উনত্রিশ_ফেব্রুয়ারি #পর্বঃ ০১

0
608

#উনত্রিশ_ফেব্রুয়ারি
#পর্বঃ ০১
– আপনি কেন রান্না করেন? আপনার না বাসায় বউ আছে? সে রান্না করে না বুঝি?
– ম্যাম , আমার স্ত্রী অসুস্থ।
– ওহ্৷ ডাক্তারের কাছে নিচ্ছেন না?
– হ্যাঁ চিকিৎসা চলছে , কিন্তু ওর যে সমস্যা তাতে ওকে বাঁচানো সম্ভব না। ডাক্তাররা মানসিক প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।

সাইমুনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তৃপ্তি। বাবার অবর্তমানে মায়ের কাছেই সম্পুর্ণ অফিসের দায়িত্ব। চলমান প্রজেক্টের বিষয় জরুরি আলোচনা করার জন্য সাইমুনকে ডেকেছিল। আংশিক ত্রুটির কারণে খানিকটা বকাঝকা করারও নিয়্যাত ছিল। কিন্তু সাইমুনের মুখে তার ব্যক্তিগত জীবনের এমন ঘটনা শুনে তৃপ্তি নিজেও খানিকটা মনমরা হয়ে গেল।
বলল ,
– এরকম পরিস্থিতিতে আপনার ছুটি নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে আপনি দিব্যি অফিস করে যাচ্ছেন। নাকি স্ত্রী আর বাঁচবে না শুনে তার প্রতি সকল ভালোবাসা কমে গেছে!
– সেরকম কিছু নয়। অফিসের একটা বড় প্রজেক্ট আমার হাতে রয়েছে। এমতাবস্থায় আমি দায়িত্বটা কারো উপর দিতে পারছি না। কাজটাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাই আমার জন্য কোম্পানির কোনো ক্ষতি হোক সেটা চাই না।

তৃপ্তি নোটবুকটা এগিয়ে দিয়ে বললো ,
– আপনার বাসার সম্পুর্ণ ঠিকানা এখানে লিখে রাখুন।
– কেন ম্যাম?
– আপনি তো আগামীকাল সম্ভবত চট্টগ্রামে যাচ্ছেন। যেহেতু দায়িত্বে অবহেলা করবেন না সেহেতু ধরেই নিচ্ছি আপনি যাচ্ছেন। আপনার অবর্তমানে যেন আপনার বাসার খোঁজ খবর নিতে পারি সেজন্যই ঠিকানা চাচ্ছি।
– ওকে।

নোটবুকে ঠিকানা লিখে দিয়ে সাইমুম রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তৃপ্তি সেই হাতে লেখা ঠিকানার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
মনে মনে ভাবলো “ তার বাবা এই ছেলেটার সাথে তাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাবা কি আগে থেকে জানতেন ছেলেটা এতো যত্নশীল হবে। ”

————-
নুড়ির খুব ইচ্ছে আজ সাইমুম তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিবে। প্রতিদিন সাইমুন রান্না করে ঠিকই কিন্তু খাই নুড়ি নিজে। নুড়ির এই এতটা শারীরিক অসুস্থতার কথা তাদের কারো পরিবারই জানে না। ডাক্তারের কাছে সবকিছু জানার পড়ে নুড়ি হাত ধরে সাইমুনকে বলেছিল ,

– প্রতিদিন কতো মানুষ তো পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। আমিও নাহয় চলে যাবো। কিন্তু আগে থেকেই মা-বাবার কাছে খবরটা গেলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে যাবে। বেঁচে থাকতে আমার মৃত্যুর জন্য বাবা মায়ের এই করুণ পরিণতি দেখতে পারবো না। প্লিজ তুমি কাউকে কিছু বলো না।

সুতরাং রাজধানীর কোটি কোটি মানুষের মাঝে শুধু তারা দুজন দু’জনকে আগলে রেখে দিনগুলো পার করে দিচ্ছে। কাউকে আর জানানো হলো না। কেউ আর আসলো না।
খেতে খেতে সাইমুন বললো ,
– তিনদিনের মধ্যে কাজটা শেষ হয়ে যাবে। তোমার কোনো চিন্তা নেই। নিহা তো আছে।

নিহা নুড়ির ছোটবোন। আজ বিকেলেই সে গ্রাম থেকে এসেছে। সাইমুন ঢাকার বাইরে যাচ্ছে তাই বলে শশুরকে ম্যানেজ করে নুড়ির ছোটবোনকে নিয়ে এসেছে।

সাইমুনের কথা শুনে নুড়ি বললো ,
– ক’দিন পড়ে যার মৃত্যু নিশ্চিত। সেই মানুষটা কি নিয়ে চিন্তা করবে বলো তো। আমার কি হারানোর মতো কিছু আছে? হ্যাঁ আছে , তুমি।

সাইমুন অবাক হয়ে বললো ,
– মানে?
– আমার জীবন তো শেষ সাইমুন। কিন্তু তবুও আমি দিনরাত তোমাকে নিয়ে চিন্তা করি। আমি মারা গেলে তুমি কীভাবে থাকবে? তোমার কষ্ট হবে তাই না?
– প্লিজ এসব কথা বন্ধ করো।
– এমন করছো কেন? আমি চলে গেলে তুমি আমার জন্য কি করবে সেটা শুনতে মন চায় না বুঝি?

সাইমুন কিছু বললো না। মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে গেল। নুড়ি বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো ,
– যদি কখনো বিয়ে করো তাহলে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাবো। এতবড় পৃথিবীতে তোমাকে একা রেখে চলে যাবো সেটা কিছুতেই মানতে পারি না। কিন্তু দেখো , চাইলেই আমি থাকতে পারবো না।
– একটা কাজ করবো নুড়ি?
– কি কাজ?
– দুজন নাহয় একসঙ্গে চলে যাবো। তুমিহীন একা থাকতে হবে এটা এক মুহূর্তের জন্যও মাথায় নিতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে যায় , ফাঁকা লাগে।
– ধুর পাগল , উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। আমার হয়ে থেকো , অনেকদিন বেঁচো। আমার লাশটা তুমি কাঁধে নিয়ে কবরের কাছে যেও।

সাইমুন আর সহ্য করতে পারলো না। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে চলে গেল। গ্রামের বাড়ি থেকে নিহা আসার কারণে ওরা বেডরুমে বিছানায় বসে খাচ্ছিল৷ নুড়ি জানে সাইমুন এখন বাথরুমে গিয়ে কান্না করবে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে তারপর বেশি করে পানি দিবে।

নুড়ির চোখেও কান্নার সমুদ্র। কতো ভাগ্য করে সাইমুনের মতো একটা মানুষ পেয়েছিল। কিন্তু সে চলে যাবে বহুদূর। সকলের মায়া-মমতা উপেক্ষা করে সে চলে যাবে। সঙ্গী হয়ে আর একসঙ্গে থাকা হবে না তাদের।
বাস্তবতা হচ্ছে ,
মৃত্যুর হাত থেকে কখনো পালানো যায় না।

————–
সাইমুন সকালেই চলে গেছে। তবে যাবার সময় একটু পর পর সে কল করে আপডেট করেছে। সাইমুন জানে নুড়ি বেশি মানসিক চাপ নিতে পারে না। নুড়ির ক্যান্সারটা ব্রেইনের মধ্যে। তাই বেশি চিন্তা ভাবনা করলেই মাথায় ভুমিকম্প শুরু হয়।
রাত আনুমানিক দশটা।
সন্ধ্যা থেকে নুড়ির প্রচন্ড মাথা ব্যথা হচ্ছে। সাইমুন রাত আটটার দিকে কল দিয়ে বলেছিল জরুরি কাজে ব্যস্ত সে , ফ্রী হয়ে কল দিবে। নুড়ির জীবনে সাইমুনের সঙ্গে এটাই ছিল শেষ কথা।

ব্রেইনের মধ্যে যখন বেশি যন্ত্রণা করে তখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে নুড়ি। আজও মোবাইলটা সাইলেন্ট করে শুয়ে ছিল। কিন্তু তার মোবাইলে যে একটার পর একটা কল আসছে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। কল দিচ্ছিল সাইমুন। কিন্তু নুড়ি সেটা জানতে পারলো না।

আরো মিনিট পাঁচেক এমনিতেই গেল। তারপর তাদের কলিংবেল বাজার শব্দ হলো। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় কণ্ঠে বললো৷
– এতো রাতে আবার কে এলো?

কিন্তু মিনিট পার হতেই একটা সুন্দরী মেয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করবে। নুড়ি খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। মানুষ এমন সুন্দরী হয়?
তৃপ্তি বললো৷
– আমি সাইমুন সাহেবের অফিসের বস। আপনার অসুস্থতার কথা আমি শুনেছি। তাই নিজ থেকে ছুটে এলাম।
– এভাবে হুট করে , একটু আগে জানাবেন না? তাহলে একটু কিছু ব্যবস্থা করতাম।
– আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি আপনার কাছে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি। শান্ত কণ্ঠে বললো তৃপ্তি।
– কি প্রশ্ন?
– যে মানুষ কদিন পড়ে চলে যাবে। সে যদি কিছু দিন আগে চলে যায় তাহলে কি কোনো ক্ষতি আছে?

নুড়ি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তৃপ্তির এমন কথা যেন বুঝতে পারছে না। ঠিক সেই সময় রুমের দরজার সামনে নিহা এসে দাঁড়ালো।
নিহা বললো৷
– আপা আমার ফোনটা কি তুমি নিয়েছ? বাসার মধ্যে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
– আমি কেন নেবো? কোথায় রেখেছিস তুই?

নিহা তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে রইল।

নুড়ি কল রিসিভ করছে না তাই সাইমুন নিহার কাছে কল দিচ্ছিল। কিন্তু নিহা যখন কল রিসিভ করে তখনই কলিং বেল বেজে ওঠে। কথা বোঝা যাচ্ছিল না তাই নেটওয়ার্ক সমস্যা মনে করে কল কেটে দেয়।
কলব্যাক করার আগে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তৃপ্তি বাসায় প্রবেশ করে নিজের পরিচয় দেবার পড় নিহা তাকে নুড়ির রুমে নিয়ে যায়। তারপর নিজের রুমে এসে আর মোবাইল খুঁজে পাচ্ছে না।

————
নুড়ির ফোন রিসিভ হচ্ছে না আর নিহার নাম্বার বন্ধ দেখে সাইমুন খানিকটা ঘাবড়ে গেল। কি করবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেও আরো দশ মিনিট গেল। তারপর বাড়ির দারোয়ানের নাম্বারে কল দিল। দারোয়ান কল রিসিভ করে৷

– হ্যালো।
– কাকা আমি সাইমুন , পাঁচ তলার ভাড়াটিয়া।
– চিনতে পারছি বাবা৷ আগেরবার তো তুমিই নিজ হাতে নাম্বার সেভ করে দিছিলা।
– কাকা সকালে তো আপনাকে বলেছিলাম আমি চট্টগ্রামে যাচ্ছি। এখন সেখানেই আছি, কিন্তু নুড়ি কল রিসিভ করছে না।
– আপনার বাসায় তো গেস্ট আসছে৷ মনে হয় সেই গেস্ট নিয়ে তারা ব্যস্ত।
– বলেন কি, কিসের গেস্ট?
– একটা মেয়ে! আপনি যে অফিসে চাকরি করেন সেই অফিসের নাকি বস। গাড়ি নিয়ে আসছে, ড্রাইভার গাড়িসহ বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
– আমার অফিসের বস?
– হ্যাঁ।

সাইমুনের মনে পড়ে গেল তৃপ্তি তার কাছ থেকে ঠিকানা রেখেছিল।
বললো,,
– ঠিক আছে , আপনি একটু উপরে গিয়ে নুড়িকে বলেন আমি কল দিচ্ছি।
– ঠিক আছে।

