কুসুম_কাঁটা #পর্ব-৬

0
471

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৬
রঙ্গনা নিজে গিয়ে মিশুকের সঙ্গে আলাপ করলো। ও অফিস থেকে এসে মৃদু ভলিউম দিয়ে গান শুনছিল। রঙ্গনা চা নিয়ে গেল। অবশ্য নিয়ে গেল বললে ভুল হবে। তুলিই পাঠালো। ও অবশ্য দাদুর এই সব প্ল্যান সম্পর্কে জানে না। এখনো পর্যন্ত প্রাথমিক অবস্থায় দাদুর কোনো পেয়িং গেস্ট কেই পছন্দ হয় নি। প্রাথমিক অবস্থা বলতে প্রথম তিন মাস। একটা মানুষের আচরণ, স্বভাব, বদ অভ্যাস জানতে হলে তাকে তিন মাস দেখতে হয়। প্রথম প্রথম সবাই ই ভালো থাকে। ভেতরের শয়তান বেরিয়ে আসতে একটু সময় লাগে। এর আগে যে তিনজন ছিলো তাদের কে বিতাড়িত করেছেন স্বভাব, পছন্দে মিলে নি বলে। তবে তার মিশুক কে প্রথম দেখায় ই পছন্দ হয়েছে। ছেলেটা অত্যন্ত সুপুরুষ। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। আরেকটা বিষয় ভালো, ছেলেটার পরিবার ছোট। বড় পরিবার রঙ্গনার জন্য ভালো হবে না। গ্যাঞ্জাম ও নিজেই করবে। তার এই নাতনি টা বদের হাড্ডি। এর কারণে ভালো একটা পরিবার নষ্ট হোক সেটা চায়ও না। তাছাড়া মিশুকের কথা বলার ধরন তার ভালো লেগেছে। এতদিনে বোধহয় বন্য ওলের সঙ্গে বাঘা তেঁতুল।

রঙ্গনা হেসে বলল,

“আমি রঙতুলির রঙ। আমার বুবুর সঙ্গে আলাপ আছে তো। ”

মিশুক স্বাভাবিক গলায় বলল,

“জি। ”

“কেমন আছেন?”

মিশুক একটু অপ্রস্তুত হলো। এমন ভাবে কেমন আছেন কথা টা জিজ্ঞেস করলো যেন অনেক দিনের আলাপ। ও কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,

“ভালো। আপনি? ”

“ভালো। আপনার বয়স কত?”

মিশুক হকচকিয়ে গেল। এতো দেখি দাদুর আদর্শ নাতনি। বয়স জিজ্ঞেস করছে, এরপর আবার ফ্যামিলি হিস্ট্রি জিজ্ঞেস করবে। ও বলল,

“বায়োডাটা আপনার দাদুর কাছে আছে?”

রঙ্গনা হেসে ফেলল৷ বলল,

“আমি আপনার প্রতিবেশী৷ উঠতে বসতে দেখা হবে। কথাবার্তা হবে। আপনার বয়স জানতে চাচ্ছি এই কারণে যে আমি আপনাকে তুমি সম্বোধনে ডাকব, নাকি তুই বলে ডাকব। ”

মিশুক এবার আর অবাক হলো না। বেশভুষায় যেমন আধুনিক তেমন কথাবার্তায়ও বেশ আধুনিক। ও বলল,

“আমি আসলে নিজের সার্কেল ছাড়া কারো কাছে তুমি, তুই সম্বোধনে অভ্যস্ত নই। আমার ছোট কিংবা বড় যেই হোক। আপনি বরং আমাকে এখন যেভাবে বলছেন তেমন ই বলুন। ”

রঙ্গনা এবার একটু চমকালো৷ এটা যে সূক্ষ্ম অপমান সেটাও বুঝলো। তবুও মৃদু হেসে বলল,

“ওকে। ”

মিশুক আবারও কৃত্রিম হাসি দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। রঙ্গনা নিচে গিয়ে তুলি কে বলল,

“এসব ভাবওয়ালা ছেলেগুলো দাদু কোথায় পায় বুবু? মেয়েদের সাথে একটু ভালো করে কথা বলতে পর্যন্ত পারে না। ”

তুলি মিটিমিটি হাসলো। দাদুর দেখেশুনে বিয়ে দেবার শখ বোধহয় এই জীবনে পূরণ হবে না।

***
মন্টি, রিন্টি আজ শ্রাবণ্যকে বিরক্ত করছে। ও হাসিমুখেই মেনে নিচ্ছে। এতো ছোট বাচ্চাদের রাগ দেখানো যায় না। মায়া লাগে। স্বপ্নীল গেছে দাদুর কাছে জ্ঞান আহরন করতে। রিন্টি শ্রাবণ্যকে বলল,

“জানো মামী আমাদের বাবা অনেক রাগী। ”

শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“তাহলে তোমরা দুষ্টমি কেন করো?”

মন্টি বলল,

“আরে আমাদের উপর রাগে না। রাগে তো মায়ের উপর। মা যতক্ষন পর্যন্ত চুমু না দেয় ততক্ষন পর্যন্ত রেগে থাকে। ”

রিন্টি আবার সাথে যোগ করে বলল, অনেক গুলো চুমু দিয়ে আমাদের রাগ ভাঙায় মা৷ আমাদের মা অনেক ভালো।

শ্রাবণ্যর চোখ বড় হয়ে গেল। কীসব ভয়ংকর কথাবার্তা। বলল,

“ইশ! তোমরা এসব পঁচা কথা কোথায় শিখেছ! ”

দুজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। শ্রাবণ্য দুজনকেই কাছে টেনে বলল,

“এসব আর বলবে না। আমাকেও না, অন্য কাউকেও না। মনে থাকবে?”

রিন্টি বলল,

“আচ্ছা। তাহলে কী চকলেট দিবা?”

“আমি কাল তোমাদের চকলেট দেব। ”

খাবার টেবিলে মন্টি গিয়ে বলল,

“মা জানো মামী কী বলেছে? চুমু দেয়া খারাপ কাজ। এজন্য মামী মামাকে চুমু দেয় না৷ ”

স্বপ্নীল মুখভর্তি ভাত নিয়েই কাশতে শুরু করলো। শ্রাবণ্য একবার তুলির দিকে তাকালো।

শিলা এমন ভান করলেন যে কিছু শুনলেন না। রঙ্গনা হো হো করে হেসে উঠলো। তুলি কে বলল,

“বুবু এখানে দাদু থাকলে ভালো হতো। এরপর জোর করে তোর মেয়েদেরও বিয়ে দিয়ে দিতো। ”

স্বপ্নীল শ্রাবণ্য দুজনেই লজ্জায় কারোর দিকে তাকাচ্ছে না।

***
আকাশী আজ বাসায় ফিরলো রাত করে। শুভ আগেই ফিরেছে। একা চা করে খেয়েছে। ঘরে ঢুকতেই মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল। ঘরভর্তি সিগারেটের গন্ধ। এতো টাকা পয়সার টানাটানি অথচ সিগারেট খাওয়া বন্ধ হয় না। আকাশী এই নিয়ে একদিন বলেছিল। শুভ জবাবে নির্লিপ্ত গলায় বলেছে,

“তোমার লিপস্টিক পরাও তো বন্ধ হয় না। ”

কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! পার্লারের দিনা আপা সেদিন একটা কথা বলেছে, শোন আকাশী অশিক্ষিত মানুষের কাছে কখনো লজিক, ম্যানার আশা করবি না। এদের সঙ্গে তর্ক করার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো। শুভ গ্রাজুয়েশন শেষ করা ছেলে হলেও চিন্তাধারায় একটুও এগোয় নি। আকাশীর খারাপ লাগে। একটা মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে! একটুও ওর কথা ভাবলো না!

ঘরে ঢুকে কোনো কথা বলল না। সবজিগুলো কাটতে শুরু করলো। শুভ আড়চোখে দেখছে। বলল,

“শ্রাবণ্যর নাকি বিয়ে হয়েছে?”

আকাশী নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“কার থেকে শুনলে?”

“মুনা বলল। মায়ের কাছেও শুনলাম যে তোমার বাবা এলাহি আয়োজন করে শ্রাবণ্যর বিয়ে দিয়েছেন। ”

“আচ্ছা। ”

“শুধু আচ্ছা!”

“আর কী বলব?”

“শুনলাম কার সঙ্গে নাকি ধরা পড়েছে তারপর….

আকাশী রুক্ষ গলায় বলল,

“ঠিক করে কথা বলো শুভ। ”

শুভ ভয় পাবার ভান করে বলল,

“নাহলে কী গলায় বটি বসিয়ে দিবে?”

আকাশী রাগে ফুসছে। শুভ খ্যাকখ্যাক করে হেসে বলল,

“যেখানে গর্জে ওঠার সেখানে গর্জাতে পারো না। বুদ্ধি থাকলে এইরকম ঘরে পঁচে মরতাম না আমরা। ”

“কেন? কী নির্বোধের মতো কাজ করেছি আমি?”

“সেটা তোমাকে বলে বুঝাতে হবে? ”

আকাশী চুপ করে রইলো। সবজিগুলো পড়ে রইলো অমনই। শুভ আর ওর মা চায় আকাশী বাবার হাতে পায়ে ধরে টাকা পয়সা এনে শুভকে দিক। লাখ পাঁচেক টাকা হলে ও ব্যবসা শুরু করতে পারবে। ঠিকঠাক গুছিয়ে চাকরি ওর পক্ষে সম্ভব না। কোথাও স্থায়ী হতে পারে না। একটা না একটা ঝামেলা লেগেই যায়। আকাশীর কাছে সত্তর হাজার টাকা আছে অবশ্য। দুই ঈদে ভাবী কিছু টাকা দিয়েছিলেন। পার্লারে কাজ ছাড়াও দুটো টিউশনি ছিলো। সেখান থেকে জমিয়েছে টাকাটা শুভ কে দেবার জন্য। প্রায় দুই বছর ধরে জমানো টাকা৷ ইদানীং শুভর সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গেছে বলে ও সেসব জানাচ্ছে না। সেই সঙ্গে আছে শুভর মায়ের মানসিক টর্চার। তাদের উদ্দেশ্য এখন আকাশীর কাছে পরিষ্কার। ইশ! বাবা ঠিক এমন কথাই বলেছিল। ও মানতে চায় নি। তার ফল এখন ভোগ করছে।

শুভ আকাশীকে বসে থাকতে দেখে বলল,

“আজ কী রান্না হবে?”

আকাশী কঠিন গলায় বলল,

“না।”

“ঢং কোরো না তো। রোজ রোজ ঢং ভালো লাগে না।”

“নিজের টা নিজে করে খাও। ”

শুভ আবারও বলল,

“যার কোথাও যাবার জায়গা নেই সে এতো রাগ দেখায় কিভাবে? কোথাও একবেলা ভাত জুটবে? এমন একটা জায়গা দেখাও তো। ”

আকাশীর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে। উঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ের গতিতে নিজের জামা কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিলো। শুভর ঠোঁটে তীর্যক হাসি। সবকিছু গুছিয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে বলল,

“আজীবনের জন্য যাচ্ছি। ”

শুভ ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল,

“আজীবন! ”

আকাশী উত্তর দিলো না। তিন বছর আগে যেমন বাড়ি থেকে চলে এসেছিল, আজও তেমন বেরিয়ে গেল।

চলবে…. কি চলবে না আপনারা ঠিক করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here