। ওরা বলেছিল নির্বাচনে কোন ঝামেলা না করতে উনি মেনে নিয়েছেন। তাহলে? ওরা কেন কথা রাখবে না?

সালিম সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে মেজাজ ঠিক রাখার চেষ্টা করেন। নতুন ছেলেটার বিরুদ্ধে কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। গত দেড়টা মাস ধরে তুহিন তার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। হয় ছেলেটা সত্যিই ইনোসেন্ট না হয় অতিরিক্ত চালাক। সালিম সাহেব খুব অসহায় বোধ করছেন। একটা মাত্র মেয়ে দুই মাসের অধিক সময় কারো কাছে বন্দী ছিল এটা মাথায় আসলেই মেজাজ চটে যাচ্ছে তার। সবচেয়ে কষ্ট দিচ্ছে যে ব্যাপারটা সেটা হলো তিনি এতোদিনেও কিছু করতে পারেননি। না মেয়ের অ/প/হ/র/ণকারীদের ধরতে পেরেছেন না মেয়েকে উদ্ধার করতে পেরেছেন। না জানি তার মেয়েটা এই দুইমাসে কত কি সয়েছে। চোয়াল শক্ত হয় তার। যদি কোনভাবে জানতে পারতেন এই অতি জঘন্য কাজটা কে করেছে তাহলে তাকে বুঝিয়ে দিতেন তিনি কি জিনিস। সালিম সাহেব অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন নিস্ফল আক্রোশ নিয়ে।

চলবে—
© Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here