#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৪
রঙ্গনা হঠাৎ ই ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেল। তেমন রাগছে না, কথাও বলছে কম। বাড়ির সবাই ভীষণ অস্থির হলো। যাই বলুক, মনে মনে ও এখনো এই ধাক্কাটা সামলাতে পারে নি। ও জেনে ভীষণ অবাক হলো যে ওর স্ট্রেটফরোয়ার্ড স্বভাবের জন্য রাফাতের মা তার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে চান নি। আরও একটা ব্যাপার, মিশুকের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো ব্যাপার টাও তাদের ইনসাল্টিং লেগেছে। এটাও যে সমস্যা হতে পারে সেটা জেনেই বরং অবাক হলো। মা কখনো বলে নি রঙ্গনা তোমাকে বদলাতে হবে। বাড়ির সবাই ই বলতো ও তো একটু অমনই। দাদুর তো সোজা কথা ছিলো, তার নাতনী যেমন তেমন দেখে যে ছেলে বিয়ে করতে চাইবে তার সঙ্গেই বিয়ে হবে। না চাইলে বিয়ে হবে না।
রাফাত ফোন করেছে, টেক্সট করেছে। রঙ্গনার ইচ্ছে করেনি কথা বলতে। ও অনেক বার সরি বলার পর রঙ্গনা জবাবে লিখেছে,
“আমি আমার ভাগ্য কেঅ মেনে নিলাম। আল্লাহ আমাকে এমন ডাকাত ফ্যামিলির হাত থেকে বাঁচিয়েছে তার জন্য শুকরিয়া আদায় করছি। আশা করি তুমি তোমার পরবর্তী জীবনে একটু সচেতন হবে। অবশ্য নিজের ফ্যামিলি নিয়ে আরও আগে সচেতন হওয়া উচিত ছিলো। আর তুমি বারবার কেন ক্ষমা চাইছ? তুমি নিজেও তো ভিক্টিম। ক্ষমা চাইবে তোমার পরিবার। ভালো থেকো।”
মেসেজ টা পাঠানোর পর রঙ্গনা শান্তি পেল। ওর ধৈর্য্যশক্তি বেশী, এতদিন তেমন ই জানতো। বাবার মৃত্যু ছাড়া কখনোই কোথাও সেভাবে ভেঙে পড়ে নি। এখনো যে খুব ভেঙে পড়েছে তেমন না। কিন্তু ওর মধ্যে একটা ব্যাপার চলে এসেছে। নিশ্চয়ই ও ভীষণ খারাপ। তাই ও’কে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করেছে। পরে আবার মনে হয় ও কেন খারাপ হবে। যারা অন্যায় করেছে তারা খারাপ মানুষ। এসব সাত, পাঁচ ভাবনা বেশ কিছুদিন ধরে মাথায় ঘুরছে।
ওয়াশরুমের দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো দু’বার।
“রঙ্গনা!”
রঙ্গনা শাওয়ার বন্ধ করলো। মিশুক ডাকছে। আবারও ডাকলো।
“রঙ্গনা!”
“হ্যাঁ। ”
“তুমি ঠিক আছ?”
“ঠিক থাকব না কেন?”
মিশুক হেসে ফেলল। দেরি হচ্ছে বলে ও টেনশন করছিল। রঙ্গনা বেরিয়ে এলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে। মিশুক দাঁড়িয়ে আছে তটস্থ হয়ে। ও কিছু বলার আগে বলল,
“আমার শাওয়ার নিতে সময় লাগে। এতো অস্থির হবার কিছু নেই। আমাকে নিয়ে ভয়ও পেতে হবে না। আমি নিজেকে ভীষণ ভালোবাসি।”
মিশুক মৃদু হেসে তাকালো। রঙ্গনার ভেজা চুল। পরনে ট্রাউজার আর টিশার্ট। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিম মাখছে। মিশুক টাওয়াল নিয়ে চুল টা মুছে দিতে গেল। হঠাৎ মিশুকের চুল মুছিয়ে দিতে আসায় রঙ্গনা হকচকিয়ে গেল। মিশুক অতি যত্নে চুল মুছিয়ে দিচ্ছে। রঙ্গনার একটু একটু ভালো লাগছে। মিশুক হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল,
“অস্থির হবার দরকার অবশ্যই আছে। কদিন আগেই আমাদের বিয়ে হলো। বউকে না দেখে আমি অস্থির হতেই পারি।”
রঙ্গনা পিছু ফিরে তাকালো। দুজনের মাঝখানে অল্প দূরত্ব। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো। রঙ্গনার ঠোঁটে স্মিত হাসি। বলল,
“একটা সত্যি কথা বলব?”
মিশুক আগের মতোই চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। বলল,
“সত্যি, মিথ্যে যা বলতে ইচ্ছে হয় বলো।”
“আমি তোমাকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছি না। প্রথমে মনে হলো ধুরন্ধর, তারপর মনে হচ্ছে মিচকে শয়তান। ”
“আর এখন?”
“ঠিকঠাক বিশেষন খুঁজে পাচ্ছি না। আগের সবকিছু ছাড়িয়ে গেছ। ”
মিশুক নি:শব্দে হাসলো। রঙ্গনাকে আরেকটু বিস্মিত করতে আচমকাই ওর গালে চুমু খেল। বলল,
“আমি অপেক্ষায় রইলাম ঠিকঠাক বিশেষনের। এখন তৈরী হয়ে নাও। আমাদের বেরোতে হবে। ”
রঙ্গনা অবশ্য তেমন বিস্মিত হয় নি। মিশুক এমন কাজ এই প্রথম করে নি। এর আগেও করেছে। দুদিন আগেই টের পেল প্রথম। কপালের পাশের চুলগুলো সরিয়ে আলতো চুমু খেল। রঙ্গনা শক্ত হয়ে রইলো। মিশুক একটু সময় নিয়ে গালে চুমু খেল। রঙ্গনা শিহরিত হলো। এই প্রথম কোনো পুরুষের ঠোঁটের স্পর্শে শিহরিত হলো। এর আগে ওর জীবনে প্রেম এসেছে। তবে নিজেকে নিয়ে বরাবরই ও সংবেদনশীল ছিলো। সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। অবচেতন মনে একটা ব্যাপার ছিলো যে ওর সবকিছুর অধিকার শুধুমাত্র যে স্বামী হবে তার ই।
আজ রঙ্গনা শ্বশুর বাড়ি যাবে। মিশুকের দুলাভাই এখনো হসপিটালে আছে। বাবা, মা বাড়িতে গিয়ে একটু গুছিয়ে নিয়ে রঙ্গনাকে নিতে এসেছেন। পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এরপর ঢাকায় বড় করে রিসিপশন হবে। রঙ্গনা এখন আর আলাদা করে নিজের মতামত দিচ্ছে না। মা, দাদু যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাতেই সায় দিচ্ছে। আলাদা করে এখন আর কোনো মতামতও নেই।
মিশুকের বাবা, মা ভীষণ আন্তরিক। আপুও ভালো। দুলাভাই কথা বলার অবস্থায় এখনো আসে নি। রঙ্গনা সহ বাকীরা হসপিটালে গিয়ে দেখে আসছে। শুধু মিশুক কেই ওর মিচকে শয়তান মনে হয়।
রঙ্গনা মেরুন রঙের জামদানী পরলো। সঙ্গে হালকা গোল্ডের গহনা। গহনাগুলো মিশুকদের বাড়ি থেকে পাঠানো। তার নিজেদের পছন্দে শপিং করে পাঠিয়েছে। আপু আবার ফোন করে বলেছে,
“রঙ্গনা রিসিপশনের আগে আমরা নিজেদের পছন্দে শপিং করব কিন্তু। ”
রঙ্গনা বলেছে,
“লাগবে না আপু। যা আছে তাতেই হবে। ”
“মোটেও হবে না। দেখি মিশুকের সঙ্গে কথা বলে, ও বেশী ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে তোমরা ইন্ডিয়া যাবে। ”
রঙ্গনা কিছু বলে নি। ভালোও লাগে, আবার ভয়ও হয়। মানুষ চেনা ভীষণ মুশকিল।
রঙ্গনা বসার ঘরে ঢুকতেই মিশুক তাকালো। ফোনে কিছু একটা দেখছিল। তাকিয়ে রইলো তো রইলোই। রঙ্গনা মনে মনে বলল,
“ব*দমায়েশ একটা। এতো সুন্দর নিশ্চয়ই লাগছে না আমাকে!”
***
স্বপ্নীলের ভীষণ মন খারাপ। ও কিছুতেই ছুটি ম্যানেজ করতে পারছে না। বৃহস্পতিবার এর মান্থলি মিটিং এ থাকতেই হবে। এদিকে শ্রাবণ্য সেজেগুজে রঙ্গনার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। স্বপ্নীল ভীষণ মন খারাপ করে বলল,
“তোমার যেতেই হবে। ”
“হ্যাঁ, রিন্টি মন্টিও যাবে।”
“তোমার ক্লাশ মিস হবে না?”
শ্রাবণ্য চোখের মেকাপ টা ঠিক করতে করতে জবাব দিলো,
“হবে। তাতে কী?”
স্বপ্নীল মনমরা হয়ে বলল,
“আমি তো যেতে পারছি না। চাকরি বাকরি আমার ভালো লাগে না এজন্য, কোনো ফ্রিডম নেই। আর এক সপ্তাহ বাকী। আমাকে অফিস থেকে বের করে দিলে ভীষণ খুশি হবো।”
শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। বলল,
“আপনার মতো এমন অলস আমি দেখি নি। ”
“আমি অলস না। আমার কষ্ট হয়।”
শ্রাবণ্য সংযত হলো। স্বপ্নীলের সামনে হাসলে ও ভীষণ রাগ করে। ও বলল,
“বুধবারের মিটিং শেষ করে রাতের ট্রেনে চলে যাবেন। ”
স্বপ্নীল মন খারাপ করে আচ্ছা বলল। শ্রাবণ্য তো যাবেই। তাছাড়া ও তো ভুলিয়ে ভালিয়ে আটকেও রাখতে পারবে না। মন্টি, রিন্টির বয়সী হলে একটা জিনিসের লোভ দেখিয়ে আটকে রাখতো।
***
যাবার আগে রঙ্গনা কাঁদলো। তুলি আর শিলা কাঁদছে বলেই হয়তো কেঁদে ফেলল। স্বপ্নীল কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি সবসময় বলি না তোকে বদলাতে হবে। সেটার দরকার নাই। যেমন আছিস তেমন ই থাক। এরকম পিওর থাকিস।”
***
আকাশী এই সাত টা পাঞ্জাবি নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। রঙ্গনাকে শাড়ি পাঠিয়েছে। পাঞ্জাবীর কথা বলতে সাহস হয় নি। মিশুক কে দিতে চেয়েছিল তুলি বারন করেছে। বলেছে রাস্তায় ফেলে দিতে। আকাশীর খারাপ লাগছে। এগুলোর ডিজাইন করতে ওর অনেক কষ্ট হয়েছে। কতো রাত জেগেছে। ও শ্রাবণ্যকে ফোন করলো। শ্রাবণ্য বলল,
“ওগুলো রাফাত ভাইকে দিয়ে দে।”
“উনি এখন পাঞ্জাবী নিয়ে কি করবে?”
“সেটা আমি কী জানি! তুই বলবি যে আপনার নামে বুকড, আপনাকে নিতে হবে। ”
আকাশী আমতা আমতা করলো। শ্রাবণ্য জোর করে রাফাতের নাম্বার দিলো। সেই সঙ্গে বলে দিলো যেন পেমেন্ট নিতে ভুল না করে।
শ্রাবণ্যর সূক্ষ্ম চাল আকাশী ধরতে পারলো না। রাফাত ভাইয়াকে ওর খারাপ মানুষ মনে হয় নি। সে এখন প্রায় নির্বাসিত। এই সময়ে একজন বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীর দরকার। আকাশী হলেও হতে পারে রাফাতের একটু কাছের বন্ধু। শুভর ব্যাপার টা ও জানে। মা, বাবা, সবাই জানে। শ্রাবণ্য বারন করেছে আকাশীকে জানাতে। এতো আনন্দ করছিল রঙ্গনার বিয়েতে। ওর ভীষণ মায়া লেগেছে। আনন্দের সময় টা আনন্দে কাটুক ওর। দু:খের গল্প পড়ে শুনুক।
চলবে….
সাবিকুন নাহার নিপা
(গল্প পাবেন রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার। অন্যধারার ৪১-৪৪ নং স্টলে কী করিলে বলো পাইবো তোমারে পাওয়া যাচ্ছে।)