দর্পহরন #পর্ব-৪০

0
263

#দর্পহরন
#পর্ব-৪০

রণর কাঁধে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে শুভ্রা। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক হতেই আপনাতেই রণর হাত উঠে এলো শুভ্রার মাথায়। ধীরে ধীরে শুভ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রণ। কিছু সময় পার হওয়ার পর শুভ্রার কান্নার শব্দ কমে এলে রণ মোলায়েম কন্ঠে ওকে ডাকলো-“শুভ্রা, কি হয়েছে? কেন কাঁদছেন বলবেন একটু? বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে? আবার যেতে চান?”
শুভ্রা মাথা নাড়লো। রণ ধৈর্য্য না হারিয়ে নরম কন্ঠে বললো-“তবে? কেউ কিছু বলেছে?”
শুভ্রা এবার ছোট্ট করে উত্তর দিলো-“হুমম।”
“কে বলেছে?”
“আন্টি।”
রণ শুভ্রার দু বাহু ধরে সামনে আনলো। শুভ্রা মাথা নিচু করলো সাথে সাথে। রণ কয়েক সেকেন্ড নতমুখী শুভ্রাকে দেখে অবাক গলায় বললো-“মা! মা কি এমন বলেছে বলুন তো?”
শুভ্রা ভাঙা গলায় বললো-“আন্টি আমাকে ভুল বুঝেছে। আমি নাকি আপনাকে মেরে ফেলতে চাই তাই বিয়ে করেছি।”
এ কথা শুনে রণ এবার পেছনে হেলান দিয়ে আয়েস করে বসলো-“ভুল কি বলেছে মা? মারতে তো চান আপনি আমাকে।”
শুভ্রা রেগে গেলো-“অযথাই বাজে বকবেন না। আমি কেন আপনাকে মারতে চাইবো?”
“আপনাকে কিডন্যাপ করেছিলাম বলে। দুই মাস বন্দী থেকে আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আপনি প্রতিশোধ নিতে আমাকে মেরে ফেলতে চান। মা ভুল কিছু তো ভাবেনি।”
শুভ্রার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো-“মানলাম প্রতিশোধ নিতে চেয়েছি তাই বলে মেরে ফেলবো? মেরে ফেললে লাভ কি হবে আমার? বরং আপনি বেঁচে থাকেন তারপর আমি রসিয়ে রসিয়ে অত্যাচার করবো আপনাকে। তাহলেই না মজা?
তাহলে বলুন মেরে ফেলার চিন্তা করবো কেন আমি?”
রণ চোখ গোল করে তাকায়-“রসিয়ে রসিয়ে অত্যাচার করবেন? তা রসালো অত্যাচারটা কেমন হতে পারে একটু বলবেন?”
শুভ্রা অপ্রস্তুত হয়ে রণর দিকে তাকালো। রণর মুখের চোরা হাসিটা অনেক কষ্টে বুঝে আসলো ওর। শুভ্রা ভেতরে ভেতরে রেগে গেলো খুব। এই লোকটা আস্ত একটা বদ। সবসময় চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর তালে থাকে। খারাপ লোক একটা। শুভ্রা গম্ভীর মুখে বিছানা থেকে নেমে যেতে চায়। রণ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো-“কোথায় যাচ্ছেন?”
“আপনার খাবার আনতে। খাননি নিশ্চয়ই?”
“বেশি করে আনবেন খাবার। আজ আপনিও সারাদিন খাননি বুঝতে পারছি। আমার ভাগেরটা খেয়ে পোষাবে না আপনার। আর হ্যা, যাওয়ার আগে শাড়ীটা ঠিক করে নিন। এমন আলুথালু বেশে বাইরে গেলে কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে বলুন তো?”
রণর ঠোঁটের কোনে দুষ্ট হাসি। শুভ্রা এবার ঝটপট নিজের শরীরের দিকে তাকালো। ভীষণ লজ্জায় নুইয়ে গেলো সে। বুকের উপর থেকে আঁচল সরে গেছে। তা কোনরকমে লুটোপুটি খাচ্ছে কাঁধের উপর। শুভ্রা একবার রণকে দেখলো। সে ঠোঁটের দুষ্টু হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শুভ্রা দ্রুত হাতে বুকের উপর আঁচল টেনে নিলো। তার গাল লাল হয়ে গেছে এরই মধ্যে। মাথাটা লজ্জায় নুইয়ে পড়ে আছে। তার এমন অবস্থা দেখে রণ দারুণ মজা পাচ্ছে, তা বুঝতে পেরেই শুভ্রা অতিদ্রুত ঘর ছেড়ে পালায়।

*****

“আচ্ছা, আন্টি যদি আমাকে ছেড়ে দিতে বলে তাহলে ছেড়ে দেবেন?”
রণর খাওয়া থেমে যায়। শুভ্রার কথা বুঝতে চোখ কুঁচকে তাকায়-“কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।”
শুভ্রা ইতস্তত করলো-“মানে আন্টির কথায় যেমন আমাকে বিয়ে করেছিলেন তেমনভাবেই যদি আন্টি আমাকে ডিভোর্স দিতে বলে দিয়ে দেবেন?”
এবার একটু স্বস্তি পেলো রণ। সে রহস্য করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“আপনার কি মনেহয়? কি করা উচিত হবে আমার?”
শুভ্রা ঠোঁট উল্টো বলে-“তার আমি কি জানি? মা ভক্ত ছেলে আপনি মায়ের কথাই নিশ্চিয়ই শুনবেন?”
রণ মুচকি হাসলো-“তাই কি করা উচিত না? মায়ের কথা শুনেছিলাম বলেই তো আজ আপনার সাথে বসে খাবার খাচ্ছি। এটা কি খুব খারাপ হয়েছে?”
শুভ্রা জবাব দিতে পারলোনা। তবে মনের ভেতরটা টলমল করছে। তাহলে কি মায়ের কথায় রণ ওকে ছেড়ে দেবে? রণ খেতে খেতে বললো-“গতদিন যেটা হয়েছে তাতে মা ভয় পেয়েছে। আর ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। এখন সেই ভয় থেকে সে যদি আপনাকে কিছু বলে তাহলে মনখারাপ করবেন না। আপনি বরং মায়ের মন জয় করার চেষ্টা করুন। তাকে বোঝান সে যা ভাবছে তা ভুল। তাহলেই তো সব প্রবলেম সলভ হয়ে যায়।”
শুভ্রা দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলো-“কিন্তু কিভাবে বুঝাবো আন্টিকে?”
রণ হেসে দিলো-“এটাও আমাকে বলে দিতে হবে?”
শুভ্রা নিরীহ মুখ করে বললো-“তো আমি কিভাবে জানবো? আগে কি বিয়ে করেছি নাকি?”
রণ চোখ বড় করে তাকায়-“আমার বুঝি এটা দ্বিতীয় বিয়ে?”
শুভ্রা গাল ফোলায়-“শাশুড়ীকে কিভাবে পটাব সেটা শাশুড়ীর ছেলেই বলে দেবে।”
রণ অবাক হয়ে তাকায়-“তাই? তা বুদ্ধি দাতার জন্য কি বরাদ্দ থাকবে?”
“আপনি খুব খারাপ জানেন এটা? সবকিছুতে বিনিময় খোঁজেন। কেন নিঃস্বার্থ ভাবে কাউকে সাহায্য করা যায় না? পূণ্যের কাজে বিনিময় খুঁজতে নেই জানেন না?”
শুভ্রার অভিমানি কথা শুনে রণ হা করে কিছুক্ষণ শুভ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হো হো করে হাসলো-“কথা তো ভালোই জানেন দেখছি। আর আমি কিনা এতোদিন ভেবেছি আপনি কম বোঝা মানুষ।”
শুভ্রা মন খারাপ করে বললো-“আমি যেমন আন্টিকে খুব ঠান্ডা মানুষ হিসেবে জানতাম। এখন দেখছি সে পুরাই আগ্নেয়গিরি।”
রণর মুখের হাসি মুছে গেলো-“মা কিন্তু ঠান্ডা মানুষই। তাকে কোনভাবেই ভুল বুঝবেন না। আমারও তাকে নিয়ে কিছু শুনতে মোটেও ভালো লাগবে না।”
শুভ্রা নিভু নিভু গলায় বললো-“ভুল আমারই। সব দিক দিয়ে আমিই দোষী।”
“আমি উঠছি। কাল আবার একটু ফরিদপুর যাব।”
রণ উঠে দাঁড়াতেই শুভ্রা ডাকলো-“শুনুন, আমি কি কিছু করতে পারি? মানে বাড়িতে বসে থাকা খুব বোরিং লাগছে।”
রণ ভাবলো কিছু সময় তারপর জবাব দিলো-“আমার আপত্তি নেই তবে মাকে একবার জিজ্ঞেস করে নেবেন।”
বলেই আর দাঁড়ালো না। শুভ্রা খাবার প্লেট গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলো।

*****

দেরি করে ঘুম ভেঙেছে শুভ্রার। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে বসেছে তখনই জলি এসে দাঁড়ায়-“বউ হয়ে এসেছ কম দিন তো হয়নি। আর কতদিন এরকম নতুন বউ সেজে থাকবে? তুমি কি এখানে অতিথি? দেরি করে উঠবে, ইচ্ছেমতো সময়ে নাস্তা খাবে। সংসারে কোথায় কি হচ্ছে কোন খবর রাখবে না। এভাবে কি সংসার করা যায়? মন কি এখনো বাপের বাড়ি রেখে এসেছ? শোন মেয়ে, সংসার করার ইচ্ছে থাকলে মন দিয়ে সংসার করো। না হলে বিদায় নাও আমাদের জীবন থেকে। এমনিতেও বাপ ভাইয়ের আগে আর কিছু চোখে পড়ে না তোমার।”
শুভ্রার কান্না পেলেও চুপ করে রইলো। জলি থামার পর আস্তে করে জানতে চাইলো-“আন্টি, আপনি কেন আমার সাথে এমন করছেন আমি জানি না। তবে ভাইয়া ওনার উপর হামলা চালাবে এটা সত্যি আমি জানতাম না। আপনি শুধু শুধু আমাকে ভুল বুঝছেন। আর সংসারের কাজ নিয়ে আমার জ্ঞান কম তাই যদি বলে দিতেন কি করতে হবে আমাকে। আমি তাই করার চেষ্টা করবো। বাবার বাড়ি নিয়ে ভয় পাবেন না। আজকের পর আর বাবার বাড়ি যাবো না। কারো সাথে নিজ থেকে যোগাযোগ রাখবো না।”
এসব কথা শুনেও জলি নরম হলো না। কড়া গলায় বললো-“কাল থেকে সকালে উঠবে। বাবাই যেন না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় না। রান্না কি হবে, বাজার আছে কিনা, মেহমান এলে কি খাবে, কোথায় থাকবে, কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সেসব দেখবে। না বুঝলে আমায় জিজ্ঞেস করে নেবে।”
জলির কথা শুনে বারকয়েক ঢোক গিললো শুভ্রা। কেথায় ভাবছিল চাকরি বাকরি করবে। এখন দেখছে তাকে ঘরকন্নার কাজ দেওয়া হচ্ছে যা করার কথা কখনো মাথায় আসেনি। সারাজীবন বাড়ি থেকে একা একা দূর দেশে থেকেছে। বাড়িতে বেড়াতে এলেও কাজ করার লোক ছিলো বলে কখনো কাজ করতে হয়নি। আর এখন কিনা তাকেই এতোসব কাজ করতে হবে? এতো এতো কাজের ফিরিস্তি শুনেই কেমন যেন লাগছে। মনেহচ্ছে এরচেয়ে কঠিন কাজ একটাও নেই। জলি তীক্ষ্ণ নজরে শুভ্রাকে মাপছিল-“শোন, তিনদিন পরে তোমার শশুরের মৃত্যুবার্ষিকি আছে। তেমন কিছু করি না। কেবল এতিম বাচ্চাদের জন্য কাপড় কিনে দেই আর নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াই। এবার তো আমার শরীর ঠিক নেই। কাজেই কাপড় কেনা আর রান্নার ভার তোমার নিতে হবে। হাতে তিনদিন আছে, মন দিয়ে রান্নাটা শিখে নাও। দেখি কেমন পারো। সালিম সাহেব ছেলেমেয়েকে খালি গুন্ডামী শিখিয়েছেন নাকি কাজও শিখিয়েছেন সেটাও দেখা হয়ে যাবে এই ফাঁকে।”
বাবার কথা শুনেই বুঝিবা শুভ্রার মন শক্ত হলো। সে মাথা দুলিয়ে বললো-“পারবো আন্টি। আমি ঠিক পারবো। আপনি ভাববেন না।”
জলি হেলাভরে জবাব দিলো-“পারলেই ভালো। না হলে বাবাইয়ের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে। ছেলে আমার জন্য কেন ভুগবে, তাই না বলো?”
শুভ্রা কিছু না বলে চুপচাপ নাস্তা নিলো প্লেটে। যদিও খেতে ইচ্ছে করছে না তবুও সব ঠিক আছে জলিকে এটা দেখাতেই যেন জোর করে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করলো।

★আমার দু’টো বইয়ের প্রি অর্ডার চলছে রকমারি সহ অন্যান্য বুকশপে। লিংক কমেন্টে দিলাম। আমার লেখা ভালো লাগলে অর্ডার করুন বই দু’টো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here