#দর্পহরন
#পর্ব-৩৬
তুলতুল যখন সোহেলের খবর পেলো ওর মন চাইলো খুশিতে জোরে একটা চিৎকার দিতে। এতো আনন্দ হচ্ছিল ওর মনের মধ্যে। পরক্ষণেই মনে পড়লো মায়ের কথা। মা বলেছিল, কারো বিপদে খুশি হতে নেই। তুলতুল তাই কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে রইলো। ওর পাশে রিমা বসে বিলাপ করছে। আর মিনু তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তুলতুলের বিরক্ত লাগছিল। রিমাকে মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে তুলতুলের। সোহেল মোটেও ভালো ছেলে না। সে যে শুধু তুলতুলের সাথে খারাপ আচরণ করে তা না। বরং সে সুযোগ পেলে প্রায় সবার সাথে খারাপ আচরণ করে। এমনকি রিমার সাথেও। রিমা কোন কথা বললে গুরুত্ব দেয় না। উল্টো খাবার দাবার বা অন্য কোন ব্যাপারে জোর করলে রিমাকে ঝাড়ি দেয়। মা হিসেবে ন্যনতম সন্মান রিমাকে দেয় না। রিমাও কেন যেন ছেলেকে কিছুই বলে না। এই যে তুহিন নামে লোকটা আছে তাকেও মাঝে মাঝে খুব বাজে ভাষায় গালিগালাজ করতে শুনেছে। শরীফ ওর বড় ভাই তাকেও গোনায় ধরে না। সোহেল একমাত্র সালিম সাহেবের সামনে নরম থাকে। তুলতুলের ধারণা, সালিম সাহেবকেও গোনায় ধরতো না সোহেল যদি না তিনি অঢেল ক্ষমতার অধিকারী হতেন। বাপকে হয়তো সেই কারণেই কিছুটা ভয় পায় সোহেল। তা না হলে বাপের সাথেও এমন করেই কথা বলতো। তুলতুল দুঃখ ভরাক্রান্ত চেহারা বানিয়ে চোখ মোছার অভিনয় করে উঠে এসে নিজের ঘরের দুয়ার দিলো।
দরজা বন্ধ করেই লাফিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ পুরো বিছানা গড়াগড়ি খেলো তারপর সিলিংয়ের পানে চেয়ে থাকলো অনেক সময়। সে মনে মনে চায় সোহেল এই ঘরে আর না ফিরুক। অনিচ্ছায় প্রতিরাতে তাকে সোহেলের মনোরন্জন আর না করতে হয় যেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগে তার। এই বন্দী জীবন থেকে সে মুক্তি চায়। আবার পড়াশোনা শুরু করতে চায়। খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে চায়। আর এসব করতে চাইলে সোহেলকে ম*রতে হবে। সোহেল বেঁচে থাকলে এসব স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। হতে পারে সোহেলে উল্টো তাকেই মেরে ফেললো। শিউরে উঠলো তুলতুল। তার বেঁচে থাকার জন্য হলেও সোহেলকে ম*রতে হবে। সে মনে মনে প্রার্থনা করলো সোহেল যেন এই যাত্রায় মা*রা যায়।
*****
সালিম সাহেব শরীফকে ডাকলো-“আম্মাকে খবর দিছোস? ফোন দে ওরে।”
শরীফ মাথা নাড়লো। তাকে দ্বিধান্বিত দেখায়। তন্ময়ের কথা বাবাকে বলবে কিনা ভাবছে। সালিম সাহেব ছেলের দিকে তাকালো-“কি হইছে তোর? কি ভাবতেছোস?”
শরীফ সালিম সাহেবের কাছে এগিয়ে এলো-“আব্বা, শুভ্রাকে এখন না জানাই।”
সালিম সন্দেহ নিয়ে তাকায়-“কেন? জানাবি না কেন? কি সমস্যা? আর ও তো এমনিতেও জানব। হুদাই জানাবি না কেন? ওর ভাই এইদিকে মরতেছে আর ও জানবো না?”
শরীফ মিনমিন করলো-“ঝামেলা অন্য জায়গায় আব্বা।”
“কোন জায়গায়? কি সব কস?”
সালিম সাহেব চাপা গলায় হুঙ্কার দিলো। শরীফ ভয় পেয়ে বললো-“আজকে তন্ময় গেছিল ওর শশুরবাড়ি। ওইখানে যায়া ভেজাল লাগায়া আসছে।”
“কি ভেজাল লাগাইছে?”
