দর্পহরন #পর্ব-৩৭

0
260

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৭

রণর ভ্রু জোড়া বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। শুভ্রার কথা শুনতে শুনতে তার মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো-“একমিনিট।”
শুভ্রা থতমত খেয়ে বললো-“কি?”
“কি বললেন আপনি? আপনার বাবা কিছুতেই এমন কিছু করতে পারে না?”
শুভ্রা মাথা দুলায়। রণর মুখে হাসি ফুটলো-“তার মানে আপনার ভাইয়েরা পারে?”
শুভ্রা রণর গেঞ্জি ছেড়ে দাঁড়ায়-“এ কথা কখন বললাম?”
“আপনি বেশ চালাক মেয়ে। অভিনয়ও ভালো করেন।”
শুভ্রা ভরকে গেলো-“মমমম মানে? কি বলতে চাইছেন?”
“বলতে চাইছি আমার উপর হামলা হবে সেটা আপনি আগে থেকেই জানতেন। তারপরও হাত পা গুটিয়ে বসে ছিলেন। আমার ধারণা আপনি আপনার পরিবার সম্পর্কে সম্পুর্ন ওয়াকিবহাল। তারা কেমন কি সব। কিন্তু সব না জানার ভাব ধরে থাকেন। তাই না?”
“কেমন কথা বলছেন? তন্ময় ভাইয়ের মুখ থেকে কথাটা শোনা মাত্রই কতবার ফোন দিয়েছি আপনাকে। আপনার নাম্বার বন্ধ পাচ্ছিলাম। মিহির ভাইকেও ফোন দিয়েছি। শেষে শরীফ ভাইকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করেছি যেন সে আপনার খোঁজ করে। বিশ্বাস না হলে ফোন দিয়ে শুনতে পারেন।”
রণ হতাশ হয়ে শ্বাস ছাড়ে-“আপনাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না শুভ্রা। আমি শুধু ভাবছি প্রতিশোধ স্পৃহা আপনাকে কতটা নিচে নামিয়ে দিয়েছে?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। রণ হাসলো-“আমি আপনাকে অপহরণ করেছিলাম এটা নিয়ে ব্লাকমেল করে আমাকে বিয়ে করেছেন। অথচ এটা জানেন না যে আপনার ভাবিকে আপনার ভাই সোহেল তুলে এনে রে*প করেছে। শুধু আপনার ভাবি কেন ওর মতো কয়েকটা মেয়েকে তুলে নিয়ে রে*প করে মে*রে ফেলেছে। আর আপনার বাবা ছেলের সব কুকীর্তি গোপন করতে সিদ্ধহস্ত। আমাকে যদি অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করান তাহলে নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে কি বলবেন? বলুন?”
শুভ্রা অটল গলায় বললো-“আপনি মিথ্যে বলছেন। প্রমান আছে কোন? এমন কোন মেয়েকে দেখান যাকে ভাই রে*প করে মেরে ফেলেছে। প্রমান ছাড়া আইনত কাউকে অপরাধী বলা যায় না, এটা জানেন না?”
“জানবো না কেন? কিন্তু মে*রে ফেললে প্রমান পাবো কোথায়? একমাত্র প্রমান হিসেবে যে বেঁচে আছে সে আপনার ভাবি তুলতুল। তাকে জিজ্ঞেস করুন সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
“জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন উত্তর পাইনি। আপনি অযথা মিথ্যে অভিযোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে রাজনীতি করা মানেই মিথ্যে অভিযোগ, বদনামি তারপর দিনশেষে জেলে পঁচে ম*রা। আর কোন পরিবার যদি আমাদের মতো তিনপুরুষ ধরে রাজনীতি করা হয় তাহলে তাদের তো শত্রুর অভাব হবে না।”
শুভ্রার কথা শুনে রণ হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেলোনা। সে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো-“আমার কি দায় পড়েছে মিথ্যে বলার? আচ্ছা আপনি বলুন, আপনার ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি কেন। আপনার ভাবি তার বাবার বাড়ি যায় না কেন? কিংবা তার বাড়ির কেউ আপনাদের বাড়িতে আসে না কেন? একটাও উত্তর আছে আপনার কাছে? আমার মনেহচ্ছে সব জেনে বুঝে আপনি অবুজপনার নাটক করছেন।”
শুভ্রা নিশ্চুপ। রণ যেয়ে সোফায় বসলো-“আমি আপনাকে তুলেছিলাম তার বিশেষ কারন ছিলো। কিন্তু এটা তো বলতে পারবেন না আমি আপনার বিন্দুমাত্র অসন্মান করেছি। পারবেন বলতে? এই যে বউ হয়ে এসেছেন তবুও কি আপনার সাথে অশোভন আচরণ করেছি কখনো? কিন্তু দেখুন আপনি সবসময় আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে গেছেন। এতোদিনেও আপনার মধ্যে বিন্দুমাত্র বদল আসেনি।”
রণ হতাশ হয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“আমার ক্লান্ত লাগছে শুভ্রা। বাবার কথা শুনে আমার সাথে সহজ হওয়ার অভিনয় করছেন, আমাকেও পাল্টা অভিনয় করতে হচ্ছে। এসব আর ভালো লাগছে না।”
শুভ্রা চমকে উঠলো। অবাক চেয়ে থেকে বললো-“আমার কাছাকাছি আসা আমাকে ছুঁয়ে দেওয়া এসব অভিনয় ছিলো আপনার কাছে!”
রণ উত্তর দিতে পারলোনা সাথে সাথে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো-“এই অভিনয় আর নিতে পারছি না শুভ্রা। আমাকে সারাদিন সিরিয়াস ইস্যু নিয়ে ডিল করতে হয়। বাসায় এসেও সাংসারিক ইস্যু নিয়ে ভাবতে হয়। নাও আই এম ফেডআপ। বাইরের জগতের সাথে যুদ্ধ করা যায় কিন্তু ঘরে কতক্ষণ? দিনশেষে মানুষের একটা আশ্রয় দরকার হয় যার কাছে সে নিশ্চিতে মনের কথা বলতে পারে। শুভ্রা আপনার যদি এখনো আমার উপর রাগ থেকে থাকে তাহলে আমি বলবো সম্পর্ক এখানেই শেষ হোক। বিয়েটা আপনার কাছে হয়তো ক্ষনিকের জেদ হতে পারে কিন্তু আমি বিয়ে নিয়ে এরকম কখনো ভাবিনি। অথচ আমাকেই আপনার মতো করে চলতে হচ্ছে। এখন সত্যিই আর ভালো লাগছে না। আর আপনার জেদ তৈরীর পেছনে যেহেতু আমার হাত আছে তাই আমি আপনাকে সরি বলতে চাই। আমি আমার কাজের জন্য অত্যন্ত লজ্জিত শুভ্রা। এর বেশি আর কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই।”
শুভ্রা খুব ধীর স্থির হয়ে বসলো রণর সামনে-“আপনি কি চান আমি আপনার জীবন থেকে চলে যাই? তাহলে খুশি হবেন আপনি?”
রণ এবার হেসে দিলো-“এবার বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন শুভ্রা। আমার খুশি হওয়া না হওয়ার কথা এখানে হচ্ছে না। কথা হচ্ছে আপনি কি চান। আপনার যদি আমার সাথে জীবন কাটানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে কিছু বিষয়ে স্ট্রং ডিসিশন নিতে হবে আপনাকে। নিজের মা আর বোনদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাই না আমি। বুঝতে পেরেছেন?”
শুভ্রা নত মুখে বসে ছিলো। মাথা উঁচু করে জানতে চাইলো-“কেমন ডিসিশন?”
“দেখুন, আমি চাইলে সিকিউরিটিকে বলে যেতে পারতাম তন্ময়কে যেন ঢুকতে না দেয়। কিন্তু বিষয়টা আমি আপনার উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। আপনি কি সিদ্ধান্ত নেন সেটা দেখতে চাইছিলাম। বলা যায় আপনার জন্য পরীক্ষা ছিলো এটা। এবং বুঝতেই পারছেন পরীক্ষায় আপনি ফেল করেছেন খুব ভালো ভাবে। আপনি প্রতিবারই সুযোগ দিয়েছেন তন্ময়কে।”
রণ থামলো। খানিকটা সময় চুপ করে থাকলো। শুভ্রার আচরণ বুঝতে চাইলো। তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললো-“আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে হলে আপনার পরিবারকে ছাড়তে হবে শুভ্রা। তাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না।”
শুভ্রা চমকে মুখ তুলে তাকায়। ওর চেহারা ফ্যাকাশে, রক্তশুন্য। আতঙ্কিত গলাতে বললো-“এসব কি বলছেন? নিজের পরিবারের সাথে কি সম্পর্ক ত্যাগ করা যায়?”
রণ হাতের উপর চিবুক ঠেকিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। মৃদুস্বরে বলে উঠলো-“যায় কিনা জানি না তবে আপনার যে কোন একটা বেছে নিতেই হবে শুভ্রা। হয় আমার সাথে থাকবেন না হয় সব শেষ করে দিয়ে পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন। আমার সাথে থাকলে আমি আপনার একশোভাগ লয়ালটি দাবি করবো। কোন ভাগ মেনে নেব না। আর না থাকলে তো কোন দাবী করার প্রশ্ন নেই। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন আমি বিনা প্রশ্নে মেনে নেব।”
শুভ্রাকে দ্বিধান্বিত দেখায়। রণ ওর অবস্থা বুঝে ওকে আশ্বস্ত করলো-“দুই একদিন সময় নিন আপনি। ভেবে আমাকে জানান কি করতে চান। চাইলে বাড়িতে যেতে পারেন আমার কোন আপত্তি নেই। শুধু একটা অনুরোধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যেন তাতে অটল থাকেন।”
শুভ্রা নিশ্চুপ বসে রইলো। রণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে গেল।

*****

রাতে শুভ্রার ফোনে ফোন এসেছিল। সালিম সাহেব ফোন করে সোহেলের খবর দিয়েছে। কাল হাসপাতালে একবার শুনেছিল রণর উপর নাকি হামলা হয়েছে। কিন্তু তন্ময়ের ভয়ে কিছু মাথায় ছিলো না শুভ্রার। বাবার ফোন পেয়ে অবাকই হলো। সালিম সাহেব পুরো ঘটনা খুলে বলেনি। উল্টো মেয়ের কাছ থেকে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে। রণ কিছু বলেছে কিনা তা জানতে চেয়েছে। যখন দেখেছে শুভ্রা কিছুই জানে না তখন একদিকে ভীষণ অবাক হয়েছে আরেকদিকে খুশি। অবাক হয়েছে রণ শুভ্রাকে কিছু জানায়নি দেখে। খুশি হয়েছে শুভ্রা যেহেতু জানে না তাই তাকে নিজের মতো করে বুঝ দেওয়া যাবে এটা ভেবে। কাঁদো কাঁদো গলায় নিজের অসহায়তা জাহির করে মেয়েকে বাসায় আসতে বললেন। শুভ্রা জানালো সকাল হলেই সে রওনা দেবে। ভাইকে দেখতে আসবে।

সকালে শুভ্রা যখন তৈরি হচ্ছিল রণ অবাকই হলো। তার অফিস যেতে হবে, আজ নেত্রী মিটিং ডেকেছে। তার উপর কাজের লিষ্ট অনেক লম্বা। পুলিশ ফোর্সের একটা অনুষ্ঠানে আজ সে চিফ গেস্ট। তবুও জানতে চাইলো-“সাতসকালে কোথায় যাচ্ছেন?”
“বাবা ফোন করেছিল। সোহেল ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। কান্নাকাটি করছিল বাবা। তাকে দেখতে যাচ্ছি।”
রাগে রণর চোয়াল শক্ত হলো। সে শুভ্রার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাল-“আপনি জানেন তো সোহেল কি করেছে? কাল ও সরাসরি ব*ন্দুক তাক করেছিল আমার উপর। না না অবাক হবেন না। প্রমান আছে আমার কাছে। আপনি তো আবার প্রমান ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেন না তাই না। ওয়েট।”
রণ নিজের ফোনটা বের করে ভিডিওটা দেখায় শুভ্রাকে। শুভ্রা চুপচাপ দেখলো, বললো-“আমরা যা দেখি সবসময় তা সত্যি হয় না। ও আপনাকে গু*লি করতো কিনা তা বোঝার আগেই পুলিশ ওকে গু*লি করেছে। হতে পারে আপনার পাশে কেউ ছিল যে ওর টার্গেট ছিলো। হতে পারে সে আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছে।”
রণ মোবাইল ছুঁড়ে দিলো বিছানায়-“আর ইউ ম্যাড? চোখের দেখাও বিশ্বাস করছেন না? এখন কি আমার ম*রে প্রমান করতে হবে? ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। রণ অধৈর্য্য হয়ে বললো-“কথা বলছেন না কেন?”
শুভ্রা শান্ত গলায় জবাব দিলো-“আপনি অযথা হাইপার হচ্ছেন। আমি আমার ভাইকে দেখতে যাবো এতে আপনার আপত্তি থাকার কথা না। মানলাম সে আপনার দোষী। আমি তার বোন, অসুস্থ ভাইকে দেখতে যাওয়া আমার কর্তব্য।”
রণ অস্থির পায়চারি করলো ঘরময়। তারপর আবার শুভ্রার সামনে এসে দাঁড়ালো-“আশাকরি ঘুরে এসে সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমি আর অপেক্ষা করতে রাজি না শুভ্রা। আমি জীবনে এগিয়ে যেতে চাই। এভাবে ঝুলে থাকতে রাজি না আর।”
বলেই মোবাইল হাতে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। আজ বাসায় যাওয়া খুব জরুরি তার জন্য। তার জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু কি সিদ্ধান্ত নেবে সে?

★প্রি অর্ডার চলছে আমার প্রথম মৌলিক থ্রিলার ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ এর। স্বল্পমূল্যে বইটি সংগ্রহ করতে প্রি অর্ডার করুন।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here