কুসুম_কাঁটা #পর্ব-১১

0
462

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১১
শুভর আজ মেজাজ টা ভীষণ খারাপ। বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। এদিকে পানির ট্যাংকিতে কী এক সমস্যা হয়েছে, সারা বাড়ি পানিতে ভরে গেছে। ওর ঘরেও ঢুকেছে দরজার ফাঁকা দিয়ে। ও কিছুই টের পায় নি। ঘুম ভাঙতেই দেখলো মেঝে ভেসে যাচ্ছে। মেঝেতে বাটি, প্লেট যেগুলো ছিলো সেগুলো ভাসছে। দেখেই মাথাটা ফাঁকা লাগলো। চা করতে রান্নাঘরে গেল, কেউ চুলা দিলো না। সবাই দুপুরের রান্না চাপিয়েছে। শুভ কে দেখে পাশের বাসার ভদ্রমহিলা বলল, এখন চা বানান যাইব না। বারোটার পর যে জমিদারের চা খাওয়া লাগে সে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসুক।

শুভ আর কিছু বলল না চলে এলো। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো আকাশীর উপর। আকাশীর এই ঢং কবে শেষ হবে কে জানে! এই মেয়েকে তার হ্যাপি আপা কতদিন তার বাসায় রাখে সেটাও দেখা যাক। যাবে আর কই! বাড়িতে পি*শাচ বাপ, মা তো জায়গা দিবে না। জায়গা না দিক, অন্তত যদি ভালো চোখে দেখতো তাতেও কপাল টা খুলে যেত।

অসময়ে মায়ের ফোন দেখে আরও বেশী বিরক্ত লাগলো। মায়ের ইদানীং নাই, নাই স্বভাব আরও বেড়েছে। মুনার এটা লাগবে, ওটা লাগবে এছাড়া যুক্ত হয়েছে একটা বাথরুম লাগবে। এমন ভাঙাচোরা বাথরুম থাকলে মুনার বিয়ের সম্বন্ধ আসবে না। এদিকে শুভ নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারছে না কোথাও। একটা না একটা ঝামেলা সবজায়গায়ই থাকে। তাও ভরসার জায়গা ছিলো আকাশীর পার্লারের চাকরি টা। ভাত, ডাল, সবজি ভালো মতোই জুটতো। অন্যান্য খরচাপাতিও সেখান থেকে চালিয়ে নেয়া যেত। কিন্তু এখন কি হবে! সামনে নতুন মাস শুরু হবে। পাঁচ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিতে না পারলে বাড়িওয়ালি খবিশের মতন আচরণ শুরু করবে। এদিকে ওর পকেটে খাওয়ার টাকাও নাই। ওর স্যালারি কবে হবে সেটারও ঠিক নাই। সামনের ভাতের হোটেলে তিন দিন বাকীতে খেয়েছে। গত রাতে খেতে গিয়ে দেখলো গরম রুই মাছ আলু পটল দিয়ে রান্না হয়েছে। দেখতে বেশ লোভনীয়। তেল ভাসছে ঝোলের উপরে। শুভ অর্ডার করলো। দোকানের ম্যানেজার নাক খুটতে খুটতে নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“নগদ টাকা দিয়া যারা খাবে মাছ তাগোর জন্য। আপনে ডাল, ভাত খান।”

শুভ আকাশীর ফোনে কল করলো। নাম্বার টা বন্ধ। আকাশী কী সত্যিই বড় কোনো স্টেপ নিতে চাচ্ছে! তাও এভাবে! নাকি শুভ কে শিক্ষা দিতে চাইছে!

****
আকাশীকে মোটামুটি গুছিয়ে দিয়ে গেছে শ্রাবণ্য। ওর জিনিসপত্র যা ছিলো সেগুলো বাদে বাদবাকি সব কিনে দিয়ে গেছে। এছাড়া এক মাসের টাকাও পে করে গেছে। আকাশী বারন করেছিল। বলেছিল লাগবে না আমার কাছে আছে। শ্রাবণ্য বলেছে, তোর যা আছে সেটা রাখ। অনেক খরচ আছে। আপাতত কদিন রেস্ট নে। মাস শুরু হলে আমার টিউশনি দুটো তোকে দিয়ে দেব।

আকাশী বিস্মিত হচ্ছে শুধু। শ্রাবণ্য ও’কে এতো সাহায্য করছে! বাবার নিষেধ অমান্য করে এর আগে দেখা করতেও চাইতো না। আকাশী এলে বিরক্ত হতো কিংবা ভয় পেত। তবুও আকাশী আসতো। শ্রাবণ্য ঢাকায় পড়ছে জানার পর থেকে মাসে দু’বার তিনবারও দেখা করতে আসতো। একটা সময় ভেবেছিল শুভ কে পেলে আর কিছু লাগবে না। পরে ঠিকই বুঝতে পেরেছে, খেয়ে পরে বাঁচা ছাড়াও জীবনে অনেক কিছু লাগে। একটা বয়স পর্যন্ত মাথার উপর বাবা, মায়ার ছায়া লাগে। স্নেহ, মায়া মমতা সব লাগে।

আকাশী শুভ কে ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত সিরিয়াস ভাবে কখনোই নেয় নি। প্রায় ই ভাবতো, এভাবে আর কতদিন! মুক্তি দরকার, জীবনে শান্তি দরকার।

রাগের মাথায় যখন বাড়ি ছাড়লো তখন ভেবে নিলো, আর ফেরা হবে না। উচিতও নয় ফেরা। যে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে একবার বেরোনো হয় সেখানে আর ফিরতে নেই। কারণ দ্বিতীয়বার ফিরলে মান থাকে না।

****
স্বপ্নীলের অফিসের আজ প্রথম দিন। ইস্ত্রি করা, শার্ট, টাই পরে চুল একপাশে সমান করে আঁচড়ে রেডি হলো৷ শ্রাবণ্য হাসতে গিয়েও হাসলো না। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে, তোর কি হয়েছে শ্রাবণ্য! স্বপ্নীলের সঙ্গে তুই একদম অন্য মানুষ৷ ও’কে কষ্ট দিতে চাস না। ওর আজেবাজে বকবক মনযোগ দিয়ে শুনিস। একটুও বিরক্তি প্রকাশ করিস না। তুই তো এমন না।

স্বপ্নীল জিজ্ঞেস করলো,

“আমাকে কেমন লাগছে? ”

“একটু অন্যরকম। ভালোই। ”

শ্রাবণ্যর আজ ক্লাশ নেই। সপ্তাহে চারদিন ওর ক্লাশ। স্বপ্নীলের একটু অস্বস্তি হচ্ছে শ্রাবণ্যকে ওর সঙ্গে যেতে বলতে। শ্রাবণ্য খুব ভালো মেয়ে। কখনো ওর উপর রাগ, কিংবা বিরক্ত হয় না। তবুও এই কথাটা বলতে কেমন লাগছে।

শ্রাবণ্য স্বপ্নীল কে দেখেই বুঝলো কিছু একটা বলতে চাইছে। জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি কী কিছু বলবেন?”

“তোমার কী বাসায় কোনো কাজ আছে শ্রাবণ্য?”

শ্রাবণ্য একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনার সঙ্গে যেতে হবে? ”

স্বপ্নীল হাসলো। বলল,

“তুমি চলো। একা থাকলে আমার নার্ভাস লাগবে। মা যেতে পারবে না। ”

শ্রাবণ্য মেনে নিলো। বলল,

“আচ্ছা আমি যাব। ”

দাদু দুজন কে একসঙ্গে দেখে খুশি হলেন। তার ছেলের অপূর্ণ ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে৷ স্বপ্নীলের মাথার ভুতও নেমেছে। বাড়ির মানুষগুলোও যদি এবার তাকে একটু ভরসা করতে পারে৷ দাদু গর্বিত গলায় বললেন,

“দেখলি তুলি, আমার হিসাব নিকাশে কোনো ভুল নাই। গরুটা সেজেগুজে কী সুন্দর অফিসে গেল!”

তুলি কিছু বলল না। ব্যাপার টা ও খেয়াল করেছে। ভালোবাসা দুজনের মধ্যে থাকুক না থাকুক সকলের সামনে কী সুন্দর সহজ! কোনো ভান নেই।

***
শিলা এসেছেন রঙ্গনাকে নিতে। তুলি আর স্বপ্নীল যেটুকু ভালোবাসা শিলার কাছে পেয়েছেন রঙ্গনা সেই তুলনায় কম পেয়েছে। মেয়েটা বাবার ন্যাওটা ছিলো। বাবাও একটু অধিক স্নেহ করতেন এই মেয়েটাকে । বাবা চলে যাবার পর মেয়েটা বদলে গেল যেন৷ রাগী, বদমেজাজী, বেপরোয়া রঙ্গনাকে সবাই দেখে। মাঝরাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যে কাঁদতে দেখে শুধু শিলাই। শিলা কাঁধে আলতো করে হাত রাখতেই চমকে উঠে বলে,

“আরে তুমি ঘুমাও না ক্যান? ভুতের মতো কেন চলো! ”

শিলা স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করেন,

“কিসের জন্য কাঁদছিস? ধার দেনায় ডুবে গেছিস আবারও! ”

রঙ্গনা উদাস গলায় বলে,

“বা*লের একটা লাইফ কাটাইতেছি মা। কিচ্ছু ঠিকঠাক হয় না। একদিক ঠিক তো অন্যদিকে ঝামেলা। ”

“প্রেমিকের ঝামেলা? ”

“ইশ ছি:! একটা ছেলের জন্য কান্নাকাটি করার মেয়ে আমি না। একজন গেলে আরেকজন আসবে। কান্নাকাটি করে মরব না।”

শিলা জানেন তার এই মেয়েটির স্বভাব। ছবি এঁকে লাখ লাখ টাকা উপার্জনের গল্প যেমন আছে, তেমনি না খেয়ে থাকার গল্পও আছে। তবুও রঙ্গনাকে নিয়ে তার টেনশন নেই। এই মেয়েটা ভালো থাকতে জানে, অন্ধকারে আলো খুঁজেও নিতে পারবে ঠিকই। মন ভালো করার জন্য ট্যুর দিয়ে আসতে পারবে যখন তখন। ওর জন্য শুধু একটাই চাওয়া, কেউ ও’কে উজাড় করে ভালোবাসুক।

রঙ্গনা মা’কে দেখে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল,

“তোমার ওই বাড়ি জীবনেও যাব না মা।”

শিলা রঙ্গনার ঘরের দিকে তাকালেন। ঘর টা এলোমেলো। একটা জিনিসও ঠিকঠাক নেই। বললেন,

“তোর দাদু যে কেন তোকে বিয়ে দিতে চায় আমিও বুঝিনা। তোর মতো মেয়েকে বিয়ে করে কেউ ঘরে তুললে সেই সংসার টাই ধ্বংস হবে। ”

রঙ্গনা চুপ করে রইলো। শিলা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন,

“কোথায় বসব? বসার মতো জায়গা তো নেই। ইশ ছি:!”

রঙ্গনা অভিমানী গলায় বলল,

“মা তুমি এক্ষুনি বের হও। আমি ওই বাড়ি আর যাব না। ”

“কেন যাবি না?”

“তোমার শ্বশুরের সাহস দেখো, একটা ছেলেকে বাড়িতে উঠিয়েছে শুধু আমাকে বিয়ে করানোর জন্য। অথচ ছেলেটাকে আমার পছন্দ কিনা সেটা একবারও জানতে চাইলো না।”

“তোর পছন্দের যে আছে তাকে দাদুর সামনে নিয়ে দাঁড় করা।”

রঙ্গনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝেতে বসলো। শিলাও সেখানে বসেছেন। বললেন,

“তোর পছন্দের কেউ নাই?”

“না থাকলে তো কবেই বিয়ে করে নিতাম। ”

“কেন? ফেসবুকে একটা ছেলের সাথে ছবি দিতি না। ওই যে তোর চুলের গোছা ধরে ছবি তুলতো।”

রঙ্গনা হেসে ফেলল। বলল,

“তোমাকে সব দেখতে হয়! ওটা শুধু বন্ধু।”

শিলা হাত বাড়িয়ে মেয়ের হাত ধরলেন। বললেন,

“বাড়ি চল। তোকে ছাড়া ভালো লাগে না। ”

রঙ্গনা মায়ের অনুনয় উপেক্ষা করতে পারলো না। বাবা চলে যাবার পর মা ওদের আর বকাবকি করেন না। এতো নরম গলায় কথা বলেন। কিছু বললে না করা যায় না।

***
মন্টি, রিন্টি ছুটে এসেছে। অকারণে ওরা হিহি করে হাসছে, লাফাচ্ছে। রঙ্গনা বলল,

“এই তোরা সর, ভিখিরির মতো জামা কাপড় পরে আছিস। যা আমার সামনে থেকে। ”

ওরা গেল না। আরও হা হা হি হি করতে লাগলো। মিশুকের সাথে সন্ধ্যেবেলা রঙ্গনার দেখা হলো। রঙ্গনা আগ বাড়িয়ে বলল,

“হাই, আপনি রিলাক্সে থাকুন। আমি আপনাকে বিয়ে করব না। কারণ আপনাকে আমার পছন্দ হয় নি। এই কারণে দাদু আর এগোবে না। ”

মন্টি বলল,

“আমাদের মনি যাকে বিয়ে করবে সে মনিকে কোলে নিবে। আপনি কী কোলে নিতে পারবেন? ”

মিশুক হেসে ফেলল। রঙ্গনা মন্টিকে চোখ রাঙানি দিয়ে বলল, এক থাপ্পড় খাবি।

মিশুক তখনও হাসছে।

চলবে….

(পাঠক রা সাড়া দিবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here