#দর্পহরন
#পর্ব-৫৯
“তুলতুল, আসবো?”
শরীফ দরজায় টোকা দিলো। তুলতুল এলেবেলে পড়তে পড়তে খিলখিলিয়ে হাসছিল। শরীফের আওয়াজ পেয়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো-“আসুন।”
বলেই আবারও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে লাগলো। শরীফ রুমে ঢুকলো, তার হাতে স্ট্রবেরি ভর্তি বাটি। তুলতুলের দিকে বাড়িয়ে দিলো বাটিটা-“সেদিন খেতে চেয়েছিলে।”
তুলতুল অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে বাটিটা নিলো-“এতো অরিজিনাল মনেহচ্ছে। কোথায় পেলেন?”
“খুঁজলে পাওয়া কঠিন না। খেয়ে দেখো কেমন।”
শরীফ চেয়ার টেনে বসলো। তুলতুল একটা স্ট্রবেরি তুলে মুখে দিলো-“দারুন মজা। আপনিও খান না।”
মাথা নাড়লো শরীফ-“তুমি খাও।”
তুলতুল খেতে খেতে বইয়ে ডুবে গেলো আবার। শরীফ ওকে দেখলো চেয়ে চেয়ে। মাঝে মাঝেই হাহা হিহি করে হেসে উঠছে। শরীফের ভালো লাগছে দেখতে। সে হঠাৎ ডাকলো-“তুলতুল একটা কথা বলি?”
“হ্যা, বলুন না।”
“শুভ্রাকে ওসব বলা উচিত হয়নি তোমার। এমনিতেই ওর মনটা খারাপ তার উপর তুমি উল্টো পাল্টা বলে ওর মন আরও খারাপ করে দিয়েছ।”
তুলতুল থতমত খেলো। বইটা বন্ধ করে পাশে রেখে শরীফের দিকে তাকালো-“মাঝে মাঝে অনুচিত কাজ করতে হয়।”
“আমি তোমার কথা মেনে নিচ্ছি কিন্তু সেটা সবসময় নয়। শুভ্রা বরাবরই বাসা থেকে দূরে থেকেছে। বাবার হয়তো ওর উপর দূর্বলতা ছিলো তাই চাইতো না ও কিছু জানুক বা বুঝুক। এমনকি স্কুল বা কলেজের বন্ধেও ওকে বেশি বাসায় থাকতে দিত না আব্বা। ও হয়তো বড় হয়ে সব বুঝে গেছে কিন্তু বুঝলেও বলার উপায় ছিলো না। এখন যখন বাড়িতে আসে আব্বা ওকে ভালোবাসে সেটা বুঝেই কিছু বলতে পারে না। সবসময় দূরে থাকাতে এই ভালোবাসাটা হয়তো ওর ভালোলাগে। কিন্তু সেজন্য এসব কথা ওর শোনার কথা না৷ ও দোষী না আসলে। মানলাম তোমার উপর অন্যায় হয়েছে। কিন্তু আমি তো সেই অন্যায়কে শোধরাবার চেষ্টা করছি।”
তুলতুল চুপচাপ শরীফের কথা শুনলো। ও থামতেই তুলতুল বিচিত্র ভাবে হাসলো-“কিছু কিছু অন্যায়ের বদলা অন্যায় করেই নিতে হয়। জানেন, আপনার ভাই কি পরিমান অন্যায় করেছে তার তিরিশ বছর জীবনে? আমার আব্বাকে তুলে আনছিল। তারপর তিনদিন পরে আব্বার লাশ পাওয়া গেছিল শীতলক্ষ্যায়। আর আমার কপাল দেখেন, আব্বার খুনির সাথে সংসার করা লাগছে। এখন তার বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরতেছি। আপনের কাছে হয়তো কোন ব্যাপার না এসব কিন্তু ভাবলে আমার মাথা ঘুরায়। জীবনটাকে কেমন যেন অর্থহীন মনেহয়। মাঝে মাঝে আমার পেটের বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে মনচায়, ভীষণ মনচায়।”
শরীফ চুপ করে রইলো। সত্যি বড্ড লজ্জা লাগে তার। সেই সাথে তুলতুলের মানসিক অবস্থা ভেবে গা শিউরে ওঠে। তুলতুল হাসলো-“ভয় পাবেন না, এমন কিছু করবো না আমি। আর হ্যা, আপাকে ওসব বলেছি তার ভালোর জন্য। মানুষটার মন নরম। নরম না হলে তন্ময় ভাইকে আগেই থামাতে পারতেন। তার জন্য নিজের বিবাহিত জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতো না। কে ভুল কে ঠিক এই বুঝটা হওয়া দরকার আছে আপার। সঠিক মানুষ চিনতে না পারলে তার জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে।”
“কিন্তু শুভ্রা বুঝলেই হবে? আরেকদিকের মানুষটাকেও তো বুঝতে হবে। এভাবে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার পরে কি ফিরে যাওয়া উচিত হবে ওর?”
“সেসব তো আমি জানি না। তবে মেয়েরা কত কিছু করে জীবনে। ভালোবাসার মানুষের জন্য কিছু করতে পারাও ভাগ্য।”
“তুমি বলতে চাইছো শুভ্রা রণকে ভালোবাসে?”
“অবশ্যই।”
শরীফ অবাক হয়ে জানতে চাইলো- “এতো শিওর হয়ে বলছো কি করে?”
“বোঝা যায়। এমন কঠিন কিছু না।”
“আচ্ছা! আমি কেন বুঝি না? তুমি কি কাউকে ভালোবেসেছ জীবনে? অভিজ্ঞতা আছে?”
হঠাৎ শরীফ বেফাঁস প্রশ্ন করে। তুুলতুল ভ্যাবাচ্যাকা খায়-“এসব বোঝার জন্য বুঝি ভালেবাসতে হয়? কি জানি? আমি তো যা মনে এলো তাই বললাম।”
বলতে বলতে আনমনা হলো তুলতুল। সামনে বসে থাকা শরীফকে এমনভাবে দেখলো যেন বহুদূরের মানুষকে দেখছে। তারপর বিরবির করলো-“কাউকে ভালোলাগার ভালোবাসার সু্যোগ পেলাম কোথায়? তার আগেই জীবনে কালিমা লেপন হয়ে গেলো।”
*****
ক্লান্ত শ্রান্ত রণ ঘরে ঢুকতেই জলির মুখোমুখি হলো। রণ বুঝলো মা রেগে আছে। সে হাসার চেষ্টা করলো-“মা, কেমন আছো তুমি? শরীর ঠিক আছে তো? ওষুধ ঠিকঠাক নিচ্ছ?”
জলি সে প্রশ্নের ধার দিয়ে গেলো না। সে গম্ভীর মুখে বললো-“বাবাই, কি শুরু করেছিল বলতো? ভোরে বেড়িয়ে যাস গভীর রাতে ফিরিস। বাসায় মা আছে বোন আছে কারো কোন খোঁজ রাখার প্রয়োজন নেই তোর?”
রণ অনেক কিছু বলতে চাইলেও শেষ মুহূর্তে কি মনে করে চুপ রইলো। ছেলের উত্তর না পেয়ে জলির মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। সে গম্ভীর হয়ে বললো-“তুই একটু বোস আমার কাছে জরুরি কথা আছে।”
রণ হতাশ চোখে তাকালো-“কাল কথা বলি মা?”
জলি গোঁয়ারের মতন মাথা নাড়ে-“না, এখনই। আয় বোস।”
রণ হার মেনে বসলো মায়ের কাছে-“কি বলবে বলো।”
জলি ভনিতা করলো না-“শোন, উকিলের সাথে কথা বলেছি। ভাইয়া আলাপ করিয়ে দিয়েছে। তোর কাগজ তৈরি করতে বলেছি।”
রণ অবাক হয়ে তাকায়-“কিসের কাগজ!”
“কিসের আবার? ডিভোর্স পেপার। আমি তোর জন্য একজনকে পছন্দ করেছি। কথাও এগিয়ে রেখেছি।”
রণ বিস্মিত হয়ে মাকে দেখলো তারপর হেসে দিলো-“বাহ! দারুণ তো? আমি জানতাম না পাত্র হিসেবে আমি এতো দামী।”
“তুই অনেক দামী বাবাই। যাইহোক, কাগজ এসে যাবে দুই একদিনের মধ্যে। আশাকরি ভনিতা না করে সাইন করে দিবি। আমি ওই খুনিটাকে কোন সুযোগ দিতে চাই না।”
“কার সাথে বিয়ে ঠিক করেছ মা?”
“চন্দ্রানী। সারাদিন ওর সাথেই তো ঘুরিস।”
রণ হতবিহ্বল হয়ে তাকালো-“আর চন্দ্র রাজি হলো? নাকি সে জানেই না?”
“তার আমি কি জানি? স্বয়ং নেত্রী রাজি হয়েছেন প্রস্তাবে।”
রণ বাকরুদ্ধ। জলি অবস্থা এতোকিছু ভাবলো না-“শোন বাবাই, এবার তোর বিয়ের পর হাসি খুশির বিয়ে দেব। বলা যায় না ওই ছেলেটা আবার কোন ঝামেলা না করে। তুই ওদের জন্য ভালো পাত্র খুঁজে বের কর।”
রণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সামনে বসে থাকা মানুষটা তার মা। কেমন যেন অচেনা লাগে জলিকে। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“আমি কাল এলাকায় যাচ্ছি মা। কয়েকদিন থাকতে হবে। নির্বাচনের কাজ আছে।”
জলি সন্দিহান নজরে তাকাতেই রণ মৃদু হাসে-“ভয় পেয়ো না মা, আমি শুভ্রার সাথে কোন যোগাযোগ করবো না। তাছাড়া আমি যোগাযোগ করতে চাইলেও শুভ্রা হয়তো করবেনা। ওকে এতোটাও হ্যাংলা ভেবো না মা। আর একটা কথা, শুভ্রাকে আমি ডিভোর্স দেব না কোনদিন। বাকী তুমি কি করবে করো।”
“ওই খুনির মেয়ে আর এ বাড়িতে ঢুকবে না বাবাই।”
“ও তো ঢুকে গেছে মা। অনেক আগে ঢুকেছে। তুমি ওকে ঢুকিয়েছ এ বাড়িতে। তাছাড়া দোষ ওর বাবার। ও কোন দোষ করেনি মা। তাই ওকে শাস্তি দেওয়াটা আমি মানতে পারলাম না। তুমি ওকে বের করে দিয়েছ আমি মেনে নিয়েছি কিন্তু এর বেশি কিছু করবো না আমি।”
রণ উঠে দাঁড়ায়। রুম থেকে বেরুবে এমন সময় জলি ক্রুদ্ধ স্বরে বললো-“যদি ও তোকে ডিভোর্স দেয় তাহলে কি করবি?”
রণর পা থেমে গেলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো পনের সেকেন্ড তারপর জবাব না দিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। বিছানার এসে বসলো চুপচাপ। শুভ্রার পাশটাতে ফিরে তাকালো একবার। আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারপর নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লো। শুভ্রার মাথার বালিশটা টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো, গন্ধে শুকলো চোখ বুঁজে। বার কয়েক গভীর শ্বাস টানলো তারপর বিরবির করলো-“ভালোবাসি তো বোকা মেয়ে।”
★প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ। তবুও বই সংগ্রহ চলবে। আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin