#দর্পহরন
#পর্ব-৬০
এলাকার রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত। মেয়র নির্বাচনের হাওয়া লেগেছে। নতুন একজনকে নির্বাচনের ময়দানে দেখে সালিম সাহেব অবাক হয়ে মুচকি হাসলো। গতবার সতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল সিরাজ আহমেদ। সালিম সাহেব জিতলেও ভালো টক্কর দিয়েছিল সিরাজ। হয়তো জিতেও যেত যদি না শেষ মুহূর্তের খেলাটা না খেলতো সালিম। সে কথা ভেবে মিটিমিটি হাসতে হাসতে চেয়ারে দোল খেলো কিছু সময়। গতবারের শিক্ষাটা কি ভুলে গেছে সিরাজ আহমেদ? নাকি সেই ভয়ে নিজে মাঠে না নেমে মেয়েকে এগিয়ে দিয়েছে? অবশ্য যে কান্ড হয়েছিল তাতে তার মুখ দেখানোর অবস্থা নেই। এজন্যই হয়তো মেয়েকে ঠেলে দিয়েছে। সালিম সাহেব নিশ্চিত মনে শ্বাস ফেলে।
চিন্তার বিষয় কেবল মেয়েটা। ওর ভবিষ্যত কি হবে তাই ভাবছে। রণর থেকে কোন সারা নেই। ওর মাতো বলেই দিলো শুভ্রা চায় না ওরা। তাহলে উপায় কি ডিভোর্স ছাড়া? বুকটা চিনচিন করে উঠলো। তাদের পরিবারে ডিভোর্স এর কোন ইতিহাস ছিলো না। শুভ্রার হাত ধরে বুঝি সেটারও চল হয়ে যাবে।
“চাচা, জামাই আসছে এলাকায়।”
তুহিনের কথায় নড়েচড়ে বসলেন সালিম-“কবে?”
“মেলাদিনই হয়ে গেলো।”
“ওহহহ। কিছু করে?”
“মেলা কিছুই তো করে। সুমনা আপা তো ওইখানেই থাকে সারাদিন। এলাকার যারা আপনের এন্টি পার্টি তাদের সাথে দফায় দফায় মিটিং করতেছে। নিজে প্রচরনায় না থাকলেও বুদ্ধি দিতেছে। দক্ষিণ মুড়াপাড়ায় পুরান ব্রিজের পাশে নতুন ব্রিজ বানায় দিলো। ওই দিকের যত নোংরা খাল ছিলো সব সাফ কইরা ফেলছে। আবর্জনা ফেলার মাঠটা খেলার মাঠ বানায়া দিছে। রাস্তা সংস্কারের ঘোষণাও দিছে। শুনলাম আগামী শনিবার সুমনা আপা শো ডাউন কইরা সমাবেশ করবো।”
বিরক্ত হলেন সালিম-“স্বতন্ত্ররে সমর্থন দিছে? ঢাকায় যায় না?”
“কাজ থাকলে যায় আবার চইলা আসে।”
“কি মনেহয়? সবাই কারে চায়?”
তুহিন চুপ করে রইলো। সালিম সাহেব অবশ্য জবাবের আশায় বসে নেই-“মুড়াপাড়ার ওইদিকে যে ময়লার ভাগার আছিল ওইটা কি ঠিক করছে?”
তুহিন অবাক হলো-“নাহ। খুব দূর্গন্ধ হয়। লোকজনের যাওয়া আসার সমস্যা করে।”
“ওইটা পরিস্কারের ব্যবস্থা কর। আর ওইখানে খালের উপর একটা ব্রিজ বানানের কাজও কইরা ফেল। আর কালকে আমি গার্মেন্টস মালিকদের সাথে মিটিং করবো। ব্যবস্থা করিস।”
তুহিন মাথা দুলায়। উসখুস করে। সালিম সাহেব জানতে চাইলো-“কিছু কবি?”
“ফাহিম।”
সালিম সাহেব হাত দেখালেন-“বাদ দে। জোর করার দরকার নাই।”
“না, জোর করমু কেন? সে থাকতে চায় আপনের সাথে।”
“সত্যি কইতাছোস!”
“হুমমম। তাইলে কি কালকে ডাকুম ওরে?”
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন।
রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই যখন উপস্থিত তখনই কথা তুললো সালিম-“ভাইজান, এইবার সবাই একটু নির্বাচনে মন দেই। বাড়ির মেয়েরা যারা আছো সবাই সকাল থিকা প্রচারনায় যাইয়েন।”
মোর্শেদ বললো-“সবাই তো শুনতেছি সতন্ত্ররে সাপোর্ট করতেছে।”
“করুক। আমরা এইবার চেষ্টা করবো মন থিকা, কোন অবহেলা করা যাইব না। আমার জিততেই হইবো নাইলে টিকতে পারুম না। হাত থিকা কাজ সব চইলা যাইতেছে একে একে। ওইদিন মোহন কইলো, চান্দা দিতে চায় না কেউ। এইদিকে ট্যাবলেটের বিক্রি কম। পুলিশের ব্যাপক ধরপাকর চলতাছে। সরকারি একটা কাজও পাই নাই গত একবছরে। কেমনে চলুন বুঝতাছেন?”
শরীফ চুপচাপ খাচ্ছিলো। সালিম সাহেব ওকে ধরলো-“তুই আর তন্ময় আমার সাথে থাকবি শরীফ। ভাইজানতো থাকবোই। নিজের মানুষ থাকলে ভরসা হয়। সোহেল থাকলে অবশ্য তোদের কাউকেই লাগতো না।”
মানা করতে চাইলেও পারলোনা শরীফ। সোহেলের কথা ভেবেই পারলোনা। বলতে পারলোনা, এইসব পাপের সম্রাজ্যে সে সামিল হতে চায় না।
*****
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে নিজের রুমে ফিরলো রণ। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এখানেই থাকছে সে। কাজ থাকলে ঢাকায় যায়, কাজ সেরে ফিরে আসে। মাঝে মাঝে মায়ের খোঁজও নেয় নিয়ম করে তবে ফিরে আসে এখানেই। বলা যায় এক প্রকার মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে থাকা।ক্লান্ত শরীরে কাপড় নিয়ে শাওয়ারে ঢুকলো রণ। বেরিয়ে এসে কাপড় পড়ে রান্নাঘরে এসে কড়া করে এককাপ কফি বানালো। পেটে খিদে থাকলেও খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না কোন। তীব্র মাথা ব্যাথায় কাতর হয়ে আছে দুপুর থেকে। কফি নিয়ে ঘরেই ফিরে এলো। কফি খেতে খেতে কি মনে করে মোবাইলের গ্যালারিতে ঢুকলো। আমেরিকায় কিছু ছবি তুলেছিল শুভ্রার। সেগুলো বের করে দেখতে লাগলো। মনটা উচাটন হলো খুব। এতো কাছাকাছি থেকে নিজের বউকে না দেখতে পারার বেদনায় হৃদয় তোলপাড় হচ্ছে। খুব মন চায় মেয়েটাকে কাছে ডাকতে। কিন্তু এবার সবকিছুর একটা হেনস্তা করতেই হবে। এভাবে আর ভালো লাগছে না। কিন্তু সমাপ্তিটা কেমন হবে সেটাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। তাতে কি শুভ্রার সাথে তার যোগাযোগ চিরদিনের মধ্যে বন্ধ হবে? মনে দ্বিধা। সে কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে শুভ্রা কি আদৌও তাকে বুঝবে? অসহ্য হয়ে ফোনটা বন্ধ করে রণ। মাথাটা টনটন করে উঠলো। না পেরে চোখ বুঁজে হেলান দিলো।
“আমাকে না দেখতে পেলে আপনার কষ্ট হয় জানতাম। তাহলে কি করে মাস পার করে ফেললেন মন্ত্রী মশায়?”
রণ চমকে উঠে বসলো। ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই সামনে শুভ্রাকে দেখতে পেলো। শান্ত হয়ে নিয়ে রণর দিকে তাকিয়ে আছে সে। রন দেখলো কয়েকদিনে বেশ শুকিয়ে গেছে শুভ্রা। তাতে অবশ্য ওর সৌন্দর্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। রণ বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে জানতে চাইলো-“তুমি! এখানে?”
শুভ্রা তাচ্ছিল্যভরে হাসলো-“কেন? এখানে আসতে নেই? এখন কাগজে কলমে আপনার বউ আমি। আসতে পারি তো, তাই না?”
রণ কি বলবে ভেবে পেলো না কেবল মাথা দুলালো। সে তৃষিতের মতো শুভ্রাকে দেখতে লাগলো। শুভ্রার দৃষ্টি স্থির-“আমাকে ছাড়া বেশ ভালোই আছেন দেখা যায়। চন্দ্রের সাথে ভালো সময় কাটছে তাহলে?”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো-“এসব বলতে এসেছ?”
শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“নাহ, আপনার জন্মদিনে উইশ করতে এসেছি। উইশ করা হলে চলে যাব।”
এতোক্ষণে রণর ঠোঁটের হাসির আভাস দেখা দিলো-“তো করছো না কেন?”