সাইমুন কল কেটে দিল। দারোয়ান মোবাইল পকেটে রেখে মাথা ঘোরাতেই দেখলো তৃপ্তি লিফট থেকে বের হয়ে আসছে। গেইট খুলে দিয়ে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো,
– সাইমুন বাবাজী কল দিছিল। বাসায় নাকি কথা বলতে পারতেছে না। আপনার সঙ্গে কি দেখা হয়েছে?
– হ্যাঁ দেখা হলো তো। ওনারা তো উপরেই আছে।

তৃপ্তি বেরিয়ে গেল। রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা গাড়িতে গিয়ে বসতেই সেটা হর্ন বাজিয়ে মুহুর্তের মধ্যে এলাকা ত্যাগ করলো। বৃদ্ধ দারোয়ান পকেটে হাত দিয়ে ৫০০ টাকার চকচকে নোটটা অনুভব করে খানিকটা শান্তি পেল।

কিছুক্ষণ পরে আবারও সাইমুন কল করাতে সে কলটা রিসিভ করলো৷ সাইমুন তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে তাড়াতাড়ি মোবাইল রেখে পাঁচ তলায় চলে গেল। সাইমুনের ফ্ল্যাটে কয়েকবার কলিং বেল বাজালো , তখন আবারও সাইমুনের কল।
দারোয়ান বললো ,
– বেল দিচ্ছি , কেউ তো খুলছে না।
– কি বলেন , দরজা ধাক্কা দেন তো।

বাম হাতে মোবাইল রেখে ডান হাত দিয়ে দরজার হাতল ধরে হালকা ধাক্কা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল , দরজা আগে থেকেই খোলা ছিল।
সাইমুনকে সে কথা জানাতেই সে বললো তাড়াতাড়ি যেন রুমের ভিতরে গিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি-না সেটা চেক করে।
দারোয়ান তাই করলো৷ প্রথমেই ডানদিকে যে রুমে গেল সেখানে নিহা ছিল। দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো বিছানায় শুয়ে আছে নিহা। তার গলাটা ক্ষত-বিক্ষত। গলা দিয়ে জবজব করে রক্ত বের হয়ে বিছানা ভেসে গেছে।

সাইমুনকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ,
– লা-লাশ। রক্ত।

সাইমুন বেশ চিৎকার করে বললো৷
– কিসের লাশ? কার কথা বলছেন? আমার নুড়ি ঠিক আছে তো কাকা?

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসে না। কলটা কেটে যায়৷ সাইমুন পাগলের মতো হয়ে বাড়িওয়ালার নাম্বারে কল করে৷ বাড়িওয়ালা তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাটে আসে। তিনি প্রথমে নুড়ির রুমে যান। বাথরুমের সামনে ফ্লোরে রক্তাক্ত নুড়ির মৃতদেহটা দেখতে পান তারা। সঙ্গে সঙ্গে কল করেন পুলিশ স্টেশনে।
তবে দারোয়ান কোথাও নেই৷ সে পলাতক।

ঘন্টা খানিক পরে পুলিশ এসে বাসা থেকে দুটো মেয়ের লাশ উদ্ধার করে। পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে সাদা চাদর জড়ানো একটা লোক আসে। চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কতকিছুই যেন খুঁজে বেড়ান। তারপর আস্তে ধিরে বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে বললেন ,

– আমি রিহানুল ইসলাম সাজু। সবাই সাজু বলেই ডাকে। ফ্ল্যাটে সবার আগে কে প্রবেশ করে লাশ দেখতে পান?

বাড়িওয়ালা ও তার স্ত্রী দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাজু ভাই কিছু না বলে তাদের কাছ থেকেই উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
.
.
চলবে…

গল্প:- #উনত্রিশ_ফেব্রুয়ারি
পর্ব:- ০১ (এক)

অনেক অনেক দিন পড়ে সাজু ভাই সিরিজের গল্প। আশা করি সবাই মন্তব্য করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবেন।
যেহেতু রিচ অনেক কম তাই আপনাদের প্রতিটি পাঠক পাঠিকার মন্তব্য অনেক জরুরি।

লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here