এবার খানিকটা নিভু নিভু শোনায় সালিম সাহেবের গলা।
“ও শুভ্রাকে বলছে, আপনেরা নাকি রণকে মা*রার চেষ্টা করবেন। এখন এইটা তো সত্যি কথা দেখা যাচ্ছে। সোহেলের ভিডিও বের হইছে। কে জানি ভিডিও কইরা ছাড়ছে। সেখানে দেখা যাইতেছে সে শুভ্রার জামাইকে গুলি করার চেষ্টা করতেছে। এখন ওরে কি বলবো তাইলে। ওর জামাই যদি সত্যটা জানে তাইলে কি হবে ভাবছেন?”
সালিম সাহেব হতবাক-“সত্যি বলতেছিস? দেখা দেখি ভিডিওটা। আমি তো কিছুই বুঝতেছি না। সোহেলকে আজকের অনুষ্ঠানে যাইতেই মানা করছিলাম। ও কখন গেলো কি করলো আমি কিছু জানি না। আর তন্ময় এইসব কথা কেন কইছে শুভ্রাকে? ও কেমনে জানলো? সোহেল কি ওরে কিছু কইছিল? কইলো ও ঠেকাইলো না কেন? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না?”
“আমিও বুঝতেছিনা। এখন যদি শুভ্রা এই কথা জামাইকে কয় তাইলে তো আরও বিপদ। সোহেলকে এইবার জেলে যাওয়া কেউ ঠেকাইতে পারবে না।”
শরীফের কথায় সালিম সাহেবের শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে। সে রেগে চাপা গলায় দাঁতে দাঁত চেপে গর্জন করলো-“হা*রা*ম*জাদা পোলা, নিজে তো ডুববো সাথে আমাগো পরিবাররে ডুবাইবো। আমার রাজনৈতিক জীবনটাও শেষ করবো। কি যে করমু ওরে নিয়া।”
নিরবতা নেমে এলো দু’জনার মধ্যে। শরীফ হঠাৎ করে বলে উঠলো-“ওরা সব জাইনা শুভ্রারে না ফেরত পাঠায়।”
সালিম সাহেব চমকে উঠে ছেলের দিকে তাকায়।
*****
“বাহ, আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র বেশ ভালোই চলছে দেখা যাচ্ছে। পুরো পরিবার মিলে মিশে আমাকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।”
রণর কথায় শুভ্রার শরীর কেঁপে উঠলো থরথর। সে অসহায় চাহুনি দিয়ে রণর দিকে তাকালো। রণ ওকেই দেখছে একনজরে। ওর চেহারায় ক্রোধ আর ঘৃনার মিশেল। শুভ্রার হৃদয়টা যেন চুরমার হয় সে দৃষ্টি দেখে। সে কাতর গলায় বললো-“সত্যি বলছি আমি কিছু জানতাম না। আর তন্ময় ভাইকে আমি অনেকবার মানা করেছি এখানে যেন না আসে। কিন্তু ভাইয়া শুনছে না। প্লিজ আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।”
রণ রাগে ফেটে পড়লো-“ভুল বুঝবোনা? লাইক সিরিয়াসলি? কেন ভুল বুঝবোনা শুনি? আপনি আপনার বাবাকে আমার বিষয়ে আপডেট দেননি? আপনার বাবা আপনাকে বলেনি আমার ব্যাপারে আপডেট দিতে? বলুন?”
শুভ্রা মুক হয়ে গেলো। তার বুকের মধ্যে ধরাস ধরাস আওয়াজ হচ্ছে। এসব কি বলছে রণ! সে কি করে জানলো বাবার সাথে কি কথা হয়েছে তার? সে কম্পিত কন্ঠে জানতে চাইলো-“আপনি কি বলছেন এসব?”
রণ হাত ঝাড়লো। শুভ্রার দিকে এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে উঠলো-“মিথ্যে বলেছি? বলুন মিথ্যে বলেছি?”
রণর এমন রণমুর্তি দেখে শুভ্রা ভয় পেয়ে গেলো। কোন কথা জোগাল না মুখে। রণ রাগে ছটফট করছে-“এক ভাই আমাকে মারার জন্য বন্দুক তাক করে। আরেক ভাই আমার বোনের দিকে নজর দেয়। আর আমার বউ হয়ে যিনি এসেছেন তিনি তার বাবার হয়ে আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছে। কি সৌভাগ্য আমার। আচ্ছা একটা কথা বলবেন?”
শুভ্রা রণ দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলার সাহস হলো না তার। রণ বললো-“আজ আমার কিছু হলে আপনি নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন?”
শুভ্রা স্বজোরে মাথা নাড়লো। রণ হাসলো-“আমি জানি আপনি ভীষণ খুশি হতেন। কিন্তু একবারও আমার মা আর বোনদের কথা ভেবেছেন? আমি না থাকলে ওদের কে দেখবে? আপনার হয়তো তেমন কিছু যাবে আসবে না। আবার নতুন করে জীবন সাজাতে পারবেন। কিন্তু ওদের জীবনটা থমকে যাবে। বাবা চলে যাওয়ার পর আমিই ওদের জীবন। আমি না থাকলে ওরাও থাকবে না হয়তো। কিন্তু এসব আপনার মতো মোটা মাথার মানুষ বুঝবে কি করে?”
শুভ্রা কেঁদে দিলো-“সত্যি বলছি আমি এসব কিছু জানতাম না। আমার বাবা এমন কিছু কখনোই করবে না। এতো নিচে সে নামবে না কখনোই।”
রণ হাসলো-“আপনার বাবা তো মহান মানুষ। কোন কিছু করতে পারে না। শুনুন, আপনি এককাজ করুন, আপনার বাবার বাড়ি ফিরে যান। এই সংসার, বউ এসব খেলা বন্ধ করুন। চারদেয়ালের ভেতর আপনার আমার সম্পর্ক কি তা নতুন করে বলার দরকার নেই আর। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবিও না। এই সম্পর্ক থেকে আমি কখনো বেশি কিছু পাওয়ার আশা করিনি। শুধু মায়ের খাতিরে বিয়েটা করেছিলাম। কিন্তু সেই মা আর বোনরাই যদি ভালো না থাকে, তাদের জীবনের হুমকি আসে তাহলে এই বিয়ে টিকিয়ে রেখে লাভ কি। আপনার প্রতিশোধ পূরণ হলে এবার দয়া করে আমাদের মুক্তি দিন।”
রণ করজোড়ে মিনতি করলো। শুভ্রা এতোক্ষণ কাঁদছিলো এবার কেবল হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার হুট করে ভীষণ রাগ হয়ে গেলো। সে এগিয়ে গিয়ে রণর গেন্জির গলা মুচড়ে ধরলো-“কেন মুক্তি দেব? কেন আমার থেকে মুক্তি চাই আপনার? যেন চন্দ্রানীকে বিয়ে করতে পারেন? কি ভেবেছেন আমি কিছু বুঝবো না? আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেবেন, তারপর নিজে নাটক বানিয়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে আমাকে আপনার জীবন থেকে বিদায় দেবেন। আর আমি অসহায় মেয়ে সেজে আপনার সব সিদ্ধান্ত মেনে বাপের বাড়ি ফিরে যাব? নো মিস্টার রণ, আমাকে এতোটা বোকা ভাববেন না। আমাকে অপহরণ করে আপনি এই খেলা শুরু করেছিলেন এর শেষ আমি করবো। আমার পরিবারকে আপনি ধ্বংস করতে চাইছেন আমার পরিবার না।”
রণ হতভম্ব। শুভ্রার আচমকা আক্রমণে সে দিশেহারা বোধ করছে। শুভ্রা ওর চোখে চোখ রেখে শাসালো-“আমার কাছ থেকে এতো সহজে মুক্তি নেই আপনার। কি ভেবেছিলেন, সালিম সাহেবের কন্যাকে অপহরণ করে নির্বাচন জিতে যাবেন তারপর আয়েস করবেন সারাজীবন? আর বদনামের ভয়ে সালিম সাহেব চুপচাপ সব হজম করবে? এই শুভ্রা তা হতে দেবে না কখনোই। আমাকে যেহেতু সিড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাই আমাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সহ্য করার জন্য তৈরী হোন। বাকী আর কেউ আসবে আপনার জীবনে। কেউ না মানে কেউ না।”
★মনে আছে তো? বইয়ের প্রি অর্ডার চলছে? স্বল্পমুল্যে আজই আপনার কপি বুকিং দেন।
চলবে—
©Farhana_Yesmin