#দর্পহরন
#পর্ব-১৩
নদী থেকে বালু উত্তোলনের কাজ নিয়ে বিশাল একটা ক্যাওয়াজ বেঁধে গেছে। এতোদিন এই কাজ এককভাবে ইব্রাহিম পরিবার দখল করে রেখেছিল। ভেতর ভেতর রুষ্ঠ থাকলেও নিজের জীবনের মায়া করে কেউ মুখ খোলেনি। এবার দলেরই আরেকপক্ষ এসে বাঁধা দিলো। প্রথমে কথা কাটাকাটি তারপর হাতাহাতি। খবর পেয়ে সোহেল ছুটে গেলো। মাথাগরম সোহেলের পিস্তলের গুলিতে একজনার লা/শ পড়ে গেলো। এবং একজন দূর থেকে পুরো ঘটনা অবলোকন রেকর্ড করে নিল। থানায় খবর গেছিল আগেই। যা আগে হয়নি তা হলো ইব্রাহিম পরিবারের কাউকে গ্রেফতার করা। সেটাও হয়ে গেলো থানায় আসা নতুন ওসির কল্যানে।
খবরটা ইব্রাহিম সালিম সাহেবের কানে যেতেই তিনি নড়েচড়ে বসলেন। ইদানীং তিনি বাড়ি থেকে কম বের হন। ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ার পর চারপাশে পুরো পরিস্থিতি অবলোকন করে সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্ততু করছেন। হুট করে খবরটা পেয়ে তাই থমকে গেছে। মোর্শেদ ছুটে এলো-“সালিম, চল থানায় যাই। সোহেলরে গ্রেপতার করছে, আমাগো সোহেলরে। ওরা জানে না কার পোলা সোহেল? এইরকম ঘটনা তো আমগোর লগে আগে ঘটে নাই। কি হইলো এইসব? বারবার এইরকম হইতে শুরু করলে তো সমস্যা। আমাগো কামকাজ নিয়া ঝামেলায় পড়ুম।”
থম ধরে বসে থাকা সালিম সাহেব মুখ তুললেন-“থানায় নতুন ওসি আইছে। সে আমাদের চিনে না এইজন্যই মনেহয় ভুল কইরা সোহেলরে তুলছে।”
“আচ্ছা, যাইহোক তুই চল।”
“চলেন ভাইজান। আপনি নামেন আমি পাঞ্জাবি পইড়া আসতেছি।”
তুহিন নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ায়। সালিম সাহেব পাঞ্জাবি পরে চিন্তিত মুখে নিচে নামে। গাড়িতে বসেও চুপচাপ থাকে। মোর্শেদ ভাইকে ডাকলো-“কি ভাবতেছোস সালিম? বালু উত্তোলনের জায়গা পুলিশ সিল করছে। কাম বন্ধ কইরা দিছে। কি করুম এখন?”
“কথা কই আগে তারপর না পরিস্থিতি বুঝুম।”
ওসি সাহেব মিটিং করছিস। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেছিল সালিম সাহেবকে। তাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে সরাসরি ওসির কেবিনে ঢুকে গেলো সালিম। ওসি সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন-“কি চাই?”
সালিম থতমত খেল, এই ওসি কি তাকে চেনে নাই নাকি ইচ্ছা করে এমন না চেনার ভাব করতেছে?
সে দরাজ গলায় বলে উঠলো-“আমি ইব্রাহিম সালিম। প্রাক্তন সাংসদ ও স্হানীয় সরকার মন্ত্রী। আমার ছেলেকে নাকি গ্রেফতার করেছেন?”
