দর্পহরন #পর্ব-২৫

0
287

#দর্পহরন
#পর্ব-২৫

সকাল সকাল শুভ্রাকে বাড়িতে উপস্থিত হতে দেখে রিমা অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“এতো সকালে তুই একা একা কোথা থিকা আসলি শারমিন?”
শুভ্রার মেজাজ খারাপ ছিলো সেটা মায়ের কথায় আরও বাড়লো-“এতো প্রশ্ন করো কেন আম্মা?আমার যখন ইচ্ছা তখন আসবো। নিজের বাড়িতে আসতে আবার সময় দেখা লাগবে? নাকি আমার আসা পছন্দ না তোমার? বিয়া হইছে মেয়ে পর হয়ে গেছে, তাই তো?”
রিমা হা করে মেয়েকে দেখছে। সে বুঝে পাচ্ছে না মেয়ে হঠাৎ করে এতো রেগে গেলো কেন? সে তো খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন করেছে। মিনু কি বুঝলো কে জানে পরিস্থিতি শান্ত করতে বললো-“রিমা, বাদ দেতো। মেয়েটা সাতসকালে আসছে ওরে খাইতে টাইতে দে। প্রশ্ন পরেও করা যাবে।”
ইশারায় রিমাকে শান্ত থাকতে বললো। শুভ্রা অবশ্য তাতে শান্ত হলো না। সে গজগজ করলো আরও কিছুক্ষন তারপর বললো-“চাচী, আমি এখন খাবো না। রাতে ঘুম হয় নাই তাই ঘুমাবো। ঘুম থেকে উঠে খেতে মন চাইলে খাবো। দয়া করে তোমরা কেউ আমাকে ডাকবে না।”

শুভ্রা চলে যেতেই রিমা জায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-“ওর হঠাৎ কি হইছে বুবু? জামাই ছাড়া সকাল সকাল চইলা আসলো কেন? কালকে এতো জোর করলাম আসলো না আর আজই সকালে চলে আসছে। দেখছেন কারবার?”
“আমার মনেহয় ঝগড়া হইছে জামাই এর সাথে।”
“কিন্তু জামাইরে তো ভালোই লাগছে আমার। ওর মা আর বোন দুইটাও ভালো। ঝগড়া কেন লাগবে? মানলাম ওরা আমাদের মতো না তাই বইলা ফেলনাও না। ঝগড়া কেন করবে?”
মিনু হাসলো-“তোর মাইয়া যে জেদি। এক্কেরে বংশের ধারা পাইছে। তয় জামাইরেও কিন্তু সোজা মনেহয় নাই। মন পরিস্কার হইতে পারে কিন্তু তেড়া আছে। নিশ্চয়ই কিছু কইছে শারমিনরে। তুই চিন্তা করিস না, আমি ওর লগে কথা কমু।”
চিন্তা করিস না বললেও রিমার মনে চিন্তা লেগে রইলো। একা একা বড় হওয়া মেয়েটা একটু বেশি জেদি সেটা তার চেয়ে ভালো কে জানে। কে জানে কি করে আসছে ওই বাড়িতে।

অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না শুভ্রার। কাল থেকে তার মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে। রণর বলাটা প্রতিটা কথা তার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধেছে। একজন মেয়ে হয়ে এই অপমান সে মেনে নিতে পারছেনা। দু’টো মাস রণ তার সাথে যা করেছিল সে শুধু তার মতো করেই সেই কাজের শোধ তুলতে চেয়েছে। এতে কি ভুল হয়েছে তার? রণ কেন এভাবে বলবে তাকে? মানুষটা কি নিজের কাজে একটুও অনুতপ্ত হবে না?

হ্যা, এটা ঠিক বন্দী থাকা সময়ে রণ তাকে কোনভাবে অপমান করেনি। কখনো বাজে দৃষ্টিতে তাকায়নি তার দিকে কিন্তু নানাভাবে কষ্ট তো দিয়েছে। সেই সব কি সে ভুলে যাবে সহজে? রণ হলে কি ভুলে যেত? বিয়েটা করে কি ভুল করেছে সে? এরচেয়ে আমেরিকায় ফিরে গেলেই হতো। পড়া শেষ এখন একটা চাকরি নিয়ে দিব্যি দিন কেটে যেত। কি এক প্রতিশোধের চক্করে বিয়ে ফিয়ে করে জীবনটা আরও জটিল করে ফেললো। এখন কি করবে সে? এই অপমানের পর কি ওর রণর কাছে ফেরা উচিত হবে? ভাবতে ভাবতে শুভ্রা কেঁদে দিলো হঠাৎ করে।

*****

রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রণ। জলি ওর অপেক্ষায় ছিলো। ছেলেকে দেখে এগিয়ে এলো-“তোর তো শরীর ঠিক নেই তুই কোথায় যাচ্ছিস রণ? বউমাই বা কোথায় গেলো সাতসকালে?”
“ও ওর বাবার বাসায় গেছে মা। এতো চিন্তার কিছু নেই। আর আমার একটা মিটিং আছে এলাকার কর্মীদের সাথে। তুমি প্লিজ হাসিখুশি নিয়ে ঢাকায় চলে যাও। আমি মিটিং করে সরাসরি ঢাকায় যাবো।”
জলি অবাক হয়ে বললো-“বউমা যাবে না?”
রণ ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে জবাব দিলো-“ও গেলে যাবে না গেলে যাবে না। ওকে নিয়ে এতো ভেবনা মা। বাবার বাড়ি গেছে থাকনা কিছুদিন।”
“বউ ছাড়া ঢাকায় ফিরে যাব? এটা কেমন ব্যাপার হলো রণ?”
জলির মনটা ভারাক্রান্ত হলো। রণ মাকে জড়িয়ে ধরে-“মা প্লিজ, বারবার বউ বউ করো না। ও নিজ ইচ্ছায় গেছে নিজ ইচ্ছায় ফিরবে। আর আমার পক্ষে বউ নিয়ে ব্যস্ত থাকা সম্ভব না। এমনিতেই কয়েকদিনের ব্যস্ততায় কাজ জমে পাহাড় হয়েছে। কিভাবে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না আর তুমি পড়ে আছো বউ নিয়ে। আমার আজ ঢাকায় ফিরতেই হবে যে কোনভাবে। তুমি প্লিজ হাসিখুশিকে রওনা দাও। দেরি করবে না মা। তুমি জানো তো তোমাদের এখানে থাকা আমি পছন্দ করছি না।”
জলিকে রুষ্ট দেখালো-“আচ্ছা ঠিক আছে চলে যাব। তুমি ঠিকঠাক মতো বের হ। ঢাকায় পৌঁছে তোকে জানিয়ে দেব ভাবিস না।”
“গুড গার্ল। আসছি তাহলে।”
রণ মায়ের কপালে চুমু একে দিয়ে বেরিয়ে এলো। জলি পেছন থেকে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনটা খচখচ করছে। মেয়েটা কি রাগ করেছে কাল? কড়া কথা শুনিয়েছিল মেয়েটাকে। সেইজন্য আবার রাগ হলো নাতো রণর সাথে? কিন্তু সে তো খারাপ কিছু বলেনি। বিয়ে হয়েছে এখন স্বামীর প্রতি টান হবে না? না হয় রণ ওকে কিডন্যাপ করেছিল, অন্যায় করেছিল কিন্তু এখন মেয়েটা যা করছে সেটাই বা কতটুকু যৌক্তিক? শুভ্রার প্রতি রুষ্টতা আরেকটু বাড়লো জলির।

রণর গাড়ি ছুটছে দলীয় কার্যালয়ের দিকে। মিহিরকে ডাকলো রণ-“মিহির, সব ঠিক আছে? সবাই কি এসেছে?”
“এসেছে ভাই। আপনার কথা মতো আজ সালিম সাহেবকে আমন্ত্রণ করি নাই।”
“ভালো করেছিস। চল দেখি শুনি ওরা কি বলে। আর কাগজগুলো এনেছিস তো?”
মিহির কোলের উপরে থাকা ব্রিফকেসটা দেখালো-“সব আছে এখানে।”
রণর মুখে হাসি ফুলটো-“গুড জব মিহির।”

*****

ডাইনিং এ খেতে বসে মেয়ের বাড়ি আসার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো সালিম সাহেবের। রিমার দিকে তাকিয়ে বললো-“ওরে ডাইকা আনো। শুইনা দেখি একা আইছে কেন? ওর না জামাই নিয়া আসার কথা আছিল? কালই কইলো জামাই অসুস্থ। আইজ আবার অসুস্থ জামাই ফালায়া এইখানে আইছে কেন?”
রিমা মিনমিন করলো-“আমিও এইকথা জিগাইছিলাম। আমারে মেলা কথা শুনাইলো।”
“ওয় ডাকতে মানা করছিল। ঘুমাইতেছে মনেহয়। ঘুমাক সালিম তুই ভাবিস না। ও উঠুক আমি কথা কমু ওর সাথে।”
পাশ থেকে বড় ভাবি মিনুর কথা শুনে খাওয়ায় মন দিলো সালিম। শরীফ নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সালিম সাহেব তাকে ডাকলো-“তুই কি আবার ফিরা যাবি? না গেলে আমার একটা বিজনেস সামলা। তাও তো আমি একটু হালকা হইতে পারি।”
শরীফ খাওয়া থামিয়ে জবাব দিলো-“হুট করে আসছিলাম তাই চাকরি ছাড়তে হইছিল। আবার কোন চাকরি হইলেই চলে যাব আব্বা। আপনাদের এইসব বিজনেস পোষাবে না আমার।”
সালিম সাহেব বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো-“বাইরে একা একা থাইকা এতো কষ্ট কেন করোস আমি বুঝি না। এইখানে সব আছে তবুও তোরা কেউ থাকতে চাস না। তাহেরটা তো বিয়েই করতে চায় না।”
শরীফ জবাব দিলো না। জবাব দিলেও লাভ নেই। উত্তর তার বাবার পছন্দ হবে না। শুধু শুধু অশান্তি চায় না সে। সালিম ছেলের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে বড়ভাইকে দেখলো-“ভাইজান, তন্ময় আইছে এইবার ওরে বিয়া করায় দেন। পোলা দেশে থাকুক। সবাই অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা থাকলে আমাদের এই এতোবড় ব্যবসা দেখবে কে বলেন দেখি? ইদানীং খুব চিন্তা হয় ভাইজান।”
মোর্শেদ পত্রিকা ভাজ করে রাখলো-“আমিও তাই ভাবছি সালিম। তন্ময়কে বিয়ে করাবো। দেখি তন্ময় কি বলে।”
মিনু কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেলো। এদের ভাইদের মধ্যকার আলোচনায় কথা বলা বৃথা। বউদের কথা এরা শোনে না। এরচেয়ে চুপ থেকে সন্মান বজায় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।

“আব্বা!”
হুট করে সোহেল চলে এলো। তার চেহারা জুড়ে উত্তেজনা। সে সালিম সাহেবের কানে কানে কিছু বলতেই সালিম সাহেব নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠলো-“কি কস এইসব? খবর পাক্কা তো?”
“একশোভাগ পাক্কা আব্বা। ওরা এখন ওইখানে আছে।”
“আচ্ছা, চল দেখি যাই।”
সালিম সাহেব টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন। মোর্শেদ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো-“কি হইছে সালিম? কই যাস এখন?”
“খুব জরুরি কাজ ভাইজান। আমি পরে আইসা বলতেছি।”
“আরে খাওন খাইয়া যান না।”
“আরে রাখো তোমার খাওন। এইদিকে জীবন চইলা যাইতেছে সে পইড়া আছে খাওন নিয়া।”
সালিম সাহেব ধমক দিলো। কোনরকমে হাত ধুয়ে নিচে নেমে গেলো। সোহেল তার পিছু পিছু।

*****

“আপনারা যারা আজকে আমার ডাকে সারা দিয়ে এসেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আশাকরি আজকের আলোচনায় উপস্থিত সকলেই আজ এখানে আলোচিত বিষয়ের ব্যাপারে গোপনীয়তা পালনে সচেষ্ট হবেন। আমি এই এলাকার নতুন নির্বাচিত সাংসদ হওয়ার পাশাপাশি একজন মন্ত্রীও বটে। আমার দায়িত্ব দেশের প্রতিটা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করতে আমি বন্ধ পরিকর। তাই সারা দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমার নিজ এলাকার প্রতি একটা বাড়তি দায়িত্ব এসে যায়। এই এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে এখনকার প্রতিটা মানুষের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে চাই বলেই আজকের এই মিটিং এর আয়োজন করেছি।

আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন আমি সালিম সাহেবের জামাতা। আমি হয়তো সব কাজে তাকে ফেভার করবো। আজ আমি নিজ মুখে বলছি যে, তার আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেবল বাড়ির ভেতর। বাড়ির বাইরে এই সম্পর্কের দাবিতে আমি কোন অন্যায়কে প্রশয় দেব না। এলাকার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কাউকে সে যেই হোক না কেন, কাউকেই আমি প্রশ্রয় দেব না। এটা মাথায় রাখবেন সবাই।

এতোদিন এই এলাকায় দলীয় কর্মকান্ড যেভাবে চলেছে এখন থেকে সেভাবে চলবে না। গেল কয়েকবছরে দলের কয়েকজন অনেক বেশি সম্পদশালী হয়েছে আর কয়েকজন বঞ্চিত হতে হতে দলের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়েছে। কেউ কেউ দলীয় লোকের হাতেই লাঞ্ছিত হয়ে নীরবে দল থেকে সরে গেছে। কে কি করেছেন এই সব তথ্য
আমার হাতের এই কাগজগুলোতে আছে। তবে ভয় পাবেন না কাউকে শাস্তি দেব না আমি। আমি শুধু চাই সব কিছু নতুন করে শুরু করতে। কারো প্রতি অবিচার না করতে। আর আপনাদের কার কি অভিযোগ আছে সব আমলে নিয়ে কাজ করতে।

সামনে দু’টো নির্বাচন হবে। আমি চাই আপনারা যোগ্য কাউকে নির্বাচিত করুন। সেই জন্য এখন থেকেই বিচার বিবেচনা করে কাজ শুরু করতে হবে। যারা কাজ করেছেন কিন্তু পদ বঞ্চিত থেকেছেন দীর্ঘদিন তাদের নিয়ে আমি বিশেষ কিছু করতে চাই। আপনারা কি রাজি আছেন?”
মিটিং এ উপস্থিত সকলে সমস্বরে চিত্কার করে উঠলো-“হ্যা, রাজি রাজি।”
রণর মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো-“বেশ, তাহলে প্রথম কয়েকটা কাজের জন্য তৈরি হয়ে যান আপনারা। সবুর চাচা, ইমাদ ভাই আপনাদের জন্য নির্বাচিত কাজ হলো…”
“আরে থামো থামো জামাই বাবা থামো। আমাকে ছাড়া কি করতেছ তোমরা এইখানে?”
পুরো মিটিংস্থল থমকে গেলো। সুনসান নিরবতা নেমে এলো। চারিদিকে ফিসফিস আওয়াজ। রণ অবাক হয়ে মিহিরকে দেখলে সে মাথা নাড়লো নিরবে। তারপর চুপচাপ হাতের কাগজগুলো ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে নিলো। সালিম সাহেব এগিয়ে এসে রণর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হাসলো-“মানলাম তুমি মন্ত্রী হইছো কিন্তু আমি এখনো এই এলাকার দলীয় প্রধান। আর তুমি আমাকে না জানায়া মিটিং করতেছ? কামটা কি ঠিক করলা?”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here