দর্পহরন #পর্ব-১৯

0
292

#দর্পহরন
#পর্ব-১৯

শুভ্রার ঘুম ভেঙেছে এগারোটায়। ঘুমঘুম চোখে সে ঘড়ি দেখে ধরমরিয়ে উঠে বসলো। রিমা তাকে পইপই করে বলে দিয়েছে বিয়েটা যেভাবেই হোক সে যেন বউ হওয়ার দায়িত্ব পালন করে ষোলআনা। সকালে যেন ঘুম থেকে ওঠে। মায়ের বাড়ি ভেবে সারাদিন শুয়ে না থাকে যেন। শুভ্রা নিজের উপর বিরক্ত হলো ভীষণ। এতো বেলা অব্দি কি করে ঘুমালো সে? তাও আবার অপরিচিত জায়গায়? পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখলো। নাহ সে নেই। স্বস্তি হলো না অসস্তি বুঝলোনা শুভ্রা। সে লোকটাকে যতটা সহজে কাবু করতে পারবে ভেবেছে এখন দেখছে ততটা সহজ হবে না ব্যাপারটা। মুখে হাত দিয়ে হামি ঠেকালো সে৷ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। শুভ্রা অলসতা ঝেড়ে উঠে দরজা খুললো। হাসিখুশিকে দেখা গেলো। ওকে দেখেই দুইবোন হাসলো। দু’জনই একসাথে বলে উঠলো-“তোমার ঘুম ভেঙেছে ভাবি? বাসায় অনেক মেহমান এসেছে। মা বললো তোমাকে তৈরী করে নিয়ে নিচে নামতে।”
শুভ্রাও পাল্টা হাসলো-“ভেতরে এসো তোমরা। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি।”
দু’জনই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো। শুভ্রা বাথরুম থেকে বেড়িয়ে দেখলো ঘর পরিপাটি হয়ে গেছে। বিছানার চাদর টানটান। এলোমেলো কাপড় সম্ভবত রণর সেগুলো ধোঁয়ার জন্য ঝুরিতে দিয়ে দিয়েছে। ওকে দেখে দুই বোন হাসলো-“নানু এসেছে তো। যদি তোমার ঘরে এসে যায় তাই গুছিয়ে দিলাম তাড়াতাড়ি। নানুর আবার ওসিডি আছে। এলোমেলো আর নোংরা দেখলে তার মেজাজ খারাপ হয়। বকাঝকা করে। মানুষ আর পরিস্থিতি বোঝে না।”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে লাগেজ খুললো। কি পরবে ভাবছে। খুশি এগিয়ে এসে বললো-“ভাবি, দেখ শাড়ি আছে তোমার লাগেজে। লাল রঙের শাড়ী ওটা পরো। তুমি নতুন বউ না শাড়ীতে ভালো লাগবে।”
শুভ্র সালোয়ার স্যুট তুলে নিলেও হাসি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে-“প্লিজ ভাবি, খুশি যা বললো সেটাই করো। মা বলেছে শাড়ী পরতে। আমার মামীরা এসেছে। তোমার উল্টো পাল্টা দেখলে ওনারা আবার মাকে কথা শোনানোর সুযোগ খুঁজবে। প্লিজ একটু কষ্ট হলেও এডজাস্ট করে নাও।”
“কিন্তু আমি শাড়ী তো পরতে পারি না।” শুভ্রার চেহারা অসহায় দেখায়।
“আরে তাতে কি? আমরা আছি না? আমরা পরিয়ে দেব।”
শুভ্রা শাড়ী বের করে রাখলো-‘তোমাদের এতো আত্মীয় তো কাল কেউ যায়নি কেন?”
খুশি হাসলো-“সে তো ভাইয়া কাউকে নেয়নি তাই। সকলেই চটে আছে ভাইয়ার উপর। ভাইয়া অবশ্য বলেছে রিসিপশন করে পুষিয়ে দেবে সব রাগ।”
শুভ্রা জবাব দিলো না। দুই বোন গল্প করতে করতে শুভ্রাকে তৈরি করে দিলো। গলায় কানে হালকা গহনা হাতে সোনার চুড় পরিয়ে দিয়ে হাসি শুভ্রাকে বললো-“ভাবি, নানু একটু উল্টো পাল্টা বকে। তুমি প্লিজ চুপচাপ থেকো। জবাব দিলে মা কষ্ট পাবে।”
শুভ্রা মাথা দুলায়। মনে মনে ভাবছে কত প্যাচরে বাবা। কোথায় ভেবেছিল লোকটাকে সারাক্ষণ কোন না কোন প্যাচে ফেলে অশান্তি দেবে এখন দেখা যাচ্ছে তার দেখা পাওয়াই দুস্কর।

“বউ তো সুন্দর কিন্তু আমার নাতি কই জলি? বিয়া করতে না করতে অফিস কিসের?”
“মা, ওর জরুরি ফোন আসছিল। ভোরে বের হইছে।”
জলি মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিলো। সেলিনা কাটকাট কন্ঠে সুর তুললো-“তুই আজীবনের জেদি জলি। পোলা বড় হইছে তাও তার সব ব্যাপারে তোর মাথা ঢুকাইতে হবে। বিয়া শাদীতে জোর চলে? এতো সুন্দরী মেয়ে তবুও তো পোলার মন নাই। বিয়ার ক্ষেত্রে সৌন্দর্য না মন দেখা লাগে জলি।”
“আম্মা থামেন। নতুন বউয়ের সামনে কি বলেন এইসব? ওরে দোয়া করে দেন।”
সেলিনা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে তার বড় বউমা রোকেয়াকে ডাকলো-“ও বড় বউ, গহনার বক্সটা দাও দেখি।”
পাশ থেকে ছোট বউ মোহনা টিপ্পনী কাটে-“আম্মা, সব রণর বউকে দিয়ে দিয়েন না। আপনার ছেলের ছেলেদের জন্যও কিন্তু রাইখেন।”
“কেন? তোমাদের কি কম আছে? তাছাড়া আমার রণ তো একশোর মধ্যে একজন। তার মতো যোগ্য কে আছে।”
শুভ্রার বিরক্ত লাগছে রণর প্রশংসা শুনতে। একবার শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকালো। তার চেহারা ভাবলেশহীন। সেলিনা নাতবউের গলায় জড়োয়া হারটা পরিয়ে দিলো। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো-“মাশাল্লাহ, সুন্দর লাগতেছে। শোন মেয়ে, এইসব গহনা যত দামীই হোক বিয়ের পর স্বামীই মেয়েদের আসল গয়না। এইটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবা ততই মঙ্গল হবে। বুঝলা?”
শুভ্রা মাথা দুলায় আর মনে মনে মুখ ভেংচি কাটে, আমার বয়েই গেছে স্বামীকে গয়না বানাতে।

★★★

রণ বেরিয়ে পড়েছে ভোর সকালে ইমার্জেন্সি ফোন পেয়ে। কাল রাতে মায়ানমার সীমান্তে প্রচুর গোলাগুলি হয়ে দু’জন সেনা মারা গেছে এবং প্রচুর বহিরাগত অনুপ্রবেশ করেছে। খবরটা শোনামাত্রই অফিসে ছুটেছে রণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান আগেই তার অপেক্ষায় ছিল। নিজের কর্মক্ষেত্রে এসেই তাদের সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দফায় দফায় মিটিং আলোচনা পর্যালেচনা শেষে করনীয় কাজ সম্পর্কে ব্রিফিং দিয়ে রণ অফিস থেকে বের হলো। এরইমধ্যে মিটিং এর ফাঁকে ফাঁকে সকলের শুভকামনা শুনতে শুনতে রণর প্রান ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। সন্ধ্যায় ছুটলো প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের কর্যালয়ের দিকে। সেখানে দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে মিটিংএ গিয়ে সবার মিশ্র প্রতিক্রিয়া রণর কানে এসেছে। স্বয়ং সালিম সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। অনেককে আড়ালে বলতে শুনেছে, ‘মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে বলেই রণর জন্য নিজের দীর্ঘদিনের নির্বাচনি সিট ছেড়ে দিয়েছে সালিম। সালিম বুদ্ধিমান, বুঝেছে ওর দূর্নাম অনেক বেড়েছে তাই সময় থাকতে সরে দাঁড়িয়েছে। এখন জামাইয়ের কাঁধে বন্দুক রেখে সব কাজ করবে। দূর্নাম হলে মেয়ে জামাইয়ের আর কাজ হবে সালিমের। একেই বলে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালানো।’ সালিম সাহেবকে তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসতে দেখেছে রণ। সব শুনে বুঝে রাগে গা কাঁপে রণর। হাতের মুঠো মুষ্টিবদ্ধ হয়। হেরে যাচ্ছে সে হেরে যাচ্ছে। নিজের সব পরিশ্রমের ফল আরেকজন নিয়ে যাচ্ছে বিনা শ্রমে। এটা কিভাবে হতে দেবে? কিভাবে?