ওসি বাকীদের ইশারা করতেই তারা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওসির জামায় ঝুলে থাকা স্টিকারে নাম দেখে নিলেন সালিম, দিলশাদ। ওসি দিলশাদ চেয়ারে হেলান দিলো-“আপনার ছেলে একজনকে গুলি করে মে/রে ফেলেছে।”
কিছু বলতে যাচ্ছিল সালিম তাকে থামিয়ে দিলো ওসি-“চাক্ষুষ প্রমান আছে কাজেই তাকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। হ/ত্যা মামলা হয়েছে। নি/হ/তে/র স্ত্রী মামলা করেছে। এই মামলা কোর্টে উঠবে, কোর্ট ডিসিশন নিবে।”
সালিমের চোয়াল শক্ত হলো। এই ওসিটা বেশ ঘোড়েল বলে মনেহচ্ছে। মোর্শেদ সালিমের হাত ধরে চাপ দিলো। শান্ত থাকার ইশারা করে বললো-“ওসি সাহেব, আপনার বুঝতে ভুল হইছে। সোহেলের এমন কিছু করার কথা না।”
ওসি তখনও ওভাবেই বসে আছে। মুচকি হেঁসে জবাব দিলো-“কোন ভুল হয়নি। রেকর্ড আছে আমাদের কাছে। এই আপনারা আসার কিছুক্ষণ আগেই নি/হ/তে/র স্ত্রী মামলা দায়ের করেছে।”
“কে মা/রা গেছে?”
সালিমের কন্ঠ নরম। দিলশাদ কলম নাড়াচাড়া করছিল। থেমে বললো-“সে আপনি একটু কষ্ট করে খুঁজে নিন।”
সালিম উঠে দাঁড়ায়-“আমার ছেলের সাথে দেখা করবো।”
“সম্ভব হবে না। যেদিন কোর্টে তুলবো দেখা করবেন। আজ না।”
এবার আর সহ্য করতে পারলেন না সালিম, হুঙ্কার দিলেন-“ওই তুই জানোস আমি কে? দুইদিন হইলো আইছোস এই এলাকায় তাই এতো ভাব? ভাব ছুটায়া দিমু।”
দিলশাদের মুচকি হাসি চওড়া হলো-“ওসব আমি জানি। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না আমি এসবে ভয় পাই না। আপনার যা করার করতে পারেন।”
“দেখতেছি তোর এই তেজ কয়দিন থাকে।”
মোর্শেদ ভাইকে থামাতে চায়, দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো-“ওসি সাহেব, কিছু মনে করিয়েন না। ছেলের চিন্তায় পাগল হয়ে গেছে।”
দিলশাদ জবাব দিলো না। মোর্শেদ ভাইকে টেনে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন। মৃদুস্বরে ধমকে বললেন,-“সালিম, কি করতেছোস কি? এইরকম পাগলামির মানে হয়?”
“আপনি দেখছেন ভাইজান, দুইদিনের আসা ওসি কেমনে কথা কইতেছিল? মেজাজ ঠিক থাকবো?”
মোর্শেদ ঠান্ডা গলায় বললো-“সব ঠিক আছে কিন্তু নিজে প্যাচে পইড়া থাকলে মাথাগরম করা যাইবো না। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হইবো। এইগুলা কি তোরে বইলা দেওয়া লাগবে?”
সালিম জবাব দিলো না। তার গা কাঁপছে এখনো। কি করবে কি করবে না ভেবে পেলো না। গাড়িতে উঠে তুহিনকে ডাকে-“তুহিন, নাহিদ কই আছে দেখতো। ওর কাছ থিকা সব খবর বাইর কর। কে মা/রা গেছে আমাকে জানা।”
“আচ্ছা।”
তুহিন নেমে গেল মাঝপথে।
সোহেলের খবরে বাড়িতে আরেকবার শোকের ছায়া নেমে এলেও তুলতুল কেন যেন ভীষণ খুশি হলো। ওই লোকটাকে ক’দিন এ বাড়িতে দেখতে পাবে না এই ভেবে শান্তি পাচ্ছে। তাছাড়া ওর সাথে যা করেছে তাতে জেলে যাওয়াটা কম সাজা। ওর জেলেই পঁচে ম/রা উচিত। ভাবতে ভাবতে তুলতুল কেঁদে দিলো। মা, ভাইয়া, চাচা চাচিকে দেখেনা হিমিটাকে কোলে তুলে আদর করে না কতদিন। ওর খুব ইচ্ছে করে মায়ের কোলে যেতে। কতদিন মায়ের আদর পায় না মেয়েটা। এমনকি কথা বলার ব্যাপারেও কত মানা। অনেক কাকুতি মিনতি করে কথা বলতে হয়। আর মাতো ভয়ে ফোনই দেয় না। তুলতুলের নিঃশব্দ কান্নায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে যায়।
★★★
রণ ঠিক করেছে যত ব্যস্ততাই থাক প্রতি সপ্তাহে একদিন এলাকায় থাকবে। যেখানকার মানুষের ভালোবাসা পেয়ে সে আজ মন্ত্রী হয়েছে তাদের সুবিধার দিকে নজর রাখবে। নিজেকে দেওয়া কথা রাখতেই প্রতিসপ্তাহে রণর পিতৃভুমে আগমন। আজও এসেছে। কয়েকজন নেতাকর্মীর সাথে মিটিং করতে করতেই দিলশাদের ফোন এলো-“ভাই, খারাপ একটা খবর আছে।”
“কি হয়েছে দিলশাদ? বলো তাড়াতাড়ি।”
“ভাই একটা মা/র্ডা/র হয়ে গেছে। ইব্রাহিম সালিমের ছেলে সোহেলের হাতে। কি করবো ভাই?”
রণর চোয়াল শক্ত হলো। এরা বাবা ছেলে আবারও শুরু করে দিয়েছে। দৃঢ় স্বরে জানতে চাইলো-“পুরো ঘটনা বলো আমাকে।”
দিলশাদ পুরো ঘটনার বিস্তারিত জানালো। রণ বললো-“সোহেলকে গ্রেফতার করে যা করার করো। নি/হ/তের স্ত্রীকে বলো মামলা করতে। ওর প্রটেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করছি। সোহেলকে কিছুতেই ছাড়বে না। আমি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়ে নিজের এলাকার মানুষের নিরাপত্তা না দিতে পারলে তো ব্যর্থ।”
দিলশাদ নরম কন্ঠে বললো-“ভাই, সালিম সাহেব থানায় এসে খুব ঝামেলা করেছে। আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে।”
রণ হাসলো-“তুমি কি ভয় পেয়েছ?”
দিলশাদ পাল্টা হাসলো-“একদমই না ভাই।”
“গুড। আপাতত সে নখদন্তহীন বাঘ, তোমার কিছু করতে পারবে না। আমি আছি দেখবো তোমাকে। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো।”
“ঠিক আছে ভাই।”
ফোন রাখতেই মিহির তাকালো-“নিচে ওরা এসেছে বিচার চাইতে।”
রণ অবাক হলো-“কারা?”
“যাদের সাথে সালিমের ঝামেলা হইছে। ওদের দাবী সালিমের একছত্র অধিপত্যে কমাতে হবে। গত কয়েকবছর তারা বঞ্চিত ছিল এখন হক চায়।”
রণ চিন্তিত হয়ে গেলো-“সে তো ঠিক আছে কিন্তু এতো তাড়াহুড়ো কেন? এতোদিন পারেনি আর কিছুদিন ধৈর্য্য ধরুক। ধীরে ধীরে সব ঠিক করবো।”
“গত কয়েকদিনে আপনার কমপ্লেন বক্সে একশোর উপরে কমপ্লেন জমা হয়েছে। কারো জমি দখল, কারো বাড়ি দখল, কারো ব্যবসা বন্ধ এরকম অভিযোগ। আমি অভিযোগের সংখ্যা দেখে অবাক ভাই। এরা কি মানুষ না হায়েনা। কত টাকা লাগে এদের?”
রণর চেহারা গম্ভীর-“ওদেরই তো টাকা লাগবে। ছেলেমেয়ে সবার প্রায় থাকে বিদেশে। খোঁজ নিয়ে দেখ বেশিরভাগই দেশ থেকে পাঠানো টাকা দিয়ে ফুর্তি করে। পড়ালেখা, আলিশান ভাবে থাকা খরচ আছে না? এইগুলা করে টাকা কামায়।”
“তাই বলে এতো মানুষের ক্ষতি করে?”
“এই কয়টা দেখেই এমন লাগছে তোর? আরও আসবে দেখিস। অদ্ভুত অদ্ভুত অভিযোগ পাবি।”
চুপ করে কিছু একটা ভাবলো রণ-“চল দেখি ওরা কি বলে শুনি। আর ওই যে কে মা/রা গেছে তার বউ আর ছোট বাচ্চা আছে একটা। ওদের অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা কর। সালিম সাহেব যেন ওদের খবর না পায়।”
মিহির মাথা দুলালো। সালিম সাহেবকে বোঝাতে হবে তার দিন ফুরিয়ে গেছে।
মিটিং শেষ করে মাত্রই ফ্রি হয়ে এককাপ কফি নিয়ে বসেছে রণ খবর এলো সালিম সাহেব স্বয়ং তার বাসার নিচে। দেখা করতে চায়। রণ এবার সত্যিই অবাক। লোকটা তার দ্বারে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে এটা সে ভাবেনি কখনোই। রণ ধীরে সুস্থে ড্রয়িংরুমে এলো-“আসসালামু আলাইকুম চাচা। হঠাৎ আপনি এলেন?”
সালিম সাহেবকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে তবুও গলায় তেজ নিয়ে বললো-“রণ, কাজটা ভালো করতেছ না। তুমি ভুলে যাইতেছ বাঘ কখনো বিড়াল হয় না। আর বিড়াল কখনো বাঘ।”
রণ নিরীহ মানুষের মতো মুখ করলো-“এসব কি বলছেন চাচা? আমি কি করেছি তাই তো জানলাম না?”
“আমার সোহেলকে পুলিশ গ্রেফতার করছে। আমি জানি এর পেছনে তোমার হাত আছে। তুমি থানার অফিসারকে সাহস দিতেছ।”
রণ দারুণ এক হাসি দিলো-“চাচা, খুব অন্যায় কথা বললেন। কেউ অপরাধ না করলে পুলিশ কেন তাকে গ্রেফতার করবে? আপনার ছেলে খু/নি, তার মতো অপরাধীকে ছাড়া যায়? আমি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, আমার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটলে আমার কি করা উচিত আপনি বলেন।”
“আমি এতো কিছু জানি না রণ। তুমি আমার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি চাই না আমি স্বরুপে আসি তাহলে এলাকায় র/ক্তে/র বন্যা বয়ে যাবে।”
রণর চেহারা গম্ভীর হলো-“এসব হুমকি ধমকি দিয়ে কাজ হবে না চাচা। এতোদিন যা হয়েছে তা আর হবে না। আমি কোন অন্যায়কারীর পক্ষ নিতে পারবোনা। এমন অনুরোধ আমাকে করবেন না।”
সালিম সাহেব মেজাজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছেন-“তাহলে তো তুমিও অপরাধী রণ।”
“আমি! আমি কি করেছি?”
সালিম সাহেব হাসলো-“কি করেছ তা তুমি ভালোই জানো। তুমি একজন অপহরণ কারী। আমার মেয়েকে গুম করেছিলে। তুমি কি ভেবেছ আমি কিছু টের পাবো না?”
বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হলো ইব্রাহিম সালিমের। রণর চেহারায় চোরা হাসি-“আপনার কাছে কোন প্রমান আছে চাচা?”
জবাব দিলো না সালিম। ধারালো দৃষ্টি হেনে রণকে কুপোকাত করার চেষ্টা করছে। রণ সেই দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উঠে দাঁড়ায়-“প্রমান ছাড়া কাউকে অপরাধী বলা ঠিক না চাচা। এটা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে। এতোদিন এভাবেই প্রমান ছাড়া অপরাধ করেই তো টিকে আছেন। যাইহোক, আপনি মুরব্বি মানুষ আপনাকে অসম্মান করবো না। আমাকে মাফ করবেন আপনার অন্যায় কাজে সাহায্য করতে পারছি না।”
রণ করজোড়ে ক্ষমা চাইতেই সালিম উঠে দাঁড়ায়, দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“এক মাঘে শীত যায় না রণ। একদিন আমার পায়ে আসতে হবে তোমাকে। সালিমকে হারায় এমন কেউ দুনিয়ায় পয়দা হয়নি এখনো। মনে রেখ কথাটা।”
চলবে—
©Farhana_Yesmin