তোমায়_পাবো_বলে
পর্ব_৩৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
রাত ৯ টা বাজতেই বাড়িতে হলুদের অনুষ্ঠান জমজমাট। পরশের জোরাজুরিতে বাবাকে ও হলুদ পাঞ্জাবি পড়তে হলো! দুই জামাই, শ্বশুড়ের হাস্যকর কান্ডে বাড়ির সব সদস্যদের পাশাপাশি মেহমান-অতিথিরা ও হাসতে বাধ্য হচ্ছিল। হাসি, খুশি, আনন্দ, অনুষ্ঠানে কেটে গেল হলুদের রাত! কাজিনরা যে যেভাবে পেরেছে নেচেছে। তবে আমি এইবার নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে পারি নি। প্রেগনেন্ট তার উপর পরশের কড়া নির্দেশ!
আজ মিলি আপুর বিয়ে! সকাল হতেই বাড়িতে কান্নার ঢল পড়ে গেল। চাচীমনি যেন কিছুতেই কান্না থামাতে পারছেন না। কিয়ৎক্ষণ পর পর মিলি আপুকে বুকে চেঁপে ধরে বিরামহীন ভাবে কেঁদে চলছেন। লোকমা তুলে অতি আদরে, যত্নে, ভালোবাসায় আপুকে খাইয়ে দিচ্ছেন। চাচা ও খুব বিষন্ন মনে মিলি আপুর আশেপাশে ছটফটিয়ে ঘুড়ছেন। ভাসমান অশ্রুকণা সমেত মিলি আপুকে অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন। মুখ খুলে শুধু বলতে পারছেন না, “যাস না মা। বাবার রাজকন্যা হয়ে থেকে যা!” বাড়িতে কম/বেশি সবার মনই খুব খারাপ। প্রয়োজন বলেই বোধ হয় কাজ করতে হচ্ছে। নয়তো সবাই মিলি আপুকে ঘিরেই বসে থাকত। অশ্রুবিলাসে মেতে থাকত। ঐদিকে পরশ, জিজু, হিমেশ ভাই, বাবা এবং ছোট চাচা মিলে বিয়ের ক্যাটারিং এবং অন্যান্য ভারী কাজ সামলাচ্ছেন। দুপুর বারোটা বাজতেই পার্লারের মেয়েরা আমাদের বাড়ি এসে জড় হলেন। মিলি আপুকে সাজিয়ে দেওয়ার পর পালাক্রমে আমাদের সব বোনদের সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
দুপুর দুটো বাজতেই বরযাত্রী চলে এলো! বাড়ির সবাই বেশ তৎপর হয়ে উঠল বরযাত্রীদের আপ্যায়নে। মিলি আপুর রুমের জানালা দিয়ে বিয়ের প্যান্ডেল এবং স্টেইজ স্পষ্টত! পরশকে অতি সূক্ষ্ম এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিতে পর্যালোচন করতে পারছি আমি। নয়নাভিরাম দৃষ্টি আমার। অতি প্রেমে রঞ্জিত! মানুষটি আজ লাল পাঞ্জাবি পড়েছেন। অনিন্দ্য সুন্দর দেখতে লাগছে মানুষটিকে! চোখ বুজে পুনরায় প্রেমে পড়ার মতোন যথেষ্ট। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে প্রফুল্ল হাসিতে মত্ত লোকটি। পিয়াস ভাইয়ার মাথার পাগড়ী নিয়ে তিনি হাসি, ঠাট্টা, দুষ্টুমিতে মশগুল। ছোট কাজিনরা সব সেজেগুজে স্টেইজে চলে গেছে। পিয়াস ভাইয়ার চারপাশে বসে নানা রকম ঠাট্টা, মশকরা করছে। আমি, পিয়ালী আপু এবং রুম্পা আপু মিলি আপুকে ঘিরে বসে আছি। বউ সাজে মিলি আপুকে দেখতে অনিন্দনীয় লাগছে! একদম তাক লেগে থাকার মতো সুন্দর লাগছে। পিয়াস ভাই হয়তো আজ আপুর থেকে দৃষ্টিই সরাতে পারবেন না। একদম ফিদা হয়ে যাবেন! পিয়াস ভাইকে ও কোনো দিক থেকে কম সুন্দর লাগছে না আজ। বিয়ের খুশিতে যেন ভাইটি আমার গ্লো করছেন! প্রিয় মানুষটিকে বউ হিসেবে পাওয়া মানেই হলো মন থেকে উৎপত্তি হওয়া এক বাঞ্ছনীয় সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। যে সৌন্দর্য পিয়াস ভাইয়ার মুখমন্ডলে ঠিকরে পড়ছে! এর মধ্যেই দরজায় হঠাৎ খটখট শব্দে টোকা পড়ল। চাচার গলার স্বর ভেসে এলো।
“এই রুম্পা? দরজাটা খোল। কাজি সাহেব এসেছেন।”
রুম্পা আপু মৃদ্যু হেসে তড়িঘড়ি করে দরজার খিলটা খুলে দিলেন। অমনি চাচা হাসি মুখে কাজি সাহেব সমেত রুমে প্রবেশ করলেন। মিলি আপুর দিকে আহত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে চাচা মাথা নুঁইয়ে নিলেন! অমনি মিলি আপু ঢুকড়ে কেঁদে উঠলেন। চাচা এই মায়া কান্না সহ্য করতে না পেরে আঁখি যুগলে বেদনা নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন! মা, চাচীমনিরা, ছোট চাচা এসে মিলি আপুকে শান্ত করে মুখ থেকে কবুল কথাটি বের করলেন। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করিয়ে আপুর দিক থেকে বিয়ে সম্পন্ন করলেন। সবার ঠোঁটের কোনে এক দীপ্তিময় তৃপ্তির হাসি লেগে আছে। শুধু মিলি আপু এবং চাচীমনি বাদে!
অপর প্রান্তে পিয়াস ভাই ও তিন কবুল বলে, রেজিষ্ট্রি পেপারে সাইন করে চূড়ান্তভাবে বিয়েটা সম্পন্ন করলেন। এরপর শুরু হলো খাওয়া দাওয়ার পালা। বরযাত্রীকে যথেষ্ট আদর, আপ্যায়ন, সেবাযত্নের মাধ্যমে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ানো হলো। বরযাত্রীদের খাওয়ার পর আমরা বাড়ির সব সদস্যরা এক টেবিলে খেতে বসলাম। বিকেল ঘনিয়ে আসতেই বিদায়ের লগ্ন দরজায় কড়া নাড়ল! এবার মিলি আপুকে এই বাড়ি ছেড়ে সারা জীবনের শ্বশুড় বাড়িতে পা বাড়াতে হবে। কান্নার রোল পড়ে গেল পুরো বাড়িময়। সবার চোখের কোটর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল জলে! ঘনিয়ে এলো যে মিলি আপুর বিদায়ের লগ্ন! বুকে এক প্রকার পাথর চাঁপা দিয়ে চাচা এবং চাচীমনি মিলে পিয়াস ভাইয়ার হাতে মিলি আপুকে সমর্পণ করে দিলেন। বাড়ির সবাইকে শান্তনা দিয়ে পিয়াস ভাই ছুটে চললেন মিলি আপুকে নিয়ে আপুর নতুন বাড়িতে! যে বাড়িই হবে মিলি আপুর শেষ আশ্রয়স্থল!
,
,
রাত ৮টা বাজতেই পরশ হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠলেন ঢাকায় ফিরে যেতে! অফিস থেকে জরুরী কল এসেছে মাত্র। আগামীকাল যেভাবেই হোক সকাল ৯ টার মধ্যে অফিসে প্রেজেন্ট থাকবে হবে। উনার তাড়াহুড়োয় আমরা বাধ্য হলাম কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে। এমনিতেই বাড়িতে সবার মন খারাপ তারপর পরশের নেওয়া এমন হুটহাট সিদ্ধান্তে বাড়ির পরিবেশটা আর ও থমথমে এবং নিরাগ হয়ে উঠেছে। বাবার অমতে গিয়ে পরশ আমাদের সবাইকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন। শ্বশুড় আব্বু এবং শ্বাশুড়ী মা মিলে বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ দিয়ে গেলেন। আগামী শুক্রবার যেন আমার স্ব-পরিবার ঐ বাড়ি উপস্থিত থাকে। বাবা অধিক রাগে বশবর্তী হয়ে আছেন বলে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন না। তবে মা বাধ্য হয়ে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন! নয়তো আমার শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী খুব কষ্ট পেতেন। বাবা-মা করে ভুল বুঝতেন। বাড়ির সবাইকে আর ও একবার কাঁদিয়ে আমি পা বাড়ালাম শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে! বাবার চোখের কোটর জুড়ে এই প্রথম বার অবাধ্য জলেদের অস্তিত্ব দেখেছি আমি! হুহু শব্দে কেঁদে উঠলাম আমি। বাবা ও দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আমায় জড়িয়ে ধরে পরশের প্রতি পোষানো রাগ থেকে বিনা শব্দে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন! পরশ চাঁপা শ্বাস নির্গত করে আমাদের সবাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। বাড়ির গাড়ি দুটো করেই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। ড্রাইভার আমাদের পৌঁছে দিয়েই গাড়ি দুটো করে কুমিল্লায় ফিরে আসবেন!
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১২ টা বাজল! সবাই ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে যে যার রুমে ফিরে গেল। আমি এবং পরশ ও নিজেদের রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম। পাশাপাশি শায়িত হতেই পরশ যখন আমায় ঝাপটে ধরতে যাবে ঠিক তখনি আমি আস্তে করে লোকটিকে উপেক্ষা করে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম! পরশ ভীষন অবাক হলেন! বিস্মিত গলায় আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,
“কি হলো? সরে গেলে কেন?”
অভিমানী গলায় আমি প্রত্যত্তুরে বললাম,,
“কিছু হয় নি। একা একাই শুয়ে পড়ুন!”
পরশ খানিক রূঢ় গলায় বললেন,,
“অফিসে ইম্পর্টেন্ট কাজ ছিল টয়া। তোমার বুঝতে হবে। অযথা রাগ দেখালে তো চলবে না!”
“গতকাল মিলি আপুর রিসিপশান। আর আজ আমি এই বাড়িতে! মানে ঢাকায়! কত মাইল দূরে বুঝতে পারছেন তো? এই পরিস্থিতিতে আমি রাগ করব না তো কি করব? আর একটা দিনের জন্য ঐ বাড়িতে আমায় রেখে আসলে কি হত?”
পরশ নিশ্চুপ! অল্প সময় মৌনতা বজায় রেখে আচম্বিতে পেছন থেকে আমায় ঝাপটে ধরে আহ্লাদি গলায় বললেন,,
“জানি। তোমার মন খারাপ হচ্ছে! কিন্তু আমি ও তো অপারগ টয়া! নতুন জব আমার। কিছুদিন হলো পেয়েছি। এখন থেকেই যদি ঢিলেমি করি জবটা হাত থেকে গেল বলে! তবে কথা দিচ্ছি আমি! পিয়ালী এবং পায়েলের বিয়ের পর কয়েকদিনের জন্য তোমাকে কুমিল্লায় রেখে আসব। কিছুদিন থেকে আসবে। কোনো আপত্তি করব না আমি।”
গলায় সেই একই অভিমানিনী ভাব ফুটিয়ে আমি বললাম,,
“অনেক হয়েছে। আর কৃপা দেখাতে হবে না। তাছাড়া আমার সাত মাস পড়তেই আমি কুমিল্লায় চলে যাব। ওখান থেকেই ডেলিভারি হবে!”
“আমার মতামত ছাড়া তোমার কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হবে না টয়া। সো এই বিষয় নিয়ে আর কোনো বার্কেটিং করবে না!”
“কিসের বার্কেটিং হুম? কিসের বার্কেটিং? নিয়ম এটাই। মেয়েদের প্রথম সন্তান তার বাবার বাড়ি থেকেই হয়। আপনার জন্য কিন্তু এই নিয়মটা পাল্টাবে না!”
“এত হাইপার হচ্ছে কেন? অযথা বিষয়টাকে তুমি টেনে হেছড়ে বড় করছ!”
“বড় আমি নই৷ আপনি করছেন! আপনার সিদ্ধান্তের উপর আমি বসে থাকব না কিন্তু। আমার প্রথম সন্তান ঐ বাড়িতেই হবে। এতে যতই আপনার আপত্তি থাকুক। আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার!”
তৎক্ষনাৎ পরশ হাতের বাঁধনটা ছেড়ে দিলেন। অন্য পাশ ফিরে অনুরক্ত গলায় বললেন,,
“তোমার যা ইচ্ছে তুমি তা করো। আমার কোনো সিদ্ধান্তের উপরই তোমার বসে থাকতে হবে না।”
মুখে হাত চেঁপে কেঁদে উঠলাম আমি। আমি চাই নি লোকটিকে রাগাতে! লোকটির সাথে খারাপ ব্যবহার করতে! তবে কেন জানি না মনটা ভীষণ বিষন্ন হয়ে আছে আমার! মা-বাবা, ভাই বোন, পরিবারের প্রতিটা সদস্যকে দারুন ভাবে মিস করছি। প্রায় এক মাসের মতো থাকা হয়েছে ঐ বাড়িতে! নতুন করে মায়া বোধ জন্ম নিয়েছে সবার প্রতি! বিশেষ করে মিলি আপুর কথা ভীষন ভাবে মনে পড়ছে। আপুর বিয়ের রিসিপশানে থাকতে পারব না আমি! কষ্ট তো আমার হবেই তাই না? ইতোমধ্যেই ক্রিং ক্রিং শব্দে পরশের ফোন বেজে উঠল। রাগ, জেদ থেকে পরশ বোধ হয় ফোনটা তুলছেন না। কেন জানি না মনে হচ্ছে ঐ বাড়ি থেকে কল এসেছে। মা-বাবা হয়তো কল করেছেন। ঠিকঠাক মতো আমরা পৌঁছেছি কিনা জানতে! তাড়াহুড়ো করে আঁখিপল্লবের জলরাশি মুছে আমি পাশ ফিরে পরশের বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতে নিলাম। অমনি স্ক্রীনে আব্বুর ফোন নাম্বারটি ভেসে উঠল৷ অপেক্ষার যেন অবসান ঘটল আমার! ঠোঁটের কোনে এক চিলতে স্বস্তির এবং প্রফুল্লতার হাসি ফুটে উঠল। চট জলদি আমি কলটা তুলতেই বাবা ঐ পাশ থেকে ব্যতিব্যস্ত গলায় বললেন,,
“তোমরা পৌঁছেছ তো পরশ?”
মুহূর্তের মধ্যেই আবার ও আমার কান্না পেয়ে বসল! মুখ চেঁপে কেঁদে আমি প্রত্যত্তুরে বললাম,,
“পৌঁছেছি বাবা!”
বাবা নিরুত্তর! হয়তো বেদনা নিবারন করতে ব্যস্ত। বেশ কিছুক্ষন পর বাবা জোর পূর্বক হাসিতে শান্ত গলায় বললেন,,
“বাবা সকালে কল করব। এখন রেস্ট নাও তুমি। গুড নাইট!”
ফট করে বাবা কলটা কেটে দিলেন। কান থেকে ফোনটা সরিয়ে আমি ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠতেই পরশ পাশ ফিরে শক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কড়া গলায় আমায় শাসিয়ে বললেন,,
“কান্না থামাবে তুমি? কি কখন থেকে ফ্যাস ফ্যাস করে কেঁদেই যাচ্ছ? একেবারে চলে এসেছ নাকি ঐ বাড়ি থেকে? আর কখন ও ফিরবে না ঐ বাড়িতে?”
কান্না থামিয়ে আমার ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টি পড়ল পরশের রাগী দৃষ্টিতে! রেগে গেলে লোকটিকে বড্ড ভয়ঙ্কর দেখায়। নিমিষেই যে কেউ জব্দ হতে বাধ্য। শুকনো ঢোকের সাথে কান্না গলাধঃকরন করে আমি খানিকটা শান্ত হতেই পরশ নমনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। অতঃপর আমার দিকে এগিয়ে এসে আলতো হাতে চোখের জল গুলো মুছে দিলেন। কপালে দীর্ঘ চুম্বন বসিয়ে বললেন,,
“আমি জানি। ঐ বাড়ির সবাইকে ছেড়ে এসেছ বলেই তোমার খুব মন খারাপ করছে। তার মানে এই না যে কান্নাকাটি করে নিজের শরীর খারাপ করতে হবে। একটু শান্ত হও তুমি। কয়েকটা দিন সময় দাও। দেখবে দুদিন পরেই তুমি আবার এই বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছ। ঐ বাড়ির কথা খুব একটা মনে পড়ছে না তখন। হুট করে স্থান পরিবর্তন কারনেই এতটা কষ্ট হচ্ছে তোমার!”
নাক টেনে কেঁদে আমি বললাম,,
“আমার প্রথম বাচ্চাটা কিন্তু ঐ বাড়ি থেকেই হবে পরশ। বাবার নির্দেশ দয়া করে অমান্য করবেন না!”
“আচ্ছা! সে এখন অনেক দূরের খবর। এখন ও তো মাস ও ফুরোয় নি। আপাতত বিষয়টিকে ভুলে নিজের শরীর এবং স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দাও। চুপ করে একটু ঘুমাও। কাল সকাল ৮ টা বাজতেই আমার রওনা দিতে হবে। তোমাকে শান্ত করতে করতেই তো রাত পাড় হয়ে যাচ্ছে আমার। ঘুমাব কখন শুনি?”
“আচ্ছা আর কাঁদব না আমি। শান্ত হয়ে গেলাম। এবার আপনি ঘুমান।”
মৃদ্যু হাসলেন পরশ। কপালে পুনরায় দীর্ঘ চুম্বন এঁকে বললেন,,
“আমার লক্ষি বউটা!”
বিপরীতে আমি মৃদ্যু হাসলাম। পরশকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমের অতলে পা বাড়ালাম!
,
,
সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙ্গল আমার। তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে আমি প্রথমে আমার রুমটা ঝাড়ু দিলাম। ফ্রেশ হয়ে ফজরের কাযা নামাজ আদায় করে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে ছুট দিলাম। মা আজ এখন ও ঘুমুচ্ছেন! ভীষন ক্লান্ত বলেই বোধ হয় ঘুম থেকে উঠতে পারছেন না। ঘন্টাখানিকের মধ্যে নাশতার জোগাড় সেরে আমি খাবার টেবিলে নাশতার প্রতিটা পদ সাজিয়ে দিলাম। আটটার মধ্যেই পরশ ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাওয়ার নিয়ে, অফিসের জন্য একেবারে রেডি হয়ে খাবার টেবিলে চলে এলেন। মা, বাবা, পায়েল, পিয়ালী আপু ও একজোট হয়ে খাবার টেবিলে সমবেত হলেন। পরশ এবং শ্বশুড় আব্বু খুব তাড়ায় আছেন! তাই কোনো রকমে নাশতা করে দুজনই অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।
দুপুর ১২ টা বাজতেই হঠাৎ সদর দরজার কলিং বেল বেজে উঠল৷ এই সময় তো সচরাচর বাড়িতে কেউ আসেন না! তবে আজ কে এলেন? গ্যাসে তরকারী বসিয়েছি মাত্র। মা বাজারে গেছেন সবজি আনতে। পায়েল ভার্সিটিতে। আগামী সপ্তাহেই তার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল এক্সাম! পিয়ালী আপু বোধ হয় ঘরে বসে পড়ছেন। বাধ্য হয়ে আমাকেই রান্নাঘর থেকে বেরুতে হলো। ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে আমি সদর দরজার দিকে অগ্রসর হতেই পিয়ালী আপু বসার ঘর থেকে আমায় থামিয়ে বললেন,,
“আমি যাচ্ছি ভাবী। তুমি বরং রান্নাঘরে যাও। আগের বারের মতো না আবার ভাতের বদলে তরকারী পুড়ে যায়!”
জিভ কেটে হুড়মুড়িয়ে আমি রান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই মনে হলো পিয়ালী আপু দরজা খুলেই কারো সাথে তুখাড় ঝগড়া ঝাঁটিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছেন! গ্যাসের আগুন কমিয়ে আমি তড়িঘড়ি করে দৌঁড়ে গেলাম সদর দরজার দিকে। চৌকাঠের ঠিক ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন খুব লম্বা-চূড়া, সুঠাম দেহের একজন সুদর্শন ছেলে। গাঁয়ের রং হালকা চাঁপা। তবে মুখমন্ডল মায়ার ভরা! চেহারার আর্ট খুব সুন্দর। হাতে ছেলেটির ফুটন্ত গোলাপের বগি, ঠোঁটের কোনে এক নজর কাড়া হাসি! সেই হাসিতেই যেন পিয়ালী আপুর সমস্ত রাগ! অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে পিয়ালী আপু ভদ্র ছেলেটিকে শুধিয়ে বলছেন,,
“কি চাই কি আপনার হুম? কি চাই? সাহস তো কম না আপনার! পিছু করতে করতে বাড়ি অবধি চলে এসেছেন? আর হাতে ওটা কি? কি ভেবেছেন? সস্তা কয়েকটা ফুল অফার করলেই অমনি আমি হ্যাংলাদের মতো আপনার প্রেম প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাব? এতই চিপ নাকি আমার মেন্টালি?”
পিয়ালী আপুর তীক্ষ্ণ কথার বিপরীতে মনে হলো না ছেলেটির খুব বেশি ভাবান্তর হলো! ঠোঁটের কোনে সেই একই হাসির রেখা ফুটিয়ে ছেলেটি অতি কোমলীয় গলায় বললেন,,
“দীর্ঘ এক মাস যাবত ফলো করছি তোমাকে! কি ভেবেছ? এত সহজে আমার হাত থেকে তোমার মুক্তি মিলবে? হাজার গাঁ ঢাকা দিয়ে ও আমার থেকে পরিত্রাণ মিলবে না তোমার! অবশেষে তোমাকে আমি জয় করেই ছাড়ব!”
#চলবে…?