দর্পহরন #পর্ব-১৫

0
347

#দর্পহরন
#পর্ব-১৫

“মা, আমি কি করেছি? এভাবে দেখছো কেন আমাকে?”
রণর অসহায় কন্ঠ শোনা গেলো। জলি ছেলের মুখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো তীব্র বিতৃষ্ণায়-“তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছি রণ? আজ তোমার বাবা থাকলে ভীষণ লজ্জা পেতেন যেমন আমি পাচ্ছি। তোমাকে নিয়ে গর্ব ছিলো আমার, সেই গর্ব চূর্ন করে দিলে। মাথা উঁচু করে ছেলেকে নিয়ে গর্ব করার অধিকার কেঁড়ে নিলে আমার কাছ থেকে।”
রণ খাবার প্লেট দূরে ঠেলে হাত ধুয়ে এলো। জলির সামনে দাঁড়িয়ে বললো-“এবার বলে কি বলছিলে? আমি কি এমন করেছি যে এতবড় কথা বলে ফেললে?”
“এখনো বুঝতে পারছো না কি করেছ?”
জলির কথায় এবার ভীষণ বিরক্ত রণ-“মা প্লিজ, এতো ভনিতা না করে বলো না কি করেছি? আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।”
জলি তীব্র চোখে ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন-“এ কথা কি সত্য যে তুমি নির্বাচনে জেতার জন্য ইব্রাহিম সালিমের মেয়েকে অপহরণ করেছিলে? মেয়েটাকে দুই মাস আঁটকে রেখেছিলে কোথাও?”
রণর মাথাটা ঘুরে উঠলো তীব্র বেগে। শ্বাস আঁটকে এলো। মা এসব কিভাবে জানলো! কে জানালো মাকে? কেউ কি এসেছিল? রণর মাথাটা হুট করে শুন্য মনে হলো। সে চেয়ারে বসে পড়লো ধপ করে।
“কি কথা নেই কেন মুখে? আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি এই কাজ করেছ। সত্যি তুমি এমন করেছ রণ? শুধু নির্বাচন করার জন্য একটা মেয়ের সম্ভ্রম নিয়ে খেলেছ এ কথাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? তুমি কি আমার সেই ছেলে রণ?”
রণ ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। কিছু বলবে সেই সাহসই করতে পারছেনা। জলি ধমকে উঠলো-“কথা বলছো না কেন? আমি সত্যি জানতে চাই। সত্যটা বলো আমাকে রণ।”
রণর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। জলি হাত বাড়িয়ে দিলো-“আমাকে ছুঁয়ে বলো রণ। মাকে ছুঁয়ে বল সত্যি তুই এমন কিছু করেছিস।”
রণ জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটলো। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গ্লাস থেকে পানি শেষ করলো। জলি একদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। রণ শান্ত গলায় ডাকলো-“মা, এখানে বসো আমার সামনে।”
জলি তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার গা জ্বলছে। ছেলের এই অধপতন মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। রণ অনুরোধ করলো-“মা প্লিজ বসো। না বসলে তোমাকে সব গুছিয়ে বলতে পারবোনা।”
জলি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বসলো চেয়ারে। রণ বারবার ঢোক গিললো। লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো-“এসব কে বলেছে তোমাকে?”
“কে বলেছে সেটা কি জরুরি? তুমি আমাকে সত্যিটা বলো।”
“তুমি যা শুনেছে সেটা সত্যি মা। তবে আমি মেয়েটাকে কোন ধরনের অসম্মান করিনি। শুধু আঁটকে রেখেছিলাম।”
“মিথ্যে, মিথ্যে, মিথ্যে। তুমি তোমার মায়ের সাথে মিথ্যে বলছো। তুমি কি ভেবেছ আমি কখনো জানবোনা তোমার কাজ? তুমি মেয়েটাকে আঁটকে রেখে নানা ধরনের মানসিক অত্যাচার করনি? ওকে অন্ধকার ঘরে আঁটকে রেখে খাবার খেতে দাওনি। বলো সত্যি কিনা?”
রণ নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করলো। জলির মুখ ছিটকে বেরিয়ে এলো-“ছিহ! ছিহ! তুমি আমার ছেলে? তোমাকে পেটে ধরেছি আমি? নিজেকেই এখন ঘেন্না ধরছে। যাদেরকে আমি অপরাধী ভাবতাম, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের মাফ করবোনা ভাবতাম, তুমি আমার সন্তান হয়ে নিজেকে তাদের পর্যায়ে নিয়ে গেলে? কেন? একটা পদ পাওয়ার জন্য!”
মায়ের ছিহ শব্দ রণর বুকে তোলপাড় তুলে দিয়েছে। প্রতিটা বাক্য ওর বুক থেকে রক্ত শোষণ করে নিচ্ছে। মাথা তুলে মায়ের চোখে চোখ রাখার সাহস আজ হারিয়ে ফেললো বুঝি। জলি একটু থেমে আবারও মুখ খুললো-“তুমি ভাবো তোমার বোনদের সাথে কেউ এমন করছে। তাদের কি মাফ করতে পারবে?”
রণ আঁতকে উঠে মুখ তুললো-“মা প্লিজ!”
জলি ফুঁসে উঠলো-“আমাকে মা বলে ডেকোনা তুমি। তোমার মত ছেলের মা হতে চাই না আমি। যে ছেলেকে মেয়েদের সন্মান করা শেখাতে পারিনি আমি তার মা না।”
“মা আমি যদি ইব্রাহিম সালিমের মেয়েকে অপহরণ না করতাম তাহলে আজকে আমি হয়তো কবরে থাকতাম। তোমাকে কি নতুন করে বলতে হবে উনি কি? কতটা নৃশংস?”
রণ নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো। জলি মাথা নাড়ে-“আমি চাইনি তুমি রাজনীতিতে আসো। কারণটা এখন বুঝতে পারছো? শুরুতেই তুমি নিজেকে নোংরামিতে জড়িয়ে ফেললে বাকী পথ কি হবে। কেন তুমি রাজনীতিতে এলে রণ?”
জলির কন্ঠে হাহাকার ফুটে উঠলো। রণ দৃঢ় স্বরে বললো-“যা বাবা করতে পারেনি তা করতে। তুমি চেয়েছ আমি শিক্ষাদিক্ষা নেই, নিয়েছি। বাবা চেয়েছে দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে, তার ইচ্ছে পূরণ করাও আমার কর্তব্য।”
জলি পুনরায় রেগে গেল-“তা বলে অন্যায় পথে? তাহলে ইব্রাহিম সালিম আর তোমার মধ্যে পার্থ্যক্য কোথায়?”
“পার্থক্য কোথায়? ওদের সাথে তুমি আমাকে তুলনা করছো?”
জলি হাসলো-“করা উচিত না? ওরাও মেয়ে তোলে তুমিও তোল৷ তো তোমরা দু’জনই এক। যে মেয়েটা দেশেই থাকে না, বাবার কাজের কিছুই জানে না সেই মেয়েটাকে আঁটকে রেখে তুমি কি প্রমান করেছ আমি জানি না। আমি শুধু জানি তুমি একজন নির্দোষকে সাজা দিয়েছ। আর ওই মেয়েটার এই ঘটনা লোকে জানলে কে বিয়ে করবে ওকে? আমার দু’টো মেয়ে আছে কাজেই আমি খুব ভালো বুঝতে পারছি এরকম ঘটনায় মা বাবার কেমন লাগে।”
“কেউ জানবে না মা। কেউ জানেনি। তুমি বেশি বেশি ভাবছো।”
রণ দূর্বল গলায় বলে। জলি অবাক হয়ে ছেলেকে দেখলো-“তোমাকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি রণ। এতটুকু অনুশোচনা নেই তোমার মধ্যে। শেম অন মি, আমি ব্যর্থ মা।”
“মা! কেন ছোট বিষয়কে বাড়িয়ে বড় করছো?”
রণর কন্ঠে আঁকুতি।
“এটা ছোট বিষয়ে লাগছে তোমার কাছে?”
জলি ভীষণ জোরে চেচিয়ে উঠলো। হাসিখুশি হাসিখুশি ভয় পেয়ে ছুটে এলো-“কি হয়েছে? তোমরা চেচাচ্ছ কেন?”
জলি রাগমিশ্রিত নজরে মেয়েদের ধমক দিলো-“নিজেদের কাজে যা।”
দু’জনেই ভয়ে পালিয়ে এলো। রণ মাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো-“মা প্লিজ ঠান্ডা হও।”
জলি ছিটকে সরে গেলো-“কাল ইব্রাহিম সালিমের বাড়ি যাব আমরা।”
রণর এবার অবাক হওয়ার পালা-“কেন?”
“কথা পাকা করতে। ওর মেয়েকে বিয়ে করবে তুমি।”
রণ আর্তনাদ করে উঠলো-“মা! এসব কি ধরনের পাগলামি?”
জলি অনড়ভাবে বললো-“আমি একজন শিক্ষিকা। তোমার অন্যায় জেনেও যদি প্রতিকার না করি তাহলে বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে আমার জন্য। যা নিজের মেয়ের বেলায় সহ্য হবে না তা অন্যের বেলায় হতে দেই কি করে?”
“আমি বারবার বলছি মা, ওর ঘটনা কেউ জানেনা জানবে না। ওই মেয়ের বিয়ে দিতে কোন সমস্যা হবে না। ওর বাপের টাকা কম নেই ছেলের অভাব হবে না।”
রণর কন্ঠে অসন্তোষ। জলি পাত্তা দিলো না-“আর বিয়ের পর পাত্র জেনে গেলে? মেয়ে দুই মাস গায়েব ছিল এটা জানার পর কোন পুরুষ মেনে নেবে? তখন কিছু হলে সে দায় কে নেবে?”
“তোমার এই অন্যায় আবদার আমি মানতে পারছি না মা। ওদের সাথে আত্মীয়তা কখনো সম্ভব হবে না। ওরা বাবার সাথে কি করেছে তা কি তুমি জানো না?”
“এতো কিছু জানি না আমি। যা বলেছি তুমি তা করবে।”
রণ হতবাক হয়ে মাকে দেখছে। যেন চিনতে পারছে না এই মাকে-“আমি পারবো না মা, কিছুতেই পারবোনা।”
জলি অটল গলায় বললো-“পারতে হবে। তোমার বাবাকে আজও খুঁজে পেলাম না। আমি চাই না তুমিও তার মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যাও। তুমি যা করেছ এরপর তোমাকে এভাবে ছেড়ে রাখতে ভরসা নেই আমার। আমি জানি সালিম সুযোগ পেলেই তোমার ক্ষতি করবে। তাছাড়া কোন বাপ মেয়ের এরকম অসম্মান মেনে নেবে?”
রণ কি বলবে ভেবে পেল না। কোন মাকে দেখছে সে? এরকম ভীতু তার মা কবে ছিল?
“তুমি কাল আমার সাথে যাবে। যত খারাপই হোক নিজের মেয়ে জামাইকে নিশ্চয়ই মে/রে ফেলবে না?”
রণ মাথা নাড়লো-“আমি কাল কোথাও যাব না। তোমার এসব পাগলামির সাথে আমি নেই। আমি কিছুতেই ইব্রাহিম সালিমের কাছে ছোট হবো না।”
“যেতে হবে তোমাকে। আমি কথা দিয়েছি ওদের। আমি স্বামী হারিয়েছি সন্তান হারানোর শক্তি নেই আমার।”
“তাই বলে অন্যায়কারীর সাথে এতবড় কম্প্রোমাইজ করবে?”
রণ সবকিছু এলোমেলো লাগছে। জলি ছলছল চোখে তাকালো-“সন্তানের জীবনের জন্য এর চাইতে বড় কম্প্রোমাইজ করা যায়। এটাতো কিছুই না।”
“সরি মা, আমি মানতে পারছি না তোমার সিদ্ধান্ত। আমাকে মাফ করো।”
রণ নিজের ঘরে চলে এলো। জলি ওর দিকে তাকিয়ে রইলো একপলকে। বিরবির করে বললো-“তোমাকে মানতে হবে। আমি ব্যবস্থা করবো।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here