#দর্পহরন
#পর্ব-৩৫
সোহেল গুলিবিদ্ধ। বুকের ডান পাশে একটা গুলি আর বা কাঁধে একটা গুলি লেগেছে তার। হাসপাতালে আনতে আনতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার অবস্থা ক্রিটিক্যাল। সোজা অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। পুরো হাসপাতাল জুড়ে সাংবাদিক আর পুলিশে গিজগিজ করছে। কি ঘটেছে সে সম্পর্কে কেউ পরিপূর্ণ অবগত না হলেও প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান পন্ড করার অভিযোগ আসবে অনুমান করা যায়। আর এটা মোটেও যা তা ব্যাপার নয়। সবমিলিয়ে একটা হুলুস্থল অবস্থা। সালিম সাহেব হতচকিত হয়ে এক কোনে বসে আছেন। তিনি এখনো ঘোরে আছেন। ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কি ঘটেছে আর ঘটছে। সোহেল কেন ওখানে গেলো আর কেনইবা ওর উপর গুলিবর্ষণ হলো। পুরো বিষয়টা তার কাছে একটা ধোঁয়াশা। তিনি মাঝে মাঝেই হতবিহ্বল দৃষ্টি মেলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছেন আর চুপ মেরে যাচ্ছেন।
দু’টো ঘন্টা এভাবেই কাটলো। অবশেষে অপারেশন শেষে ডাক্তাররা বেরিয়ে এলো। জানা গেলো আটচল্লিশ ঘন্টার অবজারভেশনে রাখতে হবে সোহেলকে। রোগীর সিভিয়ার ব্রিডিং হয়েছে এখনো হচ্ছে। ব্লাড বন্ধ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। দুই দিনের মধ্যে রোগী রেসপন্স করে কিনা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। সালিম সাহেব চুপচাপ সব শুনলেন। আবারও জায়গায় যেয়ে বসলো। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে পুরো সালিম পরিবার হাসপাতালে উপস্থিত। মোর্শেদ বুঝে পাচ্ছে কি বলে ভাইকে শান্তনা দেবে। আজ সালিমের সাথেই ছিলো মোর্শেদ। হঠাৎ কাজ পড়ে যাওয়ায় সে চলে আসে। এরমধ্যে কি এমন হলো যে সোহেল এই কাজ করবে? এদিকে সাংবাদিকরা পাগল হয়ে আছে ইব্রাহিম পরিবারের সাথে কথা বলতে। নেত্রীর দীর্ঘদিনের মিত্র ইব্রাহিম পরিবারের সাথে কি এমন হলো যে এইরকম নাশকতার পরিকল্পনা হয়? রংচং মাখিয়ে নানা রসালো খবর করতে লাগলো টিভি চ্যানেলগুলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ঘটনাটি টক অফ দা টাউন হয়ে গেলো।
*****
রণ মত পাল্টে ঢাকায় না ফিরে এলাকায় ফিরলো। তার বিহ্বল ভাব এখনো কমেনি। একটু ধাতস্থ হওয়া দরকার। এই অবস্থায় মায়ের কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। মা সবসময় সাথে আসতে চায়। কাল অনেকবার বলার পরও আনেনি। এখন এসব শোনার পর কি বলবে তাই ভাবছে। তাছাড়া এখানে কিছু হিসেব মেলাতে হবে। কি ঘটেছে সেটা জানতে হবে। নেত্রীকে জবাব দিতে হবে, কথা গোছাতে হবে। রণ পায়চারি করলো ঘরে। সে সালিম সাহেবকে যতটা বুঝেছে তাতে এতটুকু জানে, নেত্রীর ব্যাপারে আপোষ করবে না। তাই নেত্রীর অনুষ্ঠানে তারই ছেলে হামলা করবে এটা কখনোই বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। হয়তো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এটা মানতে চাইবে না। তাহলে কি বোঝা যায়? কেন এমনটা করবে সোহেল? তাকে খারাপ বানানোর একটা পরিকল্পনা হতে পারে। সে নেত্রীর আসার ব্যাপার ঠিকঠাক হ্যান্ডেল করতে পারেনি সেটা প্রমানের চেষ্টা হতে পারে। যাতে তাকে নেত্রীর কাছে ব্যর্থ প্রমান করা যায় এবং এই কারনে তার মন্ত্রীত্ব চলে যায়। কিন্তু এটাও খুব স্ট্রং যুক্তি মনেহচ্ছে না। সে প্রতিদ্বন্দি, তাকে হারাতে অনেক কিছু করতে পারে সালিম সাহেব। কিন্তু নেত্রীর জানের উপর দিয়ে নয়। যুক্তি পাল্টা যুক্তি দিয়ে নিজেকে খন্ডন করলো রণ। অনেক ভেবে ফোনটা হাতে তুলে নিলো-“কোথায় আছিস তুই?”
“নিচে আছি ভাই।”
ওপাশে দিলশাদের বিস্মিত স্বর। রণ ডাকলো-“উপরে উঠে আয়। কথা আছে।”
এলাকায় থাকলে দিলশাদকে সাথে সাথে রাখে রণ। আজও ছিলো। দরজায় আওয়াজ হলো-“ভাই, আসবো?”
“আয় দিলশাদ, বোস।”
চেয়ারে বসার ইশারা দিলো। দিলশাদ অবাক হয়ে বসলো-“হঠাৎ ডাকলেন যে? কি হইছে?”
রণ দিলশাদকে দেখলো মন দিয়ে। তারপর আচমকা প্রশ্ন করে বসলো-“আজকের ঘটনা খুলে বলতো কি হয়েছিল?”
“আমি তো কিছু বুঝলাম না ভাই। হুরোহুরিতে আপনার সাথে চলে আসলাম।”
রণ মাথা নাড়ে-“উহু, অনেক ভেবে দেখলাম আমি। নেত্রী আছে এমন অনুষ্ঠানে সালিম সাহেব হামলা করবে এটা কাউকে মানাতে পারবোনা। কেউ বিশ্বাস করবে না।”
“কিন্তু আপনাকে বদনাম করার জন্য করতে পারে। ওই লোক সব করতে পারে আপনি জানেন।”
দিলশাদ উত্তেজিত হয়ে উঠলে রণ হাসলো-“সেটাও ভেবেছি জানিস? এমনটা করতে পারে আমিও বিশ্বাস করি কিন্তু নেত্রী যেখানে থাকবে সেখানে উনি এমন কিছু করতে দেবেন না৷ নেত্রীর প্রতি উনি বিশ্বস্ত চিরকাল এটা স্বয়ং নেত্রীও স্বীকার করে।”
দিলশাদ চুপ করে রইলো। রণ বললো-“তোকে কে সাহায্য করেছে দিলশাদ? আমি জানি কাজটা তোর। তবে তুমি একা না আরও কেউ ছিলো সাথে। আমি জানি সোহেল হলো বারুদ। বারুদে একটু ঘষা দিলেই কাজ হয়। এই ঘষাটা কে দিয়েছে জানতে চাই।”
দিলশাদ ধরা পড়া গলায় মিনমিন করলো-“ফাহিম।”
রণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো-“তুলতুলের ভাই!”
দিলশাদ হ্যা বোধক মাথা নাড়ে। রণ চুকচুক করলো-“কাজটা করার জন্য টাইমিংটা ঠিক বাছিসনি। এমন একটা অনুষ্ঠানে এসব না করলেও পারতি। নেত্রী নিজেই মানবে না। আর সালিম সাহেব যদি জানতে পারে তাহলে কি হবে ভেবেছিস? গোটা শহর জ্বালিয়ে দেবে। ছেলেকে কতটা ভালোবাসে সেটা টের পেয়েছিস? তার ছেলের যদি কিছু হয় তাহলে উনি কি করবে আমি ভাবতেই পারছিনা।”
দিলশাদ ভয় না পেয়ে সিনা টানটান করে বললো-“ভাই, ওনাকে আর ভয় পাই না। আর সোহেল সত্যি সত্যি আপনাকে গুলি করতো। এক সেকেন্ড দেরি হলে গুলিগুলো আপনার বুকে বিঁধতো।”
রণ চুপ করে রইলো দেখে দিলশাদ হাসলো-“আপনের বিশ্বাস হয় না তাই না? ভাবছেন, আপনি বোনজামাই আপনাকে এইরকম করবে কেন? ওরা খুব খারাপ ভাই। ওদের কাছে সম্পর্কের মুল্য নাই। ক্ষমতার চাইতে বড় কোন সম্পর্ক নাই। আমার কাছে ভিডিও আছে। দেখেন নিজের চোখে।”
দিলশাদ মোবাইল এগিয়ে দিলো। রণ দেড় মিনিটের ভিডিওটা দেখলো মন দিয়ে। তারপর মোবাইল ফিরিয়ে দিলো দিলশাদকে-“পুলিশের তরফ থেকে একটা মামলা কর। সমাবেশে নাশকতার চেষ্টা মামলা। আর ফাহিমকে সাবধানে থাকতে বলিস কয়েকটা দিন। কেউ যেন ঘুনাক্ষরেও টের না পায়। সালিম সাহেব অবশ্যই মাঠে নিজের লোক নামাবে সত্য জানার জন্য। দোয়া কর সোহেল যেন বেঁচে যায়।”
“মনেহয় না বাঁচবে।” দিলশাদের চেহারা কঠিন-“অনেকদিনের জমানো ক্ষোভ ভাই। সামান্য অংশ দেখানোর সুযোগ পেয়েছি। আর…”
মিহির হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো-“ভাই, খালাম্মা হাসপাতালে।”
রণ চেচিয়ে উঠে দাঁড়ায়-“কিহহ?”
মিহির মাথা দুলায়-“আপনের ফোন অন করেন। ভাবি ফোন দিতে দিতে পাগল। আমি কেবল দেখলাম।”
রণর হাত কাঁপছে। মায়ের কি হলো? কাঁপা হাতে ফোন অন করতেই টুংটাং ম্যাসেজ আসতে শুরু করলো। মামার ফোন পেলো সাথে সাথে। রিসিভ করে তিরিশ সেকেন্ড কথা বলে ‘আমি আসছি’ বলে ফোন কাটলো।
*****
জলির সব টেস্ট করে দেখা গেলো রিপোর্ট সব নরমাল আছে। মাত্রাতিরিক্ত চিন্তায় প্রেশার ফল করেছিল তাই মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল। তবুও ডাক্তার একদিন অবজারভেশনে রাখতে চাইলে জলি থাকলো না। রণ মাকে বোঝাল কিন্তু জলি অটল। রণকে সুস্থ দেখে সে জেদ করে বাড়ি ফিরে এলো। মা বোনকে সাথে নিয়ে একসাথে রাতের খাবার খেলো। শুভ্রার দিকে তাকালো না খুব একটা।
ওদিকে রণকে সুস্থ দেখে বেশ স্বস্তি পেলো শুভ্রা। মনটা ভীষন হালকা লাগলো তার। তন্ময় তাহলে তাকে ভয়ই দেখালো? কিন্তু এতো বিশ্রি রকমের ভয় কেন দেখালো তাকে? মনটা খচখচ করছিলো তার। সে রণর আশপাশে ঘুরঘুর করছিল আর ভীষণ ভয়ে ভয়ে জলি আর হাসিখুশিকে দেখছিল। কখন না জানি তন্ময়ের কথা বলে দেয়। আর তন্ময়ের কথা শোনার পর রণ কি করবে? শুভ্রার ভালোলাগাটুকু গায়েব হয়ে যায়।
মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রণ নিজের ঘরে এলো। শুভ্রা চা হাতে রণর পিছুপিছু এলো। রণ কাপড় নিতে নিতে আড়চোখে শুভ্রাকে দেখলো-“ধন্যবাদ।”
শুভ্রা থমকে যায়-“কেন?”
রণ পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো-“আমার মাকে সময়মতো হাসপাতালে নিয়েছেন সেজন্য। হাসিখুশি বলেছে আপনার কথা।”
শুভ্রা মনে মনে সিটিয়ে গেলো। রণ খানিকটা এগিয়ে এসে শুভ্রার সামনে দাঁড়ায়। মায়াময় চাহুনি নিয়ে শুভ্রাকে দেখলো। ওর এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে রণর। শুভ্রা আতঙ্কে মাথা নিচু করে থাকে। রণ ওর চিবুক ধরে মুখটা উপরে তুলে নরম গলায় বলে-“খুব টেনশনে ছিলেন তাই না?”
রনকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে শুভ্রা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো-“তন্ময় ভাই যখন আপনার উপর হামলার কথা বললো আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি জানেন। ভেবেছিলাম আপনাকে হারিয়ে ফেলবো। পাগলের মতো ফোন দিচ্ছিলাম আপনাকে। এদিকে মা তন্ময় ভাইয়ের কথা শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। আমার অবস্থাটা বুঝুন এবার।”
শুভ্রার চিবুক থেকে রণর হাত নামে, চোয়াল শক্ত হয়, হাত মুঠি হয়। শুভ্রা রণর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো। ও বুঝে গেলো খুব ভুল করে ফেলেছে আজ। যে ভুলের কোন ক্ষমা নেই।
চলবে—
©Farhana_Yesmin