#দর্পহরন
#পর্ব-৪৮
শুভ্রার কান্না পেয়ে গেলো। সে হুহু করে কেঁদে দিলো। রণ যেন বোকা বনে গেলো। ছুটে এসে শুভ্রার কাছে বসে ওর হাত ধরে নরম গলায় বললো-“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো শুভ্রা-“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন আমার সাথে? কি করেছি আমি?”
রণ এবার কিছুটা লজ্জিত হলো। আসলেই তো এই মেয়েটার সাথে রুড আচরণ কেন করছে সে? মনে মনে নিজেকে কষে ধমক দিলো। অপরাধী মনে যত্ন নিয়ে শুভ্রার চোখের জল মুছে দিলো-“সরি সরি, প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।”
রণর মুখে সরি শুনে কিছুটা শান্ত হলো শুভ্রা-“আমার কোন ভুল থাকলে বলবেন আমি ভুল শোধরাতে চেষ্টা করবো। কিন্তু এরকম ব্যবহার মেনে নিতে পারবোনা।”
রণ শুভ্রাকে কাছে টানলো। নিজের বুকের কাছটাতে শুভ্রার মাথাটা ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরলো-“সরি বলছি আবারও। আসলে মায়ের কথা শুনে খুব মেজাজ খারাপ হয়েছিল। সেই রাগটা তোমার উপর দেখিয়েছি। কিছু মনে করো না প্লিজ।”
শুভ্রা কিছুক্ষন পোষা বিড়ালের মতো রণর বুকে থাকলো চুপটি করে। তারপর বললো-“আন্টি আমার কথা কি বলেছে আপনাকে?”
রণ চমকে উঠলেও শুভ্রাকে বুঝতে দিলো না। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললো-“তেমন কিছু না। বাদ দাও। ভুল আমারই, নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। যে যাই বলুক তাতে আমার প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত না অথচ দেখিয়ে ফেলছি। সরি এগেইন।”
শুভ্রা আর কথা বাড়ালো না। দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে উঠে বসলো। তার ইদানীং খুব ভয় লাগে। রণকে হারিয়ে ফেলার ভয়। পারিপার্শ্বিকের সবকিছু মিলিয়ে প্রায়ই মনেহচ্ছে রণকে সে হারিয়ে ফেলবে। শরীর কাটা দিলো শুভ্রা। সেটা লুকাতেই দ্রুত উঠে যেতে চাইলো। রণ উদ্বিগ্ন হয়ে শুভ্রার হাত ধরে-“কি হলো? কোথায় যাচ্ছ?”
“আপনার খাবার?”
রণ মাথা নাড়ে-“উহু, লাগবে না। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বসো প্লিজ।”
রণ শুভ্রার হাত ধরে টানলো। নিজের কাছে বসিয়ে দিলো। শুভ্রার দিকে তাকিয়ে স্মাল হাসলো-“তুমি নিশ্চয়ই মায়ের ব্যবহারে খুব অবাক হচ্ছ। ভাবছো যে মানুষটাকে ব্লাকমেল করে তুমি আমাকে বিয়ে করলে সে তোমার প্রতি এতো কঠোর কিভাবে হচ্ছে, তাই না?”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। রণ শ্বাস টানলো-“যখন তোমাকে বিয়ে করানোর জেদ ধরেছিল তখন আমিও ঠিক এমনটাই অবাক হয়েছিলাম।”
শুভ্রা খানিকটা কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো-“কেন?”
রণ কয়েক মুহূর্ত শুভ্রার মুখপানে তাকিয়ে রইলো। কি সুন্দর টলটলে মুখশ্রী। প্রসাধন বিহীন তবুও তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। এই মুহূর্তে একদম নিস্পাপ দেখাচ্ছে। রণর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মন চাইছে অনেকটা সময় ওই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। শুভ্রা তাড়া দিলো-“কি হলো বলুন।”
রণর ধ্যানভঙ্গ হয়। মুখে খানিকটা বিষাদের ছায়া পড়ে-“কথাগুলো তোমাকে বলার ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু মনে হলো ভবিষ্যতের জন্যই বলে ফেলা উচিত। আমার জন্য মেয়ে পছন্দ করতে হলে তুমি যদি পৃথিবীর সর্বশেষ মেয়ে হতে তবুও হয়তো মা তোমাকে পছন্দ করতো না কারণ তুমি ইব্রাহিম সালিমের মেয়ে। সেই মা হুট করে তোমাকে বউ বানাতে মরিয়া হয়ে গেলে আমি তাই ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। মাকে অনেক করে বোঝাতে চেয়েছিলাম সে যা করছে তা ঠিক না।বিয়ে কোন ছেলেখেলা না। চিরশত্রুর মেয়েকে বিয়ে করা যায় না। কিন্তু মা তখন জেদ আঁকড়ে ধরলো। এখন দেখুন আপনাকে সহ্য করতে পারছে না। অবশ্য এক্ষেত্রে মাকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। তোমার পরিবারের হাত আছে ষোল আনা। তারা নিজের আচরণে লাগাম টানতে পারছে না। যার ফলে মায়ের পুরনো রাগ ফিরে আসছে।”
রণর কথা শুনতে শুনতে শুভ্রার মুখের আদল বদলে যাচ্ছে বারবার। শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। রণ থামতেই প্রশ্ন নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো-“আন্টি কেন পছন্দ করে না? আবার কি করেছে আমার পরিবার?”
রণ প্রসঙ্গ বদলে বললে-“তুমি কি জানো খুশির ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে খুশিকে বিরক্ত করছে তন্ময়? বেশ অনেকদিন যাবত এমন চলছে। খুশি ভয়ে বলেনি আমাকে। আজ খুব বাড়াবাড়ি করেছে তন্ময়। মা জানতে পেরে রাগারাগি করছে আমার সাথে। তুমি এ বাড়িতে আছো বলেই নাকি এমন হচ্ছে।”
শুভ্রার বুক ধরফর করে তন্ময়ের কথা শুনে। এতো কিছু কবে করলো তন্ময়? বাবাকে বলার পরও বাবা কেন কিছু করলো না? শাশুড়ীর রাগটা তো তাহলে দোষের নয়। শুভ্রার নিজেকে খুব অসহায় লাগে। রণ হতাশ হয়ে বললো-“আমাকে বলো কি করবো? খুশির যদি সামান্য বিপদও হয় মা তোমার সাথে কি করবে আমি জানি না। আমি জানি তোমার কোন দোষ নেই কিন্তু তোমার পরিবারের এইসব কাজ আর কতোইবা মেনে নেব বলো তো শুভ্রা? আমাকে বলে দাও কি করবো আমি? কোনদিকে যাব?”
রণকে ভীষণ অসহায় দেখালো। অসহায় দেখায় শুভ্রাকেও। ও কি বলবে ভেবে পেলো না। তন্ময় এমন কেন করছে? মেয়ের কি অভাব পড়েছে? কেন খুশির পেছনে পড়ে আছে? রণ বললো-“দেখো শুভ্রা, যেভাবেই হোক বিয়ে করেছি তোমাকে। বউ তুমি আমার। আমি কোনভাবেই চাই না তোমার প্রতি সামান্য অন্যায় করি, অসন্মান করি। কিন্তু সেই সাথে এটাও চাই না আমার মা বোন আমার কারনে সাফারার হোক। তাহলে হয়তো আমার দ্বারাও কোন অন্যায় হয়ে যেতে পারে। তুমি বলো, এখন তন্ময়কে কি করা উচিত আমার? তোমার বোনের সাথে কেউ এমন করলে কি করতে তুমি?”
শুভ্রা মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো। কি বলবে বুঝে পেলো না। এই প্রথম নিজেকে ভীষণ অসহায় আবিস্কার করলো।
*****
রাতে শরীফকে ডেকে পাঠালেন সালিম সাহেব। শরীফ ঘরে ঢুকে বললো-“আমাকে ডাকছেন আব্বা?”
“হ্যা। বসো। তোমার লগে কথা আছে।”
শরীর খানিকটা অবাক হয়েই একবার মা আর একবার বাবার দিকে তাকালো। রিমা ইশারায় শরীফকে বসতে বললো। সালিম সাহেব শোয়া থেকে উঠে বসলো। শরীফের দিকে তাকিয়ে বললো-“সোহেল তো আর দুনিয়ায় নাই। আমার সন্তান বলতে তুমি আর শুভ্রা। আর সোহেল নাই যেহেতু তাই ওর সন্তান আমার সোহেলের জায়গা নিব। বাচ্চাটা জন্মের আগেই বাপ হারা। ওর মা ওকে চায়না হয়তো। সবই বুঝি কিন্তু নিরুপায় আমি। সন্তানের মায়া বড় মায়া। আমি চাইনা আমার সোহেলের বাচ্চা এতিমের মতো বড় হোক। তাই আমি আর তোমার মা একটা সিদ্ধান্ত নিছি। আমাদের মনে হইছে এমনটা হইলে সবদিক রক্ষা হবে।”
শরীফ ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না তার বাবা কি বলতে চাইছে। সালিম সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে মন বুঝতে চাইলো পারলো না। সংকোচ হচ্ছে শরীফকে বলতে। বরাবরই শরীফের সাথে তার দূরত্ব ছিলো। এখন তাই হুট করে ছেলের কাছে বায়না ধরতে দ্বিধা লাগে। রিমা স্বামীর কাজ সহজ করতেই মুখ খুললো-“তুলতুল তোরে মানে শরীফ। ও আমার নাতি মা হইবো কিন্তু ও যোয়ান মাইয়া, ওরে এই বাড়িতে চিরকাল রাখার উপায় নাই। আবার ও না থাকলে আমার নাতি মা হারা হইবো ভাবলেই বুক কাঁপে। ভাইবা দেখলাম সব সমস্যার একটাই উপায়। তুই যদি তুলতুলরে বিয়া করোস তাইলে বাচ্চাটা বাপ মা দুজনকেই পাইবো, তুলতুলও চিরজীবন এই বাড়িতে থাকতে পারবো।”
শরীফ হা করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মায়ের বলা কথাটা মগজে ঠিকঠাক ঢুকতেই অদ্ভুত একটা অনুভবি হলো। সে ফট করে হেসে দিলো-“তোমরা পাগল হইছো আম্মা। ওই মেয়ে কি পরিমান ঘিন্না করে আমাদের তা তুমি জানো না। তোমরা ওকে জোর করে আঁটকায় রাখছো এখন আবার আমার সাথে বিয়া দিতে চাও। এই খবর শুনলে নির্ঘাত গলায় দড়ি দিব। আম্মা, ওরে ছাইড়া দাও। নিজের মতন বাঁচতে দাও। এইসব বিয়া শাদীর চিন্তা বাদ দাও। তাছাড়া বাচ্চা পেটে বিয়া হয় না।”
রিমা খেঁকিয়ে উঠলো-“তুই পাগল হইছোস শরীফ। বাপ মায়ের কাছ থিকা সারাজীবন দূরে দূরে থাইকা তুই স্বার্থপর হইছোস। নাইলে তুই বাপ মায়ের কথা বাদ দিয়া ওই মাইয়া নিয়ে ভবোস কেন? নিজের ভাইয়ের বাচ্চার জন্যও তোর মহব্বত নাই। কেমুন ভাই তুই?”
মায়ের আক্রমনে শরীফ হতবিহ্বল বোধ করে। নিজেকে বাঁচাতে বললো-“এইসব কেমন কথা আম্মা? নিজেদের নিয়ে এতো ভাবতে যাইয়া আপনে অন্যের জীবন নিয়ে খেলতেছেন। এইগুলা ঠিক না আম্মা।”
“আচ্ছা! কি অন্যায় করতেছি ক তুই। বাচ্চা হওয়ার পর ধর তুলতুলরে যাইতে দিলাম। তারপর কি হইবো? ওয় কি হাতিঘোড়া উদ্ধার করবো জীবনে? কেডা বিয়া করবো ওরে? আর বিয়া করলেও জামাই ভালো হইবো সেই গ্যারান্টি কি? আমরা তোর মতন না। তুলতুলকে নিয়ে ভাবছি দেইখাই তোরে কইছি ওরে বিয়া করতে। তোর যদি এতই চিন্তা থাকে তাইলে তুই ওরে বিয়া কইরা ওর শখ পূরণ কর। নাইলে বড় বড় কথা কইস না।”
সালিম সাহেব বিরক্ত হলেন-“আহ রিমা, থামো তো। শোন শরীফ, এতো কথার কাম নাই। তুই আমাকে পরিস্কার কইরা ক তুই কি করবি। তুলতুলের এমনেও এই বাড়িতে থাকতে হইবো সোহেলের বাচ্চার মা হইয়া। আল্লাহর ইচ্ছাও তাই। তা না হইলে ওর পেটে সোহেলের বাচ্চা আইতো না। এখন কথা হইলো, তুই যদি ওরে সন্মান দিয়ে এই বাড়িতে রাখতে চাস তাইলে বিয়া কর নাইলে এমনেই থাক। এতো কথা চালাচালির কাম নাই। ভাইবা দেখ তুই কি করবি।”
শরীফ উঠে এলো। অবাক হলো সালিম সাহেব ওকে জোর করলো না দেখে। মায়ের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে হেঁটে নিজের ঘরে ফিরছিল। হুট করে সামনে তুলতুল এসে দাঁড়ায়-“আমার একটা কাজ করে দিবেন?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শরীফ। সেদিনের পর থেকে তার সাথে বেশ সহজ হয়ে গেছে তুলতুল। অন্য কারো সাথে না হলেও তার বেশ কথাটথা বলে। শরীফ হাসার চেষ্টা করে বললো-“কি কাজ?”
“আমার কিছু বই লাগবে। সময় কাটে না মনে খুব আজেবাজে ভাবনা আসে। তাই বই পড়ে সময় কাটাতে চাই। ভালো ভালো গল্পের বই যেগুলো পড়লে মন ভালো হবে সেগুলো এনে দিন। দেবেন তো?”
তুলতুল উত্তর শোনার জন্য শরীফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শরীফ হাসলো-“আচ্ছা ঠিক আছে। এনে দেব।”
“থ্যাংক ইউ।”
তুলতুল চলে যাচ্ছিলো শরীফ ডাকলো-“তুলতুল, শোনো।”
তুলতুল সাথে সাথে ফিরলো-“জ্বি, বলুন।”
শরীফের লজ্জা লাগলো হঠাৎ। কি মনে করে সে তুলতুলকে ডাকলো? সে সাথে সাথে বললো-“কিছু না। এমনিতেই ডেকেছি।”
বলেই সে হাটা দিয়ে চলে গেলো। তুলতুল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
★অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ উপলক্ষে আমার দু’টো বই এসেছে। একটা পলিটিকাল মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ পাবেন ৩৫৬ নং স্টলে। অন্যটা সমকালীন রোমান্টিক জনরার ‘আমি ডুবতে রাজি আছি’ পাবেন উপকথার ৫৬৪ নং স্টলে। চমৎকার বইদুটো ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপেও। আমার লেখা ভালো লাগলে বইদুটো সংগ্রহ করুন। আশা করছি বই পড়ে নিরাশ হবেন না।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin