প্রেমানুভূতি #পর্বসংখ্যা_০১ লেখবীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত

0
1416

বয়স আঠারো না পেরাতোই হুট করে এভাবে বিয়ে হয়ে যাবে তা ভাবেনি মহুয়া। নিজের বাবাকে ভীষণ ভয় পায় সে। পেছনে যতই সাহস-দম্ভ দেখাক না কেন, বাবার সামনে আসলেই সব ফুঁস। তেমনি তার বাবা যখন হুট করে তার বিয়ে ঠিক করে ফেললে মহুয়া দ্বিমত করার সুযোগ পায় নি। অনেকটা অনিচ্ছা সত্বেও বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। খুব ছোট বেলায় মা মারা গিয়েছিল তার। তারপর থেকেই তার বাবার এমন কঠিন মানুষ হয়ে গিয়েছে। কারো কথার গুরুত্ব দিতো না।

বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতেই খাওয়ার ধুম পড়ে গেলো। আজ এমন অনেক আত্নীয়-স্বজনদের সাথে দেখা হয়েছে যাদের মহুয়া তাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় কখনো দেখেনি। দেখবেই বা কি করে, বাবা তাকে যেরকম শাসনে রাখে তাতে আশপাশ দেখার সুযোগ আছে নাকি! স্কুলে পড়াকালীন সময়ে যখন স্কুল থেকে ট্যুরে নিয়ে যেতো ফারিহা তখন বাসায় বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতো। ছোটবেলা থেকেই তাকে একটা কথাই মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তা হলো – ‘পড়াশুনা ছাড়া জীবনের কোন গতি নেই।’
নিজের বাবার বলা এই গুরুগম্ভীর লাইনকেই সে পুরোপুরি মেনে চলতো। যার ফলে বাহিরের জগৎ সম্পর্কে তার তেমন একটা জ্ঞান নেই। যা আছে তা শুধু বইয়ের মুখস্তবিদ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

বিদায়ের সময় আসার আগে থেকেই মহুয়া কেঁদে-কেটে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ছোটবেলা থেকে যে বাড়িতে বড় হওয়া এখন সেই বাড়িই তাকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই হাউমাউ করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। মহুয়ার চাচী তাকে ধরে তার বাবার কাছে নিয়ে গেলো। তিনি আলাদা একটা বসার রুমে বসে ছিলেন। মহুয়া রুমে ঢুকেই তার বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো। মহুয়ার বাবা মোর্শেদ চৌধুরী চুপসানো মুখে বসে আছেন। মহুয়া চলে গেলে তার বাড়ি পুরো খালি হয়ে যাবে। মেয়েটা সবসময় পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। সারাক্ষণ টইটই করে ঘুরে বেড়াতো, আবার মাঝে মাঝে এটা-সেটা নিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলতো। এখন থেকে বাড়িটা পুরো থমথমে হয়ে যাবে ভাবতেই তার চোখে পানি এসে ভীর করলো। মহুয়া এখনো মুখ না তুলে তার কাঁধে মুখ গুঁজে কেঁদেই যাচ্ছে। মোর্শেদ চৌধুরী নিজেকে শক্ত করে তাকে উঠালেন। মহুয়াকে দেখে এখন যেকোন মানুষ মনে করবে তাকে কেউ মেরে এভাবে চোখ-মুখ লাল করে দিয়েছে।

টিস্যু দিয়ে মহুয়ার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে মোর্শেদ চৌধুরী তাকে বললেন,
– “এভাবে কেউ কান্নাকাটি করে সুঁচি। আমি আসবো আবার তোমায় দেখতে।”

মহুয়া কান্নারত স্বরে বলল,
– “আমি জানি তুমি আর আসবে না। তুমি বিদেশে চলে যাবে, তার জন্য পাসপোর্ট -ও বানিয়েছ। আমি লুকিয়ে তোমার রুমে গিয়ে দেখেছি।”

মোর্শেদ চৌধুরী থমকে গেলেন। মহুয়া চলে যাওয়ার পর বাড়িটা খালি খালি লাগবে দেখে তিনি ভেবেছিলেন বিদেশে গিয়েই এবার বিজনেসটা সামলাবেন। কিন্তু মহুয়া যে এভাবে টের পেয়ে যাবে তা ভাবেন নি তিনি।
মহুয়া কোন কথা বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বাবার উপর অভিমান হয়েছে তার। মোর্শেদ চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের পিছু পিছু গেলেন।
বাসার এক কোণায় দাঁড়িয়ে মুখ চেপে ধরে কাঁদছে মহুয়া। বাবার বিদেশ চলে যাওয়ার খবর শুনার পর থেকেই তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বার বার ভয় হচ্ছে এই ভেবে বাবাও যদি তার মায়ের মতে না ফিরে আসে। তাহলে তো সে একা হয়ে যাবে।

মোর্শেদ চৌধুরী মহুয়াকে জোর করে গাড়ির কাছে নিয়ে গেলেন। কান্নায় মহুয়ার সব ঝাপসা দেখছে। ঘোরের মাঝেই ঝাপসা চোখে দেখতে পেলো তার বাবা তার হাতটা অন্য কোন পুরুষালি হাতের মুঠোতে ভরে দিচ্ছে। শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো সে। মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলেন তিনি। মহুয়া চোখ পিটপিট করে গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে নিজের বাড়িটা দেখার চেষ্টা করলো।সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলো তাকে কেউ টেনে গাড়ির ভিতরে নিয়ে আসছে।

– “এভাবে কেউ গাড়ির বাহিরে মাথা বের করে রাখে। কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কি হতো বলুন তো!”

গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠলো মহুয়া। সে বুঝতে পারলো এই লোকটির সাথেই হয়তবা তার বিয়ে হয়েছে। কাঁপা কাঁপা স্বরে ‘সরি’ বলে গাড়ির দরজার সাথে লেপ্টে বসে রইলো সে। পাশে বসে থাকা লোকটির দিকে ভুলেও ফিরে তাকালো না।

__________

শিল্পী খাতুনের একমাত্র ছেলে আদনানের বিয়ে হয়েছে। তিনি বেশ ব্যস্ত এদিক-ওদিক সামলাতে। একবার রান্নাঘরে যান আবার ফিরে আসেন,চারপাশে চোখ বুলিয়ে আবার দৌড়িয়ে রান্নাঘরে যান। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে তিনি তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরে এসেছেন সব গোছগাছের জন্য।
আদনানের বাবা গলার আওয়াজ আর বাহিরে চেঁচামেচি শুনেই তিনি রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন।

মহুয়া গুটিশুটি হয়ে মাথা নুইয়ে সোফায় বসে আছে। বাসার সামনে গাড়ি আসার পর কয়েকজন মেয়ে দৌড়ে এসে তাকে ধরে নামিয়েছে। ভারী সাজের কারনে সে কাহিল হয়ে আছে। মিনিটখানেক পড়েই একজন মহিলা এসে তাকে ভিড়,চেঁচামেচি থেকে দূরে নিয়ে সোফায় নিয়ে বসালেন। মহুয়া মাথা তুলে তাকালে শিল্পী খাতুন মৃদু হেসে বলেন, “আমাকে চিনতে পেরেছো মা?”

মহুয়া মুখটা মনে করার চেষ্টা করে দেখলো। বিয়েতে আর তাদের বাড়িতে দেখেছিলো দুই-তিনবার। এত ভিড়ের তার সাথে তেমন একটা কথা হয়নি। মহিলার কথা শুনে মনে হচ্ছে তিনি ছেলের মা। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উপর-নিচ মাথা নাড়ালো সে।
শিল্পী খাতুন মহুয়ার ভয়ার্ত মুখ দেখে হাসলেন। হেসে বললেন,
– “আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই মা। আমিও তো তোমার মায়ের মতোই।”
কয়েকটা নিয়ম-কানুন পালন করে তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিলেন তিনি।

_______

জড়সড় হয়ে একটা ঘরে বসে আছে মহুয়া। শাড়ির ভাড়,সারাদিনের ঝড়ে তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বড় একটা হাই তুলতেই কেউ বলে উঠল,

– “আপনার তো মনে হয় ঘুম পেয়েছে। আপনি বরং ফ্রেশ হয়ে নিন।”

হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো মহুয়া। তাকে এভাবে উঠতে দেখে কিঞ্চিত অবাক হলো আদনান।

– “হেই! ডোন্ট প্যানিক! আপনার অসুবিধা কিংবা অস্বস্তি হলে আমি বারান্দায় যাচ্ছি। আপনি স্বাভাবিক হয়েফ্রেশ হন তারপর না হয় আমরা কথা বলবো কেমন?”

মহুয়া মাথা নাড়ে। আদনান বারান্দায় চলে গেলে ধীরে ধীরে গয়নাগুলো খুলে একটা শাড়ি নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। কিছুসময় পর মাথা মুছতে মুছতে বের হয়। নিজেতো ফ্রেশ হয়েছে, এবার আদনানকে ডাকা উচিত।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বারান্দায় গিয়ে নিচু স্বরে বলল,

– “আপনি এখন ফ্রেশ হতে পারেন।”

আদনান বারান্দায় বসে মোবাইল দেখছিলো। মহুয়ার ডাকে মুখ তুলে তাকালো। হাসি মুখে বলল,

– ” ও, আপনার হয়ে গেছে। তাহলে আপনি এখানে বসে একটু রিল্যাক্স করুন। এতক্ষণ মানুষের ভিড়ে নিশ্চয়ই অস্বস্তিতে ছিলেন। এখন একটু শান্তিতে নিজের মতো থাকুন। কোন কিছু প্রয়োজন হলে নিতে হেজিটেট ফিল করবেন না। ”

মহুয়া মাথা নেড়ে সায় দিলো। আদনান চলে গেলে বারান্দাটার ভালো করে লক্ষ্য করলো সে। অনেক বড় বারান্দা। একপাশ গাছপালা দিয়ে পরিপূর্ণ। আরেকপাশে ছোট দুইটা সোফার মতো বসার জায়গা, আরেক জায়গায় দোলনা। এখান থেকে সামনের গাছ-গাছালির ভিউটা অসাধারণ। রাতের আকাশটাও বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। দোলনাটায় গিয়ে ধীরে-সুস্হে ভয়ে ভয়ে বসলো সে। বসতে না বসতেই আদনান একটা তোয়ালে হাতে মহুয়ার হাতে দিয়ে বলল,

– ” মাথাটা মুছে নিন ভালো মতো নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে। ”

গল্পের নামঃ #প্রেমানুভূতি
#পর্বসংখ্যা_০১
লেখবীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত

চলবে,,

ভুলক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পে কোন অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয় থাকলে সেটি ধরিয়ে দিলে খুশি হব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here