দর্পহরন #পর্ব-৬১

0
265

#দর্পহরন
#পর্ব-৬১

“আমি এমন কিছু করিনি শুভ্রা। প্লিজ ভুল বুঝো না। আমাকে সময় দাও একটু। শুভ্রা চলে যেয় না।”
রণ ভীষণ চিৎকার করে উঠে বসলো। ঘেমে নেয়ে উঠেছে সে। বুকটা ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কয়েকবার ঢোক গিললো রণ। পানির তৃষ্ণায় মরমর অবস্থা। নিশ্বাস বন্ধ হবো হবো করছে। অনেক কষ্টে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিলো সে। ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক বোতল পানি পান করলো। তারপর চুপচাপ বসে থাকলো। এখনো মাথাটা ঠিকঠাক কাজ করছে না তার। অতি জঘন্য স্বপ্নটা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কি মনে হতে ঘড়িটা দেখলো একবার। সাড়ে এগারো বাজছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো গায়ে বাইরের কাপড়। গা চিটচিট করছে।
মাথা থেকে চিন্তা দূর করতেই শাওয়ার নিতে উঠে দাঁড়ায় রণ। মনটা চরম বিষন্ন হয়ে আছে। আজ মায়ের সাথে ভীষণ রকম কথা কাটাকাটি হয়েছে। সেটা ভেবে মনটা আরও সংকুচিত হলো রণর। একদিকে শুভ্রা আরেকদিকে মা। কোনদিকে যাবে সেটাই বুঝতে পারছে না। যে জটিলতা ভয় পেত সেটাই এখন সকাল বিকেল মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অসহ্য লাগছে জীবন। শরীর বেয়ে নেমে যাওয়া জল যদি সব সমস্যাগুলো শুষে নিতো তাহলে কতইনা ভালো হতো।

শাওয়ার নিতে নিতে টের পেলো ফোনটা বাজছে।
কোনরকমে গা মুছে ট্রাউজার পরে বেড়িয়ে আসতেই থমকে গেলো সে। বিছানার উপর শুভ্রা বসে আছে। রণর মনে হলো তার হ্যালুশিনেশন হচ্ছে। বারবার চোখ ডলে নিলো। পুনরায় তাকিয়ে দেখলো শুভ্রাকে। হ্যা শুভ্রাই। কেমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রণকে হতবিহ্বল দেখায়-“তুমি! সত্যিই তুমি এসেছ!”

উদোম গায়ের রণকে দেখে শুভ্রার ঘোর লাগে। চোখের কঠিন দৃষ্টি কোমল হতে শুরু করে। তার দু চোখ থেকে মুগ্ধতা সরাতে পারে না। মানুষটাকে সেই প্রথম থেকেই ভালো লাগতো শুভ্রার? বিয়েটা কি শুধুই জেদ ছিলো নাকি মনের কোনে কোথাও ভালোলাগাটুকুও ছিলো? আজও বুঝে উঠতে পারে না শুভ্রা। তবে যতটা রাগ রণর উপর হওয়ার কথা ছিলে ততটা রাগ সে কখনোই হতে পারেনি। কেন যেন রণকে দেখলে রাগটা আসে না ঠিকঠাক। আজও অভিমান দেখাতে পারলোনা। রণর দেহসৌষ্ঠব শুভ্রাকে মোহাবিষ্টের টানলো। সে আপনাতেই রণর কাছে এসে দাঁড়ালো। ফোঁটা ফোঁটা জল তখনও রণর গা জুড়ে। তাকিয়ে থাকলে একটা শীতল অনুভূতি ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর জুড়ে। শুভ্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো-“আমাকে ছাড়া দিব্যি ভালো আছেন দেখছি। না আমার খবর নিয়েছেন না নিজের খবর দিয়েছেন। তাহলে যা রটেছে তা সত্যি?”
রণ শুভ্রাকে দেখছে একদৃষ্টিতে। মেয়েটাকে কিছুটা এলোমেলো লাগে। স্বাস্থ্য কমেছে, চেহারায় বিষাদ ছেঁয়ে আছে। পরনে সবুজ রঙা তাঁতের শাড়ী চোখে প্রশান্তি দেয়। হুট করে দুঃস্বপ্নটা মনের কোনো উঁকি দিয়ে গেলো। একদম স্বপ্নের মতোই ঘটছে না সবকিছু? যেন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে রণ। বুকের মধ্যে জেঁকে বসা ভয়ের অনুভূতি ফিরে আসছে। তাকে হতবিহ্বল দেখলো। সে হুট করে শুভ্রার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টানলো-“ফোনটা ফেলে গেলে কি করে ফোন দেব শুভ্রা? তবুও তো টিভিতে আমার খবর পাচ্ছ তুমি। আমার কি অবস্থা বোঝ? এতদিনে একবার তোমার দেখা পাইনি।”
শুভ্রার চোখের ঘোর বাড়ে। তবুও শ্লেষের সাথে বললো-“আমাকে দেখার ইচ্ছে হয় আপনার?”
শুভ্রার কথায় কষ্ট পেলেও তা প্রকাশ করলোনা রণ-“খুব হয়। যদি অন্য কাউকে দেখে চোখ জুড়াতে পারতাম তাহলে খুশি হতাম মেয়ে। মনের মধ্যে অহর্নিশ যে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে তা থেকে রেহাই পেতাম। তোমার অভিশাপ এবার কাজে লেগেই গেলো শুভ্রা। তুমি অভিশাপ দিয়েছিলে আমি যেন কষ্ট পাই। এখন নিশ্চয়ই তুমি খুশি?”
রণর কথাগুলো শুনতে শুনতে হৃদয় তোলপাড় হয় শুভ্রার। সে বলেই ফেলে-“মোটেও এরকম কিছু আমি দোয়া করিনি৷ আর আমার খুশির কথা আসছে কেন? আপনার থেকে দূরে যেয়ে থাকায় যদি আমার খুশি হতো তাহলে আমি আপনার সাথে জুড়ে থাকতে চাইতাম না। আফসোস আমাকে বুঝতে পারেননি আপনি।”
রণ শুভ্রার কপালে চুমু দিলো-“তুমিও তো আমাকে বুঝতে চাইছো না শুভ্রা। বারবার দোষী বানিয়ে দিচ্ছ আমাকে। বিশ্বাস করো আমি দোষী না আর না হতে চাই।”
শুভ্রা হুট করে রণকে জড়িয়ে ধরে। ওর বুকে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদে-“আর কতদিন এমন চলবে? আমার ভালো লাগছে না কিছু। একটু শান্তিতে থাকতে পারবো কবে বলতে পারেন? আমি মনেহয় পাগল হয়ে যাবো।”
রণর কষ্ট লাগে। নিজেকে অক্ষম মনেহয়। শুভ্রা ফিসফিস করলো-“সারাদিন সবাই আপনাকে উইশ করলো সেই ভিডিও দেখলাম। অথচ আপনার এবারের জন্মদিনের প্রথম উইশটা আমার হওয়ার কথা ছিলো। সেই আমি কিনা উইশ করতে পারলাম না। আপনার বউ হওয়ার পরেও রাতের আঁধারে চুপিচুপি আপনার কাছে আসতে হলো। এই অপমান মানতে কষ্ট হচ্ছে রণ।”
রণ পরপর কয়েকটা চুমু দেয় শুভ্রার গালে। আর্দ্র গলায় বললো-“আর কয়েকটা দিন শুভ্রা। আমি তোমাকে স্বসন্মানে বাড়িতে তুলবো।”
“কিন্তু আন্টি কখনো রাজি হবে না।”
“মাকে মানাবো আমি। এ দায়িত্ব আমার। তুমি ভেবো না।”
“সত্যি বলছেন?”
অধীনে আগ্রহে জানতে চাইলো শুভ্রা। রণ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে-“হ্যা। দেখে নিয় তুমি।”

*****

এলাকার নির্বাচনী প্রচারনা বেশ জমজমাট। দুই পক্ষ বেশ জোর দিয়ে প্রচারনা করছে। সালিম সাহেব বড়সড় শো ডাইন করলো। এলাকার ছোট মাঝারি সমস্যা সমাধান করছে নিমিষেই। নির্বাচনের বদৌলতেই অনেকদিনের পুরনো ভাগার পরিস্কার হয়ে গেলো। পুরনো ব্রিজটা সারানো হলো। এলাকায় কয়েকটা গভীর কুপ হয়ে গেলো। তবুও যেন নিজের জন্য যতটা জোরালো আওয়াজ চাইছেন ততটা পাচ্ছেন না।

অপরদিকে সুমনার প্রচারনা কিছুটা ভিন্ন। যেহেতু এটা শিল্পাঞ্চল, গার্মেন্টস এলাকা। সে বুদ্ধি করে প্রতিটা গার্মেন্টসে যাচ্ছে মেয়ে কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কিনা দেখতে। যেখানে নেই সেখানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে নিজে উদ্যোগ নিচ্ছে। স্কুল কলেজগুলোতে একই কাজ করলো। কিশোর, তরুণ ও যুবকদের প্রোডাক্টিভ বানাতে এলাকায় পাঠাগার ও সংগঠন করার ঘোষণা দিলো। বলাই বাহুল্য, সুমনার উদ্যোগগুলো বেশ প্রসংশা পেলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে দু’জনার জনপ্রিয়তা দেখে বোঝার উপায় নাই কে জিতবে।

এমন অবস্থায় খুব সংবেদনশীল একটা ঘটনা ঘটে গেলো। একদিন সকালে সত্যি সত্যি ডিভোর্স লেটার এলো ইব্রাহিম নিবাসে। পুরো বাড়ি জুড়ে শোকের পরিবেশ সৃষ্টি হলো। শুভ্রা যেন দারুণ শক পেলো। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। বারবার নেড়েচেড়ে কাগজ দেখতে লাগলো। বলা হয়েছে পুরো কাগজটা যেন শুভ্রা ভালোমতো পড়ে দেখে। কোন শর্তে যদি রাজি না হয় তাহলে জানালে সেই বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। আর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে যেন সাইন করে পাঠিয়ে দেয়।

শুভ্রা অবিশ্বাস নিয়ে কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে রাতে রণ তাকে আশ্বাস দিয়েছিল সব ঠিক করে ফেলবে। এই কি ঠিক করা! শুভ্রা হু হু করে কেঁদে দিলো। দুইদিন সব নাওয়া খাওয়া বন্ধ তার। বুকের ভেতর উথাল পাথাল দুঃখ। নিজেকেই শেষ করে দিতে মন চাইছে। মেয়ের না খেয়ে থাকার কথা শুনে সালিম সাহেব এলো মেয়ের ঘরে-“আম্মাজান, আপনি নাকি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিছেন?”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। সালিম সাহেব ধৈর্য্য ধরে প্রশ্ন করলো-“আম্মাজান, এমনে থাকলে কি সমস্যা সমাধান হইবো? কথা কন। কি চান আপনে?”
“আমি ওনাকে চাই। ওনারে ছাড়া বাঁচবো না আব্বা। বলেন পারবেন ওনাকে আনতে?”
সালিম সাহেব হতবাক। মেয়ে এতোটা নির্লজ্জ হবে ভাবেননি। শুভ্রা এতটুকুতে ক্ষান্ত হলো না। সে বললো-“আপনাকে কতবার তন্ময় ভাইয়ের কথা বলছি আব্বা। আপনি কি ইচ্ছা করেই আমার কথা কানে নেয় নাই? মেয়ের সংসার হোক তা আপনে চান না আব্বা? কেন নিজ হাতে আমার সংসারটা নষ্ট করলেন?”
“আম্মা, এইসব কি বলতেছেন আপনে? ওরা শত্রু জানার পরও আমি মেনে নিছি। আপনে যেমনে চাইছেন তেমনে সব করছি তাও এই কথা বললেন? আর কেমন স্বামীর জন্য পাগল হইছেন আপনে? যে বেটা বউকে এতোদিন ধরে বাপের বাড়ি ফালায় রাখছে। একদিন দেখতে পর্যন্ত আসে নাই। মায়ের কথায় বউকে ছাড়তে পারে তার জন্য এমন করতেছেন? এইদিন দেখার জন্য আপনাকে এতো ভালোবাসছি?”
শুভ্রার চোখ লাল, মুখটা ক্রোধান্বিত। বাবার কথার প্রতিউত্তর দিতে পারলোনা। সালিম সাহেব বললেন-“ডিভোর্স লেটার পাঠাইছে আর আপনে এখনও ওই বাড়ি যাওয়ার আসা রাখেন? মাথায় কি ঢুকছে আপনের? এইবার তো আমি কিছুতেই আপনারে ওইখানে পাঠাবো না আম্মা। আমার সন্মান এতো ঠুনকো না। আপনে ডিভোর্স দিবেন ওই গোলামের পুতরে। মেলা সহ্য করছি আর না।”
শুভ্রা ভয় পেয়ে চমকে উঠলো। বাবার এমন মেজাজি রুপ অনেক দিন পরে দেখলো কিনা। কিছু বলার সাহস করতে পারে না। সে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে। এমন কিছু হোক সে কোনদিন চায়নি কিছুতেই চায়নি।

★প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ। তবুও বই সংগ্রহ চলবে। আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here