শুভ্রা ভ্যাবচ্যাকা খায়। রণকে এতোটা শান্ত দেখে নিজেকে অনাহুত মনেহয়। অতি আবেগি হয়ে খামোখাই চলে আসার জন্য আফসোস হয়। সে কঠিন কন্ঠে বললো-“শুভ জন্মদিন মন্ত্রী মশায়।”
রণ হাসলো-“ধন্যবাদ।”
“আমি আসছি তাহলে।”
শুভ্রা উঠে দাঁড়াতেই রণ এগিয়ে এলো দ্রুত পায়ে-“সেকি! কেক না কেটেই চলে যাবে? তাছাড়া শুধু উইশ করলে হবে? গিফট দিতে হবে না?”
শুভ্রা দু’পা পিছিয়ে যান। রণকে আসতে দেখে ওর বুক কাঁপে। তুললিয়ে বললো-“কি কি কিসের গিফট? খবরদার এগুবেন না আমার দিকে। এতোগুলো দিন একবারের জন্যও খবর না নিয়ে এখন কোন অভিনয় করবেন না।”
রণ ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে শুভ্রার কোমড় জড়িয়ে ধরে-“একশোবার ধরবো হাজারবার ধরবো। তুমিই তো বললে তুমি এখনো আমার বউ। তোমার উপর অধিকার আছে আমার।”
“কিসের অধিকার? অধিকার বুঝলে এভাবে আমায় ছাড়া ভালো থাকতে পারতেন না।”
শুভ্রা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে মোচড়ামুচড়ি করলে রণ আরও শক্ত করে এটে ধরে তাকে। শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ওর চিবুক ধরে চোখে চোখ রাখে-“নিজের শক্তির অপচয় করো না। আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবেনা নিজেকে। তাছাড়া আমি ভালো আছি কে বললো তোমাকে? সবসময় বেশি বোঝ। আমি সব ঠিক করার চেষ্টা করছি এইজন্য চুপচাপ আছি।”
শুভ্রা চুপ করে গেলো। দু’জনই একে অপরকে দেখছে। শুভ্রার চোখ ছলছল, দাঁতে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করছে। রণর সামনে কিছুতেই দূর্বল হবে না সে। রণ হুট করে শুভ্রার কপালে চুমু দেয়। ওর মাথাটা বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়-“আর কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরবে? সব ঠিক করে দেব আমি। বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”
শুভ্রা কাঁদছিল, রণর কথা শুনে ফুঁসে উঠলো-“বিশ্বাস! আপনি রেখেছেন আমার উপর? সেই তো আন্টি যা বলেছে তাই তো বিশ্বাস করেছেন। আর আপনি বলছেন বিশ্বাসের কথা?”
“হ্যা বলছি। কাকে বিশ্বাস করেছি কাকে নয় সেসব এখন ব্যখ্যা করে বলবো না শুভ্রা শুধু বলবো একটু ধৈর্য্য ধরো। কিছুদিন পর সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
শুভ্রা এবার জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো-“কিভাবে ধৈর্য্য ধরবো বলুন তো? যেখানে আপনি আপনার জন্মদিনে আমাকে এতোবড় উপহার দিলেন?”
“কিসের উপহার দিলাম?”
রণ অবাক হতেই শুভ্রার চোখের সামনে কাগজ মেলে দিলো-“ভাবিনি, আপনার এতো তাড়া আছে। আমি আসায় ছিলাম আপনি ফোন করবেন আমাকে। না হলে নিতে আসবেন। কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমান করে এটা পাঠিয়েছেন। ভালো করেছেন। আসলে ভুল তো আমারই। আপনাকে জোর করে বিয়ে করেছিলাম কিনা।”
“আমি এটা করিনি মানে আমি তুমি ভুল…। আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম শুভ্রা। তুমিই মোবাইল ফেলে গেছ। আমি কিভাবে…”
রণর কথা শেষ করতে দেয় না শুভ্রা-“আমাদের সম্পর্ক তো শুরু থেকেই শেষের মতো। এটাই ভালো। রোজ রোজকার ঝামেলা থেকে এমনটাই ভালো হবে। শত্রুর সাথে সংসার হয় না আসলে। আমিই বুঝিনি। যাক, ভুল শুধরে নিচ্ছি। আমি সাইন করে দিয়েছি। আপনার জন্মদিনের গিফটের কথা বলছিলেন না। দিয়ে দিলাম সবচেয়ে দামী গিফট। ভালো থাকবেন মন্ত্রী মশায়।”
★প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ। তবুও বই সংগ্রহ চলবে। আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin