#দর্পহরন
#পর্ব-৫৭
পুরোটা পথ কেটে গেলো নিরবতায়। মোর্শেদ, সালিম কিংবা শুভ্রা কেউই কারো সাথে কথা বললো না। শুভ্রা মনে মনে প্রথমে শাশুড়ীর উপর তারপর নিজের বাবা চাচার উপর ভীষণ রেগে থাকলো। ওরা আজ না গেলে নিশ্চয়ই এমন কিছু হতো না। রণ থাকলে ওর মার এরকম উল্টো পাল্টা কিছু করার প্রশ্নই আসে না। এখন রণ ফেরার পর যখন শুনবে বাবা আর চাচা তার অনুপস্থিতিতে তার বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তখন নিজের মাকেই ঠিক মনেহবে তার। নিশ্চয়ই শুভ্রাকে দোষ দেবে। অথচ এসব বিষয়ে শুভ্রা কিছুই জানে না। শুভ্রার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। শরীর জ্বলছে মেজাজের চাপে। নিজের বাবার দিকে একবার তাকালো সে। এতোদিন জানতো বাবা তাকে ভালোবাসে। আজ সেই ভালোবাসা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগছে। ভালোবাসলে নিজের মেয়ের সাথে কেউ এমন করতে পারে? জেনেবুঝে মেয়ের জীবন নষ্ট করবে কেন? শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগছে না কিছু ভালো লাগছে না।
সালিম সাহেব মেয়েকে দেখলো একনজর। মলিন মুখটা দেখে বুকটা হুহু করে উঠলো। যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়েছিল। এখন মেয়েটা ফিরে গেলে লোকসমাজে ছিছি তো হবেই সেই সাথে হেরে যাওয়ার সূক্ষ্ম ক্ষত তৈরি হবে। যে ক্ষত চুইয়ে রক্ত ঝড়বে চিরজীবন। তাদের পরিবারের উপর নজর লেগে গেছে বোঝা যাচ্ছে। সবদিক দিয়ে চাপে পড়ে গেছে। এরমধ্যে ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলে যেন একহাত হারিয়ে ফেললো সালিম সাহেব। এখন মেয়ের এই অবস্থা কিভাবে সামাল দেবেন? পুরনো রাগের ধারা ফিরে আসছে তার মধ্যে। নাহ, নরম হয়ে বেশ বিপদে পড়ে গেছেন দেখা যায়। এখন তো সেই পুরনো রুপে ফেরা ছাড়া গতি নেই তার। সেই খুনো সালিম যাকে দেখে বাঘা বাঘা নেতারা মাথা নুইয়ে থাকতো। সালিম ঠিক করে ফেললো, এবার মেয়র নির্বাচনে যে কোন মুল্যে জিতবেন৷ তারপর এই শহর চালানোর ক্ষমতা নিজের হাতে নেবেন। রণকে দেখিয়ে দেবেন পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। রণর মা আজ যা করলো তার জন্য আফসোস করতে হবে তাকে। সে ভুলে গেছে কার সাথে কথা বলেছে। ইব্রাহিম সালিম কোন মামুলি মানুষ না। এখন হয়তো তার সময় খারাপ তাই বলে শেষ হয়ে যায়নি সে। তার মেয়ের সাথে খারাপ করে রণ টিকতে পারবেনা এই পৃথিবীতে। দরকার পড়লে রণকে ওর বাপের মতোই নিশ্চিন্হ করে দেবে। তখন দেখবে রণর মা কিভাবে বড়াই করে। সালিমের চোয়াল শক্ত হয়, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ।
এদিকে মোর্শেদ কিছুটা সংকোচ নিয়ে বসে আছে। নিজের কাছে বড্ড অপরাধী লাগছে। ছেলের বিয়ের কথা বলতে এসে এমন কান্ড হবে টের পায়নি। সালিম একবার বলেছিল বটে কিন্তু সত্যি সত্যি পরিস্থিতি এভাবে বদলে যাবে ভাবেনি। এখন শুভ্রাকে দেখে বুক গুড়গুড় করছে। মেয়েটা মনেহয় জামাইকে ভালোবাসে তা নয়তো এভাবে শাশুড়ির পায়ে পড়তো না। এখনতো ভয় হচ্ছে তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কের সমীকরণ পাল্টে না যায়। মোর্শেদ অপরাধী মুখ নিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।
*****
দুইদিন পরে রণ ফিরলো। মনটা ভীষণ উৎফুল্ল ছিলো। এবার সব কাজে বেশ ভালো পারফরম্যান্স করেছে তারা। ইনভেস্টমেন্ট এর ব্যাপারে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বন্দর ঘিরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা গড়ে তুলতে বেশ ভালো প্রস্তাব এসেছে। এখন সে প্রস্তাব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নেত্রী ভীষণ খুশি বলা যায়। গাড়িতে আসতে আসতে শুভ্রার কথা ভাবলো বারকয়েক। ফোন দিতে গিয়ে থেমে গেলো। ভাবলো ফোন না দিয়ে সরাসরি বাসায় গিয়ে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাক মেয়েটা খুব খুশি হবে।
ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ঢুকলো রণ। যথারীতি মায়ের ঘরে গেলো প্রথমে। টুকটাক আলাপ সারতে সারতে রণ ভেতর ভেতর ছটফট করে। কখন দেখতে পাবে শুভ্রাকে। সে এলে শুভ্রাই দরজা খোলে, শরবত তৈরি করে নিয়ে আসে। আজ শুভ্রার ছায়াও দেখলো না। গেলো কোথায় মেয়েটা। রণ অস্থির হয়ে বলেই ফেললো-“আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি মা। দীর্ঘ জার্নি তো শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে।”
জলি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। ঠোঁট দু’টো চেপে রইলো। রণ উত্তরের অপেক্ষা করলোনা। ছুটে এলো নিজের কামড়ায়। শুভ্রাকে ডাকলো বারকয়েক। কোন সারা না পেয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। গোসল সেরে আসার পরও যখন শুভ্রার পাত্তা নেই তখন তার ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো। এরকম তো কখনো করে না শুভ্রা। ফোন নিয়ে ঝটপট ফোন লাগায়। ফোনটা বিছানার উপরই একবার বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। হাতে নিয়ে দেখলো চার্জ শেষ। সে কি মনে করে একবার রান্না ঘরে উঁকি দিলো। সেখানে কাজের মেয়েটা কাজ করছে। রণ ছুটে এলো মায়ের ঘরে-“মা, শুভ্রা কোথায়? আমি এলাম এতোক্ষণ হলো কিন্তু ওকে দেখলাম না।”
জলির মুখের রেখাগুলো বদল হলো। নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রান চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রণ যেন জলিকে কিছুটা পড়তে পারে। বুঝলো কিছু একটা হয়েছে, ঘরে কোন একটা গন্ডগোল হয়েছে। তার বুকটা ধকধক করছে। মনে কু ডাকছে। সে উত্তেজিত হয়ে চেচিয়ে উঠলো-“মূ, তুমি চুপ করে আছো কেন? কি হয়েছে? শুভ্রা কোথায়?”
জলিকে কিছুটা বিচলিত দেখায়। কয়েকবার চোখ পিটপিট করে ছেলেকে দেখলো। শীতল কণ্ঠে বললো-“শান্ত হয়ে আমার সামনে বোস। কথা আছে তোর সাথে।”
রণর ছটফটানি বাড়লো। সে চঞ্চল হয়ে জলির সামনে বসলো-“কি বলবে বলো। তার আগে বলো শুভ্রা কোথায়?”
জলি নিজেকে শান্ত রেখে স্থিমিত কন্ঠে বললো-“সে নাই চলে গেছে।”
“চলে গেছে! কোথায় চলে গেছে?”
রণ না বুঝে প্রশ্ন ছুড়ে দিলে জলি দীর্ঘ শ্বাস ফেললো-“ক’দিন ছিলি না। তোর অনুপস্থিতিতে অনেক কিছু ঘটে গেছে বাবাই। তোর শশুর আর চাচা শশুর এসেছিল আমাদের এখানে। তারা খুশির বিয়ের প্রস্তাব এনেছে তন্ময়ের সাথে। তুই ভাবতে পারিস ওদের সাহস কতো?”
রণর চোয়াল শক্ত হলো। সে ঠান্ডা গলায় বললো-“তুমি আমাকে ফোন দাওনি কেন মা? ওদেরকে তখনই শায়েস্তা করতাম।”
“তুই গেছিস কাজে তাই তোকে বিরক্ত করিনি। কিন্তু কথা হলো তোর বউ কিভাবে এলাও করলো এসব? তুই মানা করার পরও ওর বাবা আর চাচাকে খুশির বিয়ের প্রস্তাব আনতে বললো কেন?”
রণকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“কিন্তু মা, শুভ্রার এমন কিছু করার কথা না। ও নিজেই তন্ময়ের সাথে বিয়েতে রাজি ছিলো না। ওর বাবাকে নিষেধ করে দিয়েছিল। ও হয়তো জানতো না ওরা প্রস্তাব নিয়ে আসবে।”
জলিকে অসন্তুষ্ট দেখায়-“মানতে পারলাম না বাবাই। তুই বলতে চাস ওর বাবা ওকে না জানিয়ে এখানে এসেছিল? এটা কি সম্ভব?”
রণ জবাব দিতে পারলোনা। চুপ করে রইলো।
“ওর বাবা আর চাচার সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আমি শুভ্রাকে বলেছি নিজের পরিবার নিয়ে এসব করার ইচ্ছে থাকলে যেন সে চলে যায় তার বাবার সাথে। বিয়ের পর তো আমাদের আপন ভাবেনি। বাবা ভাইয়ের জন্য টান সর্বদা তাহলে এ বাড়িতে থেকে কি হবে। তাই না বল?”
রণ অবিশ্বাস নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না মা কি বলছে। মায়ের মাথাটাথা খারাপ হলো নাকি? সে বড়বড় চোখপ জানতে চাইলো-“তুমি কি বলছো আমি বুঝতে পারছি না। শুভ্রাকে চলে যেতে বলেছ মানে কি?”
“গতবার এমন একটা ঘটনা ঘটালো ওর ভাই তবুও শুভ্রা তারই পক্ষ নিলো। এবার ও বাবা চলে এলো প্রস্তাব নিয়ে। মেয়েটা এ বাড়িতে থাকলে এসব চলতেই থাকবে এটা ভেবেই আমি বলেছি ও না হয় বাড়ির হয়ে থাকুক না হয়ে ও বাড়ি ফিরে যাক। দোটানায় তো সংসার হয় না বাবাই। ওর জন্য আমি আমার মেয়েদের জীবন রিস্কে ফেলবো কেন? আজ ঘরে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে কাল যে জোর করে তুলে নিতে চাইবে না তার কি গ্যারান্টি?”
“এসবের সাথে শুভ্রার সম্পর্ক কি মা? ও তো কাউকে এসব করতে বলেনি।”
জলির চেহারা কঠিন হলো-“শক্ত হয়ে মানাও তো করছে না। অনেকদিন সহ্য করেছি বাবাই। সবচেয়ে বড় কথা তোর বউ চলে গেছে ওর বাবার সাথে। ওর যদি তোর জন্য আমাদের জন্য সামান্যতম টান থাকতো তাহলে কি যেতে পারতো? বরং ও বাড়ির সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতো। কিন্তু তা না করে কি করলো? একবারও তোর আমার কথা ভাবেনি। প্রতিশোধের জন্য বিয়ে করেছিল তা কমপ্লিট করে এখন বিদায় নিয়েছে। বুঝেছিস?”
কিছুই বুঝলো না রণ। মায়ের কথার কোথাও শুভ্রার দোষ না পেলেও মায়ের সামনে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারলোনা। মায়ের একটা কথায় সে সহমত পোষণ করলো। আসলেই তো, এতো সহজে ও চলে গেলো কেন? নিজের সংসার ফেলে কেন গেলো? সেদিনই না রণকে ভালোবাসার কথা জিজ্ঞেস করলো? কেন জানতে চেয়েছিল তাহলে? যদি সংসারই না করবে তবে ভালোবাসা দিয়ে কি হবে? রণর বুকটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো। হাসফাস করে রণ উঠে দাঁড়ায়। জলি বারকয়েক খাওয়ার কথা জানতে চাইলো কিন্তু সেসব কথা রণর মাথায় ঢুকলো না। সে মোহগ্রস্তের মতো মায়ের কামড়া থেকে নিজের কামড়ায় এলো। অদ্ভুত ঘোরলাগা দৃষ্টিতে পুরো কামড়ায় নজর ঘুরালো। পুরো কামড়া শুভ্রাময়। মেয়েটা ওকে ছেড়ে চলে গেছে! ওর বাবার বাড়িতে ফিরে গেছে! অথচ ও ভেবেছিল শুভ্রা ভালোবাসা ওকে। জেদের বিয়ে ভালোবাসায় গড়িয়ে গেছে ভেবে খুশি হয়েছিল। বাবার খুনির মেয়েকে নিয়ে সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল রণ। রণ পাগলের মতো কিছুক্ষণ ঘরে পায়চারি করে। বিরবির করলো, কেন চলে গেলে শুভা? আমার জন্য একটা বার অপেক্ষাও করলেনা? কেন শুভ্রা কেন? এতোদিনে তোমার মনে একটুও কি ভালোবাসা, বিশ্বাস জন্মেনি আমার জন্য? আহহহহ! কেন এমন করলে? রণ হুট করে শুভ্রার মোবাইল ছুঁড়ে দিলো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করলো-“শুভ্রাআআআআআ!”
★প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ। তবুও বই সংগ্রহ চলবে। আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin