দর্পহরন #পর্ব-৩১

0
245

#দর্পহরন
#পর্ব-৩১

“খবর শুনছোস সালিম?”
মোর্শেদ উত্তেজিত কন্ঠে ফোনের ওপাশে চেচিয়ে উঠলো। সালিম সাহেব আজ এসেছে হারুনুর রশীদের সাথে আলাপ করতে। দলের মধ্যে কি চলছে সেসব জানতে। হারুন রাজনীতিতে সালিমের সমকক্ষ, বেশ ভালো বন্ধু তারা। সেই সুবাদে আসা। সালিম সাহেব দলে বেশ কোনঠাসা অবস্থায় আছেন৷ গত মেয়াদে তার ও তার পরিবারের কৃতকর্মের বেশ চর্চা হওয়ায় নেত্রীর বিরাগভাজন হয়েছেন। দলের বড় বড় নেতারাও নেত্রীর ভয়ে পারতপক্ষে তাকে এড়িয়ে চলছে। কেউ তার সাথে দলের ভেতরকার কোন কথা বলছে না। বাধ্য হয়ে বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে হয়েছে। বন্ধু হারুন তাকে আজ বাসায় ডেকেছে আলাপ করতে। খেতে বসে কেবলই আলাপ শুরু করেছে এরমধ্যে মোর্শেদের ফোন। সালিম ‘পরে ফোন করছি’ বলে ফোন কেটে দিলো। মোর্শেদ আরও দুইবার ফোন দিলো ফোন সাইলেন্ট থাকার কারণে সালিম সাহেব টের পেলো না।

হারুনর রশীদ বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একজন। সালিমের কৃতকর্ম এবং পাওয়ার দুটো নিয়েই বেশ ভালো ভাবে অবগত। অনেকটা নিজের স্বার্থেই আজ সালিমকে ডেকে এনেছে। নেত্রী আজকাল বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের চাইতে তরুণদের প্রাধান্য দিচ্ছে। দিনে দিনে তরুন নেতৃত্বে তারা কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় কি করা যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করাটাও খুব রিস্ক। কয়েকদিন আগে তারা কয়েকজন পুরনো সদস্য গোপনে আলোচনায় বসেছিল। নেত্রী টের পেয়ে মিটিং ডেকে তাদের সাবধান করেছেন। তারপর থেকে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে তারা। কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে আরও কয়েকটি মন্ত্রনালয়ে নতুনদের সুযোগ দেবে। যেহেতু নতুনরা কাজ ভালো করছে। আর নতুনদের মধ্যে সালিমের মেয়ে জামাই এগিয়ে আছে। তাকে নেত্রী সব জায়গায় প্রায়োরিটি দিচ্ছে। মুরগী রানে কামড় দিতে দিতে হারুন বন্ধুকে দেখলো-“তোমার জামাই তো ভালোই খেল দেখাইতেছে সালিম। নেত্রী তাকে ছাড়া কিছু বোঝে না।”
সালিম অনিচ্ছায় হাসলো। হারুন বন্ধুর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো-“শুনলাম তোমার এলাকায় শো ডাউন হবে। নেত্রী যাবে আগামী সপ্তাহে। এলাকায় দলীয় প্রধানের নির্বাচন হবে। তারপরই যাওয়ার কথা। তোমার জামাইকে সাপোর্ট দিতে।”
সালিম এবার অবাক-“কি বলো? আমি তো এমন কিছু শুনি নাই? নির্বাচন হবে আর আমি জানবো না? তুমি মনেহয় ভুল জানছো?”
হারুন বুঝলো তীর জায়গা মতো লেগেছে। সে বিজ্ঞের মতো হাসলো-“আমি ঠিক জানছি সালিম। এইগুলা ভিতরের খবর। তোমাকে জানাবে না তাই গোপনীয়তা। শুধু তুমি না দলে আমাদের সবার এই অবস্থা। কোন না কোনভাবে আমাদের চাপানোর চেষ্টা করতেছে। নেত্রী চায় নতুন মানুষ নেতৃত্বে আসুক। পুরনোদের অনেক কেচ্ছা, ঝামেলা তাই ফ্রেশ মুখ আসলেই ভালো। নেত্রী যা খুশি তাই করতে পারবে কেউ কিছু বলতে পারবে না। বুঝো নাই?”
সালিম চিন্তিত হয়ে মাথা দুলায়-“বুঝেছি। কিন্তু আমি তো এতো সহজে হাল ছাড়বো না। তিরিশ বছর হইলো নেত্রীর সেবা করতেছি এতো সহজে নিজের জায়গা ছাড়বো?”
হারুন মাথা দোলায়-“আমিও তাই বলছিলাম। তুমি কতো পুরনো মানুষ। নেত্রীর বিপদে আপদে পাশে থেকেছ। অথচ দেখো তোমাকেই আগে সরালো।”
সালিম দাঁতে দাঁত চেপে বলে-“এখনো সরি নাই বন্ধু। আমার এলাকায় আমি ছাড়া আর কাউকে দলের কান্ডারী হইতে দিব না। আমাকে সংসদের জন্য নমিনেশন দেয় নাই। সামনে মেয়র ইলেকশন ওইখানে দিতেই হবে। সেই ব্যবস্থা আমি করবো।”
“যা করার তাড়াতাড়ি করো সালিম। শুনছি মেয়র হিসেবে নতুন কাউকে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে তোমার জামাই। দেখো কি করা যায়। তোমার এলাকায় সামনে বড় বড় প্রজেক্ট হবে শুনছো তো?”
সালিম মাথা নাড়ে। হারুন অবাক হয়ে বললো-“প্রজেক্ট শীতলক্ষ্যা”র নাম শোন নাই? প্রচুর টাকার কারবার। বিশ্ব ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট হবে। তার আগেই কিছু করতে হবে তোমার। না হলে কিছুই ভাগে পাইবা না।”
“হুমমম।”
চিন্তায় মুখ থেকে আর কিছু বেরুলো না। হারুন শেষ আরেকটা টোকা দিলো-“জামাই এর দিকে নজর রাইখো সালিম। নেত্রীর নজর আছে তার উপর।”
সালিম সাহেবের মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। কোনরকমে আলাপ শেষ করে বেরিয়ে এলো হারুনের বাসা থেকে। একবার মনেহলো ফেরার আগে মেয়ের বাড়ি থেকে ঢু মেয়ে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই সে পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো সোহেলের ফোন পেয়ে-“আব্বা, তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসেন জরুরি আলাপ আছে।”
সব বাদ দিয়ে সালিম বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটলো। মের্শেদ, সোহেল, তুহিন সবার মুখের রেখায় চিন্তার আভাস। সালিম সাহেব ঘাবড়ে গেলো-“কি হইছে ভাইজান। এমন চেহারা কইরা বইসা আছেন কেন? আর বারবার ফোনই বা দিতেছেন কেন? আমি জরুরি কাজে বাইরে আছিলাম।”
মোর্শেদ রেগে গেলো-“তোরে কি হুদা কামে ফোন দিমু আমি? শুনছোস কিছু? রবিবার আপা আসবো এলাকায়। শুনতেছি শুক্রবার বা শনিবার ভোট হইবো। এলাকায় দলীয় প্রধান নির্বাচন হইবো। জামাই চুপে চাপে কাম করতাছে। এলাকার যত টেন্ডার হইবো সব ভাগ কইরা দিছে জামাই। আমরা সব ঠিক দেওয়ার পরেও একটা কামও পাই নাই। দিন না আমাগোরে। উল্টা জাহাজ নতুন কারখানা হইবো শুনলাম। এতোকিছু হইতেছে কিছুই জানি না আমরা। এখন কেউ কোন কথা কইতেছে না। টাকার ভাগ পাইয়া মুখে কলুপ আঁটছে। এমনে তো চলতো না সালিম। আর কয়দিন এমন গেলে আমগো ব্যবসা লাটে উঠবো। এখন কি করবি ক?”
আজ সালিম সাহেবও উত্তেজিত। এতো কিছু চিন্তা মাথায় লোড নিতে পারছে না। সে হুট করে শুভ্রাকে ফোন দিলো-“আম্মা ভালো আছেন?”
রাতের বেলা বাবার ফোন পেয়ে শুভ্রা অবাক হলো-“জ্বি আব্বা, ভালো। আপনি?”
“আপনাকে কাজ দিছিলাম। কিছু কি করতে পারছেন? আজ পর্যন্ত কিছুই তো জানাইলেন না আমাকে।”
বাবার কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান বুঝতে পেরে শুভ্রা নরম গলায় জবাব দিলো-“সুযোগ নেই আব্বু। সে বাসাতেই থাকে না বলতে গেলে। কয়েক সপ্তাহ ধরে অনেক ব্যস্ত। কিভাবে কি করবো?”
“তনুও আম্মা। এই কথা বলতে লজ্জা হওয়া উচিত আপনার। সে আপনার স্বামী, তার একটা কাজের ব্যপারে আপনি জানেন না এইটা কেমনে হয়?”
বাবার স্পষ্ট ইঙ্গিত শুনে গাল লালিম হলো শুভ্রার। সে অতি দ্রুত ফিসফিস করলো-“সে আসছে আব্বা আমি রাখলাম।”
সালিম মেয়েকে ডাকলো-“আম্মা, আমাদের এলাকায় কি চলতেছে তার কাছ থিকা শুনে আমাকে জানান। আপনার জামাই আপনার আব্বার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেছে। তার কাছ থিকা বাপরে উদ্ধার করেন।”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। সালিম সাহেব ফোন নামিয়ে কয়েক জোড়া বিস্মিত চোখকে দেখলো। সে চোখ নাচায়-“কি হইছে?”
সোহেল অবাক হলো-“শুভ্রা কি করবো? ও রাজনীতির কি বোঝে?”
“কিছু বোঝা লাগবে না খালি আমারে খবর দিবে। এইটুক পারলেই হইবো।”
সালিম সাহেবকে ভীষন অস্থির মনে হলো। হারুনের কথা শোনার পর থেকেই অস্থিরতা পেয়ে বসেছে তাকে। আসলে এখন সালিম সাহেব হন্যে হয়ে সুযোগ খুঁজছে। কোনভাবে এমন কিছু করা যাতে নেত্রী তাকে আবার কাছে টেনে নেয়। কিন্তু কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শুধু জানেন কিছু একটা করতেই হবে।

*****

আজ গভীর রাত পর্যন্ত রণর জন্য জেগে বসে রইলো শুভ্রা। যত্ন করে শাড়ী পরলো। চোখে হালকা কাজল ঠোঁটে গোলাপি লিপবাম। আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জাই লাগলো। এভাবে সাজগোছ করতে দেখে ব্যাঁকা লোকটা না জানি কি বলে তাকে। নিজেই উদ্যোগী হয়ে রান্নাঘরে খাবার গরম করলো। শুভ্রাকে দরজায় দেখে অবাক হলো রণ-“আপনি ঘুমাননি? অনেক রাত হয়েছে তো?”
শুভ্রার বুক ধুকপুক করছে। মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বললো-“ঘুম আসছিলো না তাই মাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমি খাবার বেড়ে আনছি।”
রণ মাথা দুলিয়ে চলে গেলো। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো শুভ্রা এরইমধ্যে খাবার এনে ছোট টেবিলে রেখেছে। প্লেটে সামান্য ভাত আর ভাজা মুরগী। সাথে ঘন ডাল। রণ খাবার খেতে বসলে শুভ্রাও বসলো ওর সামনে। রণ বিস্মিত হলেও স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে বললো-“আপনি চাইলে ঘুমিয়ে যেতে পারেন। আমি খেয়ে নেব।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“না থাক। আমি বসে থাকি। একা খেতে কষ্ট হবে আপনার।”
রণ আরেকবার হোঁটচ খায়। স্মিত মুখে ভাত মাখিয়ে মুখে তোলার আগে জানতে চাইলো-“আপনি খেয়েছেন?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“খিদে ছিল না তাই খাইনি।”
রণ হুট করে প্রথম লোকমাটা শুভ্রার মুখের সামনে ধরে-“খিদে ছিল না তারমানে এখন আছে। নিন হা করুন।”
শুভ্র চমকিত-“আরে না না আপনি খান। সামান্য ভাত আমি খেলে আপনি কি খাবেন?”
রণ হাসলো-“যদি হয় সুজন তেতুল পাতায় দুজন। কথা না বাড়িয়ে হা করুন।”
বাধ্য হয়ে হা করে শুভ্রা। রণ ভাতের লোকমা শুভ্রার মুখে দিয়ে নিজেও খেলো এক লোকমা। আবার শুভ্রাকে দেয় নিজে খায়। তিনবার এমন হওয়ার পর শুভ্রা ফট করে উঠে দাঁড়ায়-“আর খাবো না। পেট ভরে গেছে আমার। আপনি খাওয়া শেষ করুন আমি আপনার জন্য এককাপ চা বানিয়ে আনছি।”
বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলো মেয়েটা। রণর মনে হলো শুভ্রার চোখের কোলে জল ছিলো। নিজেকে দূর্বল দেখাবে না বলে ওর সামনে থেকে পালিয়ে গেলো। সত্যি কি তাই? রণ বেশি ভালো না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে পুনরায় খাওয়ায় মন দিলো সে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

জানেন তো আমার প্রথম মৌলিক থ্রিলার বই আসছে? আমার দুই বছরের পরিশ্রম সফল করতে আপনাদের পাশে চাই প্রিয় পাঠক। বইটি পেতে অর্ডার করতে হবে বেনজিন প্রকাশন এর পেজে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here