দর্পহরন #পর্ব-২৭

0
256

#দর্পহরন
#পর্ব-২৭

বিয়ের পর প্রথমবারের মতো মেয়ে জামাই আসছে বলে এলাহি আয়োজন করেছে সালিম সাহেব। রণ বেশ ভদ্রভাবেই মানা করলো-“এক মগ কফি ছাড়া আমি কিছু খাবো না। সারাদিন সময় পাই না তাই রাতে মায়ের হাতের খাবার ছাড়া কিছু খাই না। আশাকরি কিছু মনে করবেন না। শুভ্রা কি তৈরী? তাহলে রাত করবোনা।”
সালিম সাহেব হইহই করে উঠলো-“এইটা কেমন কথা? জামাই প্রথমবার আসছে না খাইলে হবে?”
রণ অবিচল গলায় জবাব দিলো-“হবে। খাওয়ার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপনার মেয়েকে বলেন রেডি হতে। কালকে সকালে জরুরি মিটিং আছে তাই যত তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরবো তত ভালো। এমনিতেও অনেক রাত হয়েছে।”
সালিম সাহেব জোর করলো না-“আচ্ছা ঠিক আছে। রিমা দেখোতো শুভ্রা তৈরী কিনা?”
রিমা চলে গেলো। সালিম সাহেব রণর পাশে এসে বসলো-“আমার মেয়েটা একটু বোকা সোকা। তুমি আমার রাগ ওর উপর দেখাইও না জামাই।”
রণর মেজাজ খারাপ হলেও নিজেকে শান্ত রেখে বললো-“আপনার মেয়ে কি এমন কিছু বলেছে?”
সালিম সাহেব একটু ঘাবড়ে গেল-“না না, তা বলে নাই। সেইদিন হুট করে চলে আসছিস তাই ভাবলাম কিছু হইলো কিনা।”
“কিছু হলে তাকে নিতে আসতাম না কখনোই। আর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আপনার রাগ তার উপর দেখাবো এমন অবিবেচক আমি না। যাইহোক, আপনি আপনার মেয়েকে ভালোমতো বুঝায় দেন সে যেন ভদ্র মেয়ে হয়ে থাকে। বিয়ে করে ফেলেছি বলে আঁটকে গেছি, তার সব অন্যায় মেনে নেব এমনটাও কিন্তু ভাববেন না।”
সালিম সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে অপমান সহ্য করলো। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো-“তুমি বসো আমি দেখি মেয়ের কি অবস্থা।”
রণ জবাব দিলো না। মোবাইলটা হাতে নিয়েছে এমন সময় তুলতুল এলো কফির মগ নিয়ে। কোন কথা না বলে মগটা রণর হাতে দিয়ে চলে গেলো। কাপটা তুলতে যেয়ে তাড়াতাড়ি নামিয়ে রাখলো রণ। তার বুক টিপটিপ করছে। কাপের নিচে কিছু একটা দেখেছে সে। কিন্তু কিভাবে শিওর হবে? চারপাশ দেখে নিয়ে মগটা মুখের কাছে এনে সামান্য তুলে চুমুক দিলো। দ্রুত হাতে ছোট্ট কাগজটা পকেটে পুরো স্বাভাবিক ভাবে বসলো।

শুভ্রাকে বাবা মায়ের সাথে আসতে দেখা গেলো। শুভ্রার মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চুলগুলো পরিপাটি করা শুভ্রার পরনে সালোয়ার কামিজ। ওড়নাটা আলতো করে মাথায় দেওয়া। রিমা মেয়ের পাশে হেঁটে আসতে আাতে বারবার চোখ মুছছে। শুভ্রার মধ্যে কোন বিকার দেখা গেলো না। রণর মনে হলো শুভ্রার মেজাজ খারাপ। সে হয়তো তার সাথে যেতে চায়নি। রণর হাসি পেলো ওকে দেখে। মনেহচ্ছে ধরে বেঁধে জেলে নেওয়া হচ্ছে ওকে। রিমা এগিয়ে এসে রণর হাত ধরলো-“বাবা, আমার মেয়েটা অবুঝ তুমি তাকো বুঝে চইলো। ভুল করলে মাফ করে দিয় বাবা। ওকে ভালোবেসে আগলায়া রাইখো।”
রণর খুকখুক করে কাশে। শুভ্রা রাগি চোখে মাকে দেখে-“মা! আর কথা নাই তোমার? আমি ছোট মানুষ না যে আমাকে অন্য কারো দেখা লাগবে। নিজেকে নিজে দেখতে পারি আমি।”
রিমা গর্জে উঠলো-“চুপ থাক বেয়াদব মেয়ে। মা তোর সাথে কথা বলতেছে? তুই কেন মাঝখানে কথা বলিস?”
শুভ্রা হতচকিত। কয়েক পলক মাকে দেখে রেগেমেগে নিচে নেমে গেলো-“আমি গেলাম যার আসা দরকার সে আসুক।”
রণর ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি। আচ্ছা সবক মিলেছে মেয়ের। খুব ফটর ফটর করে। সে রিমাকে স্বান্তনা দিলো-“আপনি ভাববেন না। আমাদের বাড়িতে ওর কোন সমস্যা হবে না আশাকরি। আসছি এখন।”

*****

পুরোটা পথ দু’জনার কেউই কারো সাথে কথা বলেনি। গভীর রাত হওয়ার কারনে ওরা একঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলো বাড়িতে। জলি শুভ্রাকে দেখে অবাক হলো-“তুমি এলে শেষ পর্যন্ত? আমি তো ভেবেছি আসবে না।”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। জলি ফোঁস করে শ্বাস ফেলে-“এসেছ ভালো হয়েছে। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।”
পাশ থেকে রণ বলে উঠলো-“আমার খিদে পেয়েছে মা। তুমি খাবার রেডি করো আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি।”
জলি মাথা দুলায়। রণ চলে গেলো। শুভ্রা তবুও দাঁড়িয়ে ছিল। জলি ফিসফিস করলো-“দু’জনই রাগ করে থাকলে সম্পর্ক আগাবে না। এই যে এতোদিন গিয়ে থাকলে একবারও কথা হয়েছে রণর সাথে? যেভাবে জেদ ধরে বিয়ে করেছ সেভাবেই সম্পর্কটা ঠিক করে নাও।”
শুভ্রা বোকা বোকা চাহুনিতে জলিকে দেখলো। জলি মৃদু হাসলো-“রণ এগুবে এমন আশা করো না। ও ওর বাবার মতো। খুব জেদি। তবে যদি তুমি একবার ওর মনে জায়গা করতে পারো তাহলে তোমার জন্য সব করবে। বুঝতে পেরেছ?”
এবারে খানিকটা হাসি ফুটলো শুভ্রার মুখে। সে ভেবে পেলো না এসব কথা আন্টি তাকে বলছে কেন? যেভাবে বিয়ে হয়েছে তাতে এই মানুষটার তাকে অপছন্দ করার কথা।
“মা খাবার রেডি?”
রণ বেরিয়ে এলো। জলি ছেলের দিকে তাকায়-“তুই টেবিলে বোস আমি খাবার আনছি।”
শুভ্রা একপলক দেখলো রণকে তারপর ঘরে চলে গেলো। বাবা বলেছে রণর সাথে মিলেমিশে থাকতে যাতে ওর কাজের খবর পাওয়া যায়। রণর কাজের খবর বের করতে রণর কতটা কাছাকাছি যেতে হবে সেটা খানিকটা আন্দাজ করেছে সে। আর ভেবেই অসস্তি হচ্ছে। এই লোকের সাথে দু’টো ভালো কথাই তো বলা যায় না আর তার সাথে কিনা রংঢয়ের আলাপ করতে হবে, খাতির করতে হবে? ভেবেই অসস্তি আকড়ে ধরলো শুভ্রাকে।

“সরি।”
“হ্যাহ!”
শুভ্রা চোখ গোলগাল করে তাকায়। অবিশ্বাস তার চোখের তারায়। রণ সোফায় বসলো-“এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আমি আপনার মতো সেলফিশ নই। নিজের ভুল মনে হলে সরি বলতে পারি। সেদিন আপনার সাথে বেশি রুড হয়েছিলাম তাই সরি বলছি। এমনটা বলা উচিত হয়নি আমার।”
শুভ্রার চোখ খুলে আসার উপক্রম হলো। মুখ হা করে আছে। এই লোক হুট করে এমন বদলে গেলো কেন? নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে। শুভ্রা নিজেকে সামলে নিলো-“ইটস ওকে। কিন্তু আমার কাছে আবার সরি আশা করবেন না। আপনাকে আমি কখনো মাফ করতে পারবোনা। যদি কখনো আপনার দুই মাসের কাজের জন্য সরি বলেনও তবুও পারবোনা।”
রণ গম্ভীর হলো, শুভ্রাকে দেখলো সময় নিয়ে তারপর বললো-“আমি সরি ফিল করছি না আপাতত। কখনো ফিল করলে বলবো। মাফ করা না করা আপনার উপর।”
শুভ্রা বিছানায় রণর মুখোমুখি বসলো-“আমার মতো মেয়েকে বউ হিসেবে কখনো ভাববেন অথচ তাকে বন্দী করে রেখে কাজ উদ্ধার করতে পারবেন। পুরো ব্যাপারটা কেমন কন্ট্রাডিকটরি মনেহয় না আপনার কাছে?”
রণ জবাব দিলো না। শুভ্রা হাসলো-“আচ্ছা বাদ দিন। জানি আপনার কাছে কোন জবাব হবে না। আমার কিন্তু এখনো দুটো পুরস্কার পাওনা আপনার কাছে। মনে আছে?”
“আছে। বলুন আর কি চাই?”
“আপাতত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন তাতেই চলবে।”
“কি জানতে চান?”
“ভাবির মা আর ভাইয়ের সাথে সেদিন লুকিয়ে দেখা করিয়েছিলেন। আসল ঘটনা কি বলবেন? এতো লুকোচুরির কি আছে?”
রণ নিঃশব্দে হাসলো-“বাবা মায়ের কাছে জানতে চাননি? তারা কিছু বলেনি আপনাকে?”
শুভ্রা এবার বিরক্ত হলো-“তারা বলেনি বলেই জানতে চাইছি।”
“তাহলে আমার বলা উচিত হবে না। আমি জানি আপনি যতটা না আমার বউ তার চাইতে সালিম সাহেবের কন্যা, সোহেলের বোন। যদি পুরোপুরি আমার বউ হতেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে সব ঘটনা খুলে বলতাম।”
“আমি বুঝে পাচ্ছি না কি এমন ঘটনা যে এতো লুকোচুরি করতে হবে?”
“সেটা তো আপনার বাড়ির লোক ভালো বলতে পারবে।”
রণ সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। তার চোখেমুখে কৌতুক। এমন ভাব যেন খুব মজা পাচ্ছে শুভ্রার প্রশ্নে। শুভ্রার কন্ঠে অভিমান জমলো-“আপনি কথা দিয়েছিলেন যা চাইবো তাই দেবেন। এখন কথা রাখছেন না।”
“অন্য কিছু বলুন অবশ্যই দেব।”
“আর কিছু চাই না আমার।”
“বেশ। এবার তাহলে আমার একটা চাওয়া পূরণ করুন। কাল একজন মন্ত্রী কন্যার বিয়ের দাওয়াত আছে সেখানে যাবেন আমার সাথে।”
শুভ্রা অপলক নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো-“এইজন্যই স্বপ্রনোদিত হয়ে আমাকে নিয়ে এলেন?”
“না, ঠিক সেজন্যও না। আসলে আপনাকে মিস করছিলাম। ঝগড়া করতে না পেরে জীবনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো।”
রণ হাসছে মুচকি মুচকি। শুভ্রার হার্টবিট মিস হলো একটা। সে কন্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে বললো-“মিথ্যে বলছেন!”
রণ উঠে দাঁড়ায়, হেঁটে এসে বিছানায় শুভ্রার উল্টো প্রান্তে শুয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো-“জানেন যেহেতু প্রশ্ন করা বোকামি। শুয়ে পড়ছি, কাল আমার অনেক কাজ। বাতিটা নিভিয়ে দেবেন।”
শুভ্রা অনেকটা সময় রণর পিঠের দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা আজ একের পর এক ঝাটকা দিলো তাকে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে বোঝা মুশকিল। শুভ্রা উঠে রুমের বাতি নিভিয়ে দিয়ে রণর পাশে শুলো। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজের জীবন নিয়ে ভীষণ হতাশ লাগছিল। এখন মনেহচ্ছে, জীবনটা খুব একটা খারাপও না।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here