দর্পহরন #পর্ব-৫৮

0
297

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৮

ইব্রাহিম নিবাস মৃত্যুপুরীর চাইতেও শান্ত হয়ে আছে। এ যেন ঝড় ওঠার আগের মুহূর্ত। কাজের লোকগুলোও ত্রস্ত পায়ে কাজ সাড়ে। সামান্য আওয়াজে চমকে ওঠে। বাড়ির সবার খাবারে অনিয়ম হলেও এক তুলতুলের জন্য নিয়ম করে উনুন জ্বলে। বাকি কেউই ঠিকঠাক খায় না। সালিম সাহেব আজকাল বাড়িতেই থাকছেন না। মেয়র নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জোরেশোরে। সেই সু্যোগে মেয়ের চোখের সামনে থাকতে হচ্ছে না তার। জানে, মেয়েকে দেখলে মাথা এলোমেলো হবে।

আর শুভ্রা একেবারেই চুপ মেরে গেছে। আসার পর থেকে কারো সাথে কোন কথা নেই। চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকে। ঠিক যেমনটা ছিল বিয়ের আগে থাকতো। সালিম সাহেব মনেকরে ফোন কিনে এনেছেন পরদিনই। কিন্তু শুভ্রা তা ছুঁয়েও দেখেনি। যে নাম্বারে রণ ফোন দেবে সেটা তো ফেলেই এসেছে। আর নিজ থেকে রণকে ফোন দেওয়ার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই নেই তার৷ রণ যদি মায়ের মতো তাকে ভুল বোঝে অপমান করে তাহলে মেনে নিতে পারবে না শুভ্রা। হতাশা ঘিরে ধরে তাকে। রণর সাথে তার সম্পর্কটা কতটা গভীর হয়েছে সেসব ভাবার সুযোগ কখনো হয়নি। শুধু এতোটুকু বিশ্বাস ছিলো, রণ ওকে কাছে টেনেছে মানে সম্পর্কটা নিয়ে সে সিরিয়াস। কিন্তু এখন কয়দিনে একবারও রণর ফোন না পেয়ে সেই বিশ্বাসটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। টিভি চালিয়ে বসলো শুভ্রা। ইউটিউব খুঁজে খুঁজে রণর খবরগুলো দেখে সে। তার ফেরার খবরটাও এভাবেই পেয়েছে। তারপর মনে মনে প্রতীক্ষা করেছে রণ হয়তো ওকে নিতে আসবে। ধীরে ধীরে বুঝে গেছে রণ আসবে না। সেও হয়তো মায়ের কথা শুনে শুভ্রাকে দোষী ভেবে বসেছে। শুভ্রা টিভির সাউন্ড মিউট করে দিয়ে একদৃষ্টিতে রণকে দেখতে লাগলো। কালকের কোন একটা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছে। রণকে দেখতে দেখতে শুভ্রার চোখ ঝাপসা হলো।
“আপা, কি করছো?”
তুলতুলের কন্ঠ শুনে দ্রুত হাতে চোখ মুছলো শুভ্রা। টিভির রিমোট হাতে নিলো কিন্তু তার আগেই তুলতুল টিভিতে চলা রণর ভিডিও দেখে ফেললো। হেসে এগিয়ে এসে শুভ্রার সামনে বসলো-“ভাইয়াকে দেখছো?”
শুভ্রা টিভি বন্ধ করে দিলো। তুলতুল বললো-“তুমি কি কাঁদছিলে নাকি আপা?”
শুভ্রা এবারও জবাব দিলো না। তুলতুলের হাতের বইটা দেখলো একবার। হুমায়ুন আহমেদের এলেবেলে বইতা ওর হাতে। তুলতুল শুভ্রার দৃষ্টি লক্ষ্য করে হাসলো-“এটা পড়বে? ভীষণ হাসির বই। তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।”
শুভ্রা ক্ষীণস্বরে বললো-“আমার মন খারাপ কে বললো?”
“আচ্ছা, মন ভালো? তাহলে তো ভালোই হলো। শোন, আজ আমার সাথে যাবে?”
শুভ্রা অবাক হলো-“কোথায়?”
“ডাক্তারের কাছে। আজ আমার রেগুলার ভিজিট ডে।”
শুভ্রা মিইয়ে গেলো-“নাহ, তুমি যাও ভাবি। আমার ভালো লাগে না বাইরে যেতে।”
“তুমি বুঝি দুলাভাইকে ভালোবাসো?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?”
“এমনিতেই। ভালোবাসা জিনিসটা কেমন সেটা খুব বুঝতে ইচ্ছে করে।”
শুভ্রা থমকে গেলো। তুলতুল এমনভাবে বললো যে উত্তর যোগালো না শুভ্রার মুখে। তুলতুল মৃদুস্বরে বললো-“তোমার ভাই তো আমাকে তুলে এনেছিল তারপর দিনভর রে*প করলো। তখন খুব হট্টগোল হচ্ছিল বলে বাঁচার জন্য তোমার বাবা জোর করে বিয়ে করয়ে দিলো। তারপর প্রতিদিন বৈধ ভাবে রে*প হতাম। মজার না ব্যাপারটা?”
বলতে বলতে তুলতুল খিলখিলিয়ে হাসে। শুভ্রা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তুলতুল হাসতে হাসতে পেটে হাত দেয়-“তোমার ভাইয়ের আবার মরার আগে শখ জেগেছিল। আমাকে প্রায়ই বলতো, আমি কেন নিজ থেকে তার কাছে যাই না। বলো দেখি, কে সেধে সেধে নিজের ইজ্জত খোঁয়াতে চাইবে? আমার তো তাকে ঘৃনা হতো নিজ থেকে কিভাবে কাছে যাব? সত্যি বলতে তোমার ভাইটা মরার পর আমি খুব খুশি হয়েছিলাম জানো। মনে হয়েছিল এবার আমি মুক্তি পেলাম। অথচ কপাল দেখো, মানুষটা যেতে যেতে ঠিকই আমার পায়ে শিকল পরিয়ে দিলো। হা হা হা। শয়তান যে সহজে পিছু ছাড়ে না সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। হিহিহি।”
তুলতুল হাসতে হাসতে মুখে আঁচল চাপা দিলো। শুভ্রা অস্ফুটে চেচিয়ে উঠলো-“ভাবি!”
তুলতুল থেমে যায়, পেটের দিকে ইশারা করলো-“যদি ছেলে হয় তাহলে নিশ্চিত বাবা দাদাদের মতো গুন্ডা বদমাশ হবে। আর মেয়ে হলে তোমার মতো। হিহিহি।”
শুভ্রা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-“কি বলছো এসব? আমার মতো হলে কি খারাপ হবে?”
“তুমি কি ভালো? আমার কথা কখনো ভেবেছ? একটা মেয়েকে জোর করে আঁটকে রাখতে দেখেও চুপ করে থাকতে। তোমার বাবা আর ভাইরা মিলে কত মানুষের জীবন নরক করেছে সেসব কিছুই কি জানো না তুমি? আমার মনেহয় তুমি সব জানো কিন্তু না জানার ভান করে থাকো। তুমি নিজেও তো ওদের মতই। প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করেছিলে। জামাইয়ের ক্ষতি করবে জেনেও বাবাকে তার কথা বলতে। সেদিন তোমার ভাইয়ের গুলিটা মিস না হলে কি হতো ভেবেছ কোনদিন? তুমি মাথামোটা, স্বার্থপর একটা মেয়ে। জানো তোমার বাবা ভাই কেমন কিন্তু তবুও কোনদিন তাদের কিছু বলোনি। নেহাত তোমার জামাই ভালো মানুষ বলে তোমাকে সহ্য করেছে।”
তুলতুলের এমন কঠিন কথা শুনে শুভ্রা বাকহারা হয়ে গেলো। তুলতুলের তখনো যেন কথা বলা শেষ হয়নি। সে শান্ত গলায় বললো-“এ বাড়ির মানুষের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে বুঝলে? এখন সাজা পাওয়া শুরু হয়েছে। তোমার এই হাল সেই সাজার একটা অংশ। ভেবে দেখ, তোমার এই হালের জন্য কে দায়ী? তোমার পরিবারই কিন্তু দায়ী। আমার বিশ্বাস এসব কেবল শুরু। আরও অনেক কিছু ঘটবে এই পরিবারের সাথে।”
“ভাবি!”
শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো। তুলতুল হাসলো-“পরের মেয়ের সাথে কতকিছু হয়েছে এ বাড়ির কারো চোখে সহানুভূতি দেখিনি। এখন যখন নিজের মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে তখন সবার নাওয়া খাওয়া বন্ধ। এমন দ্বিচরিত দেখে ঘেন্না লাগে আপা। তবুও তো তোমার বর তোমাকে ভালোবেসে আগলে রেখেছে শত্রুর মেয়ে জেনেও। তোমার ভাগ্য বটে। কিছু মনে করো না আপা, অনেকদিনের জমানো রাগ তোমার উপর ঝেড়ে ফেললাম। মাফ করে দিয়।”
তুলতুল বইটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। শুভ্রা ঠায় বসে রইলো বিছানায়। কেন যেন তার মধ্যে কোন অনুভূতিই আসছে না। না রাগ না দুঃখ কিছুই না।

****

রণ আছে বিশেষ মিটিং এ। ওর এলাকায় মেয়র নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে কি দান খেলা হবে সে বিষয় গোপন মিটিং। বুকের মাঝে অহর্নিশ তীব্র জ্বালা তবুও ওর মুখ দেখে সেকথা বোঝার উপায় নেই। আজকাল মেজাজ খুব খিচিয়ে থাকে। সেই মেজাজ দেখানোর জায়গা নেই বলে বেশির ভাগ সময় তার রেশ রাজিব আর মিহিরের উপর দিয়ে যায়। আজ মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ কিন্তু মিটিং বাদ দেওয়ার উপায় নেই। আজ এখানে বিশেষ একজন মানুষ উপস্থিত আছে। ওনার কথা অনেকবার শুনলেও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। মাজহার আমিন নাম তার। বলা হয়ে থাকে নেত্রী যত বড় বড় সিদ্ধান্ত নেন তার পেছনে উনার হাত থাকে। রণ চুপচাপ বসে দেখছে মানুষটাকে। নেত্রীর পাশে বসে নিচু স্বরে কথা বলছে। ছোটখাটো মানুষটার চেহারা বেশ সৌম্য দর্শন। বিশেষ কিছু বলতে গেলে অবশ্যই তার তীক্ষ্ণ নজরের কথা উল্লেখ করতে হবে। যেন কাউকে একবার দেখলেই তার মন পড়তে পারেন। আজ এখানে আরও কয়েকজন উপস্থিত আছে। সালিম সাহেবের বিপরীত পক্ষের আব্দুস সবুর, ইমাদ করিম আছেন।
“রণ।”
নিজের নামটা শুনে চমকে উঠলো রণ। দেখলো মাজহার আমিন হাসি মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রণ আড়ষ্ট হয়ে হাসলো-“জ্বি।”
“তুমি বলেছিলে শেষ মুহুর্তে সামলে নেবে। তুমি কি ভেবেছ শেয়ার করবে কি? সালিম এবার আটঘাট বেঁধে নেমেছে। খুব সহজে হাল ছাড়বে না। মনোনয়ন জমা দিয়ে দিয়েছে। সতন্ত্র হিসেবে দু’জন দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু ওরা কেউই সালিমের প্রতিপক্ষ হিসেবে মানানসই নয়।”
রণ বিচলিত হলো। ইদানীং মনের ক্ষত ব্রেনকে চিন্তা করতে বাঁধা প্রদান করে। অনেককিছু ভেবেছিল সে কিন্তু সত্যি বলতে এখন কোন কিছুতে উৎসাহ পাছে না। তবুও কিছু একটা বলতে হবে ভেবেই মুখ খুললো-“আমি ভেবেছিলাম এলাকায় প্রবীন রাজনীতিবিধ সিরাজ আহমেদের মেয়ে সুমনা আপাকে সতন্ত্র হিসেবে দাঁড়াতে বলবো। উনি একদম ফ্রেশ মুখ, শিক্ষিত মহিলা। সুযোগ পেলে ভালো করবে মনে হয়েছে।”
মাজহার অবাক হলো-“কিন্তু তার পূর্বের কোন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই।”
রণ হাসলো-“সেজন্যই ভেবেছি। সালিম সাহেব তাকে প্রতিদন্দী হিসেবে কখনোই চিন্তা করবে না। আর ভদ্রমহিলাকে যতদূর দেখেছি কথার মারপ্যাচ বেশ ভালো পারে। আপনারা কি বলেন ইমাদ ভাই?”
“সে তো সরাসরি রাজনীতি করে নাই। এই পদ সামলাতে পারবে?”
ইমাদ দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিলো। রণ আশ্বাস দিলো-“আমার মনেহয় আপনারা সমর্থন দিলে পারবে। বাকীটা নেত্রীর বিবেচনা।”
মাজহার হাসলেন-“তোমাকে বিচক্ষণ মনে হয়েছিল। এখন দেখছি তুমি আমার ভাবনার চাইতে বেশি বুদ্ধিমান। তুমি কি রণর সাথে একমত?”
নেত্রীর দিকে তাকাতেই তিনি মাথা দুলালেন-“ওর উপর আস্থা আছে আমার।”
রণ বললো-“আপনি ভাববেন না ফুপু, সালিম সাহেব বাদে বাকি সবাই ওনার জন্য কাজ করবে। আমি কথা বলে রেখেছি সবার সাথে।”
“কিন্তু সুমনা কি রাজি হবে?”
“হবে। গতবার ওনার বাবার সাথে যা হয়েছিল তাতে উনি কষ্ট পেয়েছিলেন। সুযোগ পেলে দলের হয়ে কাজ করতে চান।”
“তাহলে তো হয়েই গেলো। ওনাকে একদম শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে বলবে। বাকী কাজ আমরা দেখে নেব। এলাকায় কি করতে হবে সেসব তুমি ম্যানেজ করে নেবে।”
“ঠিক আছে। আজ আসছি ফুফু।”
রণ বিদায় নিতেই নেত্রী প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“কেমন দেখলে?”
“চন্দ্রর জন্য একেবারে পারফেক্ট। দলের জন্যও বটে৷ ও চন্দ্রের সাথে জুড়ে গেলে তোমার দলের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হবে না। কিন্তু একটা ভ করেছ। ওকে বিয়েটা করতে দেওয়া উচিত হয়নি।”
“বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার কাছাকাছি। ওর মা খুব রাজি চন্দ্রকে বউ বানাতে। তখন বিয়েটা না করলেও চলছিল না। সালিমকে চোখে চোখে রাখা জরুরি ছিলো।”
নেত্রী জবাবদিহিতা করলো। মাজহার সন্তুষ্ট হলো কিনা বোঝা গেলো না। সে মৃদুস্বরে বললো-“সালিমের মেয়ে ওকে ছেড়ে দেবে?”
“ছেড়ে গেছে অলরেডি।”
“তাহলে দেরি করো না। শুভ কাজ তাড়াতাড়ি সারতে হয়।”

★প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ। তবুও বই সংগ্রহ চলবে। আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here