দর্পহরন #পর্ব-৪৪

0
272

#দর্পহরন
#পর্ব-৪৪

সোহেল মারা যাওয়ার পনেরো দিন পরে আবারও সালিম সাহেবের ফোন এলো শুভ্রার ফোনে। শুভ্রা মনে মনে প্রস্তুত থাকলেও বাবার ফোন দেখে ঘাবড়ে গেলো। প্রতিবার ফোন করলেই কেটে দেয় তবে এবার ফোন ধরবে ভাবলো। প্রথমবারে ফোন বেজে কেটে গেলো। দ্বিতীয় বারে সাহস করে ফোন ধরলো-“হ্যালো আব্বা। কেমন আছেন?”
সালিম সাহেবের গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো-“আম্মাজান, আপনে একবারও আব্বাকে দেখতে আসলেন না। কেমন আচরণ হইলো এইটা? আর সোহেল আপনের ভাই আছিল। তারে শেষ দেখা দেখলেন না? আপনে তো এমন আছিলেন না আম্মাজান। কি হইছে আপনের?”
শুভ্রা চুপচাপ বাবার কথা শুনলো। ফিরতি জবাব দিলো শান্ত গলায়-“উনি চাননা আমি আর বাসায় যাই। উনার মা খুব রেগে আছে আপনাদের উপর। গেলে একেবারে যাইতে হবে আব্বা। আর সেইটা আমাদের কারো জন্যই ভালো হবে না আব্বা। তাই আমি ওনার কথা মেনে নিছি।”
সালিম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর চাপা গলায় বললো-“বেশি সমস্যা মনে হইলে চইলা আসেন আম্মা। আমার সমস্যা আমি সামাল দিতে পারুম।”
শুভ্রা বুঝ দিলো বাবাকে-“সবসময় মাথা গরম করে হয় না আব্বা। আমার চিন্তা আপাতত বাদ দেন। আপনে ব্যবসা আর রাজনীতিতে মন দেন। আপনের হারানো গৌরব ফেরত আনার চেষ্টা করেন।”
“আপনে কি আমার জন্য কোন কম্প্রোমাইজ করতেছেন আম্মাজান?”
সালিম সাহেবের গলা কেঁপে উঠলো। শুভ্রা ফোনের এ প্রান্তে ঠোঁট টিপে ধরলো। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-“ভালো থাকেন আব্বা। আমাকে নিয়ে ভাববেন না আমি ভালো আছি।”
ফোন কেটে দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢাকলো শুভ্রা। জেদ করে বিয়ে করে সেটা এখন মানসম্মানের প্রশ্ন হয়ে গেছে। দিনগুলো খুব কঠিন কাটছে শুভ্রার। জলির ব্যবহার খুব কঠিন তার জন্য। রণর সামনে ভালো ব্যবহার করলেও বাকি সময় খুব খারাপ আচরণ করছে। রণ আজকাল এতো ব্যস্ত থাকে যে কোন কথা বলারই সু্যোগ পাওয়া যায় না। ইদানীং পত্রিকায় চন্দ্রবীর সাথে রণর ছবি দেখা যাচ্ছে ঘনঘন। সেটাও শুভ্রার আরেকটা মনোকষ্টের কারণ। সব মিলিয়ে ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে শুভ্রা। মন খারাপ করে নিজেকে ঘরবন্দী করে শুভ্রা।