বাড়ি ফিরতে ফিরতে গাড়িতে গুম হয়ে বসে থাকে সে। ক্লান্ত লাগছে আজ। কাল আবার সারাদিন ব্যস্ত থাকবে। যেতে হবে খুলনা, মংলা বন্দরে নতুন জেটির উদ্বোধন করতে। এদিকে বিয়ে পরবর্তী একটা অনুষ্ঠান করাও জরুরি। যেহেতু বিয়ের ব্যাপার সবাই জেনে গেছে অনুষ্ঠান সেরে ফেলাই ভালো। অবশ্য অনুষ্ঠান একটা না দু’টো করতে হবে। একটা ঢাকায় আরেকটা নিজের এলাকায়। মায়ের সাথে আলোচনা করে ডেট ফাইনাল করতে হবে। এলোমেলো ভাবনায় রণর মনটা আছন্ন হয়ে রইলো।

রাজিব চুপচাপ দেখছে রণকে। অনেক কথা তার কানেও এসেছে। সে বুঝতে পারছে রণ কেন গুম হয়ে আছে। তাই আরেকটা খারাপ খবর দিয়ে তার মন খারাপ করতে চাইলো না। বাসার নিচে এসে নরম কন্ঠে ডাকলো রণকে-“ভাই, বাসায় আসছি।”
রণ চোখ বুঁজে ছিলো। রাজিবের ডাকে চোখ মেলে তাকিয়ে একবার দেখলো তারপর চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে গেলো।

জলি বসেছিল ছেলের অপেক্ষায়। রণ মাকে দেখে হাসলো-“এতো রাত অব্দি বসে আছো কেন?”
জলি হাসলো-“সকালে তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে গেলি। সারাদিন কি খেয়েছিস তাতো জানি না। এখন হাতমুখ ধুয়ে আয় আমার সাথে বোস। তোর পছন্দের চিংড়ি মালাইকারি করেছি।”
রণ তখনই হাত ধুয়ে বসে গেলো-“তাহলে দাও খেয়ে নেই। খিদে পেয়েছে ভীষণ।”
জলি মানা করলোনা। প্লেটে ভাত আর চিংড়ি বেড়ে এগিয়ে দিলো। রণ গোগ্রাসে খেলো কয়েক লোকমা। মায়ের দিকে তাকালো-“তুমি খেয়েছ?”
“হুম। তোর নানি এসেছিল আজ। সারাদিন ছিলো এই কিছুক্ষণ আগেই গেলো। তোর সাথে দেখা করতে চাইছিল।”
“ওহহহ। আচ্ছা আমি সময় করে যাব একসময় দেখা করে আসবো। মা, অনুষ্ঠান তো করতে হবে একটা। কবে করা যায় বলো তো?”
“তোর সুবিধামতো একটা দিন ঠিক কর। কবে কাজ কম তোর?”
রণ একটু ভেবে জবাব দিলো-“আগামী শুক্রবার একটা করি আর তারপরের দিন এলাকায় আরেকটা। ঠিক আছে?”
“পরপর দুইদিন কেন? মেয়েটার জন্য অনেক ঝক্কি হয়ে যাবে। একদিন গ্যাপ দিয়ে কর।”
রণ একটু থমকায়। মেয়েটা বলতে মা কাকে বোঝালো সেটা বুঝতে খানিকটা সময় নিলো তারপর মৃদুস্বরে বললো-“আচ্ছা, তাহলে শুক্রবার আর রবিবার করি।”
“ঠিক আছে। দেখিস তোর দাদুর বাড়ি কেউ যেন বাদ না পরে।”
জলির কথায় রণ অবাক হয়ে বললো-“হঠাৎ ওদের কথা কেন বললে মা?”
জলি নাক টানে-“তোর চাচা ফোন দিয়েছিল আজ।”
“কি বললো?”
“তোকে ওদের থেকে দূরে রেখে ভালো করছি না এটাই বললো। এতোকিছু হয়ে গেলো তাদের কেন জানাইনি?”
“আশ্চর্য! এতোদিন পরে হুট করে কি চাইছে ওরা? তাছাড়া নিজেরা আমাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে এখন নিশ্চয়ই তাদের দরকারে কাছে আসার চেষ্টা করছে?”
জলি মন খারাপ করে বললো-“কারণ যাইহোক ওদের বলিস। এতো বছর পরেও নিজেকে কাঠগড়ায় দেখতে ভালো লাগে না।”
রণ থমকে গেলো। মায়ের কষ্টটা কোথায় সেটা বুঝে কথা না বাড়িয়ে মাথা দুলিয়ে নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলো।

★★★

“এতোক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হলো? নতুন বউয়ের কথা একবারও মনে হয়নি?”
রণ জানতো রুমে ঢুকে এরকম কিছু শুনবে তাই না শোনার ভান করে নিজের কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখলো শুভ্রা তখনও বসে আছে বিছানায়। রণর বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে না এই মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে। সে ক্লান্ত গলায় বললো-“আমার সাথে ঝগড়া করার জন্য বসে আছেন? আপনার ধৈর্য্য আছে বটে।”
শুভ্রা হাসলো-“ঝগড়া করার জন্য বসে আছি এ কথা কে বললো? আমি আমার গিফট নেওয়ার জন্য বসে আছি।”
“গিফট! আচ্ছা ঠিক আছে। কি চাই আপনার?”
শুভ্রা হা করে তাকালো। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না রণর কথা। লোকটা এতো সহজে মেনে নিলো?
“আরে তাড়াতাড়ি বলুন কি চাই?”
“ভাইয়ার মুক্তি।”
রণ শান্ত দীঘির জলের মতো গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো শুভ্রার দিকে-“এটা তো সম্ভব না। অন্য কিছু বলুন।”
“আপাতত এটাই আমার চাই।”
“সরি তাহলে আবার মত বদলে ফেলতে হচ্ছে। গিফট নেই আপনার কপালে।”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“বউ ছাড়া রিসিপশন করবেন?”
“মানে?”
শুভ্রা হাসলো-“মানে তো খুব সহজ। আমি চাই রিসিপশনের অনুষ্ঠানে আমার পুরো পরিবার উপস্থিত থাকুক। তো সেজন্য ভাইয়াকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে তো। ভাইয়া ছাড়া পরিবার অসম্পূর্ণ না?”
রণ কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। শুভ্রা পুনরায় মুখ খুললো-“যদি তা না হয় তাহলে কিন্তু বউ ছাড়া রিসিপশন করতে হবে। আমি কিছুতেই আপনার কোন অনুষ্ঠানে পার্টিসিপেট করবো না। আপনার বউ হওয়াটা যেমন আমার চয়েজ ছিলো তেমনি বাকী সবটা আমার চয়েজে হবে। তা না হলে সবাই জানবে, মন্ত্রী মশাই একজন নারী অপহরণকারী। তিনি একজন মন্ত্রী হয়েও নারীর প্রতি নুন্যতম সন্মান রাখে না মনে। জনগণ এসব জানলে নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে না?”
রণ হাসলো-“সত্যিই তাই করবেন বুঝি? এতে আপনার সন্মান বাড়বে?”
“আমার সন্মান তো যেদিন আপনি আমাকে তুলে নিয়েছেন সেদিনই কমে গেছে। কাজেই ওতে আর ভয় করি না।”
রণ দাঁতে দাঁত চেপে অপমান হজম করলো। সে চুপচাপ আলমারি থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। এই মেয়ের সাথে একইরুমে থাকার কোন মানেই হয় না। এই নামমাত্র বিয়ের জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়া কেন?

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here