দর্পহরন #পর্ব-৪১

0
275

#দর্পহরন
#পর্ব-৪১

গত তিনদিনে শুভ্রা যত চেষ্টাই করেছে সব মোটামুটি ফেল গেছে। কোনভাবেই জলিকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। আজ রীতিমতো বুক কাঁপছে তার। সকাল থেকে রান্নার প্রিপারেশন নিয়ে ভয়ে ভয়ে গরুর মাংস, মুরগী আর পোলাও রান্না করে গোসলে গেছে। রান্নার স্বাদ কেমন হয়েছে বুঝতে পারছে না। নিজের কাছে মোটামুটি লেগেছে এখন এই রান্না বাচ্চাগুলো তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারলেই শুভ্রা খুশি।

এ বাড়িতে আজ খুব ভীড়। রণর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী বলে কাছের আত্মীয়, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ভীড় করেছে। তাদের জন্য স্পেশাল রান্না হচ্ছে যা বাবুর্চী করছে। জলির মা, দুই বোন, ভাইয়েরা, তাদের বউ বাচ্চা সবাই এসেছে। হাসিখুশি কাজিনদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। রণও আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। শুভ্রা তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে গেলো। সালোয়ার কামিজ পরে মাথায় ঘোমটা টেনে দোতলায় এলো।

এতিম বাচ্চাগুলো চলে এসেছে। মোট বারোজন বাচ্চা। তাদের নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ানোর আদেশ দিয়েছে জলি। শুভ্রা প্রতিটা প্লেটে যত্নের সাথে খাবার তুলে দিলো। বাচ্চাগুলোর কাছে বসে থেকে খাবার খাওয়ালো। বারবার জানতে চাইলো, খাবার কেমন হয়েছে। ছোট ছোট ফুলের মতো বাচ্চারা মিষ্টি হেসে খেতে লাগলো। বড় ভালো লাগে শুভ্রার। এরকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম শুভ্রার। মনটা অজানা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে তার। খাবার খাইয়ে বাচ্চাদের হাতে কিছু নতুন কাপড়, খাতা, কলমের প্যাকেট তুলে দিলে ওরা ভীষণ খুশি হয়ে গেলো।

জলি বসে চোখের পানি ফেলছে আর রণ মায়ের সামনে বসে আছে। তারও মনটা আর্দ্র হয়ে আছে। তবে মায়ের সামনে সে সহজে চোখের পানি ফেলে না। সেলিনা মেয়ের কাছে বসে আছে। জলি মায়ের দিকে তাকালো-“তেরো বছর হইলো মা। তেরো বছর ধরে লোকটা নিখোঁজ থেকে গেলো। কি জ্বালা ধরে মনে কেমনে বুঝাই।”
সেলিনা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে উঠলো। রণর চোখ ছলছল। চোখের জল লুকাতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। জলি চাপা গলায় বললো-“লাশ পাইলেও মনকে স্বান্তনা দিতে পারতাম। তার তো কোন কবর নাই। দোয়া করি কেমনে? জানতেও পারলাম না মানুষটা বেঁচে আছে না মারা গেছে। মারা গেলে কেমনে মারা গেছে।”
সেলিনা ভেজা গলায় বললো-“আর তুই জামাই এর অপহরণকারীর মেয়েকে ঘরে তুলে আনছিস। কেন এই কাম করছিস জলি? ওই মেয়েকে দেখলেই রাগ উঠে আমার।”
জলি চোখ মুছলো-“বাবাইকে বাঁচাতে। স্বামী নাই, ছেলেকে হারাইলে কেমন করে বাঁচবো মা? ওই শয়তানটাকে চিনি তো। সুযোগ খুঁজে বাবাইকে মারার চেষ্টা করতো। ভাবছিলাম নিজের মেয়েকে নিশ্চয়ই বিধবা করতে চাবে না। কিন্তু দেখলাম মেয়ে বোন কারো কেয়ার করে না এরা এমনই জালিমের বংশ। এখন ঠিক করছি, ওই মেয়েকে বিদায় করে দিব। আর ভয় পাবো না। বাবাইকে ভালো কোন মেয়ে দেখে বিয়ে দিব।”
রণ আঁতকে উঠলো-“মা! কি বলো এইসব? বিয়ে কি ছেলেখেলা? আজকে একে তো কালকে তাকে? দয়া করে এমন কিছু করবা না তুমি।”
জলি খেপে গেলো-“আমার উপর দিয়ে কথা বলবি না বাবাই। ওকে আমিই তো বিয়ে করতে বলেছিলাম এখন আমিই বলছি ওকে ছেড়ে দিতে। একেতো মেয়েটা এই সংসারের উপযুক্ত না তারউপর ওর বাপ ভাই। ওই লোককে কিছুতেই মাফ করবোনা আমি। ওই বদমাশ লোককে এভাবেই শায়েস্তা করতে হবে। ওর মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে।”
রণ খেপে গেলো-“মা, পাগল হয়ে গেছ তুমি? কিসব বলছো? আমি তো বিয়ে করতে চাইনি তুমি জোর করেছিলে। এখন এসব পাগলামির মানে কি? নানু প্লিজ মাকে বোঝাও।”
জলিও পাল্টা রাগ দেখায়-“এতো তাড়াতাড়ি বাবাকে ভুলে গেছিস বাবাই? কিভাবে পারলি?”
রণ অবাক হয়ে গেলো-“এসব কথার সাথে বাবাকে ভুলে যাওয়া না যাওয়ার সম্পর্ক কি মা?”
“সম্পর্ক নেই বলতে চাইছিস? তোর বাবাকে তুলে নেওয়া ওই খুনীর মেয়ের জন্য এতো মায়া কেন তোর? এতো তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলি?”
রণ চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলে নেয়-“কিসব বলছো মা? তোমার মাথা দেখি সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। একটা সত্যি কথা হলো ওই মেয়েটার কোন দোষ নেই। ওর একমাত্র দোষ হলো ও সালিম সাহেবের কন্যা। তুমি জোর করেছিলে বলে ও এ বাড়িতে এসেছে। তাই বলে ভেবনা এখন তোমার কথা শুনে ওর সাথে কোন অন্যায় করবো আমি। আমার এখন ক্ষমতা আছে। যার সাজা তাকে দেবার চেষ্টা করবো।”
জলি ফুঁসে উঠলো-“ওই মেয়েকে আর কিছুতেই মেনে নেব না। তোকে মেরে ফেলতে চাইছিল ওরা।
তুই তোর মায়ের বিপক্ষে যেতে চাইলে যেতে পারিস কিন্তু মনে রাখিস ওই মেয়ের জন্য আমার মন থেকে কোন দোয়া আসবে না। বাকী তোর ইচ্ছে।”
রণ মরিয়া হয়ে বললো-“আমি ওকে তোমার মনের মতো বানাতে চাইছি মা আর তুমি অন্য কিছু চাইছো। গতবারও তোমার চাওয়া ভুল ছিলো এবারও তাই। পার্থক্য হলো গতবার নিজের মনের বিরুদ্ধে যেয়ে কাজ করছি এবার তোমার বিরুদ্ধে যেয়ে। ক্ষমা কর মা।”
“ক্ষমা! কখনোই না। তুই ওই মেয়ের জন্য নিজের মাকে অপমান করছিস! তুই কি আমারই বাবাই?”
জলির কন্ঠে স্পষ্ট খেদ। রণ উঠে দাঁড়ায়। জলি আরও কিছু বলতো কিন্তু সেলিনা তাকে থামিয়ে দিলো। রণ ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরই মেয়ের উপর হামলে পড়লো-“তোর মাথা খারাপ জলি? ছেলের সাথে এইভাবে কথা বলে? ঠিকই তো বলেছে রণ, বিয়ে করতে চায়নি ও। তুই বাধ্য করেছিলি। এখন বউয়ের সাথে খাতির হয়েছে কেন ছাড়বে বউকে?”
জলির চোখ দুটো জ্বলে উঠলো-“খাতির হয়েছে খাতির ছুটিয়ে দেব। ওই সালিম আর ওর মেয়েকে আমার পায়ে পড়াব। ওর মেয়েকে রণর জীবন থেকে বিদায় করে ছাড়বো। দেখো তুমি।”
সেলিনা মেয়েকে ঠান্ডা করতে চাইলো-“যা করবি আওয়াজ না করে করবি। কেউ যেন বুঝতে না পারে তুই কিছু করেছিস। বুঝতে পেরেছিস?”
মায়ের কথা কিছু বুঝলো কিছু বুঝলো না জলি। তার মনটা টগবগিয়ে ফুটছে কেবল। ওই শয়তানের মেয়ের জন্য তার সাথে তর্ক করলো রণ যা আগে কোনদিন করেনি।

*****

কিছুক্ষণ আগে জলির কামড়ার সামনে গেছিল শুভ্রা। বাচ্চাগুলো খেয়ে খুশি মনে বিদায় নিয়েছে সে কথা জ্বানাতেই গেছিল কিন্তু তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে শুনেই পা থেমে গেছিল নিজের অজান্তেই। তারপর পুরো কথোপকথন শুনে আর সাহস হয়নি জলির সামনে দাঁড়ানোর। একই সাথে ভালোলাগা আর খারাপ লাগার অনুভূতি মিলে মিলে একাকার হয়ে গেছে। যে জলির হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছিল সেই জলি তাকে আর পছন্দ করছে না এটা নিয়ে খারাপ লাগলেও রণ তাকে প্রটেক্ট করেছে এটা নিয়ে ভালোলাগায় মন ছেয়ে আছে। কিন্তু সেই সাথে মনে ভয় জেঁকে বসেছে, সত্যি যদি জলির কথা মেনে রণ ওকে ছেড়ে দেয়? জলি যেভাবে কথা বলেছে তাতে এটুকু পরিস্কার জলি ওকে ভীষণ জ্বালাবে। সহজে মেনে নেবে না। তখন কি করবে শুভ্রা? রণকে ছেড়ে চলে যাবে? মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে।

ঘরে ফিরে শুভ্রাকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে রণর ভ্রু কুঁচকে যায়। কাছে দাঁড়িয়ে শুভ্রাকে ডাকলো-“শুভ্রা শুনছেন? শুয়ে আছেন কেন অবেলায়? দুপুরের খাবার খাবেন না? বাচ্চারা খেয়ে চলে গেছে?”
শুভ্রা উঠে বসলো। নিজের মনের হাল রণকে বুঝতে দেবে না এই প্রত্যয়ে মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বললো-“হ্যা, চলে গেছে। আর কেউ না খেলে একা খাওয়া যায়?”
রণ বিস্মিত হতে গিয়েও হেসে দেয়-“সবাই খাচ্ছে। আপনিও খেয়ে নিন।”
শুভ্রা জানতে চাইলো-“আপনি? আপনি খাবেন না?”
রণ কিছুটা মন খারাপ করে বিছানায় বসলো-“খেতে ইচ্ছে করছে না। খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেব ভাবছি।”
“তাহলে তো আমারও খাওয়া উচিত হবে না।”
রণ মুচকি হাসে-“কেন? আপনি খাবেন না কেন?”
শুভ্রা জবাব দিলো-“আমারও খেতে মন চাইছে না।”
রণ ভ্রু কুঁচকে কিছু ভাবলো তারপর বললো-“এককাজ করুন, আপনি নিজ হাতে যা রান্না করেছেন সেগুলো নিয়ে আসুন আমাদের দু’জনার আন্দাজে।”
শুভ্রা খুশি হয়ে বললো-“আমার রান্না খাবেন?”
“হ্যা, কেন? খাওয়া যাবে না নাকি?”
“যাবে না কেন? আমি এখনি আনছি।”
শুভ্রা ছুটে বেড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর দু’হাত ভরে খাবার নিয়ে এলো। টেবিলে সাজিয়ে রণকে ডাকলো-“আসুন, খাবার সাজিয়ে ফেলেছি।”
পোলাওটা একটু নরম নরম। গরুর মাংসে মারাত্মক ঝাল আর মুরগীটা চলনসই। চুপচাপ খাচ্ছিল রণ। শুভ্রা হঠাৎ জানতে চাইলো-“খাবার কেমন হয়েছে?”
“অতোটা ভালো না তবে খাওয়া যাচ্ছে।”
রণ অমন কথায়,সাথে সাথে শুভ্রার মুখের হাসি নিভে গেলো-“হুমম, গরুর মাংসটা মারাত্বক ঝাল। বাচ্চারা কিভাবে খেলো? রান্না করে বুঝতে পারিনি কেন?”
রণ ঝাল শুষতে শুষতে বললো-“ওরা খেতে পেয়েছে তাতেই খুশি। ঝাল মিষ্টি কোন কিছুতে আপত্তি নেই ওদের। শুনুন, আপনি আবার আমার কথা শুনে মন খারাপ করবেন না। সত্যি বলেছি, মিথ্যে প্রবোধ দেওয়ার চাইতে সত্য ভালো।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। নিজে খেতে যেয়ে বুঝলো রণ মিথ্যে বলেনি। প্রচুর ঝাল হয়েছে গরুর মাংসে। শুভ্রার নাক দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। খাবার শেষ করতে পারে না ঝালের কারণে। দ্রুত হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। রণ মুচকি হাসছে আর খাচ্ছে। শুভ্রা ওর প্লেট কেঁড়ে নিলো-“আর খাবেননা প্লিজ। অনেক ঝাল, শরীর খারাপ করবে।”
রণ হেসে দিলো-“ঝাল খেয়ে মুখ জ্বলছে মিষ্টি খেতে দিন তাড়াতাড়ি।”
শুভ্রা ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়-“আমি এখনি আনছি।”
রণ ওর হাত টেনে ধরে ঠোঁটের পানে ইশারা করলো-“আমি ওই মিষ্টি খেতে চাই। তাড়াতাড়ি দিন। লজ্জা লাগলে চোখ বন্ধ করছি আমি।”
রণ সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করলো। শুভ্রা ততক্ষণে লজ্জায় লাল নীল বেগুনি কিন্তু তবুও আজ কেন যেন রণর হাক ফিরিয়ে দিতে মন চায় না। রণর ফর্সা ত্বক ঝাল খেয়ে লাল, ঘামে চিকচিক করছে। শুভ্রা সম্মোহিতের মতো রণকে দেখছে। আচমকা রণর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সম্বৃদ্ধ গালে হাত রেখে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। গালে চুমু পেয়ে চমকে তাকায় রণ। দু’জনার চোখাচোখি হলো, কেউ নজর ফিরিয়ে নিলো না। না বলা কতো কথা বলে ফেললো দু’জন চোখের ইশারাতে। কি হলো কে জানে শুভ্রা হঠাৎ আচমকা ঝাপিয়ে পড়লো রণর উপর। কিছুক্ষণ পর রণ টের পেলো ওর পুরুষালি অধরদ্বয় বেদখল হয়ে গেছে।

★বই প্রি অর্ডার করেছেন তো? না করলে কিন্তু আড়ি নিব। আসন্ন বইমেলা উপলক্ষে আমার দু’টো বই আসছে। একটা পলিটিকাল মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ অন্যটা সমকালীন রোমান্টিক জনরার ‘আমি ডুবতে রাজি আছি’। চমৎকার বইদুটোর প্রি অর্ডার চলছে রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ভালো লাগলো বইদুটো সংগ্রহ করুন। আশাকরছি ভালো পড়ে নিরাশ হবেন না। লিংক কমেন্টে।★

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here