রণ আজ সন্ধ্যাতেই বাড়ি ফিরলো। শুভ্রাকে দেখে কি বুঝলো সেই জানে। কথা না বাড়িয়ে মায়ের ঘরে গেলো। শুভ্রা ততক্ষণে খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে। যখন ঘরে এলো তখন রণ শাওয়ার নিয়ে ফুরফুরে মনে সোফায় বসছে। শুভ্রা হালকা নাস্তা এগিয়ে দিলো-“মায়ের সাথে রাতের খাবার খাবেন তো?”
রণ কিছুটা অবাক হয়ে বললো-“হ্যা। আগে বাসায় ফিরেছি সবাই একসাথেই তো খাবো। কেন? কি হয়েছে?”
“কিছুনা। এমনিতেই জানতে চাইলাম।”
শুভ্রার কাটখোট্টা উত্তর হয়তো রণর পছন্দ হয়নি। সে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো-“শুনুন, আগামী পরশু তিনদিনের সফরে আমেরিকা যাব প্রধানমন্ত্রীর সাথে।”
“চন্দ্রানী যাচ্ছে?”
শুভ্রার মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো আচমকাই। রণ চমকে মাথা দুলায়-“হ্যা,ও তো যাবেই। কিন্তু আপনি হঠাৎ কথা কেন জানতে চাইলেন?”
শুভ্রা আমতাআমতা করলো-“কিছু মনে না করলে আমি যেতে চাই আপনার সাথে। ভার্সিটিতে আমার টুকটাক কাজ আছে সেগুলো সেরে নেব এই সুযোগে।”
“কিন্তু এবারের ট্যুর তো একদম লিমিটেড মানুষের জন্য। বউ বা জামাই নেওয়ার অনুমতি নেই। খুব কনফিডেন্সিয়াল ট্যুর এটা।”
“কিন্তু আমার তো যেতেই হবে আজ না হয় কাল। আপনি যাচ্ছেন এটা একটা সুযোগ বলা যায়। একা যাওয়ার চাইতে আপনার সাথে যাওয়া বেটার না?”
রণ চিন্তায় পড়লো। কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবলো। তারপর বললো-“তাহলে এক কাজ করুন। আপনি একা চলে যান। আমি ওখানে আপনার সাথে মিট করবো। রাজীবকে বলছি আপনার এয়ার টিকেট কেটে দেবে। হোটেলও ঠিক করে রাখবে।”
শুভ্রা রাজি হয়ে গেলো। রণকে কেন যেন এবার একা ছাড়তে মন সায় দিচ্ছে না। নিজের আচরণে অবাক শুভ্রা হুট করে আবিস্কার করলো ও চন্দ্রানীকে হিংসে করছে। রণর পাশে মেয়েটাকে দেখলেই খুব হীনমন্যতা অনুভব করছে।

*****

তুলতুল এখন দিনরাত নজরবন্দী থাকছে। এমনকি বাথরুমে গেলেও তার দরজা লাগানোর অনুমতি নেই। দরজা চাপানো রেখে তার বাথরুমের যাবতীয় কাজ সারতে হচ্ছে। যার ফলে গোসল আর বাথরুম করে শান্তি পাচ্ছে না তুলতুল। বারবার মনেহয় এই বুঝি কেউ ঢুকে গেলো বাথরুমে। মানসিক চাপে জীবন ওষ্ঠাগত।
সারাক্ষণ তার সাথে মালা নামক এক জাঁদলের মহিলা থাকে। মালার স্বাস্থ্য আর উচ্চতা মাশাল্লাহ, প্রথম দেখায় যে কেউ চমকে যাবে। চেহারার অবশ্য বেশ সুন্দর। তবে গলাটা সেই বাজখাঁই। মালা মুখ খুললেই ভয়ে তুলতুলের বাথরুম চেপে যায়। এখন এই মহিলাকে সবসময় নিজের আশেপাশে দেখে কেমন যেন লাগে তুলতুলের। সে বেশ ভালোমতোই বুঝে গেছে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত এরকমই চলবে।

সালিম সাহেব ভেবেছে তুলতুল বাচ্চার ক্ষতি করবে। তাই প্রটেকশন হিসেবে তুলতুলের সাথে মালাকে জুড়ে দিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে ডাক্তার এসে দেখে যায় তুলতুলকে। শুধু আল্ট্রা করার প্রয়োজন হলে তুলতুলকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাও বলে দেওয়াই থাকে। যায় আল্ট্রাসনো করে চলে আসে। না কারো সাথে কথা বলতে দেয় না একনজর বাইরে দেখতে দেয়। এরকম বন্দী থাকতে থাকতে তুলতুলের ইদানীং নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা খুব মনে আসে। আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে হয়তো এতোদিনে নিজেকে শেষ করে দিত।

নিজের পেটের দিকে তাকালো তুলতুল। একটু ফোলা ফোলা লাগে কি? মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তুলতুলের। হা*রা*মিটা যেতে যেতেও তাকে আঁটকে রেখে গেলো এই বাড়িতে। তীব্র বিতৃষ্ণায় পেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তুলতুল। বাচ্চাটা নিশ্চয়ই ওর বাবার মতো হবে? মা হিসেবে তাকে কোন সন্মান দেবে না যেমন সোহেল তাকে বউ হিসেবে কখনো সন্মান দেয়নি। মেজাজটা বিচ্ছিরি রকমের তেতো হয়ে গেলো। রুমের মধ্যে দম আঁটকে আসছে তার। সে বিছানা ছেড়ে উঠতেই মালা তার বাজখাঁই গলায় চেচিয়ে উঠলো-“কই যান?”
তুলতুল কানে হাত চেপে রাগান্বিত হয়ে মালার দিকে তাকালো-“এতো চেচিয়ে কথা বলো কেন? মানা করেছি না?”
মালা তুলতুলের বারন পাত্তা দিলো না। সে একই সুরে দ্বিতীয় বার জানতে চাইলো-“কই যান?”
“ছাদে। ঘরে দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে শ্বাস আঁটকে আসছে।”
“আপনের না সিঁড়ি ভাঙা নিষেধ। যাওয়া যাইবো না।”
তুলতুল এবার সত্যি সত্যি রাগ হলো-“দোতলার ছাঁদে যাব। সিঁড়ি ভাঙা হয় কিভাবে? তুমি অযাচিত মাতব্বরি করবে না মালা। না হলে চড় খাবে।”
বলেই দরজার সামনে এলো। মালা লাফ দিয়ে ওর সামনে পড়লো-“যাইতে পারবেন না কইছি তে পারবেন না। কিছু হইলে পরে আমার দোষ হইবো।”
মালার স্পর্ধা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো তুলতুল। অপমানে ওর শরীর কাঁপতে শুরু করলো। সে চেচিয়ে উঠলো-“সরো আমার সামনে থেকে বেয়াদব মেয়ে। ছাঁদে আমি যাবই যাব। দেখি তুমি কিভাবে ঠেকাও।”
মালা অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো-“চেচাইয়েন না ভাবি। শরীর খারাপ হইবো আপনের।”
“চুপ বদমাশ। তোর কাছে শুনতে হবে আমি কি করবো কি করবো না? সর আমার সামনে থেকে।”
তুলতুল রাগে দিগবিদিক শুন্য হয়ে চেচিয়ে যাচ্ছে। মালা এবার ভয় পেয়ে গেলো-“আল্লাহ দোহাই লাগে ভাবিজান, চেচাইয়েন না। আপনের পায়ে পড়ি। শরীর খারাপ হইবো আপনের। শরীর খারাপ হইলে আমি বিপদে পড়ুম।”
শরীফ ডাইনিং এ এসেছিল পানি খেতে। তুলতুলের চেচামেচি শুনে এগিয়ে এলো। দরজায় আওয়াজ দিলো-“মালা, কি হয়েছে?”
মালা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। দ্রুত হাতে দরজা খুলে দিলো-“ভাইজান, ভাবি ছাঁদে যাইতে চায়। তার সিঁড়ি ভাঙা নিষেধ। আমি মানা করছি তাই চিল্লাইতাছে।”
তুলতুল মালার উপর হামলে পড়লো-“এই তুই মানা করার কে? চাকরানী তুই, তোর কথা শুনবো কেন? বল কেন শুনবো?”
তুলতুলের ব্যবহারে হতচকিত শরীফ। তুলতুলকে বরাবর শান্ত মেয়ে হিসেবে দেখেছে। এখন এমন অগ্নিরুপ দেখে মাথা ঘুরছে। শরীফ কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-“মালা, তুই যা।”
মালা যেন সুযোগ পেয়ে দৌড়ে পালালো। শরীফ তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বললো-“প্লিজ তুমি শান্ত হও। ছাঁদে যাবে তো? চলো। তবুও এরকম চেচাবে না। তোমার শরীর খারাপ হবে।”
শরীফের মুখের উপর কিছু বলতে পারলো না তুলতুল। তবে মনে মনে গজগজ করলো। ছুটে যাচ্ছিলো ছাঁদে শরীফ ঠেকালো-“আস্তে হাঁটো। ইচ্ছে করে এরকম করলে কি বাবার হাত থেকে নিস্তার মিলবে? তারচেয়ে নিজের যত্ন করা ভালো না? আস্তে আস্তে এসো।”
তুলতুল গতি থামালো। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে উঠলো। শরীফ ছিলো ওর পেছনে। ছাঁদে দাঁড়াতেই শীতল হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিলো তুলতুলের মেজাজ খানিকটা নরম হলো। মন খারাপ ঘিরে ধরলো তাকে। কিছুক্ষণ আগের চেচামেচির কথা মনে করে সে হুট করে কেঁদে দিলো।

★আসন্ন বইমেলা উপলক্ষে আমার দু’টো বই আসছে। একটা পলিটিকাল মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ অন্যটা সমকালীন রোমান্টিক জনরার ‘আমি ডুবতে রাজি আছি’। চমৎকার বইদুটোর অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ভালো লাগলো বইদুটো সংগ্রহ করুন। আশা করছি বই পড়ে নিরাশ হবেন না।★

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here