প্রেমানুভূতি #পর্বসংখ্যা_০৯ লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত

0
847

গল্পের নামঃ #প্রেমানুভূতি
#পর্বসংখ্যা_০৯
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত

মহুয়ার পাগলামি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডাক্তারের বলা কথাগুলোই ধীরে ধীরে সত্যে পরিণত হচ্ছে। সারাদিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরে আদনান ক্লান্ত শরীরের মহুয়াকে সামলায়। ঔষধ নিয়মিত কনটিনিউ করার পরও কেন এমন হচ্ছে আদনান বুঝতে পারছে না। সময় করে একদিন ডাক্তারকে ফোন করতে হবে।

মহুয়া বসে বসে পড়ছিলো। বিয়ের জন্য পড়াশোনায় তার বেশ ঘাটতি পড়ে গেছে। মেডিকেলের জন্য এখন তাকে আবার আগের মতো পড়তে হবে। আদনান মহুয়ার ঔষধগুলো নিয়ে তার কাছে দিয়েই মহুয়া বিরক্তি নিয়ে বলল,
– “আমি তো ঠিক হয়ে গেছি তাও কেন আমাকে এত ঔষধ খাওয়ান?”

আদনান থমকে গেলো ক্ষণিকের জন্য। থমথমে স্বরে বলল,
– “এত বড় এক্সিডেন্ট করেছ একটু তো ঔষধ খেতেই হবে?”

মহুয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “আমি মেডিকেল স্টুডেন্ট এটা ভুলে যাবেন না মি.। হয়ত বা এখনও সেরকমভাবে পড়াশোনা শুরু হয় নি কিন্তু নূন্যতম যেটুকু জ্ঞান আছে সেটা দিয়ে বুঝতে পারছি এটা আমার এক্সিডেন্টের কোন ঔষধ না। এটা ব্যাথার ঔষধ হতেই পারে না।”

আদনানের গলা শুকিয়ে এলো। কোনমতে ঢোক গিলে বলল,
– “আরে এটা ব্যাথারই ঔষধ। তোমার না প্রায়ই মাথা ব্যাথা করে এই জন্যই ঔষুধ।”

মহুয়া বিরক্ত হয়ে বইটা শব্দ করে বন্ধ করে বলল,
– “আমাকে বোকা মনে করেন? এতগুলো ঔষধ শুধুমাত্র মাথা ব্যাথার জন্য? আমি নিশ্চিত আপনি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন।”

আদনান এবার রেগে গেলো। সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্তিতে বাড়ি ফিরে মহুয়ার সাথে তর্কাতর্কি ভালো লাগছে না। চাপা ধমকের সুরে বলল,
– “মহুয়া, এখন তর্ক করো না তো। চুপচাপ ঔষুধগুলো খেয়ে নাও।”

মহুয়া জেদ করে বলল,
– “না, খাবো না আমি। ঔষধগুলো কিসের তা না জানা পর্যন্ত আমি কিছু খাবো না। আপনি বারবার জোর করলেও খাবো না।”

আদনান জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।শান্ত স্বরে বলল,
– “মহুয়া প্লিজ ঔষধগুলো খেয়ে নাও। এমন করে না, আমি খুব ক্লান্ত।”

মহুয়া তাও মানলো না। আদনান ঔষধগুলো মুখে পুড়ে দিতেই মহুয়া ফেলে দিলো। আদনানের এবারের সহ্য সীমার বাহিরে চলে গেলো। রাগে গজগজ করতে করতে মহুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলো। মহুয়া পেছন থেকে অশ্রুসিক্ত চোখে তার দিকে থাকলো। আজই তো সে নিজের রিপোর্ট গুলো দেখেছে। সেখানে স্পষ্ট লিখা ছিল মহুয়ার মেন্টাল ডিজওর্ডার আছে, ঔষধ না খেলে সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়বে। মহুয়া রিপোর্ট দেখে সেখানেই থমকে গিয়েছিল। বারবার মনে হচ্ছিল এটা মিথ্যা। কিন্তু পরে নিজের ঔষধগুলো দেখেই বুঝতে পেরেছে তার সমস্যাটা ঠিক কোথায়। এর সত্যতা শিল্পী খাতুনকেও জিজ্ঞেস করেছিল। তিনি সব জানতেন, আদনান তাকে বলেছিলো। মহুয়ার মুখে এমন কথা শুনে তিনি সত্য ঢাকতে চেয়েছিলেন কিনৃতু মহুয়ার হাতে রিপোর্ট দেখে আর কিছু বলতে পারেন নি। মহুয়া সেই থেকে কেঁদেই চলছে। কোনভাবেই তার কান্না থামানো যাচ্ছিল না। আজ সে চাইছিলো আদনানের মুখ থেকে সব শুনতে। কিন্তু আদনান তাকে কিছুই বললো না উল্টো আরো এড়িয়ে গেলো। এখন তার নিজের প্রতিই রাগ লাগছে আদনানকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য।

রাতে খাওয়ার টেবিলে সাধারণত হাসি-ঠাট্টা করা হয়। কিন্তু আজ সব চুপচাপ। আদনান পুরো চুপ হয়ে আছে। মহুয়া নিচের দিকে মুখ করে প্লেটে হাত বুলাচ্ছে। আদনানের বাবা কাজের জন্য শহরের বাহিরে। শিল্পী খাতুন চুপচাপ বসে খাচ্ছে আর মহুয়া-আদনানকে লক্ষ্য করছে। দুজন যে দুজনকে এড়িয়ে চলছে সেটা তার চোখে পড়েছে খুব ভালোমতো। দুজনের মাঝে যে ঝগড়াও হয়েছে এটাও বোঝা যাচ্ছে। দুজনকে একা ছেড়ে দিয়ে তিনি চলে খাওয়া শেষ করে চলে গেলেন। শিল্পী খাতুন উঠে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই মহুয়া নিজের প্লেট ছেড়ে উঠে যেতে নিলেই আদনান ধমকের স্বরে বলে,
– “এই বাসায় খাবার নষ্ট করা যাবে না।”

মহুয়ার অভিমানে চোখে পানি এসে গেলো। এই বাসা মানে কি হ্যাঁ? এটা কি তার বাসা না? কই বাসর রাতে তো খুব সুন্দর করে বলেছিল এটা তার নিজের বাসা। আর এখন কথার সুর পাল্টে গেলো। চোখে পানি আটকে কোনমতে খাবার শেষ করলো পানি দিয়ে গিলে। আদনান মহুয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
মেয়েটা একদমই কিছু বুঝতে চায় না।

_______

এবারের ডিসেম্বরে শীতটা মনে হয় একটু বেশিই পড়েছে। ঠান্ডা শিরশির বাতাসে বাহিরে দাঁড়ানো যায় না। রাতের আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তার আশপাশটা ঘিরে রয়েছে কয়েকটা তারা। রাতের নিরবতা যেন চারপাশটাকে আঁকড়ে ধরেছে। সবকিছু শুনশান কোন শব্দ নেই। অতিদূর থেকে মাঝে মাঝে এক-দুইটা কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। ছাদের এককোণায় গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহুয়া। শীতে থরথর করে কাঁপছে সে তবুও যেন পণ করেছে আজ নিচে যাবে না। আদনানের প্রতি তার প্রচুর অভিমান। এই অভিমানের দেয়াল যতক্ষণ না ভাঙবে ততক্ষণ সে আদনানের সাথে কোন কথা বলবে না, তার কোন কথাও শুনবে না। চোখ দিয়ে অভিমানের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার।
আদনান এতক্ষণ মহুয়াকে সব জায়গায় খুজছিলো। শেষে উপায় না পেয়ে ছাদে এসে দেখলো মহুয়া শীতে কাঁপছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আদনান। মহুয়াকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেছিলো। মেয়েটা যদি রাগ করে বাহিরে বের হয়ে যেতো। মহুয়াকে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আদনান। হুট করে কারো স্পর্শ পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো মহুয়া। আদনানের গভীর নিঃশ্বাস তার কান সংলগ্ন জায়গায় পড়তেই বুঝলো এটা আদনান। অভিমানে আবারো চোখ ভারী হয়ে উঠলো তার। জোরাজুরি করে নিজেকে ছাড়াতে চাইলেই আদনান তাকে চেপে ধরে ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। থমকে গেলো মহুয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে এলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু আদনানের দেওয়া একের পর এক স্পর্শগুলোর বদলে নিজেকে সামলানো তো বহুদূর আরও বেসামাল হয়ে উঠলো। হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের শরীরের ভার আদনানের উপর ছেড়ে দিলো। আদনান মৃদু হেসে মহুয়াকে আগলে নিলো। মহুয়া এখনো জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আদনান ধীর স্বরে বলল,
– “এত অভিমান কেন আপনার মহুরানী?”

মহুয়া উত্তর দিলো না। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি খসে পড়লো। আদনান আবারো বলল,
– “বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে এত অভিমান ভালো না রানী।

মহুয়া মলিন হাসলো। তারপর ভারী গলায় বলল,
– ” আমায় আপনার বোঝা মনে হয় না রাজাসাহেব? আমার প্রতি বিরক্তি আসে না?”

আদনান মহুয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,
– “নবাব নন্দীনির প্রতি কারো বিরক্তি আসতে পারে? তাকে কি কারো বোঝা মনে হতে পারে? আপনি তো আমার নবাব নন্দীনি, আপনার প্রতি আমার বিরক্ত কোনদিন আসবে না মহু কোনদিন না।”

মহুয়া মুখে সুখের হাসি ফুঁটে উঠলো। কোনমতে বলল,
– “আমার ডিজওর্ডারের কথা কেন লুকালেন আমার থেকে?”

আদনানের মুখ থেকে হাসি উবে গেলো। ভয়ার্ত গলায় বলল,
– “তুমি সব জেনে গেছো?”

মহুয়া স্লান হেসে বলল,
– “আজই জানলাম।”

আদনান কোন কথা বলল না। চুপচাপ মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলো। শিরশিরে বাতাসে মহুয়া হালকা কেঁপে কেঁপে উঠলো। আদনান ধীর স্বরে বলল,
– “আপনার এটা কোন সমস্যাই না মহুয়া। এইতো ঔষধ কন্টিনিউ করলেই আপনি ঠিক হয়ে যাবেন। এটা সাময়িক। এই সাধারণ একটা সমস্যার জন্য আমি আপনাকে ছেড়ে দেবো তা ভাবলেন কিভাবে আপনি। দাম্পত্য জীবনে নানান চড়াই-উতরাই আসবে। আমাদের হাতে হাত রেখে সে চড়াই-উতরাই পার করতে হবে। যত কিছুই হয়ে যাক না কেন দিনশেষে আমার পাশে আমি আপনাকে চাই। সময়-অসময়, সুখ-দুঃখ সবকিছুতেই আমি আপনাকে চাই। আপনাকে দেখার তৃষ্ণা, আপনাকে ভালোবাসার তৃষ্ণা আমার কখনোই মিটবে না মহুরানী। আপনি আমার প্রথম প্রেমানুভূতি, আমার মাধবীলতা,আমার প্রণয়ীনী। আপনার প্রতি বিরক্তি আসা তো দুঃসাধ্য!

মহুয়া তৃপ্তির হাসি নিয়ে চোখ বুঝলো। মনে মনে বলল,
– ” আপনিও আমার প্রথম প্রেমানুভূতি আদনান সাহেব। আপনাকেও আমি আপনার মতো করে ভালোবাসি।”

____সমাপ্ত_____

অনেকেরই হয়তো গল্পের প্রতি বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। আমি নিজেও বিরক্ত ছিলাম অনিয়মিত হয়ে। তাই আজ ইতি টানলাম গল্পের। শেষ পর্বে এসে কিছুটা প্রতিক্রিয়া